ড্যানফোর্থের গোলমাল
জুলাই ৬, ২০১৮
॥ খুরশিদ আলম ॥
টরন্টোর লিটল বাংলাদেশ খ্যাত ড্যানফোর্থে বাংলাদেশীদের আনাগোনা এখন অনেক বেশী। প্রতি উইক এন্ডে এখানে কোন না কোন সংগঠনের অনুষ্ঠান লেগেই আছে। সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠনের সাধারণ সভা, বার্ষিক সাধারণ সভা, মত বিনিময় সভা, সংর্ধনা অনুষ্ঠান, এমনকি বৈশাখী বা একুশ উপলক্ষে বিশাল মাপের শোভাযাত্রারও আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী একবার আলাপ প্রসঙ্গে বলছিলেন, “বাঙ্গালী যে আমুদে জাতি সেটার প্রমাণ আবারো পেলাম এই টরন্টোতে এসে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন অনুষ্ঠান লেগেই আছে এখানকার বাঙ্গালীদের মধ্যে। হাড় কাপানো শীতও তাদেরকে থামিয়ে রাখতে পারে না।”
কবির এই বক্তব্য যে ষোলআনাই সত্যি তা প্রবাসী প্রতিটি বাঙ্গালী জানেন। আমুদে অনুষ্ঠানের কথা বাদই দিলাম, গুরুগম্ভীর একুশের অনুষ্ঠানগুলো টরন্টোতে এমন সময় হয় যখন এখানকার আবহাওয়া চরম বৈরী রূপ ধারণ করে। ভয়াবহ শীতের কারণে চারদিক তখন জমে বরফ হয়ে যায়। তাপমাত্রা মাইনাস ২০/৩০ এ নেমে যায়। কিন্তু তারপরও একুশের প্রথম প্রহরে ড্যানফোর্থের ঘরোয়া প্রাঙ্গণে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে বাঙ্গালীদের ঢল নামে। ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই ভয়াবহ শীতকে উপেক্ষা করে প্রবাসী বাঙ্গালীরা সমবেত হন ড্যানফোর্থে। আর শুধুই কি বাঙ্গালী? মূলধারার রাজনীতিকদের মধ্য থেকেও দু-চারজনকে দেখা যায় এই সব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তাদের অবশ্য চিন্তা থাকে বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের ভোটের দিকে।
তবে বৈশাখী উৎসবের সময় টরন্টোর আবহাওয়া তার বৈরী রূপ পরিহার করে নেয়। কিন্তু তখনো মোটামুটি শীত থাকে। ফলে বাইরে গেলে একটি হালকা শীতবস্ত্র সাথে রাখতে হয়। আবহাওয়া কিছুটা অনুকুলে থাকলে বৈশাখী পদযাত্রায় শাড়ী ও পাঞ্জাবী পরে বাঙ্গালীদেরকে অংশ নিতে দেখা যায়। শিশুরাও অংশ নেয় মা-বাবার সঙ্গে।
ড্যানফোর্থে বাঙ্গালীদের কিছু রাজনৈতিক সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়। তবে এর কোনটাই কানাডীয় রাজনীতি নিয়ে নয়। পুরোটাই হয় বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অথবা কোন সামাজিক সংকট নিয়ে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০১৩ সালের ফেব্র“য়ারীতে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার ঢেউ এসে লেগেছিল টরন্টোর ড্যানফোর্থেও। তখন সেই তীব্র শীতের সময় তুষারের উপর দাড়িয়ে ড্যানফোর্থেও বাঙ্গালীরা বড় মাপের সমাবেশ করে গণজগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। রাজাকার বিরোধী বিভিন্ন ব্যানার ও পোস্টার হাতে নিয়ে স্লোগান দিয়েছেন। বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রতিবাদেও ড্যানফোর্থে সমাবেশ হয়েছে। এরকম আরো অনেক সমাবেশেরই আয়োজন হয় ড্যানফোর্থে বিভিন্ন ইস্যুতে। বাংলাদেশের ক্রিটেট টিম যখন আলোচিত কোন আন্তর্জাতিক খেলায় জিতে তখনও সমাবেশ হয় ড্যানফোর্থে। গাড়ি মিছিলও হয়।
