এই পরবাসে রবে কে-৮

জানুয়ারী ৭, ২০১৯

নাজমুল ইসলাম

‘তুই কই যাচ্ছিস? কোন জাহান্নামে? বাড়ীর ছেলে বাড়ীত থাকবি, তা না কানাডা যায়? কানাডায় কি পাইছিস? ঐসব কানাডা ফানাডা বাদ দে…..’?

বছর পাঁচেক আগে আমি যখন কানাডা আসি, তখন আমার দাদী কিছুটা রাগ আর কান্না মেশানো গলায় কথাগুলো আমাকে বলেছিলেন।

গত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন আমার প্রায় শতবর্ষী দাদী আমেনা খাতুন। প্রবাসী হবার যতগুলো কষ্টের ব্যাপার আছে, তারমধ্যে অন্যতম হলো দেশ থেকে কোন প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া। বছর শেষে আবারও সেই কষ্ট পেলাম। গত ৪ বছরে একাধিকবার এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। কানাডা আসার পর থেকে যতবারই কারও মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি, ততবারই মনে হয়েছে এ কী জীবন বেছে নিলাম? এভাবে দেশে প্রিয়জন বা পরিবারের একজন করে আপনজন মারা যাবে, আর আমাদের বসে বসে হা হুতাশ করতে হবে?

আমাদের শিশুবেলায় শুনতাম মানুষ মরে গেলে আকাশে তারা হয়ে যায়। তখন আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে খুঁজতাম সেইসব মানুষদের। দাদীও কি তারা হয়ে গেল?

আমাকে নিয়ে দাদীর ওরকম করে বলা মোটেই অযৌক্তিক নয়। কারণ আমার শৈশবের বেড়ে ওঠায় দাদীর একটি আলাদা উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। যতদুর মনে পড়ে দশ-এগারো বছর বয়স পর্যন্ত দাদীর সঙ্গেই ঘুমিয়েছি। দাদীর কিছু কিছু বিষয় আমার কাছে বিস্ময়কর লাগে আজও। আধুনিক স্বাস্থ্যবিধিতে এর কোন ব্যাখ্যা আছে কি না জানি না। সবসময় কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতেন দাদী। পান খেতেন নিয়মিত। অথচ কখনও দাঁত লাল হতে দেখিনি তাঁর। ঝকঝকে সাদা দাঁতই শুধু নয়, আমৃত্যু কোন দন্তবিয়োগও ঘটেনি দাদীর।

মা-বাবা জন্ম দেন বটে, কিন্তু সন্তানের বেড়ে ওঠায় দাদী-নানীদের ভুমিকা অনন্য। তাঁদের সেই ভিন্ন মাত্রার আদরের কোন তুলনা হয়না। পরিবারে সবার জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন আমার দাদী। ছোট দু’একটি পারিবারিক অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ইচ্ছা হচ্ছে। হয়তো অনেকের জীবনেই এধরণের স্মৃতি কমন। তবু ব্যক্তিবিশেষে এবং পরিবেশভেদে সে অনুভুতির মাত্রা যে ভিন্ন, তাতে সন্দেহ নেই। আর তাই এই শেয়ারিং।

কনকনে শীতের রাতে টয়লেটে যেতে হলে ভুত-পেত্নীর ভয়ে দাদীকে টয়লেটের দরজায় পাহারা দেয়ার জন্য সঙ্গে নিয়ে যেতাম আমরা। মফস্বল শহরের বাড়ীগুলোতে আগে এটাচ বাথরূমের প্রচলন প্রায় ছিলই না বলা চলে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বাথরুম বা টয়লেটগুলো বাড়ীর মূল অংশ থেকে আলাদা হতো। আমাদের টয়লেটে যেতে হতো বড় একটা উঠোন পেরিয়ে। কাজেই একা যাবার তো প্রশ্নই আসে না। তার উপরে অন্ধকার আর বৃষ্টি কাদার দিন হলে তো কথাই নেই।

যেন সেদিনের কথা। টয়লেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন দাদী। কিছুক্ষন পর পর হয়তো জিজ্ঞাসা করছেন ‘কিরে হলো তোর’? অথবা আমরাও চেক করছি দাদী এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কিনা। ‘দাদী তুমি আছো তো’? ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে কিংবা মৃদু হারিকেনের আলোয় এমন নির্ভয় নিশ্চিন্ত প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন ক’জনের জীবনে ঘটে? আমাদের ভাইবোনদের জীবনে ঘটেছে অসংখ্যবার। নিশ্চিন্তই বটে! টয়লেটের ভিতরে বসে মনে মনে ভাবতাম- আসুক না ভুত-পেত্নী, দাদী এক ধমকে ওদের তাড়িয়ে দেবে কিংবা ঘাড় মটকে দেবে। ধন্য আমরা যারা দাদী-নানীদের এমন সান্নিধ্য পেয়েছি। মানুষের শৈশবের বোধ বুদ্ধিতে স্বাস্থ্যবিধি নেই। আর তাই বোধহয় দাদীর মুখের চিবানো পানও খেতে চাইতাম।

দাদীকে ঘিরে অসংখ্য স্মৃতি। স্মৃতির সেলুলয়েডে ধুলো জমে না। সর্বদাই উজ্জ¦ল। দেশে আজও আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই- সকালবেলা দাদী রান্নাঘরের বাইরে বসে পরিবারের সবার জন্য আটা মেখে একগাদা রুটি বেলছেন। বাজার থেকে আনা যাবতীয় মাছ নিয়ে কুটতে বসেছেন উঠোনের একপাশে। বাড়ীর বিশাল উঠোন দু’বেলা ঝাঁট দিয়ে ঝকঝকে তকতকে করে রাখছেন। কনকনে শীতের রাতে সেহরীর সময় উঠে সবার জন্য ভাত রান্না করছেন। খড়ির চুলার পাশে বসে বিস্মিত হয়ে রান্নার সেই দৃশ্য দেখছি আমরা তার নাতি-নাতনিরা। শুনছি রূপকথার গল্প।

নাতি-নাতনীদের জীবনে দাদীর আদর বা শাসনের কোন বিকল্প নেই। দাদা-দাদীরা সংসারের বন্ধন। দাদা-দাদীরা মূল্যবোধের বাহন। শিশুর মানসিক গঠনে দাদী-নানীদের প্রত্যক্ষ ভুমিকা রয়েছে। অভিবাসী জীবনে অনেক শিশু দাদী-নানীর সান্নিধ্য পেলেও বেশীরভাগেরই হয়তো সে সৌভাগ্য হয় না। সন্তানের সন্তান নাতি, আর নাতির সন্তান পুতি। আমার দাদী তার পুতিদেরও দেখে গেছেন। আফসোস, দেশে থাকলে আমাদের সন্তানরা হয়তো আরও কিছুদিন আমাদের ¯েœহময়ী দাদীর সান্নিধ্য পেতো।

প্রবাসে প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ শোনার কষ্টের কথা একাধিকবার বলেছি। এই লেখার প্রথমেই বলেছি আমার কানাডা আসার সিদ্ধান্তে আমার দাদী খুব আপসেট হয়েছিলেন। বাধা দেয়ার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই চ’লে যাচ্ছিস, আমি মরলি আমাক কাঁদে ক’রে আরিপপুরে (আরিফপুর গোরস্থান, পাবনা) নিয়ে যাবি কেডা’? আমি বলেছিলাম, ‘তুমি মরবা ক্যান? তোমার সাথে তো দেখা হচ্ছেই। আমি ঘুরে আসি’। আর দেখা হলো না দাদীর সঙ্গে।

যে স্বার্থপর জীবনে নিজেকে সমর্পন করেছি, তাতে দাদীর লাশ কাঁধে নিয়ে কবরস্থানে যাবার মতো আবেগের কোন স্থান নেই। আমাকে ক্ষমা করো দাদী। তোমার কথা রাখতে পারলাম না। যেখানেই থাকো ভালো থেকো দাদী।

নাজমুল ইসলাম

টরন্টো, কানাডা।

nazmul13@gmail.com