বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ কানাডায় শিশু দারিদ্রতা

টরন্টোর বাঙ্গালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থ এলাকায় শতকরা প্রায় শতকরা ৫৫ ভাগ শিশু দরিদ্র অবস্থায় বাস করছে। শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় এই দারিদ্রতা। ২০০০ সালের মধ্যে কানাডা থেকে শিশু দারিদ্রতা দূর করার জন্য পার্লামেন্টে যে পরিকল্পা গ্রহণ করা হয়েছিল ৩৮ বছর আগে, সেই পরিকল্পনা আজো সফলতার মুখ দেখেনি। এই ব্যর্থতা কানাডার মতো একটি ধনী দেশের জন্য নিশ্চিতভাবেই লজ্জাকর।

মার্চ 13, 2018

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে টরন্টোতে আসা অনেক পরিবারের শিশু দারদ্রতার শিকার হয়ে বিভিন্ন মৌলিক সহায়তা ও সেবা যেমন- শিক্ষা, ভাল বাসস্থান, সামাজিক ও বিনোদনমূলক সুযোগ, চাইল্ড কেয়ার ইত্যাদিতে সমান সুযোগ সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই শিশুদের বাবা-মা প্রায় সকলেই বাংলাদেশের স্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা। টরন্টোতে সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য দেশ থেকে আসা অনেক পরিবারের শিশুদেরও একই অবস্থা।

২০১৬ সালের আদম শুমারীর উপর ভিত্তি করে রচিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরী করে Social Planning Toronto  নামের একটি অলাভজনক সংগঠন।

টরন্টো স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, এখানে এথনিক বা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু পরিবারের শিশুরা কানাডিয়ান পরিবারের শিশুদের তুলনায় দ্বিগুণ হারে দারিদ্রতায় ভুগছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শতকরা হিসাবে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর মধ্যে ২৩.৩% শিশু দারিদ্রতায় ভুগছে। কানাডিয়ান পরিবারগুলোতে এই হার ১১.৪%। আর টরন্টোতে বসবাসরত আদীবাসী পরিবারগুলোতে শিশু দারিদ্রতার হার ৮৪%।

অন্যদিকে নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট পরিবারের শিশুদের মধ্যে দারিদ্রতার হার প্রায় ৫০%। এরা কানাডায় এসেছেন গত ৫ বছরের মধ্যে এবং এদের মধ্যে অনেকেই দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য।

টরন্টোর ড্যানফোর্থ ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় প্রচুর সংখ্যক উচ্চশিক্ষিত তরুন বাংলাদেশী ইমিগ্রেন্ট থাকেন। টরন্টো স্টার এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এই এলাকায় শিশু দারিদ্রতার হার টরন্টোতে তৃতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এই এলাকার শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগ শিশু দরিদ্র অবস্থায় বাস করছে।

উল্লেখ্য যে, এই এলাকায়ই রয়েছে প্রায় সব বাংলাদেশী গ্রোসারী, বাঙ্গালী ডাক্তার, বাঙ্গালী ব্যারিস্টার, বাঙ্গালী রিয়েলটর, বাঙ্গালী একাউন্টেন্টসহ আরো বহুবিদ প্রফেশনের লোকজন। বাঙ্গালীদের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের প্রায় সবই হয়ে থাকে এই এলাকাতেই। বাঙ্গালীদের পরিচালিত গোটা চারেক মসজিদও রয়েছে এই এলাকাতে। ঈদের বড় জামাতগুলো এখানে হয়ে থাকে খোলা মাঠে। দুটি সাবওয়ে স্টেশন, একটি গো ট্রেন স্টেশন রয়েছে এই এলাকায়। প্রায় প্রতিটি রাস্তায় রয়েছে বাসের সুবিধা।

ফলে নতুন আসা ইমিগ্রেন্টরা প্রধানত এই এলাকাকেই বেছে নেন বসবাস শুরু করার জন্য। এতে সুবিধা অনেক। হাতের নাগালেই সব পাওয়া যাচ্ছে। গাড়ি ছাড়াও চলা যায় নতুন অবস্থায়। চাকরীর সন্ধানসহ অন্যান্য বিষয়েও সহযোগিতা পাওয়া যায় প্রতিবেশী বাঙ্গালীদের কাছে থেকে। চারপাশে অনেক বাংলাদেশী থাকায় নতুন আসা বাঙ্গালীদের মধ্যে হোমসিকনেসও তেমনটা প্রভাব বিস্তার করে না। নতুন আসা এই পরিবারের শিশুরা নতুন স্কুলে ভর্তি হলেও অনেক বাঙ্গালী সহপাঠী পেয়ে যায় যাদের কাছ থেকে তারা নানাভাবে উপকৃত হয়। সব মিলিয়ে ড্যানফোর্থ ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকাটি নুতন আসা ইমিগ্রেন্টদের জন্য বেশ সুবিধাজনই বলতে হয়।

