প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৫২
অক্টোবর ১১, ২০১৮
দিনটি রবিবার ছিল। কিছুটা তাই ক্লান্ত, আনন্দিত এবং অবশ্যই উৎসুক। কারণ সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করি। একটি রবিবার প্রচুর কাজ জমে থাকে। এত কাজ যে মাঝে মধ্যে হাশ ফাস লাগে। কোনটা রেখে কোনটা করবো? সপ্তাহের রান্না করে রাখতে হয়। মোছামুছিতো রইলোই। সাকালের নাস্তা সেরে এক কাপ মিন্ট চা নিয়ে ক্যাবোল বসেছি, এরই মধ্যে ছোট ছেলে দোতলা থেকে নেমে এলো বেশ উদ্ভাসিত মুখে। আমার এই ছেলেটা কথা কম বলে। শুধু কম না। অনেক বেশী কম। মাঝে মধ্যে বেশ বিব্রত লাগে মানুষজনের সামনে। কেউ হয়ত ১০টি কথা বললো। সে একটি জবাব দিলো কি দিল না।
আজ হঠাৎ দেখলাম খুউব প্রগলভ। অনেক কথা বলছে। স্বভাব বিরুদ্ধ যখন, বুঝতে হবে হয় খুউব বেশী আনন্দিত অথবা “ডাল মে কুছ কালা হ্যায়”। তাই, শেষ পর্যন্ত অবশ্য ঝেড়ে কাশলো। বললো – “মামনি, আজ বিকালে ৩/৪ জন বন্ধু আসবে। একটু চা-নাস্তা করো।”
হু… তাহলে এই ব্যাপার?
আবার কাজ বাড়লো। চা নাস্তা মানে তো ডিনার-ই। কি আর করবো। কাজে নেমে পড়লাম। নিজেদের রান্না চটপট বানিয়ে বিকালের নাস্তার যোগার শুরু করলাম। সাংহাই চাউমিন বানাবো আর রেশমি কাবাব বানানোই থাকে ডিপ ফ্রিজে,ওগুলো ভেজে দিবো ঠিক করলাম।
বিকেলে দেখলাম ৪ জন আসলো। রবার্ট আর তার গায়নিজ গার্লফ্রেন্ড। রবার্ট ফ্রেঞ্চ কানাডিয়ান। প্রনোভেন শ্রীলংকান। আর একজন কারাম। সে টার্কিস। এরা সবাই আমার ছোট ছেলের ছোট্র বেলার বন্ধু। মজার ব্যাপার, কারাম বাদে বাকি দুজন আমার ছেলের মত একই প্রফেশেনে আছে। ওরা সবাই মেডিক্যাল মাইক্রো বাইয়োলজিস্ট। কারাম বেশী দূর পর্যন্ত পড়তে পারেনি ওদের পারিবারকি অসুবিধার কারনে। তাই গ্রেড টুয়েলভ শেষ করে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। খুব ভেঙ্গে পড়েছিল। তখন আমার হাসবেন্ডই বুদ্ধি দিয়েছিল ওকে অটোমোবাইল অথবা প্লাম্বার এর কোর্স করতে। কারাম শেষ পর্যন্ত প্লাম্বার-ই হয়েছে। এখন মাশাল্লাহ খুব ভালো অবস্থা। ডান্ডাস ওয়েস্টের উপর একটা দুই বেডরূমের ডুপ্লেক্স কন্ডো কিনেছে। আর এখন এত টাকা…।
আর এদেরতো ৮ বছর লেগেছে। আমাদের তো জান শেষ। ৮ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো যে কতটা হ্যাপা, সেটা বলে বোঝানো যাবে না।
যাক সবাই এক চান্সে পাশ করেছে। আর কপালগুণে সবাই কাঙ্খিত জবও পেয়ে গেছে। ৬ মাস হলো এরা “লাইফ ল্যাব” এ জব করছে। খুব ঘোরাঘোরিও করছে। টাকা পয়সা র্যান্ডোম খরচা করছে।
তো একদিন আমার হাসবেন্ড বললো –
: টাকা পয়সা এত না উড়িয়ে বরং একটা বাড়িটাড়ি কিছু দ্যাখ।
: কি যে বল বাপী। এত টাকা পাব কই? ডাউনপেমেন্টের টাকা তো ভালই লাগবে। ওটা পাবো কোথায়?
: সে একটা ম্যানেজ করা যাবে।
: ম্যানেজ বললেই তো হবে না। এখন আবার দেখেছো কত রকম আইন করছে বাড়ি কেনার ব্যাপারে?
: হু সেটা জানি। কিন্তু সেটা তোর উপর খুব একটা বর্তাবে না। কারণ তোর সেলারী ভাল। যাদের ইনকাম কম তাদের মিনিমাম ২০% ডাউনপেমেন্ট দেওয়া লাগবে। তোর ৫% দিলেই হবে মনে হয়।
: কিন্তু ঐ ৫% তো কম না। আমি মাত্র ৪/৫ মাস হলো জব করছি। অত্তগুলো ডলার কই পাবো?
: আচ্ছা সেটা দেখা যাবে। আমি ম্যানেজ করে দিবো।
আমি তাদের কথপোকথন শুনছিলাম। বাপ-বেটা যখন কথা বলে আমি কখনো তাদের মধ্যে কথা বলি না। বিশেষ করে অর্থকড়ি বিষয়ক আলোচনা। বিষয়টা আমি তেমন বুঝি না। বুঝতেও চাই না ।
এটুকু বুঝতে পারছিলাম, ছেলে যে র্যান্ডম খরচা করছে সেটাই আমার হাজবেন্ড কায়দা করে বাধা প্রদান করছে।
যাই হোক, বিকাল বেলায় দেখলাম রবার্ট আর তার গার্লফ্রেন্ড ডায়ান চলে এলো ৫টার মধ্যেই। তার পনের মিনিটের মধ্যেই প্রানোভেন আর কারাম চলে এলো। আমার সঙ্গে অনেক্ষন গল্প করলো। তারপর ওরা সব দোতালার লিভিংরূমে চলে গেলো। ওপর থেকে তাদের হা হা, হো হো এর আওয়াজ ভেসে আসছিল। আমার বাড়িতে এই সব শব্দরা যখন ঘুরপাক খায় আমি খুব খুশী হই। মনে হয় আমার ভেতরে নতুন করে জীবন প্রাপ্তি হয়। আমি ইদানিং শূন্যতা বড় ভয় পাই।
ওরা কন্ডো কিনবে। শুনলাম এজাক্সের মেইন ইন্টারসেকশনে কন্ডো বানানোর বিশাল একটা প্রস্তুতি চলছে। এটা হারউডস এবং বেলী স্ট্রিট এর ইন্টারসেকশনে। এখান থেকে হাটা পথ ‘গো-স্টেশন’। এক মিনিটের ড্রাইভ এজাক্স হাসপাতাল। এবং কন্ডোর মুখমুখি পাবলিক লাইব্রেরী। এজাক্সের লেক-বীচ দু-মিটিটের ড্রাইভ। আসেপাশে ৩/৪টা আউটলেট মল। আমিও মনে মনে নেচে উঠলাম এখানে একটা কন্ডো কিনলে মন্দ হয় না। আর এই বিশাল কন্ডো পরিক্রমা যেখানে চলছে তার সামনেই এজাক্সের বিশাল ‘বৃদ্ধাশ্রম’। বুড়ো হলে আর যখন নিজেকে চালাতে পারবো না, তখন কন্ডো বিক্রি করে সোজা বৃদ্ধাশ্রমে। হা হা, মন্দ না আইডিয়াটা। নিজেই নিজেকে পিঠচাপ দিলাম। (চলবে)
রীনা গুলশান, টরন্টো
gulshanararina@gmail.com