কানাডায় সড়ক দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

খুরশিদ আলম ॥

কানাডার মানুষজন অতি ভদ্র এবং বিনয়ী। শিষ্টাচার তাদের আচরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেকে বলেন বিশ্বসেরা শিষ্টাচারের দেশ কানাডা। কথাটা বাড়িয়ে বলা হয় তা কিন্তু নয়। সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা, বিনয়, অথবা শিষ্টাচার যাই বলিনা কেন এ বিষয়ে কানাডিয়ানদের জুড়ি মেলা ভার। বরং বিশ্বে কানাডিয়ানদের একটি ‘বদনাম’ আছে এই বলে যে, তারা একটু বেশী ভদ্র। রাস্তায় চলতে গিয়ে কেউ যদি অসাবধানতাবশত কারো গায়ের উপর এসে পড়েন তবে তিনি কিছু বলার আগেই যার উপর গিয়ে পড়েছিলেন তিনি সরি বলবেন এবং ঐ লোকটি কোনভাবে ব্যথা পেলেন কিনা সেটা জানতে চাইবেন।

কিন্তু এই কানাডায়ই আবার একটি উল্টো চিত্রও আছে। এখানে সড়কগুলোতে গাড়ি চালানোর সময় কিছু লোক চরম অভদ্রতার পরিচয় দেন। এরা পিছন থেকে টেইলগেটিং (সামনের গাড়ির খুব পিছনে চলে এসে ড্রাইভ করা) করে চাপ সৃষ্টি করতে থাকবেন সামনের চালককে সড়কের নির্ধারিত গতি বেগের চেয়ে আরো বেশী গতিতে গাড়ি চালাতে। না চালালে হর্ণ বাজাবেন বা পেছনে খুব কাছে এসে হেডলাইট হাইবীমে জ্বালিয়ে সামনের চালকের চোখ ধাঁধিয়ে দিবেন। ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে পাশের কেউ লেন পরিবর্তন করতে চাইছেন, এই সময় তাকে সাইড দিতে গেলে পিছনের গাড়ির চালক হর্ণ বাজিয়ে সামনের চালকে গাল দিবেন অথবা হাত নাড়িয়ে বা মধ্যম আঙ্গুল প্রদর্শন করে অত্যন্ত অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করবেন। সামনের চালক কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালে পিছনের চালক লেন পরিবর্তন করে পাশে চলে আসবেন এবং ঐ অশোভন ও ইতরপনাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে থাকবেন পাশ থেকে। অনেক সময় গাড়িতে ধাক্কাও মারববেন চলন্ত অবস্থায়ই। পিছন থেকে সামনে চলে এসে গাড়ি থামিয়ে দিবেন। কখনো কখানো গাড়ি থেকে নেমে এসে টার্গেট করা গাড়ির চালকের সঙ্গে হাতাহাতিতে লিপ্ত হবেন কিংবা গাড়ির ক্ষতি করবেন। এই দুর্বৃত্তদের কেউ কেউ আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করেন এরকম পরিস্থিতিতে। সড়কে গাড়ি চালকদের এই উন্মাদনা কে কানাডীয় ভাষায় ‘Road rage’ বলা হয়। অর্থাৎ সড়ক পথের উন্মাদনা। আমি বলবো এটি শুধু উন্মাদনা নয়, বাস্তব অর্থে এটি দুর্বৃত্তপনা।

সড়কে উচ্ছৃঙ্খল ও বদ প্রকৃতির এই গাড়ি চালকদের আচরণ অনেক সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাড়ায়। প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটে নিরীহ পথচারী বা গাড়ির চালকদের। আজকাল সেল ফোন এবং ড্যাসক্যাম এর বদৌলতে এই বদ প্রকৃতির গাড়ি চালকদের কিছু কিছু কান্ডজ্ঞানহীন ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা মিডিয়ার ভিডিও ক্লিপে আমরা দেখতে পাই। মারদাঙ্গা চলচ্চিত্রের ঘটনাকেও হার মানায় এই সব ঘটনা।

