একজন নবাগত হিসাবে আপনার নামের ইংরেজিকরণ করবেন কি?
ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৯
রম্য রমানাথন
আপনার নামটা কি এমন যে তা উচ্চারণ করা ভিন্ন সংস্কৃতির লোকেদের জন্য কঠিন? আপনি কি সেটা কানাডীয়করণের কথা ভেবেছেন? এই অতি ব্যক্তিগত বিষয়টি নিয়ে অন্য অভিবাসীরা কী ভাবেন এখানে সেটিই তুলে ধরা হয়েছে:
কানাডা সাংস্কৃতিক দিক থেকে বহু বৈচিত্র্যময় হওয়ার কারণে এখানে প্রায় প্রত্যেক অভিবাসীরই নাম নিয়ে কোন না কোন কাহিনী আছে। হয়তো সেটা তার নামের ভুল উচ্চারণ নিয়ে, তার নামের কানাডীয় স্টাইলের উচ্চারণ নিয়ে কিংবা নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির বাইরের কারো কাছে নামটি উচ্চারণ বা বানান করার জটিলতা নিয়ে। আর আগামী তিন বছরে আরও যে ১০ লাখ নতুন অভিবাসী আসবেন তাদের অবস্থা কেমন দাঁড়াবে? জাতিগত উচ্চারণের নাম নিয়ে এদেশে আসা অভিবাসীরা কী ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন বলে আশা করছেন?
ধরুন, মি. এইচ-এর কথা। তিনি ছয় বছর আগে ভারত থেকে কানাডায় আসার পর নিজের নামের প্রথম অংশ পাল্টানোর চিন্তা করেছিলেন। তিনি বলেন, “স্থানীয় কানাডীয়রা আমার নাম নিয়ে সমস্যায় পড়তো। সেজন্যে কেউ কেউ আমাকে নাম পরিবর্তনের পরামর্শ দেন, আর আমিও সেরকমটাই ভেবেছিলাম। জনসম্মুখে বক্তৃতা দানকারী হিসাবে এবং একজন প্রশিক্ষণদাতা হিসাবে লোকেরা যদি আমার নামই মনে রাখতে না পারে তাহলে তাদের পক্ষে কারো কাছে আমার পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব নয়।”
এমন অভিজ্ঞতা মি. এইচ-এর একার নয়। ভিন্ন ধরণের এবং অপ্রচলিত নাম নিয়ে আসা অভিবাসী যাদের নামকে সাধারণভাবে জাতিগত, বিদেশি বা ইংরেজি নয় বলে অভিহিত করা হয়, তাদের অনেকেই কানাডায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সময় একই অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হয়েছেন।
মি. এইচ তার নাম সংরক্ষণ করেছেন। কিন্তু তিনি বলেন, “আমি যখন প্রথম এদেশে আসি তখনই নাম পাল্টানোর দরকার ছিলো। এখন যদি নাম পাল্টাই তাহলে সম্পূর্ণ নতুন নাম নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা আমার জন্য খুবই কষ্টকর হবে। আমি যদি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারতাম তাহলে প্রথম দিনেই নিজের নামটা পাল্টে নিতাম।”
এই কাজটিই করেছেন মিজ. জিয়াওয়েন। ১৭ বছর আগে চীন থেকে কানাডায় আসার পর তিনি নিজের পরিচয় দেন অ্যামি নামে। কারণ লোকেরা তার চীনা নাম উচ্চারণ করতে এবং মনে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলো। তিনি বলেন, “একটি প্রচলিত নাম বেছে নিয়েছি। আমার আসল নাম যেটা আমার বাবা-মা রেখেছিলেন (যার অর্থ হলো শুভ বা শান্ত) সেটা আমি রেখে দিয়েছি এবং কাগজপত্রে সেটাই আছে।”
তবে তিনি প্রতিদিনই অ্যামি নামটা ব্যবহার করতে থাকেন। জিয়াওয়েন বলেন, “মাঝে মাঝে ভাবতাম এই নামটা ব্যবহার করবো না। কখনও মনে হতো আমি যেন কোন কিছুর চিপায় আটকে পড়েছি।”
নাম নিয়ে মি. এইচ বা জিয়াওয়েনের চেয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতা মরিশাস থেকে আসা স্যান্ডার। তিনি নিজের নাম কিছুতেই পাল্টাতে চাননি। তিনি বলেন, “জীবন-বৃত্তান্ত লেখা ও চাকরি খোঁজা সম্পর্কিত প্রথম কর্মশালাতেই আমাকে বলা হয়েছিলো স্যান্ডা নামটা পাল্টে স্যান্ড্রা করার। আমার মনে হয়, বক্তা তার নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই ওই পরামর্শ দেন কারণ তারও নামের শেষাংশ বেশ জটিল। আমি তার সঙ্গে করমর্দন করি এবং পরামর্শ দেবার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।”