কিন্তু নতুন আসা উচ্চশিক্ষিত এই ইমিগ্রেন্টদের সবচেয়ে বড় যে সমস্যটি মোকাবেলা করতে হয় সেটি হলো- নিজ নিজ পেশার চাকরীতে প্রবেশ করতে না পারা। নতুন এই ইমিগ্রেন্টদের প্রায় নব্বুই থেকে পচানব্বুই ভাগই তাদের নিজ পেশাভিত্তিক চাকরী পান না। ফলে বাধ্য হয়ে জীবন ধারণের জন্য এমন সব পেশায় তাদেরকে প্রবেশ করতে হয় যেখানে বেতন অনেক কম। তাছাড়া কোন সুযোগসুবিধাও প্রদান করা হয়না। নেই কোন drug plan এরও সুবিধা। সংসার চালানো জন্য একার আয় মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই চাকরী করতে হয়। কিন্তু তারপরও তাদের আয় থেকে যায় দারিদ্রসীমার নিচে। টরন্টোতে ট্যাক্স প্রদানের পর যে সকল পরিবারের আয় বছরে ৩১,৩০১ হাজার ডলার (দুই সদস্যের পরিবার) এবং ৪৪,২৬৬ হাজার ডলার (চার সদস্যের পরিবার)তাদেরকে দরিদ্র বলে বিবেচনা করা হয় স্ট্যাটিসটিকস কানাডার মাপকাঠিতে। ২০১৫ সালের হিসাব এটি।

এই মাপকাঠিতে দরিদ্র পরিবার যে শুধু নতুন ইমিগ্রেন্টদের মধ্যেই আছে তা কিন্তু নয়। পুরানো অনেক ইমিগ্রেন্ট পরিবার আছে যাদের আয় দারিদ্রসীমার নিচে। ফলে তাদের পরিবারের শিশুরাও ভোগান্তির মধ্যেই আছে।

আবার নতুন ইমিগ্রেন্টদের কোন কোন পরিবারের স্ত্রী পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বিধায় (যারা গৃহবধু ছিলেন) চাকরী খুঁজে পান না সহজে। বা শারীরিক পরিশ্রমের চাকরী করা সম্ভব হয় না অভ্যাস না থাকায়। অথবা বাচ্চাদের দেখাশুনা করতে হয় বলে চাকরী করতে পারেন না। ডে কেয়ারে বাচ্চা রেখে চাকরীতে যাওয়া সম্ভব হয় না। টরন্টোতে এ্যাফোর্ডএ্যাবল চাইল্ড কেয়ার একটি প্রধান ইস্যু যা ইমিগ্রেন্টরা মোকাবেলা করছেন।

এ সকল কারণে টরন্টোতে নতুন আসা অধিকাংশ ইমিগ্রেন্ট পরিবার এবং অনেক পুরাতন ইমিগ্রেন্ট পরিবারেও শিশু সন্তানেরা দারিদ্রতার শিকার হয়ে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আর এই বঞ্চনা শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠার পিছনে বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। পদে পদে তারা বাধাগ্রস্থ ও বিপদগ্রস্ত হয়। অভাবী সংসারে সাধারণত বাবা-মায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে না। ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। এর সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়ে পরিবারের শিশু সন্তানদের উপর। কানাডার একজন মনস্তত্তবিদ ড. ম্যারিলিন চোহেম তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, “কানাডায় দারিদ্র্য হলো শিশুদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত যেমন, মনোযোগের অভাব ও অস্বাভাবিক সক্রিয়তাজনিত অসুস্থতা, বিষন্নতা, উদ্বেগ ও আচরণগত ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি।”

তিনি আরো বলেন, “দরিদ্র অভিবাসী শিশু বা দরিদ্র কানাডীয় শিশু এই উভয়ের মধ্যেই স্বচ্ছল পরিবারের শিশুদের চেয়ে বেশি সমস্যা থাকে।”

