যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন কানাডা থেকে?

যাবার আগে একাধিকবার ভাবুন : ইউএস বর্ডার গার্ড এর সদস্যরা আপনাকে গ্রেফতার করতে পারেন কানাডার মাটিতেই

10 ফেব্রুয়ারী, 2018

॥ খুরশিদ আলম ॥

কানাডা থেকে আপনি যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন? যাবার আগে একাধিকবার ভাবুন। কারণ, ইউএস বর্ডার গার্ডের সদস্যরা সন্তুষ্ট না হলে এখন থেকে কানাডার মাটিতেই আপনাকে গ্রেফতার করতে পারবেন। আর আইন পাস করিয়ে এই গ্রেফতারের ক্ষমতা তাদেরকে দিয়েছে কানাডা নিজেই।

ইতিপূর্বে কানাডার পার্লামেন্ট ও সিনেট কমিটিতে পাশ হওয়া এই গ্রেফতারের ক্ষমতা সংক্রান্ত বিল সি-২৩ সম্প্রতি রাজ সম্মতি (royal assent) পেয়েছে। রাজ সম্মতির মাধ্যমে পার্লামেন্ট ও সিনেটে পাশ হওয়া কোন বিল চূড়ান্ত রূপ লাভ করে আইনে পরিণত হয়। কানাডায় এটিই নিয়ম।

আর এই ক্ষমতা প্রদানের প্রক্রিয়াটি অনেক দিন ধরেই চলছিল। এর শুরুটা হয় ২০১৫ সালে। ঐ বছর ১৬ মার্চ কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ সম্পর্কিত একটি চুক্তি হয়। কানাডায় তখন স্টিফেন হারপারের নেতৃত্বাধীন কনজার্ভেটিভ সরকার ক্ষমতায় ছিল।

নানান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিলটি অবশেষে রাজ সম্মতি পায় গত ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭। এটি  Pre-Clearance Act নামেও পরিচিত।

এর আগে যে আইনটি ছিল তাতে কানাডার কোন নাগরিক বা ইমিগ্রেন্ট প্রি-ক্লিয়ারেন্স এলাকায় প্রবেশের পর ইউএস বর্ডার গার্ডদের আপত্তিকর প্রশ্নে বিব্রত বা অসন্তুষ্ট হলে তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ফিরে আসতে পারতেন। কিন্তু সদ্য পাস হওয়া নতুন আইনে ইউএস বর্ডার গার্ডদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না দিয়ে কেউ ফিরে আসতে পারবেন না। তাকে বলতে হবে কেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ না করে ফিরে আসতে চাইছেন। প্রশ্নের উত্তর না দিলে বা প্রশ্নের উত্তরে ইউএস বর্ডার গার্ড এর সদস্যরা সন্তুষ্ট না হলে তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে।

প্রি-ক্লিয়ারেন্স এর বিষয়টি হলো, কানাডিয়ান নাগরিক বা ইমিগ্রেন্টদের কেউ যদি ভ্রমণ বা কার্য উপলক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান তবে ইউএস কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের পক্রিয়াসমূহ কানাডার বিমানবন্দর বা রেল স্টেশনে থাকা অবস্থায়ই সেরে নিতে পারেন। বর্তমানে কানাডার আটটি বিমান বন্দরে এই সুবিধা রয়েছে। আরো দুটি বিমানবন্দরে এই সুবিধা দেয়া হবে অচিরেই। কানাডার কয়েকটি রেল স্টেশনেও রয়েছে এই সুবিধা।

উল্লেখ্য যে, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে সীমান্তে প্রি-ক্লিয়ারেন্স এর এই প্রক্রিয়াটি গত প্রায় ষাট বছর ধরেই চলে আসছে। সীমান্তে অত্যধিক ভিড় এড়াতেই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে।

ঐ প্রি-ক্লিয়ারেন্স এর আগের আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রগামী কোন যাত্রীকে স্ট্রিপ সার্চ (গায়ের কাপর খুলে) করতে পারতেন শুধুমাত্র একজন কানাডীয় বর্ডার কর্মকর্তা। ঐ সময় কোন ইউএস বর্ডার এজেন্ট ইচ্ছে করলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে পারতেন। নতুন আইনে এখন একজন ইউএস বর্ডার এজেন্ট নিজেই এই স্ট্রিপ সার্চ এর কাজটি করতে পারবেন যদি কোনা কানাডীয় কর্মকর্তা তা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ না করেন বা তা করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। আর ইউএস বর্ডার এজেন্ট এর প্রশ্নের (যত আপত্তিকর বা অবমাননাকরই হোক) উত্তর দিতে না চাইলে একজন ভ্রমণকারী কানাডার আইনও ভঙ্গ করবেন এবং কানাডার ফেডারেল আইনে তিনি অভিযুক্ত হবেন।

