ডাক্তারখানায় ‘ওয়ান ইস্যু পার ভিজিট’ বিতর্ক

মে ৫, ২০১৯

খুরশিদ আলম

বিশ্বের সেরা দশটি হাসপাতালের তালিকায় এবার ‘টরন্টো জেনারেল হাসপাতাল’ এর নাম উঠে এসেছে। গ্লোবাল মার্কেট রিসার্স কোম্পানী ও নিউজইউক ম্যাগাজিনের যৌথ সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে এই তালিকা প্রকাশ করা হয় গত ২০ মার্চ। তালিকায় প্রথম সেরা দশটি হাসপাতালের মধ্যে টরন্টো জেনারেল হাসপাতালের অবস্থান সপ্তমে।

টরন্টো ডাউনটাউনের ইউনিভার্সিটি এ্যাভিনিউ এবং জেরার্ড স্ট্রিট এর মোড়ে অবস্থিত এই হাসপাতালটির নামডাক অনেক আগে থেকেই। নর্থ আমেরিকার সর্ববৃহৎ ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার হিসাবে খ্যাত এই হাসপাতালটি হৃদরোগ চিকিৎসা সেবায়ও বিশ্বমানের প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। গবেষণা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১৭ সালে রিসার্স ইনফোসোর্স কর্তৃক কানাডায় সেরা হাসপাতাল হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল টরন্টোর এই প্রতিষ্ঠানটি। এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮১২ সালে।

কানাডায় বিশ্বমানের হাসপাতাল আরো আছে। টরন্টো জেনারেল হাসপাতালের পাশেই অবস্থিত হসপিটাল ফর সিক চিল্ড্রেন এরকম একটি বিশ্বমানের হাসপাতাল। টরন্টোর বাইরে অন্যান্য বড় শহরগুলোতেও রয়েছে বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা হাসপাতাল।

বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থার রয়েছে বেশ সুখ্যাতি। আর এই দেশের নাগরিকেরা এই সুখ্যাতির চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে চিকিৎসা পান বিনা ফি-তে! আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের ধনী নাগরিকেরা অসুস্থ হলে অনেকেই সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা করান। রোগটা যদি জটিল প্রকৃতির হয় এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়া যদি কিছুটা দীর্ঘ হয় তবে অর্ধ কোটি বা তারো বেশী টাকা বেরিয়ে যায় একেক জনের পকেট থেকে! আর যারা কানাডায় থাকেন তারা অসুস্থ হলে সেই মানের বা তার চেয়েও ভাল মানের চিকিৎসা সেবা পান বিনা অর্থ ব্যয়ে!

তবে কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থা যতই উন্নত হোক বা যতই এর সুখ্যাতি থাকুক – কিছুটা সমস্যা যে এর আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। হাসপতালের ইমার্জেন্সীর কথাই যদি ধরি তবে সেখানে ওয়েটিং টাইমটা সত্যিই পীড়াদায়ক। কেউ যদি কোন গুরুতর সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সী বিভাগে যান তবে কম করে হলেও তাকে ৪ থেকে ৬ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় ডাক্তারের কাছ পর্যন্ত যেতে! এমনকি লঘু বা কম জটিলতার কোন বিষয় নিয়ে ইমার্জেন্সীতে গেলেও ৪ থেকে ৫ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। ontariowaittimes.com এর তথ্য এটি। দীর্ঘ এই অপেক্ষার সময়টা অসুস্থ রোগীর জন্য নিশ্চিতভাবেই পীড়াদায়ক। সেই সাথে রোগীর সাথে যারা যান তাদের ভোগান্তিও কম নয়।

টরন্টোতে ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে গেলেও কি অপেক্ষার পালা কম হয়? হাসপাতালের এমার্জেন্সী বিভাগের মত হয়তো ৫/৬ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় না। তবে ২ থেকে ৩ ঘন্টাতো অপেক্ষা করতেই হয়। এ অপেক্ষার পালাও কি কম যন্ত্রণার? অনেক ক্লিনিকের ওয়েটিং রুমে কোন দেয়াল ঘড়ি টানানো থাকে না। কারণ, ওয়েটিং টাইমটা যখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকে তখন ঘড়ির দিকে বার বার নজর যায় রোগীর আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে রোগীর মানসিক টেম্পারেচার। বিরক্তি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় তখন হয়তো ডাক পড়লো ওয়েটিং রুম থেকে ভিতরের চেম্বারে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অপেক্ষার পালা তো এখানেই শেষ নয়। ভিতরের চেম্বারে গিয়েও রোগীকে আরো ১৫ থেকে ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। কখনো কখনো আধা ঘন্টা।

টরন্টোতে রোগীদের এই অভিযোগ বহুদিনের পুরানো। কিন্তু কোন সমাধান হচ্ছে না। ফলে ভোগান্তিরও শেষ হচ্ছে না।

গত কয়েক বছর ধরে অবশ্য কানাডার ফ্যামিলি ডাক্তারদের কেউ কেউ এ সমস্যা সমাধানে নতুন এক নিয়ম চালু করেছেন। তারা তাদের অফিসে রোগীদের উদ্দেশ্যে এক নোটিশ টানিয়ে রাখছেন যাতে বলা আছে “ One issue only per visit ”. কোন কোন ডাক্তারের চেম্বারে আরেকটু বিস্তারিত ভাবে বলা আছে “Only one problem per visit in order to minimize waiting times for patients.”

