রাজনৈতিক ধস, রাজনীতিকের সততা এবং দিনবদলের রাজনীতি

জুন 3, 2018


মোহাম্মদ আলী বোখারী

কানাডার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত অন্টারিও প্রদেশের প্রিমিয়ার ক্যাথলিন ওয়েন তার পুনর্নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে অর্থাৎ প্রদেশব্যাপি ৭ জুনের অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে নিজের পরাজয়টি অপ্রত্যাশিতভাবেই স্বীকার করেছেন। তবে তাতে তিনি ভোটারদের প্রতি তার লিবারেল পার্টির সর্বাধিক সংখ্যক এমপিপি বা প্রাদেশিক সংসদ সদস্য নির্বাচনের আহবান রেখে নিজের আসনে শেষ ভোটদান অবধি লড়বেন বলে দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। ফলে দিনবদলের রাজনীতিতে এমন রাজনৈতিক ধস ও স্বগতোক্তিমূলক সততার উদাহরন আধুনিক বিশ্বের রাজনীতিতে কখনো ঘটেছে কিনা, এ নিয়ে কানাডার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এখন নিমগ্ন। আর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে তার দুই পরাক্রমশীল প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডগলাস ফোর্ড ও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেত্রী এন্ড্রিয়া হরওয়াথ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিষয়টিকে নিজেদের প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ণ করেছেন।
ওই স্বীকারোক্তিকালে অশ্রুসিক্ত ও বাষ্পরুদ্ধ প্রিমিয়ার ক্যাথলিন ওয়েন ভোটারদের প্রতি পরবর্তী সরকারকে জবাবদিহিতায় রাখারও আহবান জানান। তিনি সুস্পষ্ট করে বলেন, ‘যদি আমাকে পুনর্নির্বাচন কিংবা একটি লিবারেল সরকার প্রতিষ্ঠার ভাবনা আপনাদের থেকে থাকে, তবে সেটি কিন্তু ঘটছে না। তাই লিবারেল দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচিত করা প্রয়োজন, যাতে অপর দুই দলের কেউ যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করতে না পারে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ ছিল না; তবু যেহেতু ভোটাররা দিনবদলের রাজনীতির প্রতি উদগ্রীব, সেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বী কার কাছে ক্ষমতা তুলে দেবেন তাতে দ্বিধান্বিত, সেক্ষেত্রে এটাই আমার যুক্তিযুক্ত পরবর্তী পদক্ষেপ’। তার দৃষ্টিতে ভোট যেদিকেই যাক না কেন, অন্তত জবাবদিহিতার জন্য সংখ্যালঘু সরকার গঠন করাটাই হবে শ্রেয়। তাতে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেত্রী এন্ড্রিয়া হরওয়াথ বিষয়টিকে ‘ভয়ংকর খেলা’ উল্লেখ করে বলেন, কনজারভেটিভরা সেক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে। এন্ড্রিয়ার মতে, ক্যাথলিন ওয়েন পুনর্বহাল থাকার বাসনায় তেমন আহবানটি রেখেছেন, যা ভোটাররা আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। এ কারণে ওয়েন বা ফোর্ডের জন্য ভোটদান হবে অভিন্ন পরিণতি। তাই মন্দের চেয়ে অধিকতর মন্দ কারোরই কাম্য নয়। আর এ বিষয়ে অপর প্রতিপক্ষ ডগলাস ফোর্ডের তেমন বলার কিছু ছিল না; শুধুই বলেছেন, জনগণ দিনবদলের অপেক্ষায়, তারা লিবারেলদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ।

এই পরিস্থিতিতে লিবারেল পার্টির অন্দরমহলের খবরটি হচ্ছে, তারা ভীষণভাবেই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। প্রাদেশিক সংসদে তাদের ‘দলীয় অবস্থান’টি রক্ষা হয় কিনা, সেটাই এখন প্রশ্ন। সেজন্য অন্তত আটটি আসন অর্জন অপরিহার্য। আবার কেউ বলছেন, দলটি নাকি শূন্য আসন পেতে পারে। সে কারণে নির্বাচনের দিন অবধি ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি সর্বাত্মক আত্মনিয়োগে উদারপন্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে মনোনিবেশ করবেন। একজন দলীয় সিনিয়র কর্মকর্তার মতে, শেষ বিতর্কেই প্রিমিয়ার ওয়েন বুঝে ফেলেন তার দল আর ক্ষমতাসীন হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে গুলেল্ফ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক তামারা স্মল মনে করেন, সরকারের পরাজয় আঁচ করেই ক্যাথলিন ওয়েন কৌশলী ও ‘প্রথাবিরুদ্ধ’ পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে দলের চেয়ে তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিটিই বিবেচ্য হয়েছে। হয়তোবা সেই পদক্ষেপটি শেষ রক্ষায় গ্রহণ করা, যাতে জনগণ তাদের পরিত্যাগ না করে এবং ভুলগুলো সংশোধন করার আশ্বাস। এ কারণে তিনি নিজে গ্লানির শিকার হয়ে দল ও দলের প্রার্থীদের অগ্রগণ্য করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তামারা স্মলের মতে, ‘নির্বাচনের দৃষ্টিতে তা কৌশলী পদক্ষেপ, তবে দলনেতা হিসেবে তা আত্মবিসর্জিত’।
বাস্তবে প্রিমিয়ার ক্যাথলিন ওয়েন একজন হার্ভাড শিক্ষিত নারী হিসেবে ২০১৪ সালে বিপুল জনপ্রিয়তায় ‘হোয়াট লিডারশিপ ইজ’, অর্থাৎ সংজ্ঞায় নয় বরং বাস্তবতায় নেতৃত্বকে দেখুন, এই মূলমন্ত্রে অন্টারিও প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ লিবারেল সরকার গঠন করেন। তার শাসনামলে প্রদেশে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৭টি দেশের তুলনায় সর্বাধিক অর্থনৈতিক সাফল্য, কর্মসংস্থান, মজুরিভাতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা ভাতা, শিশুপরিচর্যা, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার উন্নয়নসহ বহুবিধ সমৃদ্ধি ঘটেছে, যা বাস্তবিক অর্থেই ঈর্ষনীয়। তবু বিগত ১৫ বছরে লাগাতার লিবারেল পার্টির শাসনামলে ঘটে যাওয়া অতীত অব্যবস্থাপনা ও অর্থঅপচয় এবং নিজের শাসনামলে উন্নয়ন স্বার্থে বিদ্যুৎখাত ‘হাইড্রো ওয়ান’ বেসরকারিকরণ সকল অনর্থ ও বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ভোটারদের কাছে বিবেচিত হয়েছে। এ কারণে দিনবদলের রাজনীতিতে তার এই রাজনৈতিক ধস ও দলরক্ষায় ‘প্রথাবিরুদ্ধ’ পরাজয়ের আগাম সততাপূর্ণ স্বগতোক্তিটি ঘটেছে। তবে কি তার রাজনৈতিক সততা এখানে নিরর্থক?
পুনশ্চ: এই প্রথমবারের মতো অন্টারিও প্রাদেশিক পার্লামেন্টে বাংলাদেশি ডলি বেগম স্কারবরো সাউথওয়েস্ট নির্বাচনি আসনে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নিশ্চয়ই সকলের শুভকামনা থাকবে।

মোহাম্মদ আলী বোখারী

টরন্টো
ই-মেইল: bukhari.toronto@gmail.com