প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৫০

আগস্ট ৪, ২০১৮

(সম্মানিত পাঠক মহদোয়গণ, জনপ্রিয় কবি ও লেখক রীনা গুলশান প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের প্রায় জন্ম লগ্ন থেকেই ‘প্রবাসে পরহিতকর্ম’ নামে একটি কলাম লিখে আসছেন। চলতি সংখ্যায় তার কলামের পঞ্চাশ পর্ব পূর্তি হলো। অর্থাৎ বিগত পঞ্চাশ মাস ধরেই তিনি বিরতিহীনভাবে তার জনপ্রিয় কলামটি লিখে আসছেন। এমনকি এক দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হয়ে বিগত ৬ মাস ধরে প্রায় শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায়ও তিনি তার কলাম বন্ধ করেননি। তার এই অক্লান্ত প্ররিশ্রম, প্রবাসী কণ্ঠ ও এর পাঠকের প্রতি তার অপরিমেয় ভালবাসার কথা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। আমরা প্রবাসী কণ্ঠ পরিবারের পক্ষ থেকে রীনা গুলশানকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং তার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি । – সম্পাদক)

 রীনা গুলশান

জীবনের প্রথমবারের মত ওমরাহ সমাপন হলো। ইনশাল্লাহ্ বেশ ভালো ভাবেই হয়ে গেল।

এবারে হজ্জের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে ৭ই জিলহজ্জ থেকে। অতএব এর মধ্যে যদি আপনার হাতে আরো কয়েকদিন সময় থাকে তবে আপনি আরাম করে ৫ ওয়াক্ত ফরজ এবং তাহাজ্জুদ এর নামাজ হারেম শরীফ এ যেয়ে পড়–ন। এবং আপনার শরীরে যদি কোন অসুবিধা না থাকে, তবে প্রতি নামাজের পরই একবার তাওয়াফ করতে পারেন। যদিও আমি নিজে এত বার করতে পারিনি। আমি রাতে করতাম।

তবে অনেকে বাবা, মায়ের নামে আলাদা করে ওমরাহ করতে চায়। আমি আমার আব্বার নামে করতে চেয়েছিলাম। তবে আমাদের টিম লীডার মানা করলেন। জীবনের প্রথমবার আপনার নিজের হজ্জের সময় নাকি এটা না করাই উত্তম। পরে আমি নিজেও এটা অনলাইনে দেখেছি। আপনারাও এ ব্যাপারে সিওর হয়ে নিতে পারেন। আমাদের গ্র“পের তাই কেউই করেনি। তবে আপনি এভাবে করতে পারেন। আপনি যখন রোজ তাওয়াফ করবেন, তখন যে কোন একটা তাওয়াফ, আপনি নিয়তের সময় এটা বলবেন – “হে আল্ল্লাহ, আমি তোমার নামে কাবা শরীফ কে তাওয়াফ করছি। হে আল্ল্লাহ তুমি আমার জন্য তা সহজ  কর এবং কবুল করো। তারপর আবার বলবেন, “হে আল্ল্লাহ, আমি আমার এই তওয়াফ আমার আব্বা/আম্মা উনাদের নামে করতে চাই। তুমি যদি এর কোন পূণ্য হয়, আমার আব্বা/আম্মাকে পৌঁছে দাও।