ভাল উদ্যোগ সন্দেহ নেই। রোগীরা এখন ঐ নোটিশ দেখার পরও যদি একটার বেশী দুটো ইস্যু নিয়ে কথা বলতে যান তখন ডাক্তারগণ ঐ নোটিশের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ডাক্তারদের এই উদ্যোগ গ্রহণের পরও কি অপেক্ষার সময় কমেছে? অথবা এই জাতীয় নোটিশ টানিয়ে ডাক্তারগণ কি আইন লংঘন করছেন?

গত মার্চ মাসের একটি ঘটনা। টরন্টোর পশ্চিমে অবস্থিত হ্যামিলটনের কাছাকাছি ব্র্যান্টফোর্ড এ বসবাসকারী ক্রিস্টিনা গিলম্যান নামে এক মহিলা স্থানীয় এক ডাক্তারের কাছে যান তার অসুস্থ শিশু সন্তানকে দেখানোর জন্য। তিনি যখন ওয়েটিং রূমে বসে অপেক্ষা করছিলেন তখন তার নজরে আসে একটি নোটিশ। নোটিশটি এরকম – “For your safety and ours, please limit the discussion with your provider to one issue per visit. Please speak to our staff to book more appointments if needed.” ক্রিস্টিনা সিবিসি নিউজকে জানান, এরকম নোটিশ তিনি আগে দেখেননি। বেশ অবাক হয়ে যান তিনি নোটিশটি দেখে। তিনি আরো জানান, তার চারটি সন্তান রয়েছে এবং এই সন্তানদের রয়েছে জটিল সব স্বাস্থগত সমস্যা, যার মধ্যে আছে dyslexia (difficulty in learning to read or interpret words), autism spectrum disorder  সহ মানসিক সমস্যা ও লিউকোমিয়া। ফলে ডাক্তারের কাছে তাকে প্রতিনিয়তই যেতে হয়।

নোটিশ এর বিষয়টি ক্রিস্টিনার পছন্দ হয়নি। তিনি তার ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে ছড়িয়ে দেন। এরপরই এ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। বিতর্কে অংশ নেন রোগী সহ ডাক্তারগণও।

বিতর্কে অংশ নিয়ে ডাক্তারদের কেউ কেউ এই নোটিসের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। আবার অনেক ডাক্তারই এর পক্ষে সাফাই গান। নোটিশে ‘সেফটি’ শব্দটি কি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠে।

সিবিসি নিউজের খবরে বলা হয়, আসলে “one issue per visit” এর অনুশীলন বা প্রথাটি কানাডায় অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। কেউ কেউ মনে করেন এটি সরকারের কাছ থেকে ডাক্তারদের বেতন গ্রহণের ‘fee-for-service’ পদ্ধতির কারণেই ঘটছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ডাক্তারগণ রোগীর প্রতিটি এপয়ন্টমেন্ট এর সংখ্যা হিসাব করে সরকারের কাছ থেকে বিল আদায় করেন। সাধারণত ফ্যামিলি ডাক্তারগণ রোগীর প্রতিটি রেগুলার এপয়ন্টমেন্ট বাবদ সরকারের কাছ থেকে বিল আদায় করেন ৩০ থেকে ৪০ ডলার পর্যন্ত।

ধারণা করা হয় বাৎসরিক বেতন গ্রহণের পরিবর্তে প্রতিটি রোগীর প্রতিটি এপয়ন্টমেন্ট হিসাব করে বিল করা হয় বলে ডাক্তারগণ সময় বাচিয়ে অধিক সংখ্যক রোগী দেখার ব্যাপারে আগ্রহী হন বেশী। কানাডিয়ান ইস্টিটিউট ফর হেলথ ইনফরমেশন এর এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে ডাক্তারদের গড় আয় বছরে ৩ লক্ষ ৩৯ হাজার ডলার। আর এ বাবদ সরকারকে বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। ২০১৪-১৫ সালের হিসাব এটি।

তবে ফ্যামিলি ডাক্তারদের আয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের চেয়ে কম। ফ্যামিলি ডাক্তারদের গড় আয় বছরে ২ লক্ষ ৭১হাজার ডলার। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের গড় আয় বছরে ৩ লক্ষ ৩৮ হাজার ডলার এবং সার্জিক্যাল বিশেষজ্ঞদের গড় আয় বছরে ৪ লক্ষ ৪৬ হাজার ডলার।