এদিকে মি. হ্যাঙ তার বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাকরির আবেদনে নিজের নাম পাল্টে ফেলে হান্টার করে ফেলেছেন। তিনি বলেন, “যদিও হ্যাঙ নামটা উচ্চারণ করা সহজ তবু হান্টার শব্দটা স্থানীয়দের কাছে আরও বেশি কাছের এবং সাজুয্যপূর্ণ মনে হবে।”
নিজের নতুন নাম পছন্দ করা নিয়ে তার এখনকার অনুভূতি কী? হ্যাঙ বলেন, “আমার নামের সঙ্গে একটা আবেগময় সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। ম্যান্ডারিন ভাষায় হ্যাঙ মানে হলো উপদেশ বা পথ-প্রদর্শন। আমি এখন অনুতপ্ত, কারণ পুরনো নামে ফিরে যাওয়া এখন খুব কঠিন।”
হ্যালো, আমার নাম…
কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ইংরেজি নয় এবং বিদেশি নামধারী যারা চাকরির জন্য আবেদন করেন তাদেরকে ইন্টারভিউতে তেমন একটা ডাকা হয় না। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও পাবলিক পলিসি সম্পর্কিত বিষয়ের প্রফেসর ফিলিপ অরেওপোলস চাকরির বাজারে হিমশিম খাচ্ছেন এমন দক্ষ অভিবাসীদের বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তার প্রামাণ্য তথ্যে জাতিগত নামধারীদের চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরণের বৈষম্যের চিত্র পাওয়া গেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাদের নাম পাল্টে ফেলতে হবে।
অরেওপোলস বলেন, “তাদের নাম পরিবর্তন করার দরকার নেই। চাকরির বাজারে নামের প্রভাব বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু আপনার নামটা কেবল একটি চাকরি পাওয়ার হাতিয়ারের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। প্রশ্ন হলো, আপনি অনিচ্ছার সঙ্গে নাম পাল্টাচ্ছেন কিনা। যদি নিজের ইচ্ছায় নাম পাল্টান তাহলে আপনার জন্য সেটা মেনে নেওয়া সহজ।”
নাম নিয়ে জটিলতার কাহিনী অনেক। এর সঙ্গে গভীর আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে আছে। আর বিদেশি উচ্চারণের নামবিশিষ্ট ব্যক্তিরা (তাদের জন্ম এদেশেই হোক বা বিদেশে) নানাভাবে সেইসব পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
মানুষের সাধারণত একটি করে ডাকনামও থাকে। অনেকে তাদের নাম সংক্ষিপ্ত করে ফেলে (যেমন, সুবক্ষালক্ষ্মীর নাম এখন শুধুই সুবক্ষা)। আবার অনেকে ব্রাকেটের মধ্যে একটি ইংরেজি ধরণের ডাকনাম উল্লেখ করেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মোহাম্মদ তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ক্লায়েন্টদের কাছে কেবলই মো নামে পরিচিত।
ডরোটা যখন গ্রেড থ্রিতে নতুন স্কুলে ভর্তি হন তখন নাম পরিবর্তনের সুযোগ নেন। নতুন স্কুলে যাবার আগের রাতে তার বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তার নতুন নামটি তিনি ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারেন কিনা। সেই সময় থেকে ডরোটা হয়ে গেছেন ডরোথি। তবে তিনি যখন পোলিশদের সঙ্গে থাকেন তখন আগের নামটিই ব্যবহার করেন। এটা তার জন্য মোটেও কঠিন নয়।
তিনি দেখেছেন যে,মানুষ তার নামটি যথাযথভাবে উচ্চারণ করার চেষ্টা করে। এমনকি তার নামের জটিল শেষ অংশটিও। তার পরামর্শ হলো, নামের ব্যাপারটা যদি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে সেটা পাল্টানো দরকার নেই। আর যখন জীবনে কোন সুযোগ আসবে এবং নিজেকে একটি ডাক নাম বা ইংরেজি নামে পরিচিত হতে দেখতে চাইবেন তখন সেটি গ্রহণ করুন।
আপনার নাম উচ্চারণে অন্যদের সাহায্য করার কৌশল
আমরা যারা নিজের নামটিই ধরে রেখেছি তাদের জন্য ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের নিজের নামটি উচ্চারণে ধৈর্যের সঙ্গে সাহায্য করাই সবচেয়ে ভালো কৌশল। কেউ কেউ নিজের নামের অক্ষর তথা পদাংশের (সিলেবল) উচ্চারণের ওপর জোর দেন, অনেকে আবার নামের অক্ষরগুলো আলাদা করে লেখেন, বিশেষ করে যখন নামের অংশগুলো যেভাবে লেখা হয় উচ্চারণের ক্ষেত্রে তার ভিন্নতা থাকে। (আমি আমার জীবনবৃত্তান্তে নামটি লিখি ফোনেটিক উচ্চারণের চিহ্ণসহ)।