অর্থাৎ বিপদ এখন দুই কুল থেকেই। ইউএস বর্ডার গার্ডদের আপত্তিকর বা অবমাননাকর প্রশ্নবানে একজন কানাডীয় নাগরিক বা ইমিগ্রেন্ট যতই বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ অথবা ক্রুদ্ধ হন না কেন মুখ বুঝে তা সহ্য করতে হবে। এতে তার মানবাধিকার লংঙ্ঘিত হলেও কিছুই বলা যাবে না।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নতুন এই আইনের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হবেন কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়। আমরা ইতিপূর্বেও দেখেছি কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামী মুসলমানদের কেউ কেউ ইউএস বর্ডার গার্ডদের হতে নাজেহাল হয়েছেন। টরন্টো থেকে যারা প্রায়ই বিভিন্ন কাজে বা আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যুক্তরাষ্ট্রে যান এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই কোন না কোন সময় ইউএস বর্ডার গার্ডদের প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়েছেন। আলাদা রূমে নিয়ে ঘন্টারও অধিক সময় আটকে রেখে এমন সব প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হয়েছে যা ভ্রমণের সঙ্গে সম্পর্কিত তো নয়ই, কখনো কখনো তা শোভনতার মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

গত বছর ফেব্র“য়ারী মাসের একটি ঘটনা। মরক্কো বংশোদ্ভূত হিজাব পরিহিতা এক কানাডিয়ান মুসলিম মহিলা ফাদওয়া আলাওই মন্ট্রিয়ল এর উপশহর ব্রোসার্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিলেন। সাথে তার দুই শিশু সন্তান ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক কাজিনও ছিল। ফাদওয়া আগেও অনেকবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন বিনা বাধায় তার বাবা মা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু এবার তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডার গার্ড এর সদস্যরা বাধা দেন। প্রায় চার ঘন্টা আটকে রেখে তাকে নানান প্রশ্ন করেন। আর ঐ সব প্রশ্নের প্রায় সবই ছিল তার ধর্ম সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্ফ সম্পর্কে তার কি অভিমত তাও জানতে চাওয়া হয় বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে। কিন্তু এত কিছু জিজ্ঞেস করার পরও ইউএস বর্ডার গার্ড এর সদস্যগণ তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি এবং তাকে বর্ডার থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। ফিরিয়ে দেয়ার আগে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তুলে রাখা হয়। সিবিসি নিউজে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাদওয়া বলেন, আমি ইউএস বর্ডার গার্ডদের আচরনে খুবই অপমানিত ও বিষন্ন হই।

ফাদওয়া আরো বলেন, ইউএস বর্ডার গার্ডরা তার এবং তার কাজিনের সেল ফোন চেক করেন প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে। এর পর দুইজনকে আলাদা ভাবে নানান প্রশ্নবানে বিদ্ধ করেন আরো প্রায় এক ঘন্টা সময় ধরে। তারা নিয়মিত ধর্ম চর্চা করেন কি না, কোন মসজিদে যান, মসজিদের ইমাম এর নাম কি, মসজিদে কি নিয়ে আলোচনা হয় এই সব নিয়ে বার বার প্রশ্ন করা হয়। কুইবেক সিটির এক মসজিদে গত বছর যে ছয় জন মুসল্লিকে হত্যা করা হয় তাদের কাউকে আমি চিনতাম কি না সেই প্রশ্নও জিজ্ঞেস করা হয়।

ফাদওয়ার সেল ফোনে একটি ভিডিও ক্লিপ ছিল যেখানে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল। ইউএস বর্ডার গার্ড এর সদস্যা জানতে চেয়েছিল ঐ দৃশ্যটি কিসের।

ফাদওয়া ও তার কাজিনকে নানান প্রশ্ন করার পর প্রায় এক ঘন্টা বসিয়ে রাখা হয়। এরপর একজন গার্ড এসে বলেন, আপনাকে এবং আপনার সহযাত্রীদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। কারণ, আপনার সেল ফোনে এমন ভিডিও রয়েছে যেখানে আমেরিকার বিরুদ্ধাচারণ করা হয়েছে।