ঈদের আগের রাতে এবং ঈদের দিনও ড্যানফোর্থে বাঙ্গালীদের ভীড় পরিলক্ষিত হয়। চাঁন রাতে মেহেদী উৎসব এর আয়োজনও হয়ে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। টরন্টোর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসেন হাতে মেহেদী লাগানোর জন্য।
গত কয়েক বছর ধরে ড্যানফোর্থের ডেন্টোনিয়া পার্কে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে খোলা চত্ত্বরে ঈদ জামাত এর আয়োজন। বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী নারী-পুরুষ যোগ দেন এই জামাতে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হয় এই পার্কটিতে। পার্কে আছে খেলার মাঠও। সেখানে বাংলাদেশী ছেলেরা ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলে থাকে।
ড্যানফোর্থের এই সব সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের পিছনে থাকে মূলত মাতৃভূমির প্রতি টান এবং নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য।
বাঙ্গালীর আরেক প্রিয় বিষয় হলো আড্ডা। আড্ডা ছাড়া বাঙ্গালীর বাঙ্গালীত্ব ষোলআনা পুরণ হয় না। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এর মতে, “আড্ডা খুবই প্রয়োজনীয় একটা বিষয়। আমাদের জীবন কাজ দিয়ে তৈরি। কাজকে যদি আরও সৃষ্টিশীল করে তুলতে হয়, আনন্দময় করে তুলতে হয়, জীবনের বেঁচে থাকাকে যদি সুন্দর করতে হয় তাহলে কাজের পাশাপাশি আলসেমির সময়টাও দরকার। এবং এই আলসেমির মধ্যে দিয়েই মানুষের সৃজনশীল মনটা গড়ে ওঠে।”
তবে ড্যানফোর্থে বাঙ্গালীদের আড্ডায় বেশী চর্চা হয় রাজনীতির। আর সে রাজনীতিটা বাংলাদেশের রাজনীতি। ড্যানফোর্থে অবস্থিত রেস্টুরেন্টগুলোতে এবং বাংলাদেশীদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে চলে এই আড্ডাগুলো।
এই হলো মোটামুটি ভাবে ড্যানফোর্থের লিটল বাংলাদেশের একটি হৃদয়গ্রাহী চিত্র। কিন্তু এই চিত্রের পিছনে আছে আরেকটি চিত্র আছে যেটাকে ড্যানফোর্থের ডামাডোল বললে অত্যুক্তি হবে না। আর এই ডামাডোল বা বিশৃঙ্খলা বা উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে বাঙ্গালীদের কেউ কেউ ড্যানফোর্থে যেতে চান না। ড্যানফোর্থের নাম শুনলে নাক সিটকান।
কিন্তু কি সেই ডামাডোল? এখানে কি বাংলাদেশী স্টাইলে মাস্তানী হয়? মারপিট-দাঙ্গা এগুলোও হয়? কিংবা মহিলাদের প্রতি ঈভ টিজিং? কারো সম্ভ্রমহানি? ছিনতাই, রাহাজানি বা ড্রাগ ডিলিং? রাস্তার মোড়ে মোড়ে মদ্যপদের আড্ডা জমে ড্যানফোর্থে?
