ধনাঢ্য দেশ কানাডায় যারা দীনহীন তাদের দারিদ্রতা হ্রাস পাচ্ছে না

সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮

খুরশিদ আলম ॥

কানাডিয়ানরা সাম্প্রতিক সময়ে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করছেন যে ধনাঢ্য এই দেশটিতে যারা দীনহীন তাদের দ্রারিদ্রতা হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে ক্রমশই তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তারা এটিও বিশ্বাস করেন যে এই প্রবণতা রোধকল্পে কানাডার ফেডারেল সরকার বা প্রভিন্সিয়াল সরকারগুলো যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করছে না।  Angus Reid Institute এর এর সমীক্ষায় সম্প্রতি এই তথ্য উঠে এসেছে। ঐ সমীক্ষায় আরো যে তথ্য পাওয়া যাচেছ তাতে দেখা যায়, মানুষের এই দারিদ্রতার কারণ ‘পরিবেশ ও পরিস্থিতি’। এখানে দারিদ্রতার শিকার মানুষটির নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট কোন ভূমিকা রাখে না। অধিকাংশ কানাডিয়ানই তা বিশ্বাস করেন।

কিন্তু আমরা দেখেছি, সাধারণ মানুষ সাধরণভাবে বিশ্বাস করে থাকেন যে মানুষের ধনসম্পদের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয় সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক। কে ধনী হবেন আর কে দরিদ্র হবেন সেটি তিনিই নির্ধারণ করে দেন। অর্থাৎ মানুষের কোন ভূমিকা নেই এ ক্ষেত্রে। ধর্মগুরুরা অন্তত তাই বলে থাকেন এবং সাধারণ মানুষেরা সেটাই বিশ্বাস করেন!

এই বিশ্বাস সাধারণত পশ্চাদপদ সমাজাব্যবস্থায় বেশী দেখা যায়। অর্থাৎ যেখানে মানুষজন কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত এবং যেখানে দারিদ্রতা বেশী সেখানে এই বিশ্বাসের প্রাবল্য বেশী।

কিন্তু অধিকাংশ কানাডিয়ান তা বিশ্বাস করেন না। তারা বিশ্বাস করেন আয়ের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। তারা মনে করেন মানুষের দারিদ্রতা দূরীকরনে সরকারের উচিৎ জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি যে, দারিদ্র দূরীকরণের জন্য অন্টরিওর বিগত লিবারেল সরকার “গ্যারান্টিড বেসিক ইনকাম” নামের যে একটি পাইলট প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল তা প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় এসেই বাতিল করে দিয়েছে। যাদের আয় কম বা যারা বেকার কিংবা যারা শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে কাজ করতে অপরাগ, তাদেরকে এই প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ডলার প্রদান করা হচ্ছিল মাথা পিছু। এই পাইলট প্রকল্পটি ছিল তিন বছর মেয়াদী। তিন বছর পর পর্যালোচনা করে দেখার কথা ছিল এর সুূফল কি হয়েছে। কিংবা আদৌ কোন উপকার হয়েছে কি না তাদের যারা এই প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এই পাইলট প্রজেক্টে ৪ হাজার স্বল্প আয়ের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। টরন্টোর নিকটবর্তী হ্যামিলটন-ব্রেন্টফোর্ড এলাকা, থান্ডার বে এবং লিন্ডসে এলকায় বসবাসকারী স্বল্প আয়ের বাসিন্দাগণ এই সুযোগ পাচ্ছিলেন। আর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যায় এই বেসিক ইনকামের পাইলট প্রজেক্টটি ইতিমধ্যেই সুফল দিতে আরম্ভ করেছিল।

মানুষের দারিদ্রতার কারণ ‘পরিবেশ ও পরিস্থিতি’। দারিদ্রতার শিকার মানুষটির নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট কোন ভূমিকা রাখে না। অধিকাংশ কানাডিয়ানই তা বিশ্বাস করেন। ছবি : ফিনান্সিয়াল পোস্ট

কিন্তু কনজারভেটিভরা এর বিপক্ষে ছিলেন শুরু থেকেই। তবে তারা এই প্রকল্প চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে আছে এমন একটা ভূয়া বার্তা দিয়েছিল নির্বাচনের আগে। সম্ভবত ভোটের আশায় এমন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছিল তারা। কিন্তু আমরা জানি এই ‘বেসিক ইনকাম’ প্রজেক্টের মূল প্রবক্তা ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত কনজারভেটিভ সিনেটর যার নাম হাফ সেগাল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনভাবে তিন বছরের পাইলট প্রজেক্টটি এক বছরের মাথায় বন্ধ করে দিয়েছে বর্তমান রক্ষণশীল সরকার। ফলে বিগত সরকারের প্রতিশ্র“তির কথা বিশ্বাস করে যারা এতে এ্যানলিস্টেড হয়েছিলেন তারা এখন পড়েছেন বিব্রতকর অবস্থায়। এর ভাল দিক মন্দ দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোন সুযোগই দিল না অন্টারিওর বর্তমান রক্ষণশীল সরকার।

