অভিবাসীদেরকে বৃহত্তর টরন্টো এলাকা ও ভ্যাঙ্কুভারের বাইরে বসবাসের কথা ভাবতে হবে

অক্টোবর ৯, ২০১৯

প্রদীপ রদ্রিগেজ

কিছুদিন আগে একজন লরি চালকের সঙ্গে আমার দেখা হয় যিনি ব্রামটন থেকে এডমন্টনে এসেছেন। অভিবাসী হিসাবে আসার পর কানাডায় ওখানে তিনি ১০ বছর ধরে বসবাস করেন। তার এডমন্টনে আসার কারণ তিনি চাইছিলেন আরও উন্নততর জীবন, ভালো চাকরির সম্ভাবনা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপেক্ষাকৃত সস্তায় আবাসন সুবিধা। এই বিষয়গুলি তাকে তার সামাজিক যোগাযোগ থেকে সরে এমন এক জায়গায় আসতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে যেখানে তাকে পেশাগত ও সামাজিক উভয় দিক থেকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হবে। তিনি আমাকে বলেন, ব্রামটন থেকে এডমন্টনে আসার সিদ্ধান্তটা ছিলো তার ভারত থেকে কানাডায় আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে তার মধ্যে যদি কোনও দুঃখবোধ থেকেও থাকে তাহলে সেটা খুবই সামান্য। তিনি বলেন, “ভারতে আমার পরিবার ও বন্ধুদের মধ্য থেকে চলে আসাটা ছিলো এখানে যেসব বন্ধু তৈরি হয়েছে তাদের কাছ থেকে সরে আসার চেয়েও অনেক কঠিন।” ভারতে তার পরিবার ও বন্ধুরা তার সঙ্গে এখনও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে, কিন্তু এখানে বৃহত্তর টরন্টো এলাকার তার বন্ধুদের সবাই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।

এরপর, সপ্তাহ দুয়েক আগে একজন সুশিক্ষিত পেশাজীবীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তাকে আট বছরের মধ্যে দুবার চাকরি হারাতে হয়েছে এবং তার পেশাগত ক্যারিয়ারে অবনমিত করা হয়েছে। তিনি এখন নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন। তিনি জানান, কোম্পানিকে জনবল সরবরাহকারী এক ব্যক্তি এক সময় পশ্চিম কানাডায় বড় ধরণের সুযোগ সুবিধার কথা বলেছিলো কিন্তু তিনি বৃহত্তর টরন্টো এলাকা ছেড়ে যেখানে কাউকে চেনেন না এমন জায়গায় যাবার কথা ঝেড়েমুছে নাকচ করে দিয়েছেন, এমনকি ভাবনাতেও রাখেননি। তিনি তার বিস্তৃত সামাজিক পরিমÐলে আটকা পড়ে যান এবং সপ্তাহান্তের পার্টি থাকবে না এমন জীবন কল্পনাও করতে পারেননি। স্পষ্টতই, তিনি নিছক সপ্তাহান্তের পার্টির জন্যই বেঁচেছিলেন।

তাহলে আমরা এখানে দুজন দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীকে পেলাম, একজন লরি চালক এবং অন্যজন উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী। লরি চালক স্বল্প শিক্ষিত এবং তার ইংরেজি ভাষাজ্ঞানও সীমিত। কিন্তু বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে, ব্রামটনের বাড়ি বিক্রি করে যেখানে কাউকে তিনি চেনেন না সেই এডমন্টনে চলে আসতে তার মনে কোনও সংশয় কাজ করেনি। তিনি চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন কারণ তিনি নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে এবং নিজের ও পরিবারের জন্য একটি উন্নততর জীবনমান নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তিনি ঠিকই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে, বন্ধুরা যেমন চমৎকার তেমনই তারা প্রতিযোগীও। আর তারা সবসময়ই নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওযার চেষ্টায় থাকে। বৃহত্তর টরন্টো এলাকায় অভিবাসীদের মধ্যে যার অপেক্ষাকৃত বড় বাড়ি এবং গাড়ি আছে সে-ই প্রতিযোগিতার খেলায় জড়িত। এডমন্টনে খুব কম মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের কারণে তিনি ওই প্রতিযোগিতার চাপ থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন এবং এর ফল হলো ব্যাংকে সঞ্চয়ের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া।