না। এগুলোর কোনটাই হয় না। তবে একেবারেই যে হয় না একথা বলারও সুযোগ নেই। স্বল্প মাত্রার যে বিশৃঙ্খলা সেটা কানাডিয়ান দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে দৃষ্টিকটুই ঠেকে অনেকের কাছে।
প্রথমেই যে বিষয়টি এখানে উল্ল্লেখ করা যায় সেটি হলো, অযাচিত গোলমাল বা কোলাহল। ড্যানফোর্থ রোডের ফার্মেসী থেকে শুরু করে পশ্চিমে ডজ রোড পর্যন্ত এলাকায় প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু উল্ল্লেখিত এই অংশটুকু সম্পূর্ণভাবে বাণিজ্যিক এলাকা নয়। এই রোডের দুই পাশেই রয়েছে আবাসিক এলাকাও। এই আবাসিক এলাকায় বাঙ্গালী ছাড়া অন্যান্য এথনিক সম্প্রদায়ের লোকজনও বাস করেন। বাস করেন শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের লোকজনও। এই এলাকায় অযাচিতভাবে কোলাহল সৃষ্টি করলে স্বাভাবিক কারণেই লোকজন বিরক্ত হতে পারেন। বিরক্ত হতে পারেন ব্যবসায়ী মহলও। টরন্টো সিটির বাই ল’তে (by laws) স্পষ্টভাবেই উল্ল্লেখ রয়েছে লোকজন বিরক্ত হতে পারেন বা বিক্ষুব্ধ হতে পারেন এমন কোন উচ্চমাত্রার শব্দ বা কোলাহল অসময়ে সৃষ্টি করা যাবে না। সিটি অব টরন্টোর ‘গুড নেইবার’ গাইডলাইনে বলা আছে, বিনোদন কেন্দ্র থেকে সৃষ্ট কোন শব্দ যাতে আশপাশের লোকজনের জন্য বিরক্তির কারণ না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। নিজ আঙ্গিনায় সৃষ্ট কোন শব্দ যেন নিজ আঙ্গিনায়ই সীমাবদ্ধ থাকে।
এলাকা বিশেষ এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আরো কিছু গাইডলাইন দেয়া আছে। তাতে বলা হয়েছে, সপ্তাহের কোন দিন কোন সময় পর্যন্ত বিরক্তির উদ্্েরক হতে পারে এমন উচ্চ মাত্রার কোন শব্দ করা যাবে না। এই সব শব্দের মধ্যে আছে মিউজিক, কনস্ট্রাকশন, মালপত্র লোডিং আনলোডিং, যান্ত্রিক শব্দ, গাড়ি বা অন্যকোন কিছুর মেরামত শব্দ ইত্যাদি। যেমন মিউজিকের ক্ষেত্রে সিটি অব টরন্টোর ওয়েবসাইটে বলা আছে রবিবার এবং অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ ছুটির দিন বাদে বাকি দিনগুলোতে রাত এগারটার পর থেকে শুরু করে সকাল সাতটা পর্যন্ত উচ্চ স্বরে মিউজিক বাজানো যাবে না। আর রবিবার ও অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ ছুটির দিনে সকাল নয়টা পর্যন্ত তা করা যাবে না।
অর্থাৎ বিষয়টি দাড়াচ্ছে এই যে, অন্যের বিরক্তি উদ্রেক করে কোন কিছু করা মোটেও সমীচিন নয়। সেটা শব্দের মাধ্যমে হোক বা অন্য যে কোন উপায়েই হোক। এটা একদিকে যেমন কানাডীয় ভদ্রতা, অন্যদিকে স্থানীয় পৌর আইন। আর কনসার্ট, যে কোন সমাবেশ, মিটিং, মিছিল ইত্যাদি করতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিও নিতে হয় এখানে। যেমন একুশের আয়োজন এবং বৈশাখীর পদযাত্রা সিটির অনুমতি নিয়েই করা হয়। একুশে আয়োজনটা গভীর রাতে হয় বলে সেখানে কোলাহল নিয়ন্ত্রণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতি অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আর তখন সিটিতে অভিযোগ জমা হয়।
সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে কতিপয় বাংলাদেশী তরুণ ড্যানফোর্থের ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট এর পাশের গলি ‘এলডন’ এ রাতের দিকে এসে উচ্চ স্বরে মিউজিক বাজাতে থাকেন গাড়িতে। এই সময় গাড়ির দরজা ও জানালা খুলে রাখেন তারা যাতে সেই শব্দ আরো জোরে শুনা যায়। এদের অনেকের গাড়ির সাইলেন্সার পাইপ থাকে খোলা। ফলে আসা যাওয়ার সময় বিকট শব্দ হয়। সেই সাথে নিজেদের মধ্যে উচ্চস্বরে হৈ-চৈ তো আছেই। অথচ ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট এর পিছন থেকে শুরু করে পুরোটাই আবাসিক এলাকা। এখানে এভাবে রাতের নীরবতা ভঙ্গ করে উচ্চস্বরে গান বাজানো ও হৈ-চৈ করা মোটেও শোভন নয় এবং আইনসঙ্গত তো নয়ই। কিন্তু এই বেআইনী কাজগুলোই করে যাচ্ছেন কতিপয় উছৃংখল তরুণ। ফলে প্রচুর নালিশও জমা হচ্ছে সিটির দপ্তরে।
গত ২১ ফেব্র“য়ারী ড্যানফোর্থের ঘরোয়া প্রাঙ্গণে শহীদ দিবস পালনকালেও উচ্চ শব্দে ঝষড়মধহ উচ্চারণের কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা চলে। আর এ ঘটনা ঘটে মূলধারার কয়েকজন সম্মানিত অতিথির সামনেই। একুশের প্রথম প্রহরে ঐ দিন ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ড্যানফোর্থে এসেছিলেন সিটি অব টরন্টোর মেয়র জন টরি। আরো এসেছিলেন অত্র এলাকার এমপি নেথানিয়েল আরস্কিন স্মিথ (লিবারেল পার্টি), তৎকালীন এমপিপি আর্থার পট্স (লিবারেল পার্টি), সিটি কাউন্সিলর জেনেট ডেভিস। পার্শ্ববর্তী রাইডিং স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট এর এমপি বিল ব্লেয়ার-ও (লিবারেল পার্টি) এসেছিলেন ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এসেছিলেন সাবেক এমপি ও মন্ত্রী মারিয়া মিন্না। তারা সকলেই পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের আগে সমবেত বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।
একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে লোকজন আসেন ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। স্লোগান দিয়ে এলাকা প্রকম্পিত করার জন্য নয়। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত বাংলাদেশ আর কানাডার পরিবেশ ও পরিস্থিতি এক নয়। কানাডায় মধ্যরাতে একটি আবাসিক এলাকায় উচ্চ স্বরে স্লোগান দিয়ে লোকজনের ঘুম ভাঙ্গানো বা আতঙ্ক সৃষ্টি করার কোন যৌক্তিকতাই নেই। এতে করে কমিউনিটির সুনাম বৃদ্ধি হয় না বরং তা ক্ষুন্নই হয়।
ড্যানফোর্থে আরো লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। আর এই প্রতিবাদ সমাবেশের কারণে অত্র এলাকার ফুটপাত বা সাইডওয়াক এ কখনো কখনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় যদি লোক সমাগম বেশী হয়। আর এই বিষয়টি বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে অনেকের কাছে। তাছাড়া সিটির আইনও সমর্থন করে না অন্যের পথ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। বিষয়টির উপর সামাবেশ আয়োজনকারীদের নজর রাখা জরুরী।
আরো লক্ষ্য করা গেছে ড্যানফোর্থে সাইড ওয়াক বন্ধ করে জুমার নামাজ আদায় করারও ব্যবস্থা করা হয় সামারে। এতে করেও লোকজনের চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় যা বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে।
এমনিতেই তো মুসলমানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বে অভিযোগের শেষ নেই। তার উপর যদি সাইডওয়াকে এরকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় তবে সেই অভিযোগ বাড়বে বই কমবে না। মুসল্লীদের সংখ্যা বেশী হলে মসজিদ এর পার্কিং লট ব্যবহার করা যেতে পারে। সেটি না করে সাইডওয়াকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা কেন? এরকম অভিযোগ আমি কয়েকজন পথচারীকে করতে দেখেছি।
গত ঈদের আগের রাতে অর্থাৎ চাঁন রাতে ড্যানফোর্থে আয়োজিত মেহেদী উৎসব নিয়ে এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মধ্যরাত পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন এই উৎসব চলছিল তখন ড্যানফোর্থের কয়েকজন ব্যবসায়ী উৎসব আয়োজকদের ঐ স্থান ত্যাগ করতে বলেন। অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি ওখান থেকেই। আয়োজকদের মধ্যে একজন সঙ্গীত শিল্পী সারা বিল্ল্লাহ তার ফেসবুকে উল্ল্লেখ করেন, স্থান ত্যাগ করার কথা বলার সময় তার সাথে বাজে আচরণ করা হয়েছে। তিনি কয়েকজনের নামও উল্ল্লেখ করেন। তাকে ফলো করা হয়েছে এমন অভিযোগও তিনি তুলেন। কিন্তু যে ব্যবসায়ী তার পার্কিং লটে মেহেদী উৎসব আয়োজনের অনুমতি দিয়েছিলেন সেই কফিল উদ্দিন পারভেজ তার ফেসবুকে লিখেন, “ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সারা বিল্ল্লাহ, কয়েকজনের বিরুদ্ধে তাকে ফলো করার অভিযোগও করেছেন তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কেননা তিনি যাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছেন তারা অনুষ্ঠানস্থল পরিষ্কার করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমি আরও উল্ল্লেখ করতে চাই, সারা বিল্ল্লাহ ও তার বন্ধুরা যাদেরকে অভিযুক্ত করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এবং তার কতিপয় ফেসবুক বন্ধু (যারা নিয়মিত ড্যানফোর্থে আসেন এবং অভিযুক্তদের পূর্বপরিচিত) হয়তোবা অতিউৎসাহী হয়ে অথবা ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করার একটি নগ্ন খেলায় তার পোস্টটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বৃথা চেষ্টা চালিয়েছেন।”
কফিল উদ্দিন পারভেজ এর এই বক্তব্যের পর সারা বিল্ল্লাহ লিখেন, “খুব খারাপ লাগল আপনার কমেন্ট পড়ে। আপনার কাছ থেকে এতোটা অসত্য / ভুল তথ্য আশা করিনি। যেখানে আমরা আপনার সাহায্যের কথা বলতে এতটুকু পিছপা হলামনা, সেখানে আপনি কিছু মানুষকে খুশি করবার জন্য আমাদের নামে অসত্য ছড়াচ্ছেন। এটাও কিন্তু আমাদের কমিউনিটিতে একটি নোংরা উদাহরণ হয়ে থাকবে।”
ঘটনার পর এভাবে বেশ কিছু পাল্টা-পাল্টি বক্তব্য চলে কয়েকদিন ধরে। স্থানাভাবে এখানে তা বিস্তারিত তুলে ধরা সম্ভব হলো না। তবে দেখা গেছে সারা বিল্ল্লাহর পক্ষে যেমন স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে, তেমনি বিপক্ষেও স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে ফেসবুকে। পুরো বিষয়টি আসলে একটি বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি তৈরী করেছে কমিউনিটিতে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আয়োজকদের কেউ কেউ মধ্যরাত অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তাদের উৎসব বন্ধ করেননি। ফলে এলাকায় সমবেত লোকদের উপস্থিতির কারণে মধ্য রাতে কোলাহল সৃষ্টি হচ্ছিল যা আশপাশের বাড়ির বাসিন্দাদের জন্য প্রীতিকর ছিল না। এ কারণে মেহেদী উৎসবের আয়োজকদের বলা হয়েছিল ঐ স্থান ত্যাগ করার জন্য। উল্ল্লেখ্য যে, ঐ এলাকায় বাঙ্গালীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং সমাবেশ হয় বলে এমনিতেই স্থানীয় বাড়ির মালিকদের অভিযোগের শেষ নেই। সিটিতে তাদের অভিযোগের পাহাড় জমে আছে। স্থানীয় কাউন্সিলর জেনেট ডেভিস ঈদের পরের দিন ড্যানফোর্থের ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট এর মালিক সৈয়দ সামসুল আলমকে নাকি জানিয়েছেন তার কাছে নালিশ এসেছে বেশ কিছু।
