চার খুন এবং অভিবাসী অভিভাবকদের আতংক

আগস্ট ১৮, ২০১৯

ফরিদ আহমেদ

মাত্র কয়েকদিন আগে ঘটেছে এই ঘটনাটা। এই এক ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়েছে টরন্টো এবং এর আশেপাশে বসবাস করা বাংলাদেশি সম্প্রদায়কে। মিনহাজ নামের এক তেইশ বছরের তরুণ তার নিজের বাবা-মা, বোন এবং নানীকে খুন করেছে নিজের হাতে। ঘটনাটা ঘটেছে মার্কহামে। টরন্টোর সাথে গায়ে গা লাগানো শহর এটা।

মিনহাজ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলো। কিন্তু, প্রথম বছরের পরেই পড়ালেখা ছেড়ে দেয় সে। লেখাপড়া ছেড়ে দিলেও সেটা সে গোপন রাখে তার বাবা-মায়ের কাছে। এভাবে বছরের পর বছর কেটে যায়। ইউনিভার্সিটিতে যাবার নাম করে বাসা থেকে বের হয়ে যেতো মিনহাজ। সময় কাটাতো মলে। এরকম করতে করতে ডীপ ডিপ্রেশন এবং অপরাধবোধে ভুগতে থাকে মিনহাজ। তার মনে হতে থাকে তার মতো সন্তান থাকাটা বাবা-মায়ের জন্য লজ্জার। এ’ধরনের কেসে সাধারণত ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষটি আত্মহত্যা করে। মিনহাজের ক্ষেত্রে ঘটে উল্টোটা। পরিবারের সবাইকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। একা একা সবাইকে হত্যা করে, তাদেরর লাশের কোনো ব্যবস্থা না করেই ভিডিও গেম খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

মিনহাজের মতো একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিলো বছর মাত্র আট নয় বছর আগেও। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে সেটাও ঘটেছিলো এই মার্কহামেই।

সেই ঘটনার মূল ব্যক্তি হচ্ছে এক তরুণী। জেনিফার প্যান তার নাম। বয়স মাত্র চব্বিশ। তার বাবা-মা এসেছিলো ভিয়েতনাম থেকে। অত্যন্ত বিনয়ী এবং ভদ্রচেহারার মেয়ে জেনিফার। চশমা পরা তার শান্ত মুখশ্রী দেখে কারো বোঝার উপায় নেই কী রকম ভয়ংকর এক খুনি বসবাস করে তার ভিতরে। অন্যান্য এশিয়ান বাচ্চা-কাচ্চার মতো বাবা-মায়ের কড়া শাসনে বেড়ে উঠেছে জেনিফার।

গ্রেড নাইনে থাকা অবস্থায় অংক এবং বিজ্ঞানে কম নাম্বার পাওয়ায়, এই দুটোর নাম্বারকে জালিয়াতি করে পরিবর্তন করে ফেলে সে। বাবা-মেয়ের বকাঝকা এড়ানোর জন্য অনেক বাচ্চাই এমন কাজ করে। কিন্তু, জেনিফারের জালিয়াতির পরিমাণ ধীরে ধীরে বেড়ে যেতে থাকে। আরেকটু উপরের দিকে গিয়ে ক্যালকুলাসে ফেল করে সে। এই সত্য বাবা-মায়ের কাছে প্রকাশ করার সাহস তার ছিলো। খুব সংগোপনে স্কুল ছেড়ে দেয় জেনিফার। বাবা-মা এর কিছুই জানতে পারে না। স্কুল শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে তাদের মেয়ে এটাই জানতো তারা।

