প্রবাসে পরহিতকর্ম -৬২
ইউরোপের পথে পথে
সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
চলছিতো চলছি। এ যেন শেষ নাই। চোখে অসীম ভাললাগা। মনের মধ্যে কাজ করে চলেছে অপার বিস্ময়ের রূপরেখা। এ চলার পথ কখনো দেখিনি, তবু বড় চেনা। মনে হচ্ছে এর প্রতিটি ইঞ্চি আমার জানা। এখনো সেই ‘ওয়েস্ট মিনিস্টার’ ধরেই চলছি। এর মধ্যেই হঠাৎ পদযুগল থেমে গেল, কারণ দেখলাম, সেই রাজকীয় বিখ্যাত ‘চার্চ’ – Westminster Abbey। ইউরোপে যে সব চার্চ দেখেছি, তার তুলনায় এটা তেমন আহামরি কিছু নয়, তবু এটা সেই বিখ্যাত Westminster Abbey। এটারও আলাদা করে টিকিট কাটার দরকার নাই। যদি আপনার লন্ডনের পাস কেনা থাকে তবে টিকিট কাটা লাগবে না। আমাদের ওটা ছিল তাই দেখতে গেলাম। একটা বেশ থম ধরা শান্ত পরিবেশ। এটাকে Collegiate Church of Saint Peter at Westminster বলা হয়ে থাকে। আকৃতিতে অনেক বড়। এটা ইউনাইটেড কিংডমের রাজা রানীদের নিজস্ব চার্চ। এটা মূলত স্থাপিত হয়েছিল ৯৬০ সালে। কিন্তু চার্চের কার্যক্রম শুরু হয় ১০৬৬ সালে। এই চার্চের উচ্চতা ২২৫ ফিট। এখানে ঘন্টা আছে ১০টি। টাওয়ার দুটি। চার্চের এরিয়া ৩২,০০০ স্কোয়ার ফিট। টুরিস্টরা সর্বদা এখানে যেতে পারে না। বিধিনিষেধ আছে। এরিয়াটি খুবই সুন্দর। টুরস্টিরা খুবই শ্রদ্ধার সাথে এটি দেখছে। তবে এই চার্চ দেখার আগে মনে পড়লো এর ইতিহাস। হাজার হাজার ঘটনা যেন ভিডিওর মত আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। এখানে সেই প্রথম রাজা থেকে রানী এলিজাবেথ (দ্বিতীয়) এর পদচারনা। তাদের বিয়ে-মৃত্যু। সব স্মৃতি এই চার্চটি বুকে নিয়ে স্থির দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠলো, আরে এইতো সেই চার্চ যেখানে প্রিন্সেস ডায়নার বিবাহ হয়েছিল। যার বিবাহ দেখার জন্য আমাদের কি উদগ্রীব অপেক্ষা। আবার সেই স্বপ্নীল রমনীর মৃত্যুর পর আন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সবই এখানে। প্রিন্স উইলিয়াম, হ্যারির বিবাহ সব এখানেই হয়েছে।
যতটা দেখছিলাম, তার থেকে বেশী স্মৃতিচারণ করছিলাম। দেয়ালে অসাধারণ সব পেইন্ট । খুবই কালারফুল। অনেক্ষণ ধরে দেখলাম। ছবি তুললাম।
রাত ঘনিয়ে আসছে। ফিরার পথে অন্য আর একটা কিছু দেখে যাব এমনই পরিকল্পা। আবার আগামীকাল আসতে হবে, আরো বেশ কিছু দর্শনীয় জায়গা আছে। এগুলো দেখলে লন্ডনের সেন্টার পর্ব শেষ হবে।
আরো বেশ খানিকটা হাটার পর ‘চার্চিল’ স্ট্যাচু দর্শন করতে গেলাম। এমনিতে চার্চিলকে নিয়ে আমার সঙ্গীদের ন্যূনতম আগ্রহ নাই। কিন্তুু আমার ভেতরে সব ধরনের জিনিশ বা বস্তুর উপরই আগ্রহ আছে।
চার্চিল এর এই স্ট্যাচু পার্লামেন্টের কাছেই। The statue of Winston Churchill in Parliament Square, London. এই স্ট্যাচুটা অসাধারণ। যদিও বলা হচ্ছে যে এটা ব্রঞ্জের তৈরী। দেখলে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। ঠিক ব্রঞ্জ এর কালার না। একটা নীলাভ কালচে কালচে রঙ। হয়তো কালের স্রোতে রঙের বেশ পরিবর্তন হয়েছে। এই স্ট্যাচুটি মহা পরাক্রমশালী ব্রিটেনের একসময়ের প্রধানন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের। এটা বানিয়েছে স্থপতি আইভর রবার্ট জোনস। চার্চিলের নামে অনেকগুলি পার্ক আছে বৃটেনে। এমনকি কানাডাতেও আছে এই প্রতাপশালী প্রধানন্ত্রীর স্ট্যাচু।
লন্ডনে চার্চিলের এই স্ট্যাচুটি ওপেন পার্কেই অবস্থিত। এর জন্য কোন টিকিট লাগবে না। এটি নির্মিত হয় ১৯৫০ সালে। লম্বায় এটি ১২ ফিট। এটা ওয়েস্টমিনিস্টার প্যালেসের একদম সামনেই। চর্চিল মূলত একজন আর্মী অফিসার ছিলেন। সেই জন্য রবার্ট জোনস তার এই স্ট্যাচুটা নির্মান করেছেন আর্মিদের ওভার কোট পরিহিত অবস্থায়। তবে এই স্ট্যাচুটা নির্মিত হয়েছে তার মৃত্যুর কিছুদিন আগের অবয়ব নিয়ে। যখন তার শরীর বেশ স্থূল ছিল। সম্ভবত হাটাচলাতেও অসুবিধা ছিল। কারণ এই স্ট্যাচুর হাতে একটা ওয়াকিং স্টিক আছে।
চার্চিলের স্ট্যাচু যেদিন উন্মোচন করা হয়েছিল, সেদিন খুব বড় করে অনুষ্ঠান হয়েছিল। কারণ চার্চিলের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী স্থান ও অন্যান্য সবকিছু নির্বাচন করা হয়েছিল।
অনুষ্ঠানে রাজমাতাও এসেছিলেন। যিনি অনুষ্ঠানের দিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এবং চার্চিলের চার পুরুষের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে তার এই বিশালাকারের স্ট্যাচুটি উন্মোচন করেছিলেন তার বিধবা স্ত্রী। নাম ক্লেমেনটাইন ব্যারোনেস স্পেন্সার। এবং ঐ দিন কুইন এলিজাবেথ (দ্বিতীয়) খুব সুন্দর একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। হয়তো একজন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চার্চিল খুবই উগ্র এবং ডমিনেটিং ছিলেন। কিন্তু একটি মানব সন্তানও বলতে পারবে না যে তার নিজের দেশ ব্রিটেনের উপর প্রেম এতটুকুনও কম ছিল। চার্চিল যা কিছু করেছিলেন নিজের দেশেকে ভালবেসে করেছিলেন।
আজ এই পর্যন্ত দেখে, আমার বর্তমান আলয়ে ফিরে চল্লুম সেই ইস্ট হ্যামে। আবারো আগামীকাল আসবো লন্ডন সেন্টারে বাকী দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে।
(চলবে)
রীনা গুলশান
টরন্টো
gulshanararina@gmail.com