মেরুদন্ডহীন যারা তারাই প্রবাসে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগেন

অক্টোবর ১১, ২০১৮

খুরশিদ আলম ॥

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান মেয়ে মির্জা নাদিয়া আঞ্জুম নাহিয়ান ২০১৭-১৮ শিক্ষা বর্ষে টরন্টো ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ডের সম্মানজনক সেরা শিক্ষার্থীর মর্যাদা পেয়েছে। গড়ে ৯৯.০০ শতাংশ নম্বর পেয়ে সে তাক লাগিয়ে দেয় সবাইকে।

এর পাশাপাশি আমি আরো বেশী তাক লেগে যাই সে যখন সগর্বে এবং অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে বলে “কানাডায় আমি আমার ধর্মীয় বা এথনিক পরিচয়ের জন্য হীনমন্যতায় ভুগি না। আর আমি মনে করি বাংলা সংস্কৃতি উচ্চতর সংস্কৃতি।”

শিক্ষা ক্ষেত্রে নাহিয়ানের এই অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জনের পর তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য আমি গিয়েছিলাম তাদের বাড়িতে। উদ্দেশ্যে ছিল তার এই কৃতিত্বকে এমনভাবে তুলে ধরা যাতে করে আমাদের কমিউটির অন্যান্য ছেলে-মেয়েরাও অনুপ্রাণিত হয়। সেই সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়ই নাহিয়ান এই কথাগুলো বলে।

আমি মনে করি নাহিয়ানের এই সগর্ব ও সাহসী উচ্চারণ প্রবাসের প্রতিটি বাঙ্গালীর কাছেই একটি সুগভীর উদ্দীপনামূলক বক্তব্য। আর যারা প্রবাসে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগেন, যারা বাঙ্গালী পরিচয়ে লজ্জা বোধ করেন তাদের কাছে নাহিয়ানের এই বক্তব্য একটি দাওয়াই হিসাবে কাজ করতে পারে। দাওয়াই তাদেরই লাগে যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। হীনমন্যতাও এক ধরণের মানসিক রোগ। আর এই রোগের চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।

এমপি নাথানিয়েল স্মিথ এর ভাষ্য -“সত্যিই, বাঙ্গালীদের খুব সুন্দর এক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে। সত্যি বলতে কী, বাঙ্গালী সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করে।” ছবি : মনির বাবু

আমরা লক্ষ্য করেছি কানাডায় কিছু সংখ্যক বাংলাদেশী আছেন যারা অন্য সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদেরকে বাঙ্গালী হিসাবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। কুণ্ঠাবোধ করেন নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় দিতেও। এমনকি ‘আমি বাঙ্গালীদের সঙ্গে মিশি না’ এমন কথা বাঙ্গালীদের সঙ্গেই বলতে দ্বিধাবোধ করেন না এই শ্রেণীর বাংলাদেশীরা। ঘরে তারা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ইংরেজী ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করেন যদিও বেশীর ভাগই শুদ্ধ ইংরেজীতে কথা বলতে পারেন না। ভুল ইংরেজীতেই ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে দিনরাত কথা বলে যাচ্ছেন। এ নিয়ে আড়ালে আবডালে লোকজন যে মজা করেন সেটি উপলব্দি করার মত চৈতন্য বা বুদ্ধিমত্তা তাদের নেই।

মূূলত হীনমন্যতা বোধ থেকেই এই জাতীয় আচরণ এর জন্ম হয়। তাদের ধারণা- পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ইত্যাদি যা কিছু আছে তার সবটাই বাঙ্গালীর সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্য থেকে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। এমন কি পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতিও!

মেরুদন্ডহীন হলে যা হয়, এই শ্রেণীর বাঙ্গালীদেরও তাই হয়েছে। প্রবাসে এসে এরা আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে ফেলেন। পরিচয় সংকটে পড়ে এদের মধ্যে এক ধরণের অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব বোধ জন্ম নেয়। প্ররশ্রীকাতরতা এদের চরিত্রের গভীরে পৌঁছে যায়।

আমরা জানি, ভারতবর্ষে পীরবাদী একটি সংস্কৃতি চালু রয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে এই পীরগণ প্রায় দেবতুল্য। এই পীরদের মধ্যে শ্রেণীভেদ আছে। কেউ ধর্মীয় পীর, কেউ রাজনৈতিক পীর, কেউ তাবিজ-কবজের পীর। এই পীরেরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ বিশেষত যারা ঐ পীরদের মুরিদ তাদের কাছে তা দৈববাণী হিসাবে বিবেচিত হয়। অন্ধভাবে তারা পীরের বাণী বিশ্বাস করেন। সেই বাণী যদি ভুলও হয়, যদি বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও হয় তবু তা অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন ঐ পীরদের মুরিদ বা অনুসারীরা।

কেন বিশ্বাস করেন? ঐ যে বললাম মেরুদন্ডহীনতা। নিজের উপর আস্থার অভাব। আত্মমর্যাদার অভাব। এই শ্রেণীর মানুষ প্রবাসে এসেও সেই একই চিন্তা চেতনাকে লালন করেন। তারা ভাবতে থাকেন বাঙ্গালীর ভাষা, বাঙ্গালীর সংস্কৃতি, বাঙ্গালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিন্মমানের। পাশ্চাত্যের তুলনায় তা নিকৃষ্টতর।

তাদের চোখে পাশ্চাত্যের যা কিছু আছে তা সবই শ্রেষ্ঠতর। পাশ্চাত্যের মানুষজন সব পীরতুল্য। সুতরাং এই পীরদেরকে অবশ্যই অনুকরণ করতে হবে। প্রয়োজনে নিজের সবকিছু জলাঞ্জলী দিয়ে হলেও তা করতে হবে।

কেউ কেউ আছেন নিজের পিতৃপ্রদত্ত নামটারও বিকৃতি ঘটিয়ে ফেলেন এই শ্বেত গাত্র বর্ণের মানুষদের নাম অনুকরণ করে। নামের মধ্যে কিছুটা পাশ্চাত্য গন্ধ যুক্ত করতে পারলে যেন তারা জাতে উঠে গেলেন এমন একটা ভাব তাদের মধ্যে কাজ করে। আর তাই নামের আগে বা পিছে একটা পাশ্চাত্য নাম জুড়ে দেন যেটা তার সার্টিফিকেটে নেই।

উল্ল্লেখ্য যে, একবার প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে টরন্টোর বাঙ্গালী অধ্যুষিত বিচেস্ট-ইস্টইয়র্ক রাইডিং এর এমপি (লিবারেল) নাথানিয়েল স্মিথ বলেছিলেন, “সত্যিই, বাঙ্গালীদের খুব সুন্দর এক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে। সত্যি বলতে কী, বাঙ্গালী সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করে।”

টরন্টোর বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের সঙ্গে নাথানিয়েলের সম্পর্ক অনেকদিনের। তিনি গত বছর বাংলাদেশেও গিয়েছিলেন পার্লামেন্টারিয়ানদের এক বিশ্ব সম্মেলনে যোগ দিতে। তিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত আইনজ্ঞ। অক্সফোর্ড এর ডিগ্রিধারী। সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি বিষয়ে তিনি লেখাপড়া করেছেন। তিনি নিশ্চই বানিয়ে বানিয়ে এ কথাগুলো বলেন নি।

আরথী থিরুথনিকান নামের এক তামিল লেখিকার একটি অনুদিত কলাম ছাপা হয়েছিল প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে। মূল কলামটি প্রকাশিত হয়েছিল কানাডার হাফিংটন পোস্ট এ। ঐ কলামে তিনি লিখেন, “আমার মনের মধ্যে একটি বিষয় গেথে গিয়েছিল যে, কানাডিয়ান হতে হলে আমাকে আমার তামিল পরিচয়, তামিল সংস্কৃতি, তামিল ঐতিহ্যকে ভুলে যেতে হবে। আমাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে তামিল পরিচয়ের সবকিছু। … এই সময় আমার মধ্যে একটি প্রশ্নও জাগরিত হয়। প্রশ্নটি হলো, আমি কেন শ্বেতাঙ্গিনী হয়ে জন্ম নিলাম না? … আমি মনে করতাম – তুমি যদি শ্বেতাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গিনী হও তার অর্থ হলো, তুমি কানাডিয়ান। তুমি সকলের চেয়ে সেরা। সমাজে তোমার আবস্থান অনেক উঁচুতে। সমাজে তোমার গুরুত্ব অনেক বেশী।”

আরথী আরো লিখেন, “তবে সৈভাগ্য এই যে, শেষ পর্যন্ত ‘শ্বেতাঙ্গ’ বিষয়ে আমার মোহ ভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। আমি যখন হাই স্কুলে উঠি তখন থেকে আমি আমার নিজ সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করি। আমি আমার ঐতিহ্যের মর্ম উপলব্দি করতে শুরু করি। … আমি উপলব্দি করতে পেরেছি যে, কানাডিয়ান হওয়ার অর্থ ‘শ্বেতাঙ্গিনী’ হওয়ার চেয়ে আরো অনেক বেশী কিছু। কানাডিয়ান হওয়ার অর্থ এই নয় যে, একজনকে শ্বেতাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গিনী হতে হবে। কানাডিয়ান হওয়ার অর্থ হলো তোমাকে দুয়ালু হতে হবে এবং একে অপরকে গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে। কানাডিয়া হওয়ার অর্থ হলো, তুমি নিজে যা তাই হওয়া। একজন তামিল তরুনী হিসাবে আমি যা, সেটিই আমার কানাডিয়ান পরিচয়।”

উল্ল্লেখ্য যে, ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষে গিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর ছলনার আশ্রয় নিয়ে অবৈধভাবে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল এবং পরবর্তী প্রায় দুই শ বছর শাসন ও শোষনের রাজত্ব কায়েম করেছিল তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে নেননি। প্রয়োজনে যতটুকু ভাষা জানার দরকার ছিল ঠিক ততটুকুই তারা শিখে নিয়েছিল। শুধু ভারতবর্ষ কেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই তারা একই কায়দায় রাজত্ব দখল করেছিল। কিন্তু নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে এক পা-ও সরে আসেননি। একই কর্ম করেছিল ফরাসীরাও। এই ইংরেজ আর ফরাসীরা যখন কানাডায় আসেন তখন তারাও কিন্তু নিজেদের এথনিক পরিচয়, ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি।

তাহলে কানাডায় কেন একশ্রেণীর বাঙ্গালী তাদের এথনিক পরিচয়, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য হীনমন্যতায় ভুগেন? বাঙ্গালীর পরিচয়, বাঙ্গালীর সংস্কৃতি, বাঙ্গালীর ভাষা বিশ্বসভায় কোন অংশে হীন? মানুষে মানুষে মিলনের বাণী তো বাঙ্গালীর সংস্কৃতির প্রধান সুর। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লিখেছেন, “উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাউল কবি লালন শাহের গানেও আমরা শুনি সেই একই সুর। সহজ-সরল প্রাণস্পর্শী ভাষায় লালনের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে তুলনাহীন এ চরণগুলো:-

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে

লালন বলে, জাতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।

যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী

লোকের কি হয় বিধান

বামুন কি হয় বিধান

বামুন চিনি পৈতেয় প্রমাণ, বামনী চিনি কিসে রে।”

বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে মানুষেরই জয়গান গাওয়া হয়েছে। কানাডার এই বহু-সাংস্কৃতিক সমাজেও সেই মানুষেরই জয়গান আমরা লক্ষ্য করি। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী আরো লিখেছেন, “ভিন্নতার উপর জোর নয়, সমন্বয়ের মাধ্যমে ঐক্যের সাধনাই বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির অন্যতম চরিত্র। এরই প্রতিফলন আমরা দেখি মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি চন্ডীদাসের অবিস্মরণীয় উচ্চারণে, বাঙালী গণমানুষকে সম্বোধন করে দৃপ্তকণ্ঠে যিনি বলেন :

শুন হ মানুষ ভাই

সবার উপরে মানুষ সত্য

তাহার উপরে নাই”

স্কারবরো সাউথওয়েস্ট রাইডিং থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশী কানাডিয়ান মেয়ে ডলি বেগম সম্প্রতি প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “কানাডীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি আমাদের যে নিজের একটা সংস্কৃতি আছে, যে সংস্কৃতি আমরা দেশ থেকে নিয়ে এসেছি সেটা যেন ভুল না যাই তাও দেখতে হবে। কারণ এটা আমাদের শিকড়।”

আমরা জানি কানাডা একটি একক সংস্কৃতির দেশ নয়। বহুজাতিক সংস্কৃতির দেশ এটি। এটি শুধু কথার কথা নয়। রাষ্ট্রিয়ভাবেই গত ৪৫ বছর ধরে এটি স্বীকৃত হয়ে আসছে কানাডায়। ১৯৭০ দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো উদ্যোগে রাষ্ট্রিয়ভাবে গৃহীত হয় এই পলিসি। বলা হয়ে থাকে যে, “Multiculturalism in Canada is the sense of an equal celebration of racial, religious and cultural backgrounds”। আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির মূলমন্ত্রও তাই। সে কারণে কানাডায় আমাদের নিজ সংস্কৃতি নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগার কোন কারণ আমরা দেখি না। তারপরও যারা হীনমন্যতায় ভুগেন তারা নাহিয়ান বা আরথী থিরুথনিকান কিংবা ডলি বেগম এর বক্তব্য থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন।

সবশেষে বলবো, খোদ কানাডিয়ান সরকারই এখানকার বিভিন্ন এথনিক কমিউনিটির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে যথেষ্ট মর্যাদার চোখে দেখে এবং অনুপ্রেরণা প্রদান করে। শুধু তাই নয়, পৃষ্ঠপোষকতাও করে থাকে। তবে কেন বাঙ্গালী হয়েও কানাডায় বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগবেন কেউ কেউ?

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