টরন্টোর ক্যাসেলফিল্ড সড়কের একটি দৃশ্য। (বাঁয়ে) দুই চালক মুষ্ঠিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। (ডানে) অন্যরা গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন যুদ্ধ থামানোর জন্য। ড্যাসক্যামে ধরা পড়েছে এই দৃশ্য। ছবি : নারসিটি.কম

এই তো গত বছর আগস্ট মাসের একটি ঘটনা। টরন্টোর নিকটবর্তী ৪০৪ হাইওয়েতে এক চালক এক লেন থেকে আরেক লেনে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি চলছিল যে গাড়িটি সেই গাড়ির চালক তাকে সেই সুযোগ দিচ্ছিলেন না। এতে ক্ষেপে গিয়ে অপর গাড়ির চালক অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে দুই গাড়ির চালকই হাইওয়েতে থামেন। এই সময় লেন পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন যে চালক তিনি হাতের কাছে পাওয়া একটি টুল বক্স নিয়ে এসে অন্য গাড়ির চালকের দিকে ছুড়ে মারেন। এরপর রাগ কিছুটা কমলে তিনি নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠেন। এদিকে যার দিকে টুলবক্স ছুড়ে মারা হয়েছিল তিনি গাড়ি থেকে নেমে এসে অপর চালক ও তার লাইসেন্স প্লেট এর ছবি তোলার চেষ্টা করছিলেন গাড়ির সামনে এসে। এটি দেখে টুলবক্স ছুড়ে মারা চালক আরো ক্ষেপে যান এবং সজোরে গাড়ি সামনের দিকে চালাতে থাকেন। বিপদ বুঝে ছবি তোলা বাদ দিয়ে অপর চালক গাড়ির হুডের উপর ঝাপিয়ে পড়েন আত্মরক্ষার জন্য। এই অবস্থায়ই হাইওয়েতে গাড়িটি চলতে থাকে প্রায় একশ কিলোমিটার বেগে! আর এই ঘটনা রেকর্ড হয়ে যায় অন্য এক গাড়ির ড্যাশ বোর্ড ক্যামেরায়। প্রায় ৫ শত মিটার পর্যন্ত চলার পর হঠাৎ থামে গাড়িটি। খবরটি প্রকাশিত হয় সিবিসি নিউজে।

এখানে মারাত্মক একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। ঘটতে পারতো জীবনহানী। অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পুলিশের হাইওয়ে সেফটি ডিভিশনের মুখপাত্র সার্জেন্ট ক্যারি শ্মিট সিবিসি-কে বলেন, এটি চূড়ান্ত মাত্রায় আক্রমনাত্মক ড্রাইভিং এবং আমি কখনো এই ধরণে ঘটনা দেখিনি। এই ধরণের আচরণ সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।

২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল টরন্টোর নিকটবর্তী এজাক্সে কালো রং এর একটি জাগুয়ার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয় অপর এক গাড়ির চালককে লক্ষ্য করে। ব্যস্ততম হাইওয়ে ৪০১ এর উপর ঘটে এই ঘটনা। আর ঘটনাটি ঘটায় ২৫ বছরের এক যুবক। সৌভাগ্যবশত গুলিটি লক্ষভ্রষ্ট হয়। কানাডিয়ান প্রেস খবরে বলা হয়, পরে পুলিশ ঐ যুবককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

Global News  এক খবরে বলা হয়, ২০১৮ সালের আগস্টে ভেঙ্কুভারে ৩৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মারা যান সড়কে অপর গাড়ির চালকের গুলিতে। খুনি চালককে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।

কানাডার সড়কগুলোতে এরকম রোড রেজের হাজারো ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই। এই সমস্ত ঘটনায় কোথাও লোকজন আহত হচ্ছেন, কোথাও গাড়ির ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। তবে গুলি বর্ষনের ঘটনা বিরল।

