ইউশরা জাভেদের অতুৎজ্জ্বল সাংবাদিকতা কানাডায় অজানা ছিল বাংলাদেশিদের

সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৯

মোহাম্মদ আলী বোখারী

ইউশরা জাভেদ। ছবি : সংগৃহীত

ইউশরা জাভেদ। রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রী। বয়স ২১ বছর। গত শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ভোরে হৃদসংক্রান্ত অসুস্থতায় টরন্টো শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে পিকারিংয়ে নিজ বাড়ীতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন স্কারবরোর ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয় পিকারিংয়ের পাইন রিড্জ মেমোরিয়াল গার্ডেনে। কিন্তু তার অভাবনীয় পরিচিতি, আত্মনিবেদন ও একনিষ্ঠতার কথা সবে মাত্র কানাডায় নিজ বাংলাদেশি কমিউনিটি জানতে শুরু করেছে। যেন ‘অতুলনীয় আলোর বিচ্ছুরণ’ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।
‘সন্দেহ নেই তিনি কানাডায় সেরা সাংবাদিকদের একজন হয়ে উঠতেন’ এমনটাই চারদিন পর রজার্স কমিউনিকেশন সেন্টারে আয়োজিত শোক সভায় জানিয়েছেন অন্টারিও প্রাদেশিক প্রেস গ্যালারির প্রেসিডেন্ট অ্যালিসন জোনস, যেখানে সহকর্মী ও বন্ধুরা ছাড়াও পরিবার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ‘তার মাঝে পরিশীলিত সাংবাদিকতার আত্মবিশ্বাস ও স্পৃহা ছিল ভরপুর।’ শোকার্তের মাঝে একটা কথার অনুরণনই ঘটেছে, বয়সের তুলনায় তার সাংবাদিকতার দীপ্তি ছিল ঔজ্জ্বল্যপূর্ণ।

তিনি অন্টারিও প্রাদেশিক সংসদের প্রেস গ্যালারিতে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেছেন। জোনসই তাকে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে কাজ দেন। তার ভাষায়, যখনই তিনি রুমে আসতেন, তখনই প্রেস গ্যালরির সবাই উদ্দীপনায় প্রানবন্ত হয়ে ওঠতেন। কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা ও দক্ষতার কারণেই তাকে চাকরি দেয়া হয়েছিল। এই ইন্টার্নশিপের সময়েই তিনি টরন্টো স্টার পত্রিকার ‘আইপলিটিক্স’, কুইন্স পার্কের প্রেস ব্রিফিং ও ন্যাশনাল অবজারভারের জন্য লিখতেন। ‘তিনি তার স্বপ্নেরস্থল কুইন্স পার্কে কাজ করেছেন। অতি উৎসাহের বিষয়বস্তু রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন। জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্র সিবিসি-তে যাবার জন্য নির্ধারিত ছিলেন, পছন্দের প্রকাশনায় মুক্তকলাম লিখতেন এবং গ্র্যাজুয়েশনের দ্বারপ্রান্তে ছিলেন।’ ‘সাধারণ অর্থে নয়, বরং যা করে গেছেন, তার মাঝে সাংবাদিকতার প্রভাববিস্তারি শক্তিকে বিশ্বাস করেছেন’ এমনটাই বলেন ফাতেমা সৈয়দ, যার সঙ্গে প্রেস গ্যালারিতে কাজ করার সময় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। প্রয়াণের সপ্তাহান্তেই তাৎক্ষণিক টুইটারে ইউশরার সন্মানে সমবেদনা জানিয়েছেন অন্টারিও প্রিমিয়ার ডগ ফোর্ড, বিরোধীনেত্রী এনডিপি প্রধান অ্যান্ড্রিয়া হরওয়াথ, গ্রীণ পার্টির নেতা মাইক শ্রীনার, লিবারেল পার্টির অন্তবর্তীকালীন নেতা জন ফ্রেজারসহ স্বনামধন্য সব সাংবাদিক।