এতো গেলে মেহেদী উৎসব নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ।
আবার সামারটাইমে বিকেলের দিকে ড্যানফোর্থের সাইডওয়াকের ঠিক মাঝখানে দাড়িয়ে কাউকে কাউকে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গল্পে মেতে উঠতে দেখা যায়। এর ফলে সাধারণ পথচারীদের চলার পথে বিঘœ সৃষ্টি হয় এবং অনেককেই বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায় আর নানান মন্তব্য করতেও দেখা যায়।
সমস্যার মধ্যে আরো আছে অনুমতিহীন পোস্টারিং। কোন কোন সংগঠন এর কর্মীগণ তাদের অনুষ্ঠান বা সমাবেশের আগে পোষ্টারিং করে থাকেন। আর এই পোস্টারগুলো বিল্ডিং এর মালিক বা ভাড়াটিয়াদের অনুমতি না নিয়েই লাগান তারা। এমনও দেখা গেছে যে কাঁচের দেয়াল বা দরজার উপর পোস্টার আঠা দিয়ে লাগিয়ে যান যা পরে খুলতে গিয়ে বিল্ডিং মালিক বা ভাড়াটিয়াদের গলদঘর্ম হতে হয়। কাঁচ থেকে আঠার দাগ সহজে উঠানো যায় না। মারহাবা সুপারমার্কেট এর সামনে একটি লাল রঙের স্টিল বক্স বসানো আছে যেখানে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিন রাখা হয়। ঐ বক্সে ম্যাগাজিন ডিসপ্লে’র ব্যবস্থাও আছে। কয়েক মাস আগে এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক (একটি গাড়ি ডিলার কোম্পানীতে কাজ করেন) ঐ ডিসপ্লে’র যায়গায় গাড়ি বিক্রির একটি ফ্লায়ার লাগিয়ে যান স্কচ টেপ দিয়ে। ফলে ঐ ফ্লায়ারের নিচে সম্পূর্ণভাবে ঢাকা পড়ে যায় ডিসপ্লে-তে রাখা ম্যাগাজিনটি। বিষয়টি যখন আমাদের নজরে আসে তখন ঐ ভদ্রলোককে ফোন দেয়া হয় ফ্লায়ারে প্রদত্ত নাম্বার দেখে। তিনি তখন সরি বলেন। কিন্তু দায় স্বীকার করেননি। দায় তিনি চাপিয়ে দেন অন্যের উপর। অর্থাৎ তিনি নিজে ফ্লায়ারটি লাগাননি। তার হয়ে অন্যকেউ এ কাজটি করেছে, এই ছিল তার বক্তব্য।
ড্যানফোর্থের ডামাডোলের মধ্যে আরো আছে গাড়ি পার্কিং নিয়ে সমস্যা। ঐ এলাকার ব্যবসায়ীরা নিজেরা নিজেদের পার্কিং লটে গাড়ি রাখতে পারেন না অধিকাংশ সময়ে। বাইরের লোকজন এসে গাড়ি পার্ক করে রাখেন।
অফিস বিল্ডিংগুলোর পিছনে পার্কিং লটের কোনায় মাঝে মধ্যে বাঙ্গালীদের মধ্যে দুএকজনকে মূত্রত্যাগ করতেও দেখা যায়!
টরন্টো সিটির মেয়র থেকে শুরু করে ড্যানফোর্থের বিচেস ইস্ট ইয়র্ক এলাকার
এমপি, এমপিপি, কাউন্সিলর এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষও জানেন বাংলাদেশীরা এই এলাকায় একটি অন্যতম বৃহত্তম এথনিক গ্র“প। ড্যানফোর্থ ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশীর বাস। সুতরাং এই এলাকায়, বিশেষ করে ড্যানফোর্থ এর বাঙ্গালী বাণিজ্যিক এলাকায় অশোভন বা অপ্রীতিকর কিংবা বেআইনী কিছু ঘটলে প্রথম অপবাদটা আসে বাঙ্গালীদের উপরই। সুতরাং বাঙ্গালী কমিউনিটির সদস্য হিসাবে প্রতিটি বাঙ্গালীরই দায়িত্ব রয়েছে এই এলাকার শোভনতা বজায় রাখা, শিষ্টাচার বজায় রাখা, সৌজন্যতা প্রদর্শন করা এবং আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
প্রবাসে আমরা প্রতিটি বাংলাদেশীই বাংলাদেশের একেকজন এ্যাম্বাসাডর। আমাদের আচরণ, আমাদের শিষ্টাচার, আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এগুলোর উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের সুনাম এবং প্রবাসে আমাদের সম্মান। একই সাথে প্রবাসে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মেরও সুনাম।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