ফাদওয়ার বিষয়টি জানার জন্য সিবিসি নিউজের পক্ষ থেকে ইউএস কাস্টমস এ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন এর নিকট একটি ইমেইল পাঠানো হয়েছিল। জবাবে জানানো হয়, তারা কোন ব্যক্তি বিশেষ এর বিষয়ে কোন কিছু বলতে অপরাগ। আইন তাদেরকে এই সুযোগ দেয় না।

ইমেইলের উত্তরে আরো বলা হয়, ইউএস কাস্টমস এ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন এর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয় হলো, দেশের অভ্যন্তরে যাতে জঙ্গী ও তাদের অস্ত্র প্রবেশ করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা। যারা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে আসেন নানান কাজে আমরা তাদের প্রতি বর্ডারে কোনরকম বৈষম্যমূলক আচরণ করি না তাদের ধর্ম, এথনিসিটি, লিঙ্গ প্রভৃতি বিচার করে।

যুক্তরাষ্ট্রে কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন প্রায় ১২ লক্ষ ভিজিটর এসে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এর মুখমুখি হন। এদের মধ্যে গড়ে তিন শত থেকে পাঁচ শত ভিজিটরকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না।

কানাডীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে গিয়ে নানান রকম ঝক্কি-ঝামেলা ও অশোভন আচরণের মোকাবেলা করে আসছেন। এখন প্রি-ক্লিয়ারেন্স আইনে কিছু পরিবর্তন আনায় এই ঝক্কি-ঝামেলা ও অশোভন আচরণের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে এমনটাই আশা করছেন কেউ কেউ। কানাডিয়ান ক্রস-বর্ডার লিগ্যাল কোয়ালিয়শন এর টরন্টো কোঅর্ডিনেটর কোরী শেফম্যান বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর কানাডিয়ান বিশেষ করে কানাডিয়ান মুসলিমদের প্রতি ইউএস কাস্টম কর্মকর্তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

কানাডার একজন ইমিগ্রেশন আইনজীবী মাইকেল গ্রীন ইতিপূর্বে বলেছিলেন, “কানাডার পাবলিক সেফটি মিনিস্টার রালফ গুডেল কর্তৃক পার্লামেন্টে প্রস্তাবিত নতুন এই আইন কানাডিয়ানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারকে হরণ করবে। সেটা হলো, তারা আগের মত প্রি-ক্লিয়ারেন্স এলাকা (যেটি কানাডার মাটিতেই অবস্থিত) থেকে নিজের ইচ্ছায় ফিরে আসতে পারবেন না যদি ইউএস বর্ডার গার্ডদের করা প্রশ্ন পছন্দ না করেন। ইউএস বর্ডার গার্ডরা শক্তি প্রয়োগ করতে পারবেন প্রশ্নের উত্তর আদায় করার জন্য। প্রয়োজন মনে করলে গ্রেফতারও করতে পারেন কানাডার মাটিতেই। মাইকেল গ্রীন বলেন, এটি বাস্তবিক অর্থেই আক্রমণাত্মক এবং অপমানকর একটি আইন।”

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য দাবী করেন যে, এই আইনের কারণে ‘কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম’এ কানাডার নাগরিকগদের যে অধিকার দেয়া আছে সেই অধিকার ইউএস বর্ডার এজেন্টদের তল্লাসীর কারণে ক্ষুন্ন হবে না। তিনি বলেন, “কেউ যখন প্রি-ক্লিয়ারেন্স এর জন্য যাচ্ছেন কানাডার অভ্যন্তরে থেকে তখন তিনি কানাডার চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম এর প্রটেকশনের আন্ডারেই থাকছেন।”

প্রধানমন্ত্রী ইতিপূর্বে আরো বলেছিলেন, বিল সি-২৩ পাস হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন কানাডিয়ানদের এবং যারা যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন তাদের স্বার্থেই। সীমান্তের নিরাপত্তার জন্য এবং পাশাপাশি বর্ডারে ইমিগ্রেশন এ্যান্ড কাস্টম এর কার্যাদি ত্বরান্বিত করার জন্যও এটি প্রয়োজন।

কিন্তু সমালোকরা বলছেন, ইউএস বর্ডার এজেন্টদেরকে অধিকতর ক্ষমতা দেয়ার অর্থ হলো যাত্রীদের নাজেহাল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া, বিশেষ করে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত একজন ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছেন। তাছাড়া ট্রাম্প নিজেই বলেছেন তিনি বিশ্বাস করেন না যে ইউএস- কানাডা বর্ডার নিরাপদ।

