—(ড্যাশ) হেরিটেজ মান্থ ও কতিপয় জিজ্ঞাসা
নভেম্বর ৪, ২০১৮
সুরজিৎ রায় মজুমদার
বাধ্য হয়ে শিরোনামে —(ড্যাশ) ব্যবহার করতে হয়েছে।‘হিন্দু’ বা ‘মুসলিম’ উচ্চারণ না করে ড্যাশ ব্যবহার করা ইদানিং নিরাপদ মনে হচ্ছে।নতুবা আবার ‘ডিসক্রিমিনেট’ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয় আছে।বোঝা গেল না তো? তাহলে শুনুন।
এবার টরোন্টোর শারদীয় পূজা বার্ষিকীতে একটা লেখা দিয়েছিলাম।ইংরেজি ভাষায়।গত পাঁচ বছর ধরেই তা করে আসছি।কখনও ইংরেজি, কখনও বাংলায়।ছাপা হচ্ছিলো।গোল বাঁধল এবার।কেন? আমার শিরোনামটি ছিল ‘আন/ইম্পরটেঞ্চ অব ডিকলনাইজিং হি(ন্দু)স্ট্রি’ (UN/IMPORTANCE OF DECOLONIZING HI(NDU)STORY)।ঘটনা হোল, গত বছর ঢাকায় গিয়ে গ্যারি জে, বাস –এর ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ বই টার একটা কম দামের ভারতীয় সংস্করণ পেয়ে কিনে ফেলি এবং দ্রুত পড়ে ফেলি।গ্যারির বইটাতে একটা অজানা তথ্য আমাকে বেশ বিচলিত করতে থাকে।পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনী যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের জঘন্য গনহত্যার সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিশেষ টার্গেট করেছিল এবং যার ফলশ্রুতিতে ভারতে আশ্রয় নেয়া এক কোটি শরণার্থীর শতকরা নব্বই ভাগই যে হিন্দু ছিল, সেটি ঐতিহাসিক সত্য।আরও পীড়াদায়ক সত্য হল তৎকালীন ভারত সরকার এবং সরকারের মুখপাত্রসমুহ গনমাধ্যমে সে সত্য চেপে রাখতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছিলেন।নয়াদিল্লির বিদেশমন্ত্রি সর্দার শরন সিং সেসময় লন্ডনে কূটনীতিকদের সম্মেলনে ব্যাক্তিগত ভাবে অনুরোধ করেন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু এথনিক ক্লেনজিং বা হিন্দু জাতিগত নিধনের ঘটনা চেপে যেতে (দি ব্লাড টেলিগ্রাম, রান্ডম হাউস ইন্ডিয়া ২০১৪, চ্যাপ্টার ৮, পৃষ্ঠা ১২১)।
একাত্তরের লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত শরণার্থী শিশুদের একজন আমিও।তথ্যটি আমার জন্যে অপ্রত্যাশিত এবং পীড়াদায়ক।আমার চেতনার জগত ভীষণ ঝাঁকুনিখায় ।আমার ধারণা একাত্তরের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার তখনকার শিশু মনে এক ভয়ঙ্কর নেতিবাচক ছাপ ফেলে, যার প্রভাব আজ পর্যন্ত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।আমি পাকিস্তান শব্দটি, পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র, তার সেনাবাহিনী ও মানুষদের প্রতি এক অস্বাভাবিক ঘৃণা নিয়ে বড় হতে এবং বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়েছি।অথচ ধর্মের কারণে কোন মানুষকে ঘৃণা করা আমার সংস্কৃতির অঙ্গ নয় ।অনেক সময় মনে হয়েছে আমার মত একটি প্রজন্মের এক ধরনের মানসিক বৈকল্যের দায়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানানোর কি কোন উপায় নেই।আর এখন গ্যারির তথ্যটি আমার সমস্যায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।আমার হঠাৎ মনে হয়েছে পৃথিবীতে হিন্দু নামের জনগোষ্ঠীটি কি ঐতিহাসিকভাবে অবহেলিত? আমি হাতের কাছে থাকা কিছু বই একটা ভিন্ন পার্সপেকটিভ থেকে উল্টে দেখতে লাগলাম।এটি কোন মৌলিক থিসিস নয়, একটা সাধারণ পর্যবেক্ষণ মাত্র।