জেনিফারের এই মিথ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার প্রথম দিনে গর্বিত বাবা-মা ল্যাপটপ উপহার দেয়। সেই ল্যাপটপ হাতে নিয়ে জেনিফার বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে পাবলিক লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়ে আসে সারাদিন। এই ঘটনা নিয়মিত ঘটায় সে। প্রফেশনাল জালিয়াতদের দিয়ে কাগজপত্র নকল করানো শুরু করে সে। এই নকলের কারণে কয়েক বছর পরে বাবা-মা ভ্রান্তিতে ভোগে এই ভেবে যে মেয়ে তাদের ফার্মাসিতে গ্রাজুয়েশন করেছে। শুধু গ্রাজুয়েশনই করেনি, সে একটা ভালো চাকরিও পেয়েছে।

খুব বেশিদিন অবশ্য মিথ্যা ঢেকে রাখা যায় না। তার বাবা-মা সত্যটা একদিন জেনে ফেলে। ক্ষুব্ধ বাবা-মা তার দীর্ঘদিনের বয়ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্ককে বন্ধ করে দেয়, তার টাকা-পয়সা এবং সেলফোন ছিনিয়ে নেয়। রাত নয়টার পরে বাড়ি থেকে বের হওয়াও নিষিদ্ধ হয়ে যায় তার জন্য।

মার্কহাম সিটিতে হত্যাকান্ডের শিকার মিনহাজের পরিবারের সদস্যগণ। ছবি: সংগৃহীত

মিনহাজের মতোই ডিপ্রেশনে ভুগতো জেনিফার। তবে, মিনহাজ আত্মহত্যাপ্রবন না হলেও, জেনিফার আত্মহত্যাপ্রবন ছিলো। এই ঘটনার পরে অবশ্য আত্মহত্যা নয়, বাবা-মাকে হত্যা করার ঠান্তা মাথার পরিকল্পনা শুরু করে সে। তিনজন হিটম্যানকে সে হায়ার করে তার বাবা-মাকে হত্যার জন্য।

এই তিন হিটম্যান একদিন দরজা খুলে ঢুকে পড়ে বাড়ির ভিতরে। জেনিফারের বাবা-মাকে টেনে নিয়ে যায় বেইজমেন্ট। সেখানে গুলি করা হয় তাদের। জেনিফারের বাবা গুলি খেয়েও নিজেকে কোনোভাবে ফ্রন্ট লনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। আর মা, নিজে গুলি খাবার আগে তারা যেনো জেনিফারের কোনো ক্ষতি না করে সেজন্য ঘাতকদের কাছে ভিক্ষা চাচ্ছিলো। মা জানতো না, উপর তলায় বসে থাকা তার সেই প্রাণপ্রিয় মেয়েই আসলে তাদের মারার মূল পরিকল্পনা করেছে।

উপরের দুটো ঘটনা অভিবাসী বাবা-মায়েদের জন্য অত্যন্ত আতঙ্কজনক এবং অশনি সংকেত হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।, বেশির ভাগ অভিবাসী ক্যানাডায় এসেছে একটা ভালো এবং নিরাপদ জীবন যাপন করার জন্য, সুন্দরভাবে বাচ্চাকাচ্চাদের মানুষ করার জন্য। যে সন্তানের জন্য বিদেশ-বিভূঁই এ আসা, সেই সন্তানই যদি মানুষ না হয়, কিংবা ঠান্ডা মাথার খুনি হয়, তবে মা-বাবার যাবার আর কোনো জায়গা থাকে না। মনে হয়, কী লাভ হলো দেশ ছেড়ে এই বহু দূরের দেশে থেকে?

মিনহাজ কিংবা জেনিফারের এই অধঃপতনের দায়ভার কী কিছুটা গিয়ে বাবা-মায়ের ঘাড়েও পড়ে না? আমরা যারা প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী, তারা তাদের সন্তানদের শিকড় থেকে উপড়ে নিয়ে এসেছি। আমরা ভাবি, নতুন একটা দেশ আমাদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জিং। প্রতি মুহূর্তে আমাদের ভাষার কারণে ডিসক্রিমিনেটেড হতে হয় এখানে, এখানকার সংস্কৃতি না বোঝার কারণে মূল স্রোতের বাইরে থাকতে হয় আমাদের।

কিন্তু, আমাদের চেয়েও যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আরো বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে, সেটা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমরা? ওরাতো আসলে না ঘরকা না ঘটকা। বাংলাদেশে ওদের শিকড় নেই, নেই এমন কোনো স্মৃতি যেটা দিয়ে বাংলাদেশকে ফিল করতে পারে তারা। আবার মূলস্রোতেও তারা মিশে যেতে পারে না বাবা-মায়ের কারণে। বাবা-মা পিছন থেকে দড়ি ধরে রাখে তাদের। এরকম একটা দ্বন্দ্বমূখর পরিস্থিতিতে কনফিউজিং পরিস্থিতিতে থাকে এই প্রজন্ম। আইডেন্টিটি নিয়েও সমস্যা তৈরি হয় তাদের মধ্যে। তারা আসলে কী? বাংলাদেশি নাকি ক্যানাডিয়ান। আমাদের প্রজন্ম ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, অচেনা সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে হিমশিম খাবার পরে নিজেদের রক্ষা করতে পারে খুব সহজেই। অন্য দেশে থেকেও বাংলাদেশি বলয়ের একটা ককুন (cocoon) তারা তৈরি করে নিয়েছে। সেই ককুনের মধ্যেই মূলত বসবাস করি আমরা। নতুন প্রজন্মের এই সুযোগটা নেই। না পারে তারা বাবা-মায়ের সাথে সহজভাবে মিশতে, না পারে পুরোপুরি ক্যানাডিয়ান হয়ে যেতে।

এই দ্বন্দ্বমুখরতা, পরিচয়গত সমস্যায় ভোগা, বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার আকাশছোঁয়া বোঝা ঘাড়ে চাপা, বিভ্রান্তির জালে আটকে পড়া, এগুলো ডিপ্রেশন তৈরি করছে নতুন প্রজন্মের মাঝে। এদের বেশিরভাগই সুখি না। এদের বাবা-মায়েরা এদের দোহাই দিয়ে, এরা বাংলা শিখবে না বাংলাদেশের সংস্কৃতি বুঝবে এই অজুহাতে সারা উইকএন্ড ধরে পার্টি করে বেড়ায়। বাচ্চাকাচ্চাদের অনেকটা জোর করে ধরে নিয়ে যায় সেখানে। তারা সেখানে যায়, কিন্তু কোনো সংযোগ অনুভব করে না। বাচ্চা-কাচ্চাদের বোঝা, তাদের সময় দেবার সময় তাদের নেই। নিজদের ফুর্তি নিয়েই ব্যস্ত থাকে তারা। আর অন্যদিকে অনাদর এবং অবহেলায় পড়ে থাকে সেই অংশটা, যে অংশটা অত্যন্ত নাজুক এবং নিদারুণ রকমের ভংগুর।

মিনহাজ এবং জেনিফার তাই অভিবাসী বাবা-মায়ের জন্য একটা এসিড টেস্ট। খালি পিটিয়ে পাটিয়ে, হুমকি-ধামকি দিয়ে, স্বর্গের লোভ কিংবা নরকের ভয় দেখিয়ে তাদের সঠিক পথে আনা যাবে না। সঠিক পথে আনতে গেলে বাবা-মাকেও সঠিক আচরণটা করতে হবে।

এর বিকল্প আর কিছু নেই। এটা না করতে পারলে আগামীতে আরো মিনহাজ এবং জেনিফারকে দেখতে হতে পারে আমাদের। আমরা কি সেটা চাই? নিশ্চয়ই নয়। না চাইলে বাচ্চাকাচ্চাদের আরেকটু সময় দিন, আরেকটু ভালো বন্ধু হোন তাদের, বোঝার চেষ্টা করুন তাদের। আপনার কিংবা আমার স্বপ্ন নয়, তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে দিন তাদের।

ফরিদ আহমেদ

টরন্টো