তবে কনজারভেটিভ পার্টি এই বিল পাসের পক্ষে। কারণ, তারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই ২০১৫ সালে এই আইন প্রণয়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র সময় নষ্ট না করেই তা কংগ্রেসে পাস করিয়ে নেয় ঐ বছরেরই ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু কানাডা একটু ধীর গতিতে অগ্রসর হয়। কানাডা এই সংক্রান্ত বিলটি পার্লামেন্টে তুলে ২০১৬ সালের জুন মাসে।

উল্লেখ্য যে, কানাডার বিমানবন্দর এবং অন্যান্য বন্দরে প্রি-ক্লিয়ারেন্স সম্পর্কিত নতুন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর কয়েকমাস আগে বিপুল সংখ্যক মানুষের ই-মেল বার্তা পেয়েছে। নতুন আইনে মার্কিন সীমান্ত রক্ষীদেরকে যে ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ঐ সময় সিবিসি নিউজে একটি খবর প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ই-মেলের বন্যা বয়ে যায়। সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জনগণের পক্ষ থেকে পাঠানো বার্তার সংখ্যা “নজীরবিহীন” এবং জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তারা এটা দেখে বিস্মিত হয়েছেন।

সরকারি নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তখন ধারণা করা হয়েছিল যে, বিলটি সম্ভবত বাস্তবায়িত হবে না শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সে ধারণা ছিল ভ্রান্ত।

উদ্বেগের কারণ মূলত ইউএস বর্ডার গার্ড কর্তৃক কানাডার নাগরিক বা ইমিগ্রেন্টদেরকে আটক করার ক্ষমতা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো বেশিরভাগ চিঠিতে লেখকরা কানাডার মাটিতে কর্মরত মার্কিন সীমান্তরক্ষা কর্মকর্তাদেরকে দেয়া নতুন ক্ষমতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, বর্ডার গার্ডদের অস্ত্র বহন করার ক্ষমতা এবং সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়, মার্কিন কর্মকর্তারা যদি জিজ্ঞাসাবাদের সময় কানাডীয় পর্যটকের জবাবে সন্তুষ্ট না হন তাহলে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আটক করতে পারবেন এমন ক্ষমতা প্রদান।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একজন লিখেছেন, “কানাডার মাটিতে অবস্থানকালে কোনও কানাডীয়কে আটক করার ক্ষমতা মার্কিন কর্তৃপক্ষকে দেয়ার মাধ্যমে কানাডার নাগরিক হিসাবে আমাদের অধিকার লংঘন করা হয়েছে।” তিনি লিখেছেন, “জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার প্রতি আমার সমবেদনা থাকলেও আমি দেখতে পাচ্ছি যে, এটি হলো আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আরেকটি বিপজ্জনক আঘাত।”

আগের আইন অনুসারে প্রি-ক্লিয়ারেন্স এরিয়াতে ইউএস বর্ডার গার্ড এর সদস্যরা কোনরকম সাইডআর্মস (ব্যায়নট, পিস্তল বা রিভলবার) রাখতে পারতেন না। কিন্তু বর্তমান আইন তাদেরকে সেই অধিকার দিয়েছে। তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরকে সন্দেহ হলে কাপড় খুলেও তল্ল্লাসী করতে পারবেন।

ধরণা করা যেতে পারে যে, এই আইন প্রধানত কানাডার দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিমদেরকে টার্গেট করে করা। সীমান্তে চোরাকারবারী বা ড্রাগ পাচারকারীদেরকে টার্গেট করে নতুন এই আইন করা হয়নি। কিন্তু তারপরও দেখা গেছে কানাডার মূলধারার লোকদের মধ্যেও নতুন এই আইন নিয়ে যথেষ্ট অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে মানবাধিকার নিয়েও। কানাডার মাটিতেই কানাডিয়ানদের অধিকার বিদেশীদের দ্বারা লঙ্ঘিত হওয়ার প্রশ্ন উঠেছে।

অন্যদিকে যে সকল কানাডিয়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার্ক পার্মিট নিয়ে কাজ করতে যান তারাও নতুন এই আইনের কারণে প্রি-ক্লিয়ারেন্স এলাকায় নতুন ঝামেলায় পড়তে পারেন বলে আশংকা করছেন। কাজে যেতে না পারার আশংকাও করছেন অনেকে। নিউজ ১১৩০.কম এর এক রিপোর্টে বলা হয়, গত ডিসেম্বরে প্রি-ক্লিয়ারেন্স এ্যাক্ট রাজ সম্মতি পাওয়ার পর ভেঙ্কুভারে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সদস্যরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। এই প্রতিবাদ সমাবেশের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে সেখানকার বিসি ফেডারেশন অব লেবার। প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন এই ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট আইরীন ল্যান্ডসিঙ্গার। তিনি বলেন, এই আইন পশ্চাদভিমুখে প্রত্যাবর্তন করার সামিল। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে এই আইন চূড়ান্তভাবে পশ্চাদমুখী।

