এই হেমন্তে পাতাঝড়া – আমাদের নেলি আপা

ফারহানা পল্লব

টরোন্টোর আবহাওয়া নামা উঠার মধ্যে চলছে। আজই সুন্দর ঝলমলে দিন আবার পরের দিন মেঘে ঢাকা গম্ভীর আকাশ- ঠান্ডার কমতি নেই। এবারের রঙ্গীন হেমন্ত আমাদের কাপনের মধ্যেই রেখেছে।
বেড়াতে যাই হেমন্তের রং বদল দেখতে সেই মন্ট ট্রেম্বলেন্ট এর পাহাড়ে। অপরূপ সেই রং বদলের খেলা, ক্যামেরা আর রং তুলিতে যতই ধরতে চাই কিছুই মন ভরে না- চোখজুড়ানো সেই দৃশ্য দেখি আমার ছেলে মেয়ের সাথে। ওরাই আমাকে বেড়াতে নিয়ে যায়, মনটা ভরে আছে। আবার কেনো যেন একটু মন খারাপ রয়ে যাচ্ছে, একটা কিছু হয়ে যেতে পারে, নেলি আপা আবারো হাসপাতালে। দেখতে যাবো, গতবার হাসপাতালে থাকতে গিয়েছিলাম একদিন। অনেকক্ষন দুইজনে আড্ডা দিলাম, মন ভরেনা, উনার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যায়। এবারে হেমন্তে যত ছবি তুলেছি রংবদলের, তার চাইতে বেশি দেখেছি পাতাঝড়ার দৃশ্য।
একদিন দেখি অনলাইন এ আছেন নেলি আপা। বললাম, নেলি আপা আজকে আসবো আড্ডা দিতে। রতন ভাই উত্তর দিলেন, আপা, আমি রতন, নেলীর শরীরটা তো ভালো নেই, আসেন যখন সময় পাবেন। গতবার গল্পের সময় নেলি আপা বলেছিলেন, এতো ভালো বন্ধু বান্ধব আমার, যে একেবারেই একা লাগে না, সারাক্ষন সবাই সঙ্গ দেয়, কথা বলে, সময় দেয় , আমার সৌভাগ্য। আমি বলি আপনার মতো মানুষ কে আমরা পাই সে আমাদের সৌভাগ্য।

লেখাটা শুরু একদিন আগে থেকে – আজ নাহিদ আপার ফোন পেয়ে হাসপাতাল গিয়েছিলাম, অবস্থা বেশি ভালো নেই শুনে, কাল রাতেই সবাই নাহিদ অপার রেটুরেন্ট এ আলাপ করেছি দেখতে যাবো, দুপুরেই ফোন পেয়ে দৌড়ে গেলাম, হাসপাতালের হলওয়েতে সবার চেহারা দেখেই বুঝে যাই নেলি আপা ভালো নেই। মেয়ে তনিমা আর ছেলের বৌ মার্জিয়ার কাছে বিস্তারিত শুনি, একটু পর রুম এ গিয়ে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই কি আমাদের সেই সদা হাস্যময়ী নেলি আপা? সেই সুন্দর চেহারাটা বেদনায় মলিন, চোখ অর্ধ বুজে, ঠোঁট গুলো সাদা হয়ে গেছে, শুধু গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে। সবাই দোয়া দরুদ পড়ছে, আমরাও পড়লাম, উনার শান্তি যাতে হয়। বেশিক্ষন সহ্য করতে পারিনি। আমি আর বন্ধু ইলোরা কাজে বের হয়ে যাই, সারা পথ উনার গল্প করি, মন জুড়ে নেলি অপার দুশ্চিন্তা কালো ছায়া হয়ে ঝুলে থাকে। কাজ শেষে ঘরে ফিরে হাটতে বের হই, সারাক্ষণ মনে করতে চেষ্টা করছি কবে প্রথম দেখা, কবে এতো আপন হয়ে গেল মানুষটা।

ইসমত নেলী । ছবি : লেখিকার সংগ্রহ থেকে

প্রথম দেখা সাবেক এমপি ম্যাথিউ কেলওয়ের একুশের অনুষ্ঠানে- মহিউদ্দিন ভাই, নেলি আপার বড় ভাই, উনাকে চিনতাম, উনি দেখিয়ে দিলেন দর্শক সারিতে উনার ছোট বোন বসা। আমরা আলাপ করলাম, আরো পরে আমাদের কিছু অনুষ্ঠানে উনি আসেন, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্ম জীবন, আর সর্বোপোরী পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা বিমোহিত হয়ে ২০১৫ তে উনাকে বাঙালি কালচারাল সোসাইটির পরিচালক পদে পেলাম। তখন জানতে পারি উনার শারীরিক অসুস্থতার কথা, ক্যান্সার গত ৮ বছর ধরে উনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, উনাকে দেখে একটুও অসুস্থ মনে হয় নি। যতই কাছে এসেছি আবিষ্কার করেছি অনেক বড় মাপের এক মানুষ কে। অনেক আহ্লাদী স্বভাবের আপা, খুব আদর করে কথা বলতেন, আপন করে নিয়েছিলেন আমাদের অল্প সময়ে। আমার মাকে দেখলেই বলতেন উনার মায়ের মতো লাগে, মা ও উনাকে অনেক আদর করতেন। নেলি অপার বড় ভাই মহিউদ্দিন ভাই বর্তমানে আমাদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক – আরেক জন ভালো মানুষ। এমন আদর করে ভাইয়া বলে নেলি আপা ডাকতেন আমার সব সময় নিজের ভাইয়ার কথা মনে পড়তো।
সংগঠনে জড়িত হওয়ার পর থেকে যখন যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে খুব নিপুন হাতে তিনি করেছেন, কোনো অসুস্থতা উনাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। এমন জীবনী শক্তি একটা মানুষের মধ্যে কি করে থাকে, যে জানে তার সময় কতটা কম, সে কিভাবে এমন সাহসের সাথে সব কাজ সম্পন্ন করে যায়, সৃষ্টিকর্তা কোন শক্তি দিয়েছিলেন আমি জানিনা।
ভীষণ আদূরে একটা মেয়ে তার তনিমা, কলেজে পড়ছে, ছেলে তানজিম পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করছে, তাকে ছোটতেই বিয়ে দিয়েছেন, একটি চমৎকার বৌ, মার্জিয়াকে যেন নিজ হাতে গড়ছিলেন নেলি আপা, কিভাবে, অল্প বয়েসের এই মেয়েটি পুরো পরিবারের ভার সুনিপুন হাতে সামলে চলেছে, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। নেলি আপার জীবন সঙ্গী রতন ভাই এক মাটির মানুষ, কারো সাতে পাঁচে নেই, সব সংগঠনের ভূমিকা রাখেন, দারুন সংসারী এই মানুষটাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে, নেলি আপাকে কিভাবে যে সে ভালোবাসতেন, নেলি ছাড়া সে যেন অচল, এই লোকটার বাকি জীবন কিভাবে কাটবে, ভাবছি।
নেলি আপা আমাদের রিহার্সাল এ টেবিল সাজিয়ে খাওয়া দিতেন, এবারের নারী দিবসের উপস্থাপনাতে টিপু ভাইর সাথে কাজ করেছেন, নিজের লেখা কবিতা পড়তেন, দলীয় গানে অংশ নিতেন,যখন আমাদের দরকার এক ডাকেই পেয়ে যেতাম নেলি আপাকে। প্রতিদিন, কথা হতোনা, দেখা বা আড্ডাও নিয়মিত ছিল না, কিন্তু যখনি কথা হতো আমরা দুজনে দুজনার কথা খুব বুঝতাম, দারুন এক অদৃশ্য যোগাযোগ যেন কাজ করতো, দেখা যেত আমি যে বিষয়ে ফোন করেছি উনিও সেটাই ভাবছিলেন। নারী দিবসের অনুষ্ঠান আগেই শেষ করে, উনাদের বাসায় তুমুল আড্ডা চললো। মহিউদ্দিন ভাই, ইয়াসমিন ভাবী সহ মা কে নিয়ে আমি আরিফ যোগ দেই সে আড্ডাতে। সে রাতে নেলি আপাকে যেন গানের জাদু ভর করেছিল, উনি একের পর এক গান শুনতে চাইছিলেন আমরাও সবাই গেয়ে চলেছি, শানু ভাবি আর তারিক ভাই ও ছিলেন, লুৎফুর ভাই লাভলী ভাবিও। শেষে তারিক ভাই ও গানে মেতে উঠলেন। অনেক রাত অব্দি নেলি আপা শুনতে চাইলেন, গাইলেন, আমরা কিছু গাইলাম কিছু শুনলাম, উনার বাসার লিভিং রুমের আবছা আলোয় দারুন এক মায়াবী পরিবেশে আমরা সুরের আরেক মণ্ডলে বিচরণ করছিলাম। এই সুন্দর সময় গুলো রয়ে যাবে।
একসাথে আমরা অটোয়াতে টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল গিয়েছিলাম, উনি আর আমি ফটো সেশনে মত্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমার সকল ছেলেমানুষি, পাগলামির সাথে নেলি আপা সাবলীল ভাবে মিশে যেতেন, আমরা যেন সেই ছোটবেলার বান্ধবী হয়ে যেতাম। গল্প জুড়ে দিলে আমাদের বিষয়ের অভাব হতো না, এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে কত আনন্দ, বেদনার গল্প করেছি। বৈশাখে অনুষ্ঠানে লাল জামদানি পরে খোঁপায় সাদা ফুলের মালা পরে যখন আসলেন, আমি চোখ ফিরাতে পারিনি। আমাদের সংগঠনের এবারের অনুষ্ঠান ফেরদৌস আরাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো, উনি এসে পৌঁছে গেছেন উনাকে এয়ারপোর্ট থেকে স্বাগত জানিয়ে পরের দিন আবার দেখা হবে জেসমিন অপার বাসায় , আমি নাস্তা নিয়ে রেডি কাউকে সাথে পাচ্ছিনা, তখন নেলি আপাকে নিয়ে চলে গেলাম সকাল বেলায় জেসমিন অপার বাসায়, নাস্তার টেবিলে দারুন আড্ডা হলো, দেখা গেলো নেলি অপার আত্মীয় জেসমিন আপা আর ফেরদৌস আরা দুজনেই। এই অনুষ্ঠানে আমরা এক রকমের শাড়ি পড়লাম, সাধারণ বাঙালির চাইতে অনেক লম্বা আর সুন্দর সুঠাম দেহি নেলি আপাকে যে কোনো সাজেই আমার ভালো লাগতো, মার্জিত চাল চলন আর সাজ পোশাকে নিমেষেই সবার সম্মান আর কোমল হৃদয়স্পর্শী আচরণে সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন।
বাগান করার নেশা ছিল নেলি অপার, অনেক শরীর খারাপ হলেও তাকেই বাগান থেকে বিরিত রাখা যায়নি, আমাকে কতগুলো ফুলের বীজ দিয়ে বললেন এগুলো মাটিতে ছড়িয়ে দিয়েন, আগামী বছর ছাড়া বেরুবে। সামনের বাগানটা ফুলে ফুলে ভরে যেত সুমারে, উনি সিটি থেকে পুরস্কারও জিতেছেন সুন্দর বাগানের জন্যে। কে দেখবে এই সাজানো বাগান উনি না থাকলে? শুধু মনে হচ্ছে মার্সেলা রাস্তায় আর বুঝি যাওয়া হবে না, – যখন পড়বে না এই পায়ের চিহ্ন এই বাটে… আজ দুপুরে নেলি অপার যে বেদনার্ত রূপ দেখেছি- সারাক্ষন স্মৃতির পাতা উল্টে উল্টে ভাবছিলাম আর দোয়া করছিলাম সৃষ্টিকর্তা যেন আর কষ্ট না দেন উনাকে, তুলে নিক তাড়াতাড়ি।