টরন্টোতে বাঙ্গালীদের মধ্যে যারা গাড়ি চালান তাদের প্রায় সকলেই কখনো না কখনো এই বদপ্রকৃতির দুর্বৃত্ত চালকদের মোকাবেলা করতে হয়েছে সন্দেহ নেই। আমি নিজেও বেশ কয়েকবার এই দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েছি। এইতো মাত্র কদিন আগের একটি ঘটনা- সেদিন টরন্টোতে ছিল মাইনাস ৩৫ তাপমাত্রা আর সেই সাথে প্রচন্ড বাতাস। তার আগের রাতে প্রায় ১০ সেন্টিমিটার তুষারপাত হয়েছে। আমি ৪০১ ধরে ওয়েস্টের দিকে যাচ্ছি। রাস্তার কন্ডিশন ভাল নয়। সতর্ক না থাকলে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। চার লেনের সড়কে আমি (ডান দিক থেকে) তৃতীয় লেন ধরে এগুচ্ছিলাম। গতিবেগ একশতে। পাশের লেনের গাড়িগুলোও আশি থেকে নব্বুইয়ে চলছিল। সবাই সতর্ক। এমন সময় পিছন থেকে এক পিকআপ ভ্যান আমাকে টেইলগেটিং করা শুরু করলো। প্রায় মিনিট খানেক এইভাবেই চললো। আমি গতিবেগ বাড়াচ্ছি না বলে পিছনের চালক তখন হাইবীমে তার গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিল। সেই হাইবীম আমার গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে প্রতিফলিত হয়ে আমার চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছিল। সামনে ভাল করে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না।

এই অবস্থায় আমার কি করা উচিত ছিল ? গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে পিছনের পিকআপ ভ্যানের চালকের দু গালে কষে দুটি চড় মারা? নাকি পুলিশ ডাকা?

এর কোনাটাই করা সম্ভব ছিল না ঐ মুহূর্তে। কারণ, কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করতে গেলে উল্টো আমিও দোষী সাব্যস্ত হতে পারি। আর পিকআপ ভ্যানের চালক কুংফু ক্যারাটের মাস্টার না কুস্তিগির সেটাতো আমি জানিনা। অথবা তার কোমরে পিস্তল লুকানো আছে কি না সেটাও আমি জানিনা। পুলিশ ডেকেও লাভ নেই। প্রথমত হাইওয়েতে পুলিশ আসতে যে সময় নিবে পিকআপ ভ্যানের চালক তার অনেক আগেই পাগার পার হয়ে যাবে। আর আমার হাতে তখন ডকুমেন্টেড কোন কিছু থাকবে না অভিযোগ সত্য প্রমাণিত করার। তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আমার গাড়ির এমার্জেন্সী লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। তখন পিকআপ ভ্যানের চালক বাধ্য হয়ে লেন পরিবর্তন করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে তার গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে শুনিয়ে গেলেন।

এই লেন পরিবর্তনের কাজটা তিনি আগেও করতে পারতেন। আমিতো বেআইনী কিছু করছিলাম না। ৪০১ এর নির্ধারিত গতি বেগ ১০০ কিলোমিটার। চালকরা সাধারণত ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটারে গাড়ি চালান ৪০১ এ। অল্প কিছু চালক আছেন যারা ১২০ এ গাড়ি চালান। আর আবহাওয়ার কারণে রাস্তার পরিস্থিতি খারাপ হলে গতিবেগ স্বাভাবিকভাবেই কমিয়ে দেন সবাই। সেদিন আমিসহ অন্যান্য চালকরাও তাই করছিলেন। তারপরও আমার গতিবেগ ছিল ১০০ তে। তাহলে আমার দোষটা কোথায়? কেন পিকআপ ভ্যানের চালক এরকম কান্ড করলেন? উনার যদি কোন ব্যস্ততা থাকতো তবে তো তিনি লেন পরিবর্তন করতে পারতেন? তা না করে কেন অন্যকে উত্যক্ত করা। আর শুধুই কি উত্যক্ত করা? এরকম পরিস্থিতিতে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে! এটা নিশ্চিতভাবেই সড়ক দুর্বৃত্তপনা।

এই সড়ক দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে আমার এক বন্ধুর পরামর্শ হলো, “কুকুর কামড়ালে কি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তুমিও কুকুরকে কামড়াতে যাবে নাকি?”

