প্রবাসে পরহিতকর্ম -৫৯
ইউরোপের পথে পথে
জুন ৬, ২০১৯
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দিনের আলো ফোটার সাথে সাথে পৃথিবীটা যেন হাতের মুঠোয় চলে আসে। মনে হয়, ওহ! এতো আমার সেই চেনা পৃথিবী। এ আমার বহুকাল ধরে চোখের উপর বুড়ো হয়ে যাচ্ছে! নাকি আমি একটু একটু জীবনের শেষ প্রান্তে চলে আসছি। ধুর! এই সুন্দর সকালে একটা নতুন পরিবেশে, অজানিত উপকণ্ঠে বসে আমি এসব কি ভাবছি?
ট্রেনটা একসময় ‘ভিক্টোরিয়া’ স্টেশনে থামলো। এটা আমাদের টরন্টোর ‘ইউনিয়ন’ স্টেশনের মত। এখানে যে যার গন্তব্যের ট্রেনে উঠবে। আমরাও ডিসট্রিকট লাইন ধরে ক্যানন স্টেশন দিয়ে ‘ইস্টহ্যাম’ এ আসলাম। এটাকে ‘আপ মিনিস্টার’ বলে। স্টেশনের বাইরে এসে দেখি বেশ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। তবে গোটা লন্ডনেই আমি কেমন জানি পুরানো একটা গন্ধ পেলাম। বাড়িগুলো সব অনেক পুরানো ডিজাইনের। এমনকি ‘বৃস্টল’ এর দিকে বেশ ডিটাচড্ হাউজ দেখলাম। কিন্তু আরকিটেক্চারাল ডিজাইনে সেই পুরানো গন্ধ। লন্ডনের ম্যাক্সিমাম জায়গাগুলো আমার খুবই কনজাস্টেড মনে হলো। পরিসর হিসাবে মানুষের ভীড় অকে বেশী পরিলক্ষিত হলো। হঠাৎ করে মনে হলো ঢাকায় চলে এসেছি। সাবওয়ে সিস্টেমটাও আমার কাছে যথেষ্ট ক্রিটিক্যাল মনে হলো। আমাদের কানাডাতে যেমন ইস্ট-ওয়েস্ট এর একটা লাইন। আবার অন্যটাতে নর্থ সাউথ। তাই একদম নতুন লোকদেরও তেমন অসুবিধা হয় না। এখানে একই লাইনে পরপর ট্রেন আসবে। আপনাদের সারাক্ষণ ডিসপ্লেতে দেখতে হবে এটা কোন লাইনের ট্রেন। যারা বহুদিন ধরে আছে তাদের জন্য হয়তোবা ব্যাপারটা স্বাভাবিক। তবে আমাদের মত নবিশদের জন্য যথেষ্ট উদ্বিগ্নতার কারণ।
যেখানে বারোটার মধ্যেই মাজেদাপার বাসায় পৌঁছানোর কথা। সেখানে প্রায় সাড়ে চারটায় পৌঁছালাম। কারণ পথে ট্রেনে এক সুইসাইড কেসের জটিলতায় আমাদের ২/৩ ঘন্টা অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছিল। যাইহোক তবু এলাম। ইস্টহ্যামের ১২০ নম্বর বাড়িটাতে এসে দেখি ঐ ঠান্ডাতেই আমার আপা উদ্বিগ্ন পায়চারী করছে বাড়ির সামনে। আমাদের দেখেই জোরে জড়িয়ে ধরলো দুহাত ভালবাসায়। কথা বলে উঠলো অনর্গল। কতটা উদ্বিগ্নতায় কেটেছে তার প্রতিটি প্রহর, তারই বয়ান দিল অনর্গল। অসম্ভব সরল এবং এক মমতাময়ী মা। তার বুকের মধ্যে কেবলই মাটির সোদা গন্ধে ভরা ভালবাসা। এতটুকুনও জটিলতার ছায়ামাত্র নাই। দোতালা, লম্বা করে বাড়িটা। টাউন হাউজ। তবে খুব বড় বাড়ি। পেছনে বিশাল পরিসর। সেখানে একরাশ বৃক্ষরাজি। এমনকি একটি বিশাল তেজপাতার বৃক্ষও সদর্পে দাড়িয়ে আছে। আমি আর কথা বলতে পারছিলাম না। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় আমি মূলতই মৃয়মান লতার মত এলিয়ে পড়লাম। আপা জলদি করে গরম ভাত, ভাজি, ভর্তা, মাংশ দিয়ে টেবিল সাজিয়ে দিল। কিন্তু আমি কিছুই খেতে পারছিলাম না। অল্প কটি ভাত ডাল দিয়ে খেয়েই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। আয়াত দুুলাভাই মসজিদে ছিল। এসেই এক সাদর সম্ভাষনে আমাদের ভাসিয়ে দিল। কি মধুর তার সরলতা। প্রতিটি বাক্যেই তার মায়া মমতায় যেন ঝরে ঝরে পড়ে। আমার স্বামী কে.কে. তো প্রথম আলাপনেই তার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গেল। প্রচন্ড পরহেজগার এবং অবসরের এই জীবনটা উনি দ্বীনের জন্য নিবেদন করে দিয়েছে। তবে তার অসম্ভব আকর্ষনীয় দিক হলো, কারো উপর তার কোন মতামত চাপিয়ে দেয় না। আর অযথা কাউকে উপদেশ দিয়ে হয়রানি করে না। আজকাল বিনা পয়সায় কেউ উপদেশ শুনতে চায় না। বরং সদাহাস্যময় দুলাভাই প্রতিটি মূহুর্তে আনন্দময় বাক্যে আমাদের লন্ডন থাকার সময়টুকু উপভোগ্য করে রাখলেন।
ছয়টার দিকেই রায়হান চলে এলো তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমায়। প্রায় তিন বছর মা-বাবার সাথে দেখা হয়নি। কিন্তু আমাদের পরিবার একেবারেই অন্যরকম। কোন উচ্ছ্বাস বা ভালবাসায় দেখানেপনা নাই। ব্যাস সহজ ভঙ্গিতে কথা হলো। খালা খালুর সাথেও অনেক গল্প করলো। তারমধ্যে আগামীকালের এবং আগামী ৫ দিনের পরিকল্পনা বিস্তারিত জানালো। গোটা ইউরোপের যেখানে যেখানে আমরা গিয়েছি, রায়হন সব জায়গায় একজন করে প্রফেশনাল গাইড হায়ার করেছে। এটার তাৎপর্য আসলেই অত্যন্ত গভীর। একটা জিনিশ আপনি দেখলেন, কিন্তু সেটার বিষয়ে কিছুই জানলেন না! তার তাৎপর্য তো একেবারেই মূল্যহীন হয়ে রইলো। তো এবারে আমাদের গাইড যে হবে, আমিতো আনন্দে একেবারে উচ্ছসিত হয়ে পড়লাম। ইসতিয়াক হাসান বাবু, এ রায়হানের একজন অন্যতম প্রধান বন্ধু। ওরা ঢাকায় নটরডেম কলেজে পড়তো। যদিও বাবু রায়হানের এক ক্লাশ জুনিয়র ছিল। বাবুর ভাই জীতু রায়হানের অনেক ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল। জীতুর আপন চাচাতো ভাই এই বাবু। তাই ওরা এক সাথেই প্রায় সময়গুলো কাটিয়েছে। আবার লন্ডনে বাবু যখন ব্যারিস্টারী পড়তে এলো তখন সময় পেলে মাঝে
মধ্যেই সে কানাডয় চলে আসতো রায়হানের সঙ্গে সময় কাটাতে। তবে এখন সে ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেলের একজন প্রতিষ্ঠিত, নামকরা ব্যারিস্টার। বাবু বিয়েও করেছে কানাডায় অবস্থিত একজন বাঙ্গালী মেয়েকে। তো, যখন শুনলাম বাবু আমাদের লন্ডন দেখাবে তখন আমি তো আনন্দে আটখানা। বাবুর চেয়ে লন্ডন এত ভাল করে আর কে দেখাতে পারবে? কারণ, বাবু প্রায় ১৭/১৮ বছর ধরে লন্ডনে আছে। ৫/৬ বছর মাত্র, নিউক্যাসেলে গেছে।
কথা হলো আগামীকাল আমরা সকালে সাবওয়ে ধরে ‘ওয়েস্টহ্যাম’এ নামবো। রায়হান আর বাবু ওখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। রায়হান ঐ এলাকায়ই একটি হোটেলে উঠেছে। ওখান থেকে পরে আমরা একত্রে লন্ডনের ‘সেন্টার’ এ চলে যাব। সেন্টার মানে আমরা কানাডিয়ানরা যাকে ‘ডাউন টাউন’ বলি। আর লন্ডনের দ্রষ্টব্য স্থান গুলো সবই লন্ডন সেন্টারে।
পরদিন ৮টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম। কারণ, প্রায় ১২/১৪টা দ্রষ্টব্য স্থান যা এই ৫ দিনে দেখে শেষ করতে হবে। তার মধ্যে ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম’ এর জন্য আমরা গোটা ১টা দিন রেখে দিয়েছি। ওখানকার সবাই বললো, ব্রিটিশ মিউজিয়াম নাকি সত্যিকার অর্থে দেখলে এক মাসেও শেষ হয় না। তো আমাদের পক্ষে তো সেটা সম্ভব নয়। তবে ১টি গোটা দিন আমি মিউজিয়ামের জন্য রেখে দিলাম।
যাবার সময় মাজেদাপা কিছু খাবার দিয়ে দিতে চাইলো, তবে আমি রায়হানের ভয়ে নিলাম না। রায়হান আবার খুবই অপছন্দ করে কোথাও বেড়াতে যাবার সময় খাবার বয়ে নিয়ে যাওয়া। শুধু পানির একটা বোতল নিলাম।
পাতাল রেলের ‘ওয়েস্টার কার্ড’ তো গতকালই কিনে রেখেছিলাম। পাউন্ডও যথেষ্ট-ই ভরা আছে কার্ডের মধ্যে। ৩/৪ দিন আরাম করে চলে যাবে।
আমরা সোজা ওয়েস্টহ্যামে চলে গেলাম। এদিকে রায়হান এবং ইশতিয়াক বাবুও ‘স্ট্যার্টফোর্ড’ থেকে ডাইরেক্ট ওয়েস্টহ্যামে নামলো। এরপর আমরা একসাথে লন্ডনের সেন্টার এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বেশ অনেকটা পথ। মজার ব্যাপার, ট্রেনে উঠে দেখলাম প্রচুর সাউথ এশিয়ারন পিপল। বেশ ভাল লাগছিল। হোক ভারতীয় বা বাংলাদেশী। তবু আমাদের এই ব্রাউন স্কিনদের সারা পৃথিবীতে প্রবল দৌরাত্মে আমার হৃদয়ের ভেতরে এক গৌরবের আনন্দ আসে। একদিন সারাপৃথিবী যে ব্রিটিশরা শাসন করেছে, সেখানেও দেখলাম আমাদের ব্রাউন স্কিন তথা বাংলাদেশীদের দৌরাত্ম। এমনকি ‘হোয়াইট চ্যাপেল’ এরিয়া রীতিমত বাঙ্গালী অধ্যুষিত এরিয়া। ওখানে বর্তমানে ৩ জন এমপি সাউথ এশিয়ান। সবচেয়ে বড় কথা বর্তমানে সিটি মেয়র একজন মুসলমান এবং সাউথ এশিয়ান। এবং এই মেয়র বেশ মানসিক শক্তিধর মানুষ। চারপাশে মুসলমানদের খুবই সুযোগ সুবিধা দান করেছে। তারমধ্যে আমি প্রচন্ড বিস্মিত হয়েছিলাম যখন লন্ডনের সবথেকে বড় মল ‘ওয়েস্ট ফিল্ড’ এ গিয়েছিলাম। আমারা যেতে যেতে মাগরীবের ওয়াক্ত এসে পড়েছিল। আমি ভাবছিলাম, ফুডকোর্টের কোন একটা চেয়ারে বসে নামাজটা পড়ে ফেলবো। বাইরে বেড়াতে গেলে আমি সাধারণত যা করি। কিন্তু রায়হানের বন্ধু টিনা বললো, না আন্টি এই মলে নামাজের ঘর আছে। আমি তো একেবারে বিষ্ময়ে এবং আনন্দে আবিষ্ট হয়ে পড়লাম।
লন্ডনে দেখলাম সাউথ এশিয়ানরা রীতিমত গৌরবের সাথে মাথা উচু করে বসবাস করছে। আজ থেকে ৪০ বছর আগে যে রেসিজমের কথা শুনতে পেতাম, সেটা আর নেই বললেই চলে। (চলবে)
রীনা গুলশান
টরন্টো
gulshanararina@gmail.com