যখন দলগতভাবে বসবেন বা সামনাসামনি মিটিং করবেন তখন নিজের নামটি উচ্চারণ করুন ‘স্ট্রেটেজি’র মত করে, যেমন লিখিতভাবে শেখর-এর (Shekar) উচ্চারণ হয় শাকের-এর (shaker) মতো।
আপনি নিজের নামের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কোনও নামের সঙ্গে মিলিয়ে আপনার নাম মনে রাখার জন্য বলতে পারেন। যেমন, “আমি গঙ্গা, ভারতের বিখ্যাত নদী গঙ্গার নামে আমার নাম।”
মি. এইচ, অ্যামি, হ্যাং, সুবক্ষা, মো, ডরোথি এবং আরও অনেক মানুষ মনে করেন নাম নিয়ে এই বিড়ম্বনার কোন সহজ সমাধান নেই। আপনার ক্ষেত্রে যেটা প্রযোজ্য সেটাই করুন। মানুষ নিজেকে কী নামে পরিচিত করাতে চায় সেটা সম্পূর্ণভাবে তার ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়।
লোকেরা যখন আপনার নাম ভুলভাবে উচ্চারণ করে, বিশেষ করে তিনি যদি এমন কেউ হন যার সঙ্গে আপনি বিশেষ সম্পর্র্ক গড়ে তুলতে চান, তাহলে তাকে বা তাদেরকে ভদ্র ও ন¤্রভাবে সাহায্য করুন। পশ্চিম অন্টারিও ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগের কিভকারেন পেনেসি লিখেছেন, কারও নাম চিনতে পারা, মনে রাখা, গ্রহণ করা এবং টিকভাবে উচ্চারণ করার মানে হলো তার সঙ্গে একধরণের একাত্মতার বোধ তৈরি হওয়া।
সময় পাল্টে যাচ্ছে, তবে নাম পাল্টানো উচিৎ নয়
পেনেসি আরও বলেছেন, ক্রমবর্ধমান অভিবাসী জনসংখ্যা এবং একটি বহু সংস্কৃতির সমাজ হিসাবে সবাইকে সমাজের সঙ্গে একাত্ম করার দায়িত্ব কেবল নবাগতদের ওপরেই বর্তায় না বরং এই ভার সবারই। তিনি বলেন, “স্বাগতিক সমাজের সদস্যরা অপরিচিত নাম বানান করতে এবং যথাযথভাবে উচ্চারণ করতে শেখা এবং একটি নামের মধ্য দিয়ে কখনও কখনও সেই ব্যক্তির সম্পর্কে যে ধারণার জন্ম হয় তার ভিত্তিতে একজন অভিবাসীর ভাষাজ্ঞান, নাগরিকত্বের অবস্থান, ধর্ম, রাজনৈতিক প্রবণতা, নৈতিকতা বা কর্মদক্ষতা সম্পর্কে নির্দিষ্টরকমের ধারণা করে নেওয়ার অভ্যাস এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে সামাজিকভাবে একাত্ম করার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন।”
পেনেসি তার গবেষণা “অভিবাসনের পারস্পরিক দিক” শীর্ষক গবেষণার সুপারিশে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছেন তার মধ্যে আছে, কোনও অভিবাসীর নামটি যেন শুরু থেকেই ঠিকভাবে উচ্চারণ করা সম্ভব হয় সেজন্যে তাকে নিয়ে দলীয় সভায় তার নাম উচ্চারণ করানো, তার নামের বানান ও উচ্চারণ নিয়ে বাস্তবসম্মতভাবে যাচাই করা যেমনভাবে মানুষ অন্যের টেলিফোন নম্বর জিজ্ঞাসা করে। আর একজন মানুষের নাম উচ্চারণ করা কঠিন বলেই যেন কাউকে উপেক্ষা করা বা তার সঙ্গে কথা বলা এড়িয়ে যাওয়া না হয়। শেষ কথা: আপনি যতই একটি নাম উচ্চারণের অনুশীলন করবেন ততই সেটা রপ্ত করা সহজ হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে বর্তমান প্রবণতা কী? পেনেসি বলেন, “সার্বিকভাবে এখন অনেক লোকই নিজের নামটি সংরক্ষণ করেন। কারও ইংরেজি নাম গ্রহণের প্রক্রিয়া যেমনটা হওয়া উচিৎ সেটি কোনও স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া নয়।”
১৯৬০-এর দশকে ভারত থেকে কানাডায় আসা রেশমি নাথওয়ানি টরন্টো ও হ্যামিল্টনের সিটি হলে কয়েক দশক ধরে কাজ করেছেন। আমাদের সমাজের অভিযোজনের ক্ষমতার ওপর তার আস্থা আছে। তিনি বলেন, “কাউকে কাছে টেনে নেওয়ার ব্যাপারটি এখন অনেক বেশি। আর সেকারণেই আমার মতো অনেক অভিবাসীই সমাজের সফল অবস্থানে উঠে এসেছেন। আমার মনে হয়, সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং জীবনে পরিবর্তন আনতে পুরো একটি প্রজন্মের প্রয়োজন হয়।”
-সৌজন্যে : কানাডাইমিগ্রান্ট.সিএ