ইন্টারন্যাশনাল সিভিল লিবার্টিস মনিটরিং গ্র“পের প্রতিনিধি টিম ম্যাকসরলি বলেন, ইউএস বর্ডার গার্ডরা প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রগামী কোন যাত্রীকে। এরকম পরিস্থিতিতে কেউ যদি সত্যি কথা না বলেন বা প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন তবে সেটি ইউএস বর্ডার গার্ডদের কাছে অপরাধ হিসাবে গন্য হতে পারে এবং তারা নানারকম সন্দেহও করতে পারে। কাউকে কাপড় খুলে তল্লাসী করতে চাইলেও কিছু বলা যাবে না এবং এর বিরুদ্ধে আদালতেও কোন অভিযোগ করা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বন্দরে বা নৌবন্দরে কানাডিয়ান বর্ডার গার্ডদের জন্য এরকম প্রি-ক্লিয়ারেন্স জোন নেই। নতুন আইনে অবশ্য কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ এই রকম প্রি-ক্লিয়াসেন্স জোন স্থাপনের প্রস্তাব তুলতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত যে কোন আমেরিকান এতে খুশী হবে না।

এদিকে এক জরীপেও দেখা যাচ্ছে বেশীরভাগ কানাডিয়ানই মনে করছেন বিল সি-২৩ এর মাধ্যমে কানাডার মাটিতে আমেরিকান বর্ডার গার্ডদেরকে অতিমাত্রায় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। Angus Reid Institute পরিচালিত জরীপে এই তথ্য উঠে আসে।

সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সমালোকচরা বলছেন এই আইন বিরক্তিকর এবং উপদ্রবকারী।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই আইনের প্রধান টার্গেট কানাডার মুসলিম সম্প্রাদায়। যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ ভূখন্ডে জঙ্গী হামলার আশংকায় থাকে সবসময়ই আর সেই হামলা প্রতিরোধ করার জন্যই সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের এই পদক্ষেপ। এই অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই আছে। একটি দেশের নাগরিকদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সেই দেশের সরকারেরই। আর সেটি করতে গিয়ে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করতেই পারে যে কোন দেশের সরকার। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে অন্য দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে কি না তা কি খতিয়ে দেখা উচিৎ নয়? কানাডার মাটিতেই কানাডিয়ানদের অধিকার মার্কিনীদের দ্বারা লঙ্ঘিত হবে সেটি কি লজ্জাজনক নয় কানাডা সরকারের জন্য?

বলা হচ্ছে “কেউ যখন প্রি-ক্লিয়ারেন্স এর জন্য যাচ্ছেন কানাডার অভ্যন্তরে থেকে তখন তিনি কানাডার চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম এর প্রটেকশনের আন্ডারেই থাকছেন।” কিন্তু আমরা জানি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই একজন চরম বর্ণবাদী ব্যক্তি। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই একের পর এক বর্ণবাদী মন্তব্য করে চলেছেন। সেটি যেমন মুসলিমদের বিরুদ্ধে, তেমনি আফ্রিকান জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধেও। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই বর্ণবাদী পরিচয় আসলে নতুন নয়। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার আরো বহু আগে থেকেই বর্ণবাদী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু অশ্চর্যের বিষয় হলো, এরকম এটি বর্ণবাদী, অহংকারী, অশোভন আচরণকারী, খেপাটে এবং মিথ্যাবাদী ব্যক্তিকেই আমেরিকার জনগণ বেছে নিলেন তাদের প্রেসিডেন্ট হিসাবে! আর এই রকম একজন ব্যক্তির অধিনে যে দেশ সেই দেশের বর্ডার গার্ডগণ যুক্তরাষ্ট্রে যেতে ইচ্ছুক তালিকাভুক্ত দেশের নাগরিকদের সঙ্গে শোভন আচরণ করবেন তা কি হয়? তাদের উদ্ধতপনা ও দাম্ভিকতার কারণে ‘কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম’এ কানাডার নাগরিকগদের যে অধিকার দেয়া আছে সেই অধিকার ক্ষুন্ন হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়?

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