তার কথায় যুক্তি আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই কুকুরকে না কামড়ালেও মুগুড় তো মারা যেতে পারে? অর্থাৎ উপযুক্ত শিক্ষাতো দেয়া যেতে পারে? কিন্তু কে দেবে এই শিক্ষা?

কানাডায় এই সড়ক দুর্বৃত্তদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়! জরীপে দেখা গেছে প্রতি তিনজন চালকের মধ্যে একজন চালক প্রতি মাসে একবার করে সড়ক দুর্বৃত্তপনার শিকার হন। ‘স্টেট ফার্ম কানাডা’ পরিচালিত জরীপ তথ্য এটি।

ঐ জরীপে বলা হয়, সবচেয়ে বেশী দুর্বৃত্তপনা করা হয় টেইলগেটিং এর মাধ্যমে। অবশ্য প্রায় অর্ধেক চালকই (৪৬%) বলেন সড়ক দুর্বৃত্তদের উৎপাতের সময় তারা শান্ত থাকেন। অর্থাৎ কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখান না। আর ২০% চালক বলেন তারা প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে গাড়ির হর্ণ বাজান।

প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যায়, কানাডায় এই সড়ক দুর্বৃত্তপনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর বড় শহরগুলোতেই তা ঘটছে বেশী। এর কারণ হিসাবে কেউ কেউ দায়ী করছেন জনসংখ্যা তথা চালকের সংখ্যা বৃদ্ধিকে। চালকের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সকাল-সন্ধ্যায় সড়কগুলোতে অত্যধিক চাপ পড়ে। সৃষ্টি হয় ট্র্যাফিক জ্যাম। ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টির পিছনে আরো যে সকল ফ্যাক্টর কাজ করে তার মধ্যে আছে সড়ক সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ, শীতকালের আইসি কন্ডিশন, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি। আর জ্যামে আটকা পড়লে মানুষের মেজাজ ঠিক থাকে না। এই সময় সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কর্মস্থলে ঠিক সময়মত পৌঁছাতে পারে না। এপয়েন্টমেন্ট মিস করে। স্কুল বা ডে কেয়ারে বাচ্চাদের সঠিক সময় নামাতে বা উঠাতে ব্যর্থ হয়। এরকম আরো নানান ঝামেলায় পড়তে হয় ট্রাফিক জ্যামের কারণে। আর এ কারণগুলো সড়ক দুর্বৃত্তপনায় উস্কে দেয় যাদের মেজাজ দুর্বল বা মেজাজ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা যাদের কম তাদেরকে।

ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়ে যাদের মেজাজ বিগড়ে যায় তারা একটি কথা ভুলে যান যে, ঐ ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টির পিছনে তিনি নিজেও একজন কন্ট্রিবিউটর। সুতরাং কেউ ট্র্যাফিক জ্যামের দোহাই দিয়ে সড়ক দুর্বৃত্তপনার অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করবেন তা হতে পারে না।

রোড রেজ এর আরো যে সকল কারণ থাকতে পারে তার মধ্যে আছে :

– পুয়র ড্রাইভিং কন্ডিশন

-পুয়র ড্রাইভিং হেবিটস (লেন পরিবর্তনের সময় ঠিকমত সিগনাল না দেওয়া, blind spots চেক না করা, সেলফোন ব্যবহার করা ইত্যাদি)