বাসায় ফিরে অনেক রান্নায় ডুবে রইলাম, যেন বা পরের দিন আমার কত কাজ আজই সব রেঁধে রাখি। ভোরের বেলা টেক্সট এলো লুৎফুর ভাইয়ের, তারপর আবার নাহিদ অপার ফোন, শুনলাম যে মুক্তির জন্য দোয়া করছিলাম সকলে, সে মুক্তি পেয়েছে, নেলি আপা আর আমাদের মাঝে নেই, ভোর ৩.৩০ এ তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন, (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নালিল্লাহে রাজিউন) আমরা দৌড়ে গেলাম, গিয়ে দেখি চেহারার সেই বেদনা মুছে গেছে, শুভ্র শান্ত নেলি আপা যেন ঘুমাচ্ছেন। পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। শেষ বিদায়ের সময় একটু মুখটা ছুঁয়ে, মাথায় হাতবুলিয়ে আদর করে দিলাম, শরীর ঠান্ডা হয়ে এসেছে, নিস্তেজ ত্বক, একটু আধবোজা চুখ, ডুকরে কেঁদে উঠলাম, নেলি আপা, যেতে দিতে ইচ্ছা করে না আপা, কষ্ট হউক তবু থাকেন, কেন চলে যেতে হচ্ছে, কেন যেতে দিতে হয়? তাহলে কেন এই আসা? এতো স্বল্প আয়ু নিয়ে এমন মানুষটি কি আর পাবো? উনার ছেলেটা মায়ের দিকে তখন তাকিয়ে আছে। যেন চোখ ফিরাতে পারে না। আমি হাউ মাও করে করে উঠলাম- কি এই মায়ার জগৎ, কেন এই আসা, সংসারে মায়ার জাল বুনে আবার কেন চলে যাওয়া, এতো কি ত্বরা ছিল নেলি আপা?
গতবার কবরস্থানে গেছি, বন্ধু পরিবারের ছেলে ফাহমি বাবাকে শোয়াতে, তার আগে আমার আব্বার মৃত্যু আমার হাতের উপরেই, এতো কাছের মানুষগুলো, সবাই চলে যাচ্ছে, যে যাওয়াটা আর দূরের লাগছে না, আমরা যেন প্রস্তুত, যেকোনো সময় চলে যাবো। আমি সেলুট করি নেলি অপার মতো আরো যারা ক্যান্সার নিয়ে বেঁচে আছেন, সারাক্ষন নীরবে যুদ্ধ করে চলেছেন এই ব্যাধির সাথে। কত শক্তি সৃষ্টিকর্তা আপনাদের দিয়েছেন যে এরকম যুদ্ধ করতে পারছেন।
একটি বিষয় খুব চোখে পড়ছে, যে প্রবাসীদের মধ্যে পুরুষ, আর নতুন প্রজন্মের ছেলেদের যেভাবে বিষন্নতায় শেষ করে দিচ্ছে, তেমনি অনেক বেশি নারী যেন বা ক্যান্সার এ আক্রান্ত হচ্ছেন। মনোবিজ্ঞানী বা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ভাববার সময় এসেছে ক্যান্সার কেন এভাবে আমাদের নারীদের আক্রান্ত করছে, এর প্রতিকার আছে কি কোন, লাইফ স্টাইল বা জীবন যাপনের ধরণ ধারণে কোনো পরিবর্তন কি এর কারণ কিনা আর এর থেকে প্রতিকার আর প্রতিরোধের উপায়গুলো নিয়ে ও ভাবার সময় এসেছে। আমাদের নেলি অপার এই অকাল মৃত্যু আমাদের ভীষন ভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে – আমাদের প্রতিদিনের জীবন যাত্রা চলবে, যেভাবে চলছিল। কিন্তু নেলি আপার অভাব, উনার পরিবার থেকে শুরু করে বাঙালি কমিউনিটি, বাঙালি কালচারাল সোসাইটি আর উনার সকল শুভাকাংখীর মনে যে দাগ কেটেছে তা চিরদিন মনে থাকবে, যেখানেই গেছেন নেলি আপা অনেক ভালো থাকেন – কখনো ভাবিনি নেলি আপা আপনি আমার লেখায় এভাবে আসবেন।
ফারহানা পল্লব, টরন্টো কানাডা অক্টোবর ২৩, ২০১৮