অন্যদিকে, উচ্চশিক্ষিত ও নাগরিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত দক্ষিণ এশীয় ব্যক্তিটি তার ব্যাপক বন্ধুসমাজকে নিয়ে জিটিএতে থেকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আর্থিক এবং পেশাগত ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। তিনি আলবার্টা তো বাদই এমনকি অটোয়াতেও (খুবই বোরিং) যেতে চাননি। দৃশ্যত নিজের অবস্থার উন্নয়নের চেয়েও বন্ধুরা তার কাছে অনেক বেশি কিছু।

অনেক নতুন দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী বিশেষ করে যারা বিভিন্ন ট্রেডে জড়িত, যাদের শিক্ষাগত তেমন পটভূমি নেই, তাদের মধ্যে অচেনা জায়গায়, যেখানে হয়তো তিনিই একমাত্র দৃশ্যমান সংখ্যালঘু, যাওয়ার ব্যাপারে কোনও আবেগপ্রসূত বাধা নেই। নিজের উন্নততর ভবিষ্যৎ পরিত্যাগ করার জন্য বন্ধু সার্কেল কোনও কারণ হতে পারে না।

যখন কেউ নতুন কোনও দেশে বা প্রদেশে যান তখন সেখানে তার জন্য সামাজিক সহায়তা নেটওয়ার্কের প্রয়োজন আছে সেটা বুঝি। অভিবাসীরা তাদের বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, তাদের সমস্ত স্মৃতি ফেলে রেখে একেবারেই অচেনা মানুষজনের মধ্যে কানাডায় চলে আসেন শুধু বৃহত্তর সুযোগ সুবিধার কথা মাথায় রেখে। কিন্তু এখানে আসার পর অনেকেই প্রয়োজন হলেও দেশের এক এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাবার সিদ্ধান্ত নিতেও সমস্যায় পড়েন।

একেবারে শুরুর দিকে শিখ বা অন্য অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা যারা ৪০ বছর বা তারও আগে এখানে এসেছিলেন তারা প্রায়শ এমন সব ছোট শহরে বসবাস করেছেন যেখানে কেউ কাউকে চিনতেন না।

যেখানে তাদের বেশিরভাগই ইংরেজি বা ফরাসীতে একটি বাক্যও পুরো বলতে পারতেন না তাদের জন্য নতুন একটি মহল্লায় একেবারে ভিন্ন গ্রহ থেকে নেমে আসা লোকেদের মত করে বসবাস শুরু করাটা ছিলো বিরাট সাহসের ব্যাপার।

আমি জানতে পেরেছি যে, যেসব অভিবাসী ইংরেজি ভাষাজ্ঞানে দুর্বল তারা চাকরির সুবিধাটুকু থাকলে যে কোনও স্থানে এমনকি উত্তর-পশ্চিম টেরিটোরিতেও বসবাস করতে ইচ্ছুক। নাগরিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ও আধুনিকমনস্ক অভিবাসীরা চাকরির ভালো সুযোগের জন্যও অন্যত্র সরে যাবার পরিবর্তে অপূর্ণ চাকরিতে থেকেও এক জায়গায় স্থির থাকতে পছন্দ করেন। তারা হচ্ছেন সেইসব মানুষ যারা সমমনা বন্ধুদের মধ্যেই জীবনের পরিপূর্ণতা খুঁজে পান।

এধরনের চিন্তা খুবই সাধারণ এবং এর মধ্যেই কানাডায় অঞ্চলভেদে প্রবৃদ্ধি কেন এত অসমদৃশ তার আংশিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অভিবাসীদের উচিৎ সেইসব জায়গায় যাওয়া যেখানে তাদের দরকার আছে, সামাজিক গÐির মধ্যে আবদ্ধ থাকা নয়। -সৌজন্যে : ক্যানইন্ডিয়ানিউজ