– অন্য ড্রাইভারের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়া

– রাস্তায় দেরী হয়ে যাওয়া

– ক্লান্ত থাকা বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিরতিহীন ড্রাইভ করা

– মানসিকভাবে খারাপ মুডে থাকা

এগুলো ছাড়াও আরো বহু কারণ আছে রোড রেজে জড়িয়ে পরার পিছনে।

সড়ক দুর্বৃত্তপনা কতটা বিপজ্জনক তা হয়তো আমরা অনেকেই অনুধাবন করতে পারি না। কেউ কেউ হয়তো বলবেন এ নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কি আছে? পিছন থেকে কেউ যদি টেইলগেটিং করে বা হর্ণ বাজায় তাতে কি আসে যায়? জাস্ট ইগনর ইট।

না, বিষয়টি অত হালকা ভাবে নেয়ার মত নয়। অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পুলিশের সার্জেন্ট কেরী শ্মিট সিবিসি-কে বলেন, রোড রেজ অবশ্যই একটি সিরিয়াস ইস্যু। অনেক রোড রেজ এর ঘটনা আছে যেগুলোকে এগ্রেসিভ ড্রাইভিং হিসাবে বিবেচনা করা যায়। এবং অন্টারিওর হাইওয়েগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ এই এগ্রেসিভ ড্রাইভিং। আর এটি ঘটেই চলছে এবং লোকজন এ ব্যাপারে হতাশ।

এগ্রেসিভ রোড রেজ কতটা সিরিয়াস বিষয় তার একটি পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরা হলো :

– মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে শতকরা ৬৬ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে এগ্রেসিভ ড্রাইভিং এর কারণে।

– ৩৭% এগ্রেসিভ ড্রাইভিং এর ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে।

– ১৯ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদেরকে বেশী মাত্রায় রোড রেজ এ অংশ নিতে দেখা যায়।

– অর্ধেক গাড়ি চালক স্বীকার করেছেন কেউ তাদেরকে রোড রেজ এর মাধ্যমে উত্যক্ত করলে তারাও আক্রমনাত্মক প্রতিক্রিয়া জানান।

– সাত বছরের একটি হিসাব নিয়ে দেখা গেছে ঐ সময় সীমার মধ্যে রোড রেজ এর কারণে ২১৮টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে এবং আহত হয়েছেন ১২,৬১০ জন। (সূত্র : thinkinsure.ca )

রোড রেজ পরিস্থিতিতে নিজেকে এবং সাথের যাত্রীদেরকে নিরাপদ রাখার জন্য যা করা উচিৎ :

সড়ক পথে গাড়ি চালানোর সময় আমরা সবাই কখনো না কখনো রোড রেজ এর শিকার হই। এর মধ্যে আছে টেইলগেটিং, হর্ণ, হাইবীম, কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গী, মিডল ফিংগার প্রদর্শণ, গালাগাল ইত্যাদি। এগুলোর শিকার হলে স্বাভাবিকভাবেই যে কেউ উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারেন এবং পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু নিরাপদ সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রাখা হলো সবচেয়ে বুদ্ধমানের কাজ। আর এই সময়টাতে যা করতে হবে তা হলো :

– প্রতিক্রিয়া দেখাতে যাবেন না বা প্রতিশোধ নিতেও যাবেন না

– আই কনটাক্ট এড়িয়ে চলুন

– গাড়ি থেকে কখনোই নামতে যাবেন না

– আপনার নজর রাখুন সড়কের উপর

– কেউ টেইলগেট করতে থাকলে আপনি লেন পরিবর্তন করে তাকে যেতে দিন

– যদি দেখেন পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে তবে সড়কের পাশে যেখানে নিরাপদ সেখানে গাড়ি পার্ক করুন এবং পুলিশ কল করুন