এভাবে হান্টিংটন ( Samuel P Huntington), গ্যারি বাস (Gary J Bass), জাস্টিন ট্রুডো ( Justin Trudeau) সহ আরও দু একজনের পাঠক-পরিচিত কয়েকটি বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমি উপরে উল্লিখিত প্রবন্ধটি লিখেছিলাম।আমার উপসংহারটি ছিল এরকম যে একটি দেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর উপর নারী-শিশু নির্বিশেষে বর্বর নির্যাতন চালাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই সভ্য সমাজে লজ্জিত বা বিব্রত বোধ করে নি।অথচ ভারত সরকারের কর্মকর্তারা এই কথাটি মুখ ফুটে বলতে বিব্রত বোধ করেছেন যে নির্যাতিতদের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিশেষ টার্গেট করা হয়েছে। কোদাল কে কোদাল বলতে না পারার কি কারণ থাকতে পারে।যা সত্য, তা বলতে বাধা কোথায়।আমার দৃষ্টিতে এই লক্ষণটি সামষ্টিক হিন্দু মনস্তত্বের দীর্ঘ ঔপনিবেশিকতাজনিত দুর্বলতা এবং এর থেকে উত্তরণ (de-colonization) জরুরি।দুটি পূজা বার্ষিকীর দুইজন সম্পাদকই আমার লেখা ছাপানো তাঁদের স্মরনিকার ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর ভেবেছেন এবং তা জায়গা পেয়েছে ময়লার ঝুড়িতে।তাই ‘হিন্দু’, ‘মুসলিম ‘ এই শব্দ গুলো লিখে আবার কাউকে বিব্রত করতে চাইছিলাম না।
অন্যদিকে, কানাডা নামের এই দেশটি মানব সভ্যতাকে অনেক কিছু দিয়েছে।কিন্তু আমি ব্যাক্তগত ভাবে সব চেয়ে মুল্যবান যা পেয়েছি তা হচ্ছে কানাডার তেরতম প্রধানমন্ত্রী জন ডিফেনবেকারের (John Diefenbaker) সেই অনন্য সাধারণ মানবাধিকারের উক্তিটি যাকে বরং একটি মানবাধিকারের কবিতা বলাই শ্রেয়ঃ I am a Canadian,/a free Canadian,/free to speak without fear,/free to speak in my own way,/ free to stand for what I think right,/ free to oppose what I believe wrong,… ।এই ক্ষুদ্র ‘সংবিধান’ আমার ‘আজন্ম শরণার্থী’ জীবনের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা।তাই যা সঙ্গত মনে করি তা লিখতে, প্রকাশ করতে আর কোন দ্বিধা করি না।
বলতে যাচ্ছিলাম কানাডার হেরিটেজ মান্থ উদযাপন নিয়ে।অক্টোবর ছিল মুসলিম হেরিটেজ মান্থ আর নভেম্বর এর প্রথম দিন থেকে শুরু হল অন্টারিওর হিন্দু হেরিটেজ মান্থ।এই উদযাপনের উদ্দেশ্য আমার কাছে আরও অনেক কিছুর মত স্পষ্ট নয়। দৃশ্যত মাল্টিকালচারালিজম বা বহুসংস্কৃতির পরিপোষণ হল উদ্দেশ্য। কিন্তু চূড়ান্ত লক্ষ্য তো ন্যাশন বিল্ডিং বা জাতিগঠন। সে লক্ষ্য কতোটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে? জাতি গঠনের চেয়ে জাতির মানসে বিভাজনটাই উৎসাহিত হচ্ছে বলেই মনে হয়। আসলে কানাডা বহু সংস্কৃতির মোজাইক, আমেরিকার মত মেলটিং পট নয়। এখানে বসবাসকারী ভিন্ন ভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে তারাও যে বৃহৎ একীভূত কানাডীয় জাতির অঙ্গীভূত তা তাদেরকে অনুভব করতে দেয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটি করার জন্যে যে প্রক্রিয়া বেছে নেয়া হয়েছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। হেরিটেজ উদযাপন বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পারিক বোঝাপড়ার সুযোগ সৃষ্টির পরিবর্তে একধরনের অদৃশ্যএবং অসুস্থ্য প্রতিযোগিতার সূত্রপাত করছে কিনা, তলিয়ে দেখা দরকার।