অবশ্য কানাডায় যারা ধনী এবং যারা এখানকার কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক, তারা মনে করেন দারিদ্রতা দূরীকরণে সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা সমীচিন নয়। বরং তারা মনে করেন দরিদ্র মানুষের কঠোর প্ররিশ্রম করা উচিৎ তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করার জন্য।

Angus Reid Institute কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষায় জানতে চাওয়া হয়েছিল ‘আপনার দৃষ্টিতে ফেডারেল সরকার কি সাধারণ কর্মজীবী মানুষের দারিদ্র দূরীকরনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে? এর উত্তরে দুই তৃতীয়াংশ (৬৫%) কানাডিয়ান বলেন, সরকার খুব  কম প্রচেষ্টা চালায় এই দারিদ্র দূরীকরণের ব্যপারে। অন্যদিকে প্রভিন্সিয়াল পর্যায়েও প্রায় একই সংখ্যক লোক (৬৪%) বলেছেন সরকার খুব কম মাত্রায় জনগনের দারিদ্রতা দূরীকরণে ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে থাকে।

প্রতি দশজনের মধ্যে সাত জন (৭২%) বলেন দরিদ্র জনগণের দারিদ্রতার পিছনে পরিবেশ ও পরিস্থিতি দায়ী। এমন না যে তারা পরিশ্রমী নন বা বেকার বসে থাকেন।

আবার ৬৫% কানাডিয়ান মনে করেন যারা ধনী তারা দরিদ্রদের তুলনায় খুব পরিশ্রমী এবং উদ্যোমী এ কথা সত্যি নয়। তারা ধনী হয়েছে কারণ তাদের জীবনে সুযোগ-সুবিধা ছিল বেশী।

সমীক্ষায় আরো যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে দেখা যায় ৮২% কানাডিয়ান মনে করেন ধনী দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান গ্রহণযোগ্য নয়।

আমরা জানি কানাডা বিশেষ করে অন্টারিওর অর্থনীতি এখন বেশ চাঙ্গা। গত জুলাই মাসেই অন্টারিওতে ষাট হাজার নতুন চাকরী যোগ হয়েছে (যদিও এর একটা উল্ল্লেখযোগ্য অংশ সরকারী প্রতিষ্ঠানে)। অন্যদিকে বেকারত্বের হার কমে এসে ৫.৪ এ ঠেকেছে। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাব এটি। এবং গত ১৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ম বেকারত্বের হার এটি।

কিন্তু এই চাঙ্গা অর্থনীতির মাঝেও অনেকে দারিদ্রতাকে নিত্য সাথী করে জীবনধারণ করছেন। কানাডিয়ান প্রেস এ প্রকাশিত এক গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, কানাডায় সাধারণ কর্মজীবী মানুষদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই অর্থনৈতিক অবস্থা এমন যে, কোন এক পক্ষের পে চেক পেতে সপ্তাহখানেক দেরী হলে দৈনন্দিন জীবনের কর্মকান্ডে ছন্দপতন ঘটে। সময় মত বাড়ি ভাড়া প্রদান, ক্রেডিট কার্ডের বিল প্রদান, লাইন অব ক্রেডিট এর বিল প্রদান, টেলিফোন বিল প্রদান, গাড়ির পেমেন্ট, ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম প্রদান এমনকি সাপ্তাহিক গ্রোসারী করাও সমস্যা হয়ে দাড়ায়।

যারা বলেন, দরিদ্র কানাডিয়ানরা পরিশ্রমী নয়, তারা উদ্যোগী নয়, তারা হয়তো জানেন না যে এই দরিদ্র মানুষগুলোর অনেকেই জীবনধারনের জন্য অন্তত দুটি চাকরী করেন। একটি ফুলটাইম আরেকটি পার্টটাইম। অথবা দু-তিনটি পার্টটাইম চাকরী করেন। তারপরও সংসারের চাকা ঠিক মত ঘুড়ে না। কোন এক পক্ষের পে চেক পেতে সপ্তাহখানেক দেরী হলে চোখে অন্ধকার দেখেন। একাধিক চাকরী করতে হয় বলে নিজের প্রতি, সংসারের প্রতি সময় দিতে পারেন না। অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ারও সময় থাকে না অনেক সময়। ফলে দিনে দিনে বৃদ্ধি পায় অসুস্থতার মাত্রা। এক পর্যায়ে দৌড়াতে হয় এমার্জেন্সীতে। ছেলে মেয়েদের প্রতি সময় দিতে না পারায় তাদের লেখাপড়া বিঘিœত হয়, কেউ কেউ হয় বিপথগামী। সময়ের অভাবে স্বামী-স্ত্রীতে দেখা সাক্ষাৎ হয় কম। ফলে দেখা দেয় পারিবারিক সংকট। কখনো কখনো বিচ্ছেদ। এই মানুষগুলোকে যদি বলা হয় অলস বা শ্রমবিমুখ কিংবা নিষ্কর্মা তবে তা কতটুকু যুক্তসংগত তা নিশ্চই বিবেচনার দাবী রাখে। আর এই দরিদ্রদের একটা উল্ল্লেখযোগ্য অংশই ইমিগ্রেন্ট। অর্থাৎ দেশান্তরী। আর অলস মানুষ কখনো দেশান্তরী হয় না।

কিন্তু সরকার কি করছে এই দরিদ্র মানুষদের জন্য? অথবা যা করছে সেটা দরিদ্র মানুষের উপকারে আসছে কতটুকু?