এতো গেল বিশেষজ্ঞদের কথা। কিন্তু রোড রেজ বা সড়ক দুর্বৃত্তপনার শেষ কোথায়? এটা বন্ধ করার কোন উপায়ই কি নেই? রোড রেজ নিশ্চই এক ধরণের অপরাধ। আর যখন তা ডেঞ্জারাস ড্রাইভিং এর পর্যায়ে চলে যায় তখন তো তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ধরা যাক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী রোড রেজ এর শিকার প্রতিটি ব্যক্তিই চুপচাপ রইলেন। কোনরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। শান্ত থেকে সড়ক দুর্বৃত্তদের আরো প্রশ্রয় দিলেন তাদের ইতরপনা বা দুর্বৃত্তপনা নির্ভিঘেœ চালিয়ে যেতে। এতে করে কি সমস্যার সমাধান হলো?

কানাডা নাকি বিশ্বসেরা শিষ্টাচারের দেশ। কই, সড়ক পথে গাড়ি চালনার সময়তো তার কোন প্রমাণ মিলে না! প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে বড় শহরগুলোতে নাকি গাড়ি চালকরা বেশী মাত্রায় রোড রেজ করে থাকেন। অন্টারিও প্রভিন্সের অন্যান্য অঞ্চল থেকে টরন্টোতে অনেক বেশী রোড রেজ হয়ে থাকে। কানাডিয়ান জার্নাল অব পাবলিক হেলথ এর তথ্য এটি। ঐ তথ্যে আরো দেখা যায় যারা উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চ বেতনভূক তারাই নাকি বেশী মাত্রায় রোড রেজ করে থাকেন এবং রোড রেজ এর শিকারও তারাই বেশী হন। আশ্চর্য হওয়ার মত তথ্য বটে!

বিষয়টি একটু অন্যভাবে এনালাইসিস করা যেতে পারে। আমরা জানি কানাডার বড় শহরগুলোতে ইমিগ্রেন্টদের উপস্থিতি গত কয়েক দশকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর ফলে টরন্টোতে এখন ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা তথাকথিত মূলধারার জনসংখ্যার চেয়েও বেশী। শতকরা হিসাবে ৫১.৫%। ২০১৬ সালের আদম শুমারীর রিপোর্ট এটি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ইমিগ্রেন্টদের কারণেই কি টরন্টোতে রোড রেজ এর সংখ্যা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে?

আমি এর সাথে এক মত হতে পারছি না। কারণ গত বিশ বছর ধরে আমি এই টরন্টোতে গাড়ি ড্রাইভ করতে গিয়ে যতবার সড়ক দুর্বৃত্তদের হয়রানীর শিকার হয়েছি তার একটি বাদে সবকটিই ঘটিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ চালক।

তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সড়কের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মানার অর্থ হলো দুর্বৃত্তদের নম নম করে পথ ছেড়ে দিতে হবে, পিছন থেকে কামড় দিলেও সোহাগ করে তাদেরকে পিঠ চাপড়ে দিতে হবে মারহাবা মারহাবা বলে! এ তো অপরাধীদেরকে আস্কারা দেওয়ার মতই নীতি। এটা কি রোড রেজ বন্ধ করার কোন স্থায়ী সমাধান হলো?

রোড রেজ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা শান্ত থাকার যে পরামর্শ দিয়েছেন তা একটি অস্থায়ী সমাধান। আপতত সেই সমাধানই সকলের অনুসরণ করা উচিৎ।

কিন্তু আমাদের মনে হয় সড়ক পথের এই রোড রেজ তথা দুর্বৃত্তপনা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হলে সড়ক কর্তৃপক্ষসহ আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য ও নীতিনির্ধারকদেরকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়কে বাড়াতে হবে নজরদারী। হয়তো শূন্যের কোঠায় তা নামিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু কানাডার মত একটি সুসভ্য ও শিষ্টাচারের দেশে অসভ্য কিছু গাড়ি চালকের কারণে লোকজন হয়রানী ও ক্ষেত্রবিশেষ মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হবেন তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