প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৪৯

জুলাই ৬, ২০১৮

রীনা গুলশান

আমাদের প্রথমেই মনে রাখতে হবে ওমরাহ্ এর ফরজ দুইটি – ১. এহরাম বাঁধা; ২. তওয়াফ। এবং ওয়াজেব দুইটি – ১. সায়ী এবং ২. মাথা মুন্ডন। পুরুষদের জন্য এবং মহিলাদের জন্য চুল ছাঁটা। আপনার চুলের অগ্রভাগ, আপনার আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে পুরোপুরি ঘুরাবেন, এতে যতটা চুল আসে, ততোটা চুল কাটতে হবে। দেড় থেকে দুই ইঞ্চির মত কাটতে হবে।

তাওয়াফ এর নিয়ত করার পর, এটা মূলত: শুরু হবে হযরে আসওয়াদ থেকে। এবং শেষও করতে হবে ইযকে আসওয়াদে। পবিত্র কাবাঘর সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়ফ করা বলে। তাওয়াফের মূল মর্ম্ম হচ্ছে, কাবা গৃহকে সাক্ষ রেখে, আল্ল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। নিজের কৃত অপরাধের কথা বারবার স্মরণ পূর্বক আল্ল্লাহর কাছে কাঁদবেন। অঝোরে কাঁদবেন। কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চাইবেন। আল্ল্লাহ রাব্বুল আলামীন দয়াশীল। অবশ্যই ক্ষমা করবেন।

তাওয়াফ চলাকালীন কথাবার্তা বলবেন না। এবং সবচেয়ে বড় কথা, হযরে আসওয়াদ এ পুরনরায় প্রদক্ষিণ করে না আসা পর্যন্ত, কাবা ঘরের দিকে তাকাবেন না। প্রদক্ষিণ (প্রতিবার) করে, হযরে আসওয়াদের সামনে আসুন, যদি আপনি সুযোগ পান, তো চুম্বন করুন (এটা চুম্বন করা সুন্নত, ওয়াজের নয়।) না পারলে দূর থেকে (ওখানে দাঁড়িয়েই) আপনার দু’হাত কাঁধ পর্যন্ত হাত তুলে বলুন – “বিসমিল্ল্লাহ আল্লাহু আকবর; ওয়ালিল্ল্লাহিল হামদ।” অর্থাৎ “আল্ল্লাহর নামে আরম্ভ করিলাম, আল্ল্লাহ মহান, তাহার জন্য সমস্ত প্রশংসা।” এটা বলতে বলতে হাত নামিয়ে ফেলুন। প্রতি তাওয়াফের শুরুতে এবং শেষে হজরে আসওয়াদে চুম্বন দিতে হবে।

অতঃপর রোকনে ইয়ামানীর কাছে আসতে আসমে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। এবং এই দোয়াটি পড়–ন। “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাছানাতাওঁ, ওয়াফিল আখেরাতে হাছানাতাওঁ ওয়াকেনা আজাবান্নার। ওয়া আদখিলনাল জান্নাত মা’য়াল আবরার। ইয়া আযিযু, ইয়া গাফফারু, ইয়া রাব্বাল আলামীন” অর্থাৎ “ হে আমার প্রতিপালক। আমাদের কল্যান দাও দুনিয়াতে ও আখেরাতে। এবং বাচাও দোজখের আজাব থেকে। দাখিল কর আমাদেরকে বেহেস্তে নেককারদের সাথে, হে শক্তিমান, হে মার্জনাকারী, হে সর্ব জগতের প্রতিপালক।” প্রতিবার রোকনে ইয়ামানীতে আপনার এই দোয়াটি পড়তে হবে।

আমি এই হজ্জের বর্ণনায় একটা কথা বারবার বলছি যে, আমি হজ্জ শিখাচ্ছি না। আমি আমার অভিজ্ঞতাটাই বর্ণনা করছি। তাই নিজ চোখে যা দেখা, তাই-ই বর্ণনা করছি। ওখানে যেয়ে অনেকে পাগলের মত আচরণ শুরু করেন। তারা পবিত্র কাবা ঘরে যেয়ে আসল কথাটাই ভুলে যান। ওটা আল্ল্লাহর একটা ঘর মাত্র। কিন্তু, আপনি শুধুমাত্র আল্ল্লাহ-কেই মন, প্রাণ নিবেদন করে ডাকছেন। কাবাঘর শুধু সাক্ষিমাত্র। কিন্তু, অনেককে দেখেছি কাবা ঘরকে উল্টো অমর্যাদা করে ফেলেন। কাবা ঘরের গিলাফ ধরে ঝুলে থাকেন। ওটা ধরে প্রচুর কান্না কাটি করেন। গিলাফের কাপড়ের টুকরা নেবার জন্য প্রচুর পগলামী করেন। অনেকে ঘন্টার পর ঘন্টা গিলাফ ধরে ঝুলে থাকেন। হয়তোবা তাওয়াফের কথাটাই তারা ভুলে যান। হযরে আসওয়াদের কথা আর কি বলবো? ওখানে একটা চুম্বন দেবার প্রচুর চেষ্টা করলাম। ধারে কাছেও যেতে দেয় না মানুষ। মাসাসে ইব্রাহীম এর কাছে একবার পৌঁছাতে পেরেছিলাম। (তাও মধ্য রাতে গিয়েছিলাম।) হাত দিয়ে ছুঁয়ে, ভেতরটা একবার দেখবার বাসনায়। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পদচিহ্ন স্বচক্ষে দেখেছি। খুবই রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছিল।

মুলতাজিমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করবার খুবই বাসনা ছিল। মুলতাজিম হলো, হযরে আসওয়াদ ও কাবাঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থানটুকু। এখানে দোয়া কবুল হয়। কাবা শরীফের ইমামসাহেব মুলতাজিমের পাশে কাবাকে সামনে রেখে নামাজ পরিচালনা করেন।

তাওয়াফে আপনি যা যা দোয়া পড়বেন, খুব ভাল হয় যদি আপনি নিজের মত করে একটা কাগজে তা লিখে নিয়ে যান। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে। তাওয়াফ হলো ‘আসতাগফার’ আর ‘দরুদ’ এর উত্তম স্থান। খুব বেশী বেশী করে আসতাগফার পড়বেন। আর যতরকম ‘দরুদ শরীফ’ জানা আছে তা পড়বেন।

তাওয়াফ শেষে যেখানে দিয়ে শুরু করেছিলেন, সেখানেই শেষ করবেন। অতঃপর তাওয়াফের বাউন্ডারী দিয়ে বের হয়ে ‘মাকামে ইব্রাহীম’ এর পেছনে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হবে। এই নামাজ ওয়াজিব। ওখানে একটু ধাক্কা-ধাক্কি হলেও একদম প্রথম সারিতে না পড়ে, দরকার হলে একটু পেছনের সারিতে নামাজটা আদায় করুন। আর মুলতাজিমে যদি নামাজ পড়তে চান, তাহলে উত্তম স্থান হলো দোতালা। একতলায় এটা প্রায় অসম্ভব। আমি তাই চেষ্টাও করিনি।

এরপর ‘হাতিমে’ও দুই রাকাত নামাজ পড়বার জন্য মানুষ খুবই ব্যাকুল হয়। আমি পড়তে পারিনি। তবে পুরুষদের পক্ষে সম্ভব। হাতিম অথবা মীজাবে রহমতের নিচে নামাজ পড়লে এবং দোয়া করলে সেই দোয়া কবুল হয়।

আপনার তাওয়াফ শেষ হলে মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে দুই রাকাত নামাজ পড়ে, অতঃপর ‘জমজম’ এর পানি পান করতে হবে। এই পানি পান করার সময়ও দোয়া করবেন খাশ দিলে। ইনশাল্ল্লাহ আপনার দোয়া কবুল হবে। এখানে দুই রকমের জমজম আছে। একটা সরাসরি টেপ থেকে আসে। অন্যটা বিভিন্ন পাত্রে থাকে। বড় বড় মটকার মধ্যে এই জমজম এর পানি থাকে। নীচে কলের মত নল লাগানো আছে। পাশে থাকে গ্লাস পানি পান করার জন্য। জমজমের পানি পান করার সময় যতটুকু পানি নিবেন সেটা তিনবারে পান করবেন। প্রতিবার কাবাঘরের দিকে তাকিয়ে বিসমিল্ল্লাহ্ বলবেন এবং একটা মনের কোন নিয়ত বা দোয়া করবেন এবং এক ঢোক পানি খাবেন। এভাবে তিনবার। আবার যাবার সময় বোতলে (ওখানে যাওয়ার সময় খালি বোতল সাথে নিয়ে যাবেন) পানি ভরে নিয়ে যাবেন। স্বরণ রাখবেন, জমজমের পানি পান করার সময় ট্যাপের পানিটা পান করবেন। ওটা ভাল এবং ফ্রেশ (সরাসরি জমজমের কূপ থেকে পিউরিফাইড হয়ে আসে।) মটকিতে রাখা পানি পান না করার চেষ্টা করবেন। ওটা খুব ক্লিন থাকে না। হয়তো শ্যাওলা পড়ে গেছে মটকার মধ্যে । খালি বোতল ভরে নিয়ে যাবেন। হোটেলে বা আপনার বাসায় যেয়েও ঐ জমজমের পারি মনভরে পান করবেন।

এর পর ‘সায়ী’র উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন। মনে রাখতে হবে সায়ী করা ওয়াজিব। ফরজ নয়। যেহেতু ওয়াজিব, তাই করতেই হবে। এটা মসজিদুল হারাম সংলগ্ন সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে অবস্থিত। এই দুই পাহাড়ের মধ্যস্থলে নির্বাসিতা বিবি হাজেরা (রাঃ) তার পুত্র হযরত ইসমাইলের জন্য পানীয়ের অনুসন্ধানে পাগলের মত ছুটাছুটি করেছিলেন। সেই স্মৃতি রক্ষার্থে হাজীদের এই পাহাড়ের মধ্য সাত চক্কর দিতে হয়। এই সাত চক্করকেই সায়ী বলে। সাফা পাড়ার থেকে মারওয়া পাহাড়ের দিকে ৫০ হাত গেলে মসজিদুল হারাম শরীফের ছাদের উপর লম্বালম্বিভাবে সবুজ লাইটের দ্বারা চিহ্নিত প্রায় ৪০ হাত দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়া এবং আসার পথে একটু জোরে দৌড়ে দৌড়ে পার হতে হয়। এটাকে ‘রমল’ করা বলে। এটা করা সুন্নত। তবে এটা মহিলাদের করতে হয় না। এটা শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য। তবে যদি কোন মহিলা করতে চান অসুবিধা নাই। আমি অনেক মহিলাদেরকে করতে দেখেছি।

সাফা পাহাড়ে উঠে কাবাঘরের দিকে মুখ করে নিয়ত করে সায়ী শুরু করতে হয়। সাফা পাহাড় থেকে মারওয়া পাহাড়ে গেলে এক চক্কর। আবার মারওয়া পাহাড় থেকে সাফা পাহাড়ে ফিরে গেলে আর এক চক্কর। এভাবেই দৌড় সমাপ্ত হবে। মারওয়া পাহাড়ে গিয়ে সায়ী সমাপ্ত হবে। সাফা হতে মারওয়া ৪৪০ গজ। পথটি বেশ দীর্ঘ। বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য। আমরা বাংলাদেশীরাই মনে হয় সবথেকে বৃদ্ধ বয়সে হজ্জে যাই। অথবা সাউথ এশিয়ান বলাই উত্তম। অথচ ইউরোপ, নর্থ আমেরিকান মুসলমানরা দেখলাম ২০/৪০ এর কোঠায় হজ্জ করে ফেলে।

যেহেতু পথটি বেশ দীর্ঘই বলা চলে। এবং যারা বেশ দুর্বল এবং হাটায় পারঙ্গম নন, তাদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা আছে। হুইল চেয়ার। সাথে একজন হুইল চেয়ার ঠেলার জন্য যুবক। যদি একদম শুরু থকেই নেন তো ১৮০ থেকে ২০০ রিয়াল এর মতো চায়। তবে লোকজনকে দরদাম করতে দেখেছি। আবার এক চক্কর পায়ে হেটে যদি নেন, মাঝখানেও হুইল চেয়ার নিয়ে এরা বসে থাকে। এরা চায় ১৫০ রিয়াল। এরা আবার দরদামে বিশ্বাস করে না। এক দরে বিশ্বাসী। দেখলাম দুই রিয়ালও কম করে না। হুইল চেয়ারের জন্য মাঝখানে আলাদা পথ করা আছে। খুবই সুন্দর। অনেকে পথ কমানোর জন্য এই পথ দিয়েও হাটে দেখেছি। তবে এটা খুবই রিস্কি। ওরা খুবই অবদমিত। আপনার শরীরে হুইল চেয়ার লাগিয়ে দিতে পারে। এটার পায়ের পাতা রাখার জায়গা খুব ধারালো। অতএব খুব সাবধান। সবশেষে যেখানে শেষ হবে। দেখবেন অনেক মানুষ জমায়েত। ওখানে দুই রাকাত নামাজ পড়–ন। এখানে কোন চাপাচাপি নাই। বি¯তৃত জায়গা। কোরআন শরীফও পড়তে পারেন।

এরপর এখান থেকে বের হয়ে নীচে যেয়ে কাবাঘর থেকে বের হবেন। কিন্তু আব্দুল আজীজ গেট দিয়ে। ঐ বি¯তৃত প্রান্তরের কর্নারেই দেখবেন একটা বিশাল সেলুন এবং ওয়াশরুম এবং গোসলখানাও আছে। ওখানে শুধু পুরুষরা যেতে পারবেন। মাথা মুন্ডন করে দিবে, মাত্র ১০ রিয়াল। মহিলারা নিজ হোটেল ঘরে যেয়ে , একজন আরেকজনের চুল কাটতে পারেন। অথবা তাদের স্বামী কেটে দিতে পারেন। অথবা আপনি আয়নার সামনে দাড়িয়ে গোটা চুলের দেড় ইঞ্চির মত কেটে ফেলবেন। খেয়াল রাখবেন সব চুলেই যেন টাচ লাগে।

আপনার ওমরাহ্ হয়ে গেল। এখন শুধু পবিত্র হজ্জের জন্য অপেক্ষা। আপনার সারা জীবনের স্বপ্নের শেষ হতে চলেছে। (চলবে)

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com