অনেকে এক দিনে/রাতে ৬/৭টা করেও তাওয়াফ করেছে। খুবই ভালো, আপনি যদি তা পারেন।

এরপর ৭ই জিলহজ্জ থেকে হজ্জের সত্যিকারের প্রস্তুতি শুরু হলো। আমাদের হোটেল থেকে মিনার কাছেই (২০/৩০ মিনিটের রাস্তা) একটি জায়গা ‘বাত্ত্বাকুরাইশ’ ওখানে নিয়ে গেল। ওখানকার সরকারী ‘রেস্টহাউজ। খুব বিশাল, তিনতলা, আবার বেজমেন্ট কিচেন ও ডাইনিং হল। ওখানে আমাদের কনফারেন্স হতো। এক এক ফ্লোরে ১০টি করে কক্ষ এবং এটাচড্ বাথ। খুবই সুন্দর। আমাদের প্যাকেজ এটা করলো এই কারণে যে ৭ তারিখে মক্কা থেকে এত বাস এবং গাড়ি মিনার দিকে যায় যে, মাঝে মাঝে ৩/৪ ঘন্টার জন্য সব জ্যামে আটকা পড়ে যায়। আমাদের ৭ তারিখে সকালে ব্রেকফাস্ট এর পরই নিয়ে গেল। আগেই আমাদের বড় একটা সুটকেস মদিনা থেকেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওখানে আধা ঘন্টার মধ্যেই চলে গেলাম। এত্ত ভালো লাগছিল ওখানে যেয়ে। অসম্ভব সুন্দর এরিয়াটা। এটা মক্কার মধ্যেই এবং মিনার খুব কাছে। এখানে যেয়ে এতদিনের মধ্যে খুব হোমলি লাগছিল। অনেক বড় বড় রুম। আমাদের ৫ বাংলাদেশী মহিলাকে একটি রুমে দিল। অনেক দিন পর খুব ভাল লাগছিল। তারপর যার যত ময়লা কাপড় ছিল, এখানে সবার কাপড় নিয়ে কেঁচে ধুয়ে আয়রন করে দিয়ে গেল। সব থেকে মজার হলো, মনে হলো অনেক দিন পর ঘরের খাবার খাচ্ছি। কানাডা থেকে একজন খুব বড় শেফ, সেলিম ভাইকে নিয়ে গিয়েছিল। উনি আফগানি। অসম্ভব সুন্দর রান্না করে। বাংলাদেশী না হলেও পাঞ্জাবী, সাউথ ইন্ডিয়ান, আফগানী এবং মোগলাই ডিস রান্না করতেন। প্রতি বেলায় ৭/৮ পদের খাবার এবং ২/৩ রকমের ডেজার্ট। উনার মশলা চা এর স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে আছে। অসম্ভব সুন্দর চা বানায় সেলিম ভাই। উনার দুজন সহকারীও ছিল।

আমরা সবাই ৭ তারিখে সুন্দর করে গোসল করে ফেললাম। কাপড় ধুয়ে সব গুছিয়ে একটা সুটকেসে তালা মেরে রেখে দিলাম। শুধু ‘মিনায়’ যাবার জন্য ছোট একটা ব্যাক প্যাক রেডি করলাম। সাব্বির ভাই বারবার বলে দিয়েছিল, ব্যাগ যেন বড় না হয়। বলেছিল, এখান থেকে সবই নিতে পারবেন, কারণ বড় বাসে যাবেন। কিন্তু মিনায় রাখার জায়গা পাবেন না। আমি আল ফালাহ’র ব্যাক প্যাকেই একটা কাপড় পরা আর ২টা কাপড় নিয়েছিলাম। আর ছোট্ট একটা ঔষধের প্যাকে সব ঔষধ একসঙ্গে নিলাম। শুধু এই ৫ দিনের জন্য। মাথায় হেজাব আর জায়নামাজ। আর ভেতরে নিলাম আর একটা ছোট ব্যাক প্যাক। যাতে ২/৩টা মাত্র পানির বা ইলেক্টর বোতল ধরবে। ¯েপ্র বটল। খুবই আবশ্যক। এটা আমি কানাডা থেকেই ডলার স্টোর থেকে কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম।

৮ ই জিলহজ্জ মিনাতে রওনা করতে হবে। ফজরের নামাজ পড়ে। কারণ নিয়ম হলো, মিনায় গিয়ে ৫ ওয়াক্ত নাজাম-অর্থাৎ জোহর, আছর, মাগরীব এশা এবং পরদিনের ফজরের নামাজ আদায় করা। কেউ ফজরের আগেই, কেউবা পরে সবাই আমরা গোসল করলাম এবার একদম হজ্জের নিয়তে। নামাজ পড়ে, সাকালের ব্রেকফাস্টের পর আমাদের মূল লিডার বয়ান করলেন হজ্জের নিয়ামাবলী। উনি প্রতিদিন নিয়ম করে দুইবার বয়ান করতেন নিয়ম কানুন। আজ যদিও ব্রেকফাস্টে সেলিম ভাই চমৎকার সব ডিস করে ছিলেন কিন্তু আমরা খেতে পারছিলাম না। এত বেশী একসাইটেড ছিলাম যে, এমনকি কোন কিছুতে মনোসংযোগও করতে পারছিলাম না। যাইহোক পরুষরা সব গোসল করে এহরাম পরিধান করলো। এবং এরপর আমরা হজ্জের নিয়তে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করলাম।

এরপর আমরা সবাই বিসমিল্ল্লাহ পড়ে রওনা দিলাম। পথে যেতে যেতে সবাই আমরা কোরাসে তালবিয়া পড়ছিলাম – ‘লাব্বায়েক…আল্লাহহুমা লাব্বায়েক…।’

দূর থেকে মিনার ছোট বড় তাবু চুড়ো দেখতে পাচ্ছিলাম। কাছে আসতে দেখলাম মিনার আসল রূপ। হাজার হাজার লাখ লাখ তাবু-সাদা রঙের। বেশীর ভাগ নীচের লেভেলে। বেশ কিছু পাহাড়ের উপর। এই সেই মিনা! আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল সেই বাস্তব ইতিহাস স্মরণ করে। যেখানে আল্ল্লাহ পাকের আদেশে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নিজের পুত্র তার কলিজার টুকরা হযরত ইসমাইল (আঃ) কে কোরবানী দেবার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ। এনারা যে আমাদের প্রফেট ছিলেন, তা তাদের জীবদ্দশায় প্রতিটি কর্মকান্ডে প্রমাণ দিয়েছেন। আমরা হলে কি করতাম? একবার ভাবুন।

যাইহোক মিনার পাদদেশে বাস আমাদের নামিয়ে দিল। টিম লীডার, মূল সাব্বির ভাই আগেই এসে সব ঠিক ঠাক করছিলেন। এবার ছোট ছোট গ্র“প লিডাররা ‘আলফালাহ্’ ফ্লাগ নিয়ে মিছিলের মত মিনার ভেতরে প্রবেশ করলো আমাদের নিয়ে। আমারতো মাথা খারাপ হয়ে যাবার দশা। হায় আল্ল্লাহ, কি বিশাল বিস্তির্ন পরিসর। নির্ঘাত হারিয়ে যাবো। সব তাবু কপড়ের ছিল। আমাদের তাবু ছিল অবশ্য ‘ড্রাইওয়ালের’। এবং আমাদের তাবুতে এসি ছিল। এই এসিটা না থাকলে আমাদের কানাডিয়ানদের জন্য আসলেই মারাত্মক কষ্টকর হতো। এরপর আমরা দুপুরে নামাজ আদায় করলাম। এরমধ্যেই সেলিম ভায়ের গ্র“প আমাদের জন্য মধ্যাহ্ন ভোজ পাঠিয়ে দিল। সাথে আমের সুগন্ধযুক্ত ইলেক্ট্রা। মহিলাদের একটি কক্ষ (তিনটি দরজা)। একটি বিশাল কক্ষের মধ্যে তিনটি ভাগ করা। প্রতি আইলের মধ্যে এক হাতেরও কম জায়গা। এবং সব ফোল্ডার করা বিছানা। প্রতিটি বিছানা সোয়া হাত হতে পারে। আর কোন জায়গা নাই। এবার বুঝতে পারছেন নিশ্চই কেন সাব্বির ভাই বারবার বলছিল, ছোট্ট ব্যাগ নিতে হবে। যার যার বিছানার ফোল্ডার খোলার সাথে সাথেই দেখলাম, সৌদি সরকারের পাঠানো ‘গিফট’। একটি করে ব্যাগ (খুব সুন্দর ব্যাক প্যাকের মত রয়েল ব্লু রঙের) তার মধ্যে একটি জায়নামাজ, তসবি, একটি খোরমার প্যাকেট এবং একটি করে হজ্জের বই)। জায়নামাজটা সূতীর সাদা রঙের। ওতেই আছর, মাগরিব পড়লাম। এরপর সাব্বির ভায়ের নিয়মাবলীর বয়ান শুরু  হলো। আগামীকাল মূল কার্যাবলী শুরু হবে। এবার প্রচন্ড মনোযোগ দিয়ে বয়ান শুনলাম। আগামীকাল ফজরের নামাজের পরই আমাদের নিয়ে রওনা হবে আরাফায়। ফজরের নামাজের পড়েই সবাই রেডি হয়ে গেলাম। ৯ জিলহজ্জ মধ্যাহ্নের পূর্বেই আরাফাতে হাজির হতে হবে। এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে আমাদের অবস্থান করতে হবে। সবাই একসাথে রওনা দিলাম। মুখে ছিল তালবিয়া।

আরাফাতে এলাম মধ্যাহ্নের মধ্যে। পিঠের উপর ছোট একটা ব্যাকপ্যাক নিবেন। ১টা পানি, ১টা তসবী বা কাউন্টার নিতে পারেন। খুবই সুন্দর জায়গাটি। একদম সাজানো বাগান। এখানেও হাজার হাজার তাবু। আমরা যথারীতি ড্রাইওয়ালের তাবু পেলাম এসি সহ। একপাশে মহিলা এবং অন্যপাশে

পুরুষ। এরপর আমাদেরকে বলা হলো দোয়া দরুদ, কোরআন তেলওয়াত করতে। এখানে যোহরের নামাজ এবং আছরের নামাজ একসাথে পড়তে হবে।

আরাফাতে দুনিয়ার কথা না বলাই উত্তম। ওখানে প্রবেশ করতে হবে লাব্বায়েক পড়তে পড়তে। এরপর নিয়ম করে, তিনবার লাব্বায়েক পুরোটা পড়বেন। তিনবার ‘আল্ল্লাহু আকবর, আল্ল্লাহু  আকবর, আল্ল্লাহু আকবর অলিল্লাহিল হামদ’।

এরপর পড়বেন এই দোয়াটি ১০০ বার। (এ জন্য তসবি বা কাউন্টার খুবই জরুরী। )

‘লা ইলাহা ইল্লাল্ল্ল্লাহু অহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলক, ওয়ালাহুল হামদ, ইহয়ী ওয়া ইউমিতো বেইয়াদেহীল খায়রো, ওয়া হুয়া আলা কুল্লে শাইয়ীন কাদীর।’

উপরে উল্ল্লেখিত দোয়াটি হজ্জের সমস্ত সময়টা পড়তে থাকবেন। কারণ দোয়া বা কলমার মধ্যে আপনি সবই আল্লাহ পাককে বলে দিচ্ছেন। অর্থাৎ ‘আল্ল্লাহ ব্যতিত উপসনার যোগ্য অন্য কেহ নাই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নাই। তাঁরই রাজত্ব, তাঁরই প্রশংসা। তিনি জীবন দেন, আর দেন মৃত্যু। তিনি চিরজীবিত, অক্ষয়, তাঁরই আয়ত্বাধীনে কল্যান, তিনি প্রত্যেক বিষয়ে ক্ষমতাবান।’

এরপর আপনার টিম লিডার আপনাকে সম্ভবত ১টি পেপার দিবে, ওখানে আবশ্যকীয় কি কি দোয়া পড়তে হবে তা লেখা থাকবে। সেগুলো একে একে পড়তে থাকবেন। দুনিয়ার কথা একদমই না বলার চেষ্টা করবেন। এরপর সৌদী সরকারের প্রেরিত দুপুরের খাবার এবং ড্রাম ড্রাম অরেঞ্জ এবং আমের ইলেক্ট্রা চলে আসবে। তবে আমাদের কোম্পানী আমাদেরকে নিজস্ব খাবারও পরিবেশন করেছিল। খুবই সুন্দর খাবার।

জামাতের সঙ্গে আমরা জোহর এবং আছরের নামাজ পড়লাম। এরপর সাব্বির ভাইয়ের স্পেশাল দোয়া শুরু হলো। যাকে বলে আল্ল্লাহর কাছে কান্না। উনার মোনাজাতে এমন কোন মানুষ নাই যে হাউ হাউ করে কাঁদছিলো না। জীবনের সমস্ত ভুল ক্রুটি গুলো যেন চোখের উপর চলে আসে। আপনি কাঁদতে থাকবেন। এবং কাঁদুন। আল্ল্লাহর কাছে কাঁদুন। যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন তার কাছে হৃদয়ের কথা উজাড় করে বলেন। এবং ক্ষমা প্রার্থনা করুন। (চলবে)

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com