Angus Reid Institute এর প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে দেখা যায়, সিংহভাগ কানাডিয়ান মনে করছেন ফেডারেল বা প্রভিন্সিয়াল সরকারগুলো মানুষের দারিদ্রতা দূরীকরণে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। যতটুকু করছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

তারা ন্যূনতম মজুরী ১৫ ডলারে উন্নীত করার বিষয়েও মত দিয়ে বলেছেন এটি একটি ভাল ধারণা বা আইডিয়া। অতীতে  Angus Reid Institute কর্তৃক পরিচালিত অন্য এক সমীক্ষায় দেখা গেছে কানাডিয়ানরা ‘গ্যারান্টিড মিনিমাম ইনকাম’ প্রকল্পেরও সমর্থক ব্যাপকভাবে। তবে তারা এও মনে করেন যে ফেডারেল সরকার এই ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে না। এবং তারা এ ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য তাদের উপর বাড়তি টেক্স আরোপ করা হোক তাও চান না।

আবার আরেকদল আছেন যারা মনে করেন গ্যারাটিন্টড মিনিমাম ইনকাম প্রকল্প চালু করলে এর সুবিধাভোগিরা কর্মবিমুখ হয়ে পড়বেন। যেমন শ্রম আইনজীবী ডেভিড ওয়েকলি বলেন, এটি একটি বিরাট ধারণা বলেই মনে হয়, কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে এটির প্রচলন কতটা সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, “আমি মনে করি না যে, এটা সাশ্রয়ী কোনও বিষয়। যত মানুষকে এ ধরণের সহায়তা দিতে হবে তাদের সংখ্যা এত বেশি যে তা কোনওভাবেই সামাল দেওয়ার মত নয়। এতে যে ব্যয় হবে সেটাও বিশাল। এটি একটি বিরাট ব্যাপার।”

ওয়েকলি মনে করেন, এ ধরণের সহায়তা দেওয়া হলে তা লোকেদের মধ্যে কাজের প্রতি অনীহার জন্ম দেবে। অন্য সমালোচকেরা বলেন, এটি কোনও অর্থবহ পরিবর্তনের সূচনা করবে না, বরং কার্যত অন্যান্য সুবিধা কর্তনের পটভূমি হিসাবে কাজ করবে।

তবে সুস্থভাবে বেচে থাকার জন্য বেসিক কিছু আয় জুটলে মানুষজন কাজের প্রতি অনীহা প্রকাশ করবে এমন ধারনার বিরোধীতা করে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একজন পুরষ্কারপ্রাপ্ত সমাজসেবী এ্যালেস সাংহা বলেন, তাহলে ধনীর দুলালেরা কি সবাই অলস? খাওয়া পরার চিন্তা নেই বলে কি তারা সবাই সারাদিন ঘরে বসে থাকেন? তারা কি তাহলে আনপ্রোডাক্টিভ, মদ্যপ? সমাজের কোন কিছুতেই তাদের কোন কন্ট্রিবিউশন নেই?

আসলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডায় দারিদ্রতার হার বৃদ্ধির পিছনে পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদেরকে মূলধারার চাকরীতে প্রবেশ করতে না দেওয়াটা একটি অন্যতম কারণ তাতে সন্দেহ নেই। আমরা দেখেছি কানাডায় চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে অনেক। কিন্তু পাশাপাশি এও দেখছি যে, বিপুল সংখ্যক ইমিগ্রেন্ট চিকিৎসক চিকিৎসা পেশায় প্রবেশ করতে না পেরে এমন সব পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন যার জন্য গ্রেড টুয়েলভ পাশ লোকেরাও ওভারকোয়ালিফাইড! অন্যান্য প্রফেশনের ইমিগ্রেন্টদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। অথচ এই পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টরা যদি তাদের নিজ নিজ পেশায় প্রবেশের সুযোগ পেত তবে কানাডায় দারিদ্র লোকের হার প্রায় অর্ধেকই কমে যেত বলে আমাদের বিশ্বাস। সে ক্ষেত্রে মিউনিসিপাল, প্রভিন্সিয়াল ও ফেডারেল সরকারগুলোর উপরও অর্থনৈতিক চাপ অনেকাংশেই কমে যেত।

কারণ কানাডায় এখন ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা মোটেও কম নয়। প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা গত প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছর ২৫ অক্টোবর প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সর্বশেষ হিসাব (২০১৬) অনুযায়ী দেখা যায় বর্তমানে কানাডার মোট জনসংখ্যার ২১.৯%-ই ইমিগ্রেন্ট।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসীকণ্ঠ