দ্বিতীয়ত, হেরিটেজ মাসের নামগুলো হিন্দু বা মুসলিম— এরকম নির্দিষ্ট ধর্ম ভিত্তিক না হয়ে ভৌগোলিক, ভাষাভিত্তিক বা সংস্কৃতিভিত্তিক যেমন, বাঙালি হেরিটেজ মাস, তামিল হেরিটেজ মাস আবার ভারতীয় হেরিটেজ মাস, ইরানি হেরিটেজ মাস, আরবীয় হেরিটেজ মাস, ইত্যাদি হওয়াই বাঞ্চনীয়।বাস্তবিক কারণেই দুটি ভিন্ন ধর্মের মধ্যে আদান-প্রদান যতটা না সহজ, ভিন্ন ভাষা বা সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদান তার চেয়ে অনেক বেশি সহজ।সমাজতাত্ত্বিক কারণেই আন্তধর্মীয় যোগাযোগের চেয়ে আন্তসাংস্কৃতিক যোগাযোগের মধ্যে অনমনীয়তা বা রেজিস্টেন্স অনেক কম থাকে।
মোদ্দাকথা, কানাডায় অভিবাসী, অনভিবাসি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হলে কানাডীয় হিসেবেই দিন না কেন।হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান রঙ লাগিয়ে দেবার দরকার কি? আর যদি রঙ লাগাতেই হয়, আর এক পোঁচ বেশি লাগান।পরিস্কার করে বলুন ‘হিন্দু হেরিটেজ মান্থ’ নয়, ‘কানাডীয় হিন্দু হেরিটেজ মান্থ’।একই ভাবে ‘মুসলিম হেরিটেজ মান্থ’ নয়, ‘কানাডীয় মুসলিম হেরিটেজ মান্থ’।সেক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে ভারতে বা আরবে কৃত অতীত ঐতিহ্যকে নয়, বরং কানাডা নির্মাণে কে কিভাবে অবদান রেখেছে, রাখছে, কার আত্মত্যাগ কানাডায় কতটুকু, গুরুত্ব দিতে হবে সেখানে।
এবারে ছোট দু একটা অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করব।কানাডার বহু সংস্কৃতির ঐতিহ্য ১৫০ বছর এগিয়েছে। এতদিনে তা একটা শক্ত ভিত পেয়ে যাবার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়েছে কি। এখনও সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ঘৃণা-বিদ্বেষ কমানোর জন্যে আইন পাস করতে হচ্ছে। কে কতখানি বহু সংস্কৃতির ঐতিহ্য আন্তরিক ভাবে মনে ধারণ করে, দেড় শতাব্দী পরে এখন সেটা তলিয়ে দেখা জরুরি হয়ে হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। বেশি দূরে যাবার দরকার নেই। আমি যে এলাকায় থাকি সেই ড্যানফোর্থ-ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় একটু নজর দিন।এখানে ডজনখানেক বাংলা পত্রিকা বের হয়।সেগুলোর প্রায় সবকটাতেই ‘ধর্ম’ নামে একটা নিয়মিত পাতা থাকে।ঢাকায় থাকতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবলিক সেক্টরে নিয়মিত চাকুরীর মাঝের বছর গুলোতে সাংবাদিকতা করেছি।একটা বদভ্যাস তৈরী হয়েছে যেকোনো কাগজ হাতে পেলে একটু ব্যবচ্ছেদ করে দেখার।গত পাঁচ বছরে ওই ধর্ম পাতাগুলোতে একটামাত্রবিশেষ ধর্মের প্রচারধর্মী লেখা ছাড়া অন্য কিছু পড়ার সুযোগ হয়নি।যে কারো এ ধারণা জন্মাতেইপারে যে এখানে ওই একটিমাত্র ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই।অথচ কাগজগুলো কিন্তু কমুনিটির মানুষদের ট্যাক্সের পয়সায় অথবা বিজ্ঞাপনের পয়সায় পোষিত।সম্মানিত সম্পাদকদের বহুসংস্কৃতির বোধের একটা উদাহরণ দিলাম।সাধারণ মানুষের কথা একটু ভাবুন তাহলে।ঘটা করে অমুক হেরিটেজ, তমুক হেরিটেজ করে কাজের কাজ আসলে হচ্ছে কি কিছু?
–সুরজিৎ রায় মজুমদার, টরন্টো
[লেখক প্রাবন্ধিক, গবেষক ও প্রাক্তন সাংবাদিক দি ডেইলি মর্নিং সান, ঢাকা।]