আমরা দেখেছি কানাডায় নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট পরিবারের ছেলে-মেয়েদেরকে এমনিতেই নতুন সংস্কৃতি ও ভাষার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নানারকম মানসিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। এখন এর সঙ্গে যদি দারিদ্রতা যোগ হয় তবে সেই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠে আরো জোড়ালো এবং অসহনীয়।

নতুন আসা এই সকল ছেলে-মেয়েরা যখন দেখে তাদের বাবা-মা’রা কানাডায় এসে জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম বেতনে এমনসব পরিশ্রমের কাজ করছেন যা তাদের শারীরিক সামর্থ বা কর্মক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়, তখন তাদের মধ্যে এক ধরণের কষ্টবোধ তৈরী হয়। সেই সঙ্গে তৈরী হয় নিরাপত্তাহীনতা এবং কখনো কখানো হীনমন্যতাবোধও। এতে করে ইমিগ্রেন্ট পরিবারের সন্তানদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কেউ কেউ লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। বিশৃঙ্খল জীবন যাপনের দিকে ঝুঁকে পড়ে অনেকেই।

কানাডায় যে সকল ইমিগ্রেন্ট আসেন, বিশেষত এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে যারা আসেন তাদের অধিকাংশেরই স্বপ্ন প্রায় এক। সেই স্বপ্ন হলো – ছেলে-মেয়েদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। তারা যাতে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে প্রবাসে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে প্রধানত সেই স্বপ্ন নিয়েই ইমিগ্রেন্টদের কানাডায় আসা। আর এই ইমিগ্রেন্টদের অধিকাংশই উচ্চ শিক্ষিত। নিজ নিজ দেশে তারা আর্থিক ও সামাজিক দিক বিবেচনায় ছিলেন ভাল অবস্থানে।

কিন্তু কানাডায় এসে তাদের সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে অতি দ্রুত। সাথে করে নিয়ে আসা অর্থ ফুরাতে দুই তিন মাসের বেশী সময় লাগেনা তাদের। এর পরই শুরু হয় এই প্রবাসে জীবন সংগ্রামের কঠিন অধ্যায় এবং ভাগ্যের অগ্নিপরীক্ষা। কঠিন এই জীবন সংগ্রাম আর ভাগ্যের অগ্নিপরীক্ষায় কেউ কেউ সফল হন, আবার কেউ কেউ ব্যর্থ হন। যারা ব্যর্থ হন দারিদ্রতা তাদের পিছু ছাড়ে না। প্রবাসের জীবন হয়ে উঠে তাদের কাছে দুর্বিসহ। আর অনেক ক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়ে তাদের সন্তানদের উপরও।

উল্লেখ্য যে, দৃশ্যমান সংখ্যালঘু হিসাবে পরিচিত, নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট এবং কানাডার অবশিষ্ট মানুষ অর্থাৎ আদিবাসীদের ক্ষেত্রে আয়ের বিশাল ব্যবধান রয়েই গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে আসা অভিবাসীরাÑ যাদের অনেকেই দৃশ্যমান সংখ্যালঘু তারা কঠিনতম অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কারণ তাদের মোট আয় কানাডায় জন্মগ্রহণকারীদের মোট আয়ের চেয়ে ৩৭ শতাংশ কম।

কানাডিয়ান প্রেস এ প্রকাশিত আরেক গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, কানাডায় সাধারণ কর্মজীবী মানুষদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই অর্থনৈতিক অবস্থা এমন যে, কোন এক পক্ষের পে চেক পেতে সপ্তাহখানেক দেরী হলে দৈনন্দিন জীবনের কর্মকান্ডে ছন্দপতন ঘটে। সময় মত বাড়ি ভাড়া প্রদান, ক্রেডিট কার্ডের বিল প্রদান, লাইন অব ক্রেডিট এর বিল প্রদান, টেলিফোন বিল প্রদান, গাড়ির পেমেন্ট, ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম প্রদান এমনকি সাপ্তাহিক গ্রোসারী করাও সমস্যা হয়ে দাড়ায়। সাম্প্রতিক কালের উর্ধ্বগামী খরচ এবং ঋণের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

কানাডিয়ান প্রেস এর খবর থেকে আরো জানা যায় যে, অন্টারিওতে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের কর্মীদেরকে উপযুক্ত বেতন দিচ্ছেন না, দিচ্ছেন না ভেকেশন পে এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধাও। ফলে এই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীগণ বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের পাওনা অধিকার থেকে। বিভিন্ন কর্মস্থলে শ্রম মন্ত্রণালয় পরিচালিত তদন্তে দেখা গেছে অন্টারিও’র শ্রম আইনের লংঘন হচ্ছে শতকরা ৭৫ থেকে ৭৭ ভাগ ক্ষেত্রেই।

একদিকে এই শ্রম আইনের লংঘন অন্যদিকে ধনী দরিদ্রের আয়ের ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল ব্যবধান এবং গুটি কতক লোকের হাতে সীমাহীন সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ায় কারণে এখানকার সামাজিক সমস্যাগুলো ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠছে। গত বছর প্রকাশিত অন্টারিওর সানসাইন লিস্টে দেখা যায়, অন্টারিও পাওয়ার জেনারেশন এর চীফ এক্সিকিউটিভ জেফরী ল্যাস এক বছরে মোট বেতন নিয়েছেন ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯ শ ডলার। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো এসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন প্রেসিডেন্ট এন্ড সিইও উইলিয়াম মরিয়ার্টি বেতন নিয়েছেন ১ মিলিয়ন ৪৫ হাজার ডলার। অন্টারিও পেনশন বোর্ড এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট জিল পেপল বেতন নিয়েছেন ৮ লাখ ৩৫ হাজার ডলার। এরকম বিশাল অংকের বেতন গ্রহণকারীর সংখ্যা আরো আছে।

পাশাপাশি আমরা এও দেখছি, কানাডায় দুইজন ধনী ব্যক্তির হাতে যে পরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে তার পরিমাণ দেশটির ১ কোটি ১০ লাখ দরিদ্র মানুষের হাতে যে সম্পদ রয়েছে তার সমান। ধনী এই দুই ব্যক্তি হলেন ডেভিড থমসন এবং গ্যালেন ওয়েস্টন সিনিয়র। ডেভিড থমসন ‘থমসন রয়টার্স’ এর চেয়ারম্যান এবং গ্যালেন ওয়েস্টন সিনিয়র লবলজ কোম্পানী লিমিটেড এর প্রেসিডেন্ট। থমসন রয়টার্সের ব্যবসা হলো মিডিয়া আর লবলজ এর ব্যবসা হলো গ্রোসারী ও ঔষধের দোকান। এরা দুজন মিলে কানাডার মাঝারি ধরনের একটি প্রভিন্সের সবকিছু কিনে ফেলার ক্ষমতা রাখেন! গত বছর প্রকাশিত আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফ্যামের এক গবেষণা পত্র থেকে এই তথ্য জানা যায়।

কানাডায় অতি ধনীদের হাতে সম্পদের যে পরিমাণ গড়ে উঠেছে তা রূপকথাকেও হার মানায়। আর এর উল্টো চিত্রটি হলো, দেশটির নিন্ম আয়ের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষেরা প্রতিনিয়ত কঠিন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন কোন রকম বেঁচে থাকার জন্য। নুন আনতে তাদের পান্তা ফুরায়। সঠিক সময় বিভিন্ন বিল পে করতে পারেন না। বাড়ি ভাড়াও সঠিক সময় দেওয়া হয়ে উঠেনা প্রতিমাসে। মাস শেষে ক্রেডিড কার্ড ঘষতে হয় সংসার চালানোর জন্য। এই সকল চাপ সহ্য না করতে পেরে অনেকের মানসিক ও শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। বিষন্নতায় আক্রান্ত হন অনেকে, এক পর্যায়ে মানসিক রোগে ভুগতে থাকেন। আর তার সরাসরি প্রভাব পড়ে পরিবারের সন্তানদের উপর। পিতা-মাতার দারিদ্রতার কারণে সন্তানরাও দারিদ্রতার শিকার হয়। এই দারিদ্রতা তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দেয় না। পদে পদে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। স্কুলে ড্রপআউটের সংখ্যা বাড়ে। তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যহানি ঘটার কারণে সরকারের চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। শৈশবে যে সকল ছেলে-মেয়ের স্বাস্থ্যহানি ঘটে অভাবের কারণে, দেখা গেছে পরবর্তী জীবনেও সেই স্বাস্থ্যহানির প্রভাব থেকে যায় নানাভাবে। অভাবী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা স্কুলেও খারাপ রিজাল্ট করে। Canadian Child Welfare Research Portal এর ওয়েবসাইটে বর্ণিত শিশুদের নিয়ে একটি গবেষণার তথ্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ঐ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে অভাবী নয় এমন পরিবারের ৭২% শিশু কিন্ডাগার্টেন ক্লাশে শব্দ চিনতে পারার ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। অপর দিকে অভাবী পরিবারে এরকম দক্ষ শিশুর সংখ্যা ১৯%। (Duncan & Magnuson, 2011) এই লেখকদ্বয়ের গবেষণায় আরো দেখা গেছে, শিশুকালে যারা দারিদ্রতার কষাঘাতে আঘাতপ্রাপ্ত ছিল, পরবর্তী জীবনে তাদের মধ্যে গ্রেফতার হওয়ার মাত্রা স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েদের তুলনায় বেশী। অনুপাতটা হলো ২৬% বনাম ১৩%।

কানাডায় শিশু দারিদ্রতা আসলে নতুন কিছু নয়। আজকে নতুন আসা অধিকাংশ ইমিগ্রেন্ট পরিবারেই শিশুরা যে দারিদ্রতার শিকার হচ্ছে তা নয়। অতীতেও শিশু দারিদ্রতার সমস্যা নিয়ে কানাডাকে নানান পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। যেমন ১৯৮৯ সালে কাডার পার্লামেন্টে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে ২০০০ সালের মধ্যে কানাডা থেকে শিশু দারিদ্রতা দূর করা হবে। প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য দেখা গিয়েছিল নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করায়। শিশু দারিদ্রতার হার নব্বুই দশকের মাঝামাঝি ১২.৮% এ নেমে এসেছিল। আগে এই হার ছিল ১৫.৮%। কিন্তু এর পর পরিস্থিতি আবারো খারাপের দিকে যেতে থাকে। বর্তমানে এই হার ১৮.৩% এ উঠে এসেছে।

কানাডায় বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ শিশু দারিদ্রতার মধ্যে বাস করছে। টরন্টো স্টার এর এক সম্পাদকীয়তে এই পরিস্থিতিকে কানাডার জন্য লজ্জাজনক বলে আখ্যায়িত করেছে। ইউনিসেফ এর হিসাবে শিশু দারিদ্রতার তালিকায় বিশ্বের ৩৫টি ধনী দেশের মধ্যে কানাডার অবস্থান ২৬তম। অর্থাৎ বাজে অবস্থানে রয়েছে কানাডা।

কানাডায় শিশু দারিদ্রতা দূরীকরণের পক্ষে কাজ করছে এমন একটি সংগঠন ‘ক্যাম্পেইং ২০০০’ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দারিদ্রতার কারণে শিশুদের মধ্যে যে সকল জটিলতা দেখা দেয় তার মধ্যে আছে জরুরী স্বাস্ব্য সেবা, মানসিক স্বাস্থ্য, আশ্রয় খরচ, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম এর খরচ ইত্যাদি। এবং এগুলোর পিছনে কানাডা সরকারকে বছরে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়। শিশু দারিদ্রতা রোধ করা জন্য যারা আন্দোলন ও ওকালতি করে আসছেন তরা বলেন, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সরাসরি শিশু দারিদ্রতা রোধ করার জন্য ব্যয় করা যেতে পারে।

২০০০ সালের মধ্যে কানাডা থেকে শিশু দারিদ্রতা দূর করার জন্য পার্লামেন্টে যে পরিকল্পা গ্রহণ করা হয়েছিল ৩৮ বছর আগে, সেই পরিকল্পনা আজো সফলতার মুখ দেখেনি। এই ব্যর্থতা কানাডার মতো একটি ধনী দেশের জন্য নিশ্চিতভাবেই লজ্জাকর। গত কয়েক বছরে ফেডারেল সরকার ও অন্টারিও সরকার চাইল্ড টেক্স বেনিফিট বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বটে। অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরীও বৃদ্ধি করা হয়েছে। আগামী বছর তা ১৫ ডলারে দাড়াবে। কিন্তু তা শিশু দারিদ্র বিমোচনে কিছুটা সহায়ক হলেও পর্যাপ্ত নয়। কানাডার রাজনীতিক ও পলিসি মেকারদেরকে এ বিষয়ে আরো জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে এমনটাই মনে করছেন চাইল্ড এ্যাভোকেসী গ্র“পের সদস্যরা।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