বাবা, মা ও ভাইয়ের সঙ্গে ইউশরা জাভেদ। ছবি : সংগৃহীত

‘গত কয়েক দিনে অনেক রাজনীতিবিদ আমার কাছে এসে বলেছেন, তারা ইউশরার কাছ থেকে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন’ বলে আরও জানান জোনস। তিনি বলেন, প্রিমিয়ারের তাকে মনে আছে একজন ‘ফায়ারক্রেকার’ বা ‘অতুলনীয় আলোর বিচ্ছুরণ’ হিসেবে। ‘তিন বছর আগে আমাদের স্কুলকে পছন্দ করে সে ভর্তি হয়েছিল বলে আমরা গর্বিত’, জানান রায়ারসন স্কুল অব জার্নালিজমের চেয়ার জেনিস নীল। নীল বলেছেন, তার জন্য ইউশরার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয়টি হচ্ছে, অন্যের জন্য তার প্রশংসা ছিল চিরায়ত। ‘মনে হতো তার অতিরিক্ত ৩০ সেকেন্ড ছিল অবারিত। আমি নিজের জীবনের ক্ষেত্রে সেটি ধারণ করেছি, যা অন্যের মাঝে বিলিয়ে দেবো।’
আর সেই আলোকচ্ছটার প্রতিফলনই তার উইক্সসাইটে দৃশ্যমান: ‘যখন সংবাদপ্রবাহে ডুবে আছেন, পডকাস্ট শুনছেন ও ইনস্টাগ্রামে সিএনএন খ্যাত অ্যান্ডারসন কুপারের নতুন ছবিতে লাইক দিচ্ছেন, বাড়ীতে তার দুটো বড় বিড়ালকে জড়িয়ে আছেন ইউশরা, নেটফ্লিক্সে প্রামাণ্যচিত্র দেখছেন, নতুবা বাবার সঙ্গে টরন্টো র‌্যাপটরের জন্য হর্ষোৎফুল্ল হচ্ছেন।’ সবই আজ বিলীন তার অকাল প্রয়াণে।
এই প্রতিবেদক একাধিকবার দেখা করার অভিপ্রায়ে তার মা, সাবরিনা সুরাইয়ার ফোনে কল দিয়েও এক সপ্তাহ পর প্রথম কথা বলতে সক্ষম হন। প্রায় দু’সপ্তাহ পর এক শুক্রবারের বিকেলে কবরস্থানের প্রার্থনায় দেখা হয় শোকাভিভূত বাবা মোহাম্মদ জাভেদ, একমাত্র বড় ভাই জুনায়েদ জাভেদ ও মায়ের সঙ্গে। তখনই স্বল্প পরিসরে জানা যায়, ইউশরার জন্ম কানাডায়। নব্বই দশকের সূচনায় পুরনো ঢাকা ওয়ারীর বাসিন্দা বাবাই প্রথম কানাডায় আসেন। তিনি রেডবেরি ফ্রাঞ্চাজিংয়ের এরিয়া ম্যানেজার। বড় ভাই গত বছরই লাইফ সায়েন্সে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এই শোকাভিভূত পরিবারটি এখন ধারণ করে আছেন ইউশরার দুটো প্রিয় বিড়াল। তবু বাবা জানালেন, ‘আমি তাকে বিশ্ব রাজনীতি বিষয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছি। তার ইচ্ছা ছিল, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়েও লিখার।’ আর মায়ের ভাষায়, ‘ইউশরার লেখনীর বিষয়বস্তু রাজনীতি হলেও কখনো কোনো দলীয় রাজনীতির প্রতি তার আনুগত্য ছিলো না।’

ইউশরার কবর জিয়ারত করছেন তার শোকাভিভূত বাবা মোহাম্মদ জাভেদ। ছবি : লেখক

ইউশরা রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম কোর্স ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন, কাজ করেছেন আরইউটিভি ও দুরহাম রজার্স টিভির জন্য এবং নিউ ওয়েভ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। তার চতুর্থ বর্ষে সিবিসি-তে ইন্টার্ন করার পাশাপশি রায়ারসোনিয়ান মাস্টহেডে সমাসীন হওয়াটাও ছিল কুসুমিত। তবুও ২০২০ সালের জুনে অনুষ্ঠেয় সমাবর্তনে ইউশরাকে তার বিশ্ববিদ্যালয় মরনোত্তর ব্যাচেলর অব জার্নালিজম ডিগ্রি দেবে। উপরন্তু তার পোট্রেয়েট প্রাদেশিক প্রেস গ্যালারির বার্ষিক রাজনৈতিক প্রতিবেদকদের মাঝে স্থান দেয়াসহ সংসদ নেতার কার্যালয় অক্টোবরের শেষে প্রাদেশিক সংসদের অধিবেশন শুরুতে এক মিনিটের নীরবতা পালন করবে বলে জানানো হয়েছে। প্রয়াণের এক সপ্তাহের মাঝে এতো সব আয়োজনে তার ফোনে রিংয়ের পর স্বকন্ঠে ইংরেজিতে শোনা যায়: ‘হে, আপনি ইউশরার ফোনে কল দিয়েছেন। আমি আপনার কল ধরতে না পেরে খুবই দুঃখিত। অনুগ্রহপূর্বক আপনার ম্যাসেজ রাখুন, আমি শীঘ্রই ফিরতি কল দিতে চেষ্টা করবো।’ অথচ সেখানে আর ম্যাসেজ রাখার জায়গা নেই; একমাত্র আমাদের অভিলাষের পানে দূর মহাকাশে দীপ্যমান নক্ষত্রের মতো হারিয়ে গেছেন। প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ তার বিদেহী আত্মা ও শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সহায় হন।
ই-মেইল: bukhari.toronto@gmail.com

মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো