প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৪৮
জুন 3, 2018
রীনা গুলশান
“লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক” – পড়তে পড়তে কখন জানি রাতের অন্ধকারে মহানবী (সাঃ) এর জন্মনগরী পবিত্র মক্কা শরীফে প্রবেশ করেছি, জানতেও পারিনি। রাতের আকাশে হঠাৎ চোখে পড়লো বিশাল ক্লক টাউয়ার।
এর পরেরটাই আমাদের হোটেল। হোটেল ‘আল-সাফওয়া’। আমাদের ‘আলফালাহ’ প্যাকেজের অন্যতম ভালো হোটেল ছিল এটি। এটি বৃহৎ একটি হোটেল। এই হোটেলের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো এর সীমানা হারেম শরীফের মধ্যে। আপনার মসজীদুল মুনওয়ারায় নামাজের সওয়াব এক রাকাত নামাজ পড়লে ৫০ হাজার রাকাত সওয়াব। আর মসজিদুল হারেমে ১ লাখ রাকাতের সওয়াব এক রাকাতে।
আপনার যদি মসজিদুল হারেমে না যেতে ইচ্ছা করে তো, আপনার হোটেল কক্ষে অথবা এই হোটেলের চতুর্থ তলাতে (গচ) ফ্লোরে, টোটাল ফ্লোরটা মসজিদ করা হয়েছে। এখানে সরাসরি ‘হারেম শরীফ’ এর জামাত এর সাথে জামাত আদায় হয়। এমনকি আপনার হোটেলের কক্ষে বসেও একই জামাতের সাথে আপনি নামাজ পড়তে পারবেন। আমিতো তাহাজ্জুদ এর নামাজ আমার কক্ষে বসেই ঐ জামাতের সাথে পড়তাম। মাঝে মধ্যে গচ তে নেমে যেতাম।
যাইহোক, আমরা মদীনা থেকে, সোজা হোটেলে এসে, ঘন্টাখানেক লাগলো যার যার রুমের চাবি পেতে। আমাদেরকে বলা হলো, রাত ১২টার সময় নীচে নেমে আসতে কনফারেন্স কক্ষে। ওখানে জমায়েত হতে। তারপর আমাতের টিম লীডার, ওমরাহ’র উদ্দেশ্যে নিয়ে যাবে।
রুমে আসলাম। খুবই সুন্দর করে সাজানো রুমটা। একটা ফাইভ স্টার হোটেলের সব রকম সুবিধা যা আপানারা চিন্তা করেন, তার থেকে বেশী ছাড়া কম নাই। এদের রুম সার্ভিস খুবই ভালো।
মক্কা নগরী একটা ভ্যালি। এই নগরীর চারপাশ খাড়া পাহাড় দিয়ে পরিবৃত। যার জন্য বাতাস উপর দিয়ে চলে যায়। তবে মানুষ যে রকম বলে, সেরকম কিছু না। আমি মদিনার থেকে, মক্কায় মসজিদের বাইরে অনেকটা সময় থেকেছি। তবে আমার সেই রকম গরম অনুভব হয়নি। যদিও আমি কানাডার মত ঠান্ডা দেশ থেকে গেছি। মক্কায় হজ্জের সময় যে গরমটা অনুভব হয় সেটা মানুষের গরম। জায়গার গরম নয়। ৩/৪ মিলিয়ন মানুষ ঐ মসজিদুল হারেমের মধ্যে। তবে এর সীমানার বিস্তারও অচিন্তনিয়। এবং সৌদী সরকার এর বেশীর ভাগ স্থান টাউয়ারের মত করে দিয়েছে। আকাশ খুব কমই দেখা যায়।
মসজিদুল হারাম শরীফ এত বৃহৎ যে চিন্তার বাইরে। এবঙ হারাম শরীফের অনেকগুলি দরজা আছে। প্রতিটি দরজা বা গেট একই রকম দেখতে। আপনাকে মনে রাখতে হবে এর নাম্বার এবং আপনার সুবিধা যে গেট দিয়ে ভেতরে যাওয়া সেটি মনে রাখতে হবে। না হলে আপনি গোল গোল ঘুরবেন এবং বৃথা সময় অপচয় হবে।
আমরা সবাই আবার পবিত্র ভাবে ওজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম ওমরাহ’র নিয়তে। এরপর গলায় ঝুলাতে হবে আপনার আইডি কার্ড, মোয়াল্লেম কার্ড। এটা ছাড়া এক পাও বের হবেন না। সেল ফোনে আপনার সঙ্গির নাম্বার, দুএকজন সফর সঙ্গির নাম্বারও রাখবেন। মোয়াল্লেম এবং টিম লিডারের নাম্বার অবশ্যই রাখবেন। এটা অসম্ভব জরুরী। ঘর থেকে বের হলেই প্রতি মুহুর্তে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা। মনে রাখবেন আমি আপনাকে হজ্জ শিখাচ্ছি না। ওটা আপনার প্যাকেজ থেকে শিখিয়ে দেবে। এবং আপনি নিজে যতই জানুন না কেন, ওখানে যেয়ে প্রতি মুহুর্তে আপনার টিম লিডারকে অনুসরন কতে হবে। যা অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ করে ওখানকার নিয়ম কানুন।
এবার আপনার (ওমