প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৫১

সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮

রীনা গুলশান

৯ই জেলহজ্জ্ব সূর্য অস্তমিত হবার বেশ আগে থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে আরাফার ময়দানে আসতে শুরু করলো। মানুষের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছিল। এরপর যারা যারা জোড়ে গেছে অর্থাৎ স্বামী স্ত্রী সহ, অস্তমিত সূর্য্যরে দিকে তাকিয়ে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা এবং যার যার হৃদয়ের প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে পেশ করছিল। কিন্তু আরাফায় জোহর এবং আছরের নামাজ একত্রে পড়তে হবে।

আরাফার ময়দানে মাগরীর এর নামাজ পড়া যাবে না। মুজদালাফায় গিয়ে একেবারে মাগরীব এবং এশার নামাজ পড়তে হবে। একসময় আমরাও আরাফার ময়দান কে বিদায় জানালাম এবং মুজদালাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। মুজদালাফা নিয়ে প্রচুর কথা শুনেছি। কত কি ভেবেছি। পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল বিস্তির্ন খোলা ময়দান। নীচে জমিন, উপরে খোলা আসমান। সবাই যার যার মত জায়গা দখল করে, বিছানা (চাদর, চাটাই, যে যা কিছু নিয়ে গেছে) পেতে শুয়ে পড়েছে। আমাদের কোম্পানী থেকে খুব স্ন্দুর ংষববঢ়রহম নবফ দিল। সবাই মাগরিব এবং এশার নামাজ আদায় করে, যার যার মত দোয়া দরুদ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মজার ব্যাপার ঐ রাতে, ঐ খোলা আকাশের নীচে প্রগাঢ় ঘুম হলো। আবার খুব ভোরে ফজরের আগেই আমরা রওনা দিলাম মিনার উদ্দেশে। মিনায় পৌছে ফজরের নামাজ পড়ে আমরা ব্রেকফাস্ট করলাম। তারপর ১১টার দিকে বড় জামারার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এটা অত্যন্ত আনন্দের এক পথযাত্রা। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ মিছিল করে যার যার দেশের এবং যার যার কোম্পানির পতাকা নিয়ে জামারাকে (বড় শয়তান) প্রস্তর ছুড়তে রওনা দিয়েছে। ওখানে তিনটি জামারা (শয়তান) আছে। বড় শয়তান। মেঝ শয়তান এবং ছোট শয়তান। পর পর তিনদিন এদেরকে ৭টি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। প্রতিদিন ২১টি। এই কঙ্কর আরাফা অথবা মুজদালাফায় গিয়ে সংগ্রহ করতে হবে। এক একটি কঙ্কর চিপিকের সাইজ হবে।

১০ই জেলহজ্জ্ব মুজদালাফা থেকে সূর্য উদয়ের সামান্য কিছু পূর্বে মিনার উদ্দেশে রওনা হতে হবে। মিনায় ফজরের নামাজ পড়ে, মিনা থেকে রওনা করে দ্বিপ্রহরের পূর্বে জোমরাতুল আকাবায় (বড় শয়তান) পৌঁছে, ঠিক জোহরের আজানের পরই ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। এরপর তালবিয়া পড়ার দরকার নাই।

মিনায় ফিরে কোরবানী দিতে হবে। পুরুষদের মাথা মুন্ডন এবং মহিলাদের চুল ছাটতে হবে (দেড় ইঞ্চির মত)।

এরপর মিনা থেকে, মসজিদুল হারেমে রওনা করতে হবে। হজ্জের তওয়াফ এবং সাহী করবার উদ্দেশে। যেহেতু এটা হজ্জ্বের তাওয়াফ এবং সাহী তাই প্রচন্ড ভীড় হয়। আমরা তাই রাত ১১টার পর করেছিলাম। তাওয়াফ এবং সাহী করে একেবারে ফজরের নামাজ পড়ে পুনরায় মিনায় চলে এসেছি।

১১ই এবং ১২ই জেলহজ্জ্ব মিনায় অবস্থান করে জোহরের নামাজের পর ছোট শয়তানকে ৭টি, মেঝ শয়তানকে ৭টি তারপর বড় শয়তানকে ৭টি কঙ্কর মারতে হবে। ১২ তারিখেও একইভাবে শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে।

১২ তারিখে সূর্যান্তের আগেই মক্কায় ফিরে আসলে হজ্জ্ব সম্পাদন হয়ে যাবে। যদি সূর্যাস্তের আগে ফিরতে না পারেন, তবে আরেকবার ঐ রাত মিনায় অবস্থান করতে হবে।

এরপর আপনাকে মক্কায় ফিরে এসে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে। বিদায়ি তাওয়াফ করে আর মক্কাতে অবস্থান করা যাবে না। সরাসরি জেদ্দা চলে আসতে হবে। অনেকে আবার বিদায়ী তাওয়াফ করার পর মদিনাতে যায়। সেখানে ৮/১০দিন অবস্থান করে। হুজুর (সাঃ) এর রওজা শরীফ জেয়ারত করেন এবং ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন।

মনে রাখবেন সুখ্যাতির আশায় বা রোজগারের পথ সহজসাধ্য করার জন্য হজ্জ্ব করলে শরীয়তের হজ্জ্ব আদায় হয়ত হবে। তবে তরীকতের হজ্জ্ব আদায় হবে না। হজ্জ্বের মূল উদ্দেশ্য ‘আমিত্ব’ বর্জন করা। সেটা আমরা কয়জন করতে পারি? হজ্জ্ব করার সময় যদি; দ্বারা পরিবার এবং টাকা পয়সার চিন্তায় আপনি নিমজ্জিত থাকেন, সে হজ্জ্ব কতটুকু আল্লাহ পাক গ্রহন করবেন আমি জানিনা।

এখন আর একটি ফ্যাশন হয়েছে :- হজ্জ্বের প্রতিটি পদক্ষেপে সেলফি তুলছে আর ফেসবুকে আপলোড দিচ্ছে। এ কেমন হজ্জ্ব? যেখানে তোয়াফ করা কালিন ক্বাবা শরীফের দিকে দেখাই নিষেধ, সেখানে দেখলাম জনগণ সেদিকে তাকিয়ে, সেলফি স্টিক দিয়ে একটির পর একটি ছবি তুলে যাচ্ছে।

আমি ২০১৭ তে হজ্জ্ব করলাম। তখন থেকে লিখে চলেছি। ২০১৮ এর হজ্জ্ব কদিন আগে শেষ হলো।

আমার এই কলাম শুরুতেই বলে নিয়েছিলাম, আমি হজ্জ্ব শিখানোর জন্য লিখিনি। যার জন্য মিলা থেকে বিদায়ী তাওয়াফ আমি দ্রুত লিখেছি। কারণ, হজ্জ্ব শেখানোর মত বিদূষী আমি নই। আমি হজ্জ্ব বিষারদ বা মাওলানা, মুফতি বা হাফেজ নই। প্রকৃত হজ্জ্বের ঐ ৫ দিন আপনি যা যা করবেন, আপনাকে বই পড়ে অথবা অনলাইনে বার বার দেখে আত্মস্থ করে যেতে হবে। ওটা আপনাকেই প্রকৃতভাবে হৃদয়ঙ্গম করে যেতে হবে। আর একটা ব্যাপারও বলে দেই, হজ্জ্ব কেও কাওকে শেখাতে পারে না। আপনাকেই বার বার অনলাইনে অথবা বই পড়ে আত্মস্থ করতে হবে। এবং হজ্জ্বের ঐ ৪/৫ দিন আপনাকে শতভাগ মনোযোগি হতে হবে। দুনিয়ার কোন কিছুতেই মনোনিবেশ করবেন না।

আর একটা কথা বলে নেই, তওয়াফ আপনি যতবার পারবেন করবেন। অন্যেরা কি করছে বা কি পড়ছে সেটা আপনার জানার দরকার নাই। আপনি যেটা আত্মস্থ করে যাবেন, পূর্ণাঙ্গ ভাবে অর্থ জেনে সেটাই পড়তে থাকবেন। যা আপনার কাছে খুবই সহজ মনে হবে।

মনে রাখবেন দরূদে ইব্রাহীম এর উপর আর কিছু নাই, হারেম শরীফে। ওটা বার বার পড়বেন। আসতাগ ফার। এবং আল্ল্লাহর প্রশংসা। অর্থাৎ –

“সুবহানাল্ল্লাহে ওয়াল হামদুলিল্ল্লাহে ওয়ালা ইলাহা

ইল্ল্লাহু ওয়াল্ল্ল্লাহু আকবর।”

এর উপর আর কোন দোয়া নাই। সব কিছু বলে ফেলছেন এই একটি ছোট্ট দোয়ায়।

পরিশেষে আবারো আমার পাঠকদের কাছে বিনয়ের সাথে বলছি, আমি কোন মৌলানা নই। তাই আমি কিছু শিখানোর চেষ্টা করিনি। আমি আমার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছি মাত্র। এবং হজ্জ্বে যাবার পূর্বে যে মানসিক টানাপোড়েন চলে তার কিছুটা নির্বান করবার প্রয়াস করেছি। যদি কারো কিছু কম মনে হয় ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। (শেষ)

রীনা গুলশান, টরন্টো