২০১২ সালে ‘ওয়ান ইস্যু পার ভিজিট’ বিষয়টি নিয়ে মেনিটোবার কলেজ অব ফিজিসিয়ানস এন্ড সার্জনস কর্তৃপক্ষ (provincial licensing and disciplinary body for doctors) সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছিল। কারণ, ঐ সময় স্থানীয় এক ডাক্তার তার এক রোগীর একটি ইস্যু নিয়ে কথা বলার পর দ্বিতীয় ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। ঐ রোগী দ্বিতীয় ইস্যুটি ছিল বুক ব্যথা নিয়ে। ডাক্তার সময় না দেয়াতে ঐ রোগী বাসায় ফিরে যান এবং এর এক সপ্তাহ পরে তার হার্ট এ্যাটক হয় এবং তিনি মারা যান।

২০১৬ সালে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এ্যান্ড সার্জনস-ও এই ‘ওয়ান ইস্যু পার ভিজিট’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল এবং ডাক্তারদেরকে এই ধরণের নোটিশ টানানো থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলো।

ডাক্তারদের আইন বিষয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কানাডিয়ান মেডিকেল প্রোটেকটিভ এসোসিয়েশন-ও ‘ওয়ান ইস্যু পার ভিজিট’ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছিল, এটি রোগীর জন্য খুবই বিপজ্জনক হয়ে দাড়াতে পারে। কারণ, একাধিক ইস্যু থাকলে রোগী জানেনা কোন বিষয়টি জরুরী বা কোন বিষয়টি আগে আলোচনা করা উচিৎ ডাক্তারের সঙ্গে।

‘ওয়ান ইস্যু পার ভিজিট’ এর বিষয়টি আসলে একটি জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। এখানে রোগীর দিকটি যেমন বিবেচনায় আনতে হয় তেমনি ডাক্তারদের সময়ের বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হয়। একজন রোগী যদি এক এপয়ন্টমেন্টেই ৪/৫টা ইস্যু নিয়ে কথা বলতে চান তবে ডাক্তারের জন্য তা নিশ্চিতভাবেই কঠিন হয়ে দাড়ায় সময় ম্যানেজ করার ব্যাপারে। কারণ, ওয়েটিং রূমে আরো রোগী অপেক্ষায় থাকেন। তখন সেই রোগীদের সময় অপচয় হয়। পাশাপাশি এপয়েন্টমেন্ট সিডিউল রক্ষা করা সম্ভব হয় না। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ডাক্তার কেভিন মার্টিন তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে সিবিসি নিউজকে বলেন, এক রোগী তার কাছে এসে একে একে ১১টি ইস্যু উত্থাপন করেন। ফলে তার পিছনেই সময় ব্যয় করতে হয়েছিল দেড় ঘন্টা।

যারা বয়স্ক রোগী, তাদের ইস্যু থাকে একাধিক। চারটা বা পাঁচটা এমনকি তারও বেশী ইস্যু থাকা বিচিত্র কিছু নয়। যারা হৃদরোগসহ অন্যান্য জটিল রোগে ভুগেন তাদেরও ইস্যু একাধিক থাকতে পারে। এখন এরকম একজন রোগী যখন ডাক্তারের চেম্বারে আসেন তখন সময় ম্যানেজ করা ডাক্তারের পক্ষে কঠিন হয়ে দাড়ায় সন্দেহ নেই। কিন্তু যত কঠিনই হোক, ডাক্তারেরও কিছু নৈতিক ও আইনগত দায়বদ্ধতা থাকে রোগীকে সময় দেওয়ার ব্যাপারে। এই বিষয়টি ইতিপূর্বে যখন একজন নাগরিক ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ‘কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এ্যান্ড সার্জনস’ বরাবর উত্থাপন করেন তখন ঐ সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়- “ডাক্তারদের পেশাগত, নৈতিক এবং আইনগত দায়িত্ব রয়েছে একজন রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে। এ ক্ষেত্রে কতটা সময় লাগলো তা কখনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না।”

অবশ্য এ কথাও বলা হয় যে, “ডাক্তারগণ তদের ক্লিনিক কি ভাবে পরিচালনা করবেন, বা তাদের টাইম ম্যানেজমেন্ট কি হবে সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়ার পূর্ণ অথরিটি বা কর্তৃত্ব নেই ‘কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এ্যান্ড সার্জনস’ এর। কিন্তু তা সত্বেও ‘ওয়ান ইস্যু পার ভিজিট’ এর বিষয়টি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় যদি কেউ অভিযোগ তুলেন এই বলে যে এই পলিসির কারণে তিনি ক্রুটিযুক্ত চিকিৎসা পেয়েছেন।”

আসলে এখানে দায়িত্বটা উভয় পক্ষকেই নিতে হবে। ডাক্তারদের যেমন নৈতিক, পেশাগত ও আইনগত দায়িত্ব রয়েছে রোগীর সেবা যথাযথভাবে প্রদান করার, তেমনি রোগীরও দায়িত্ব রয়েছে সময়জ্ঞান সম্পর্কে সচেতন হওয়ার এবং পাশাপাশি কোন ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি ডাক্তারের সঙ্গে প্রথমেই আলাপ করে নেয়ার। তাহলে উভয় পক্ষেরই স্বার্থ রক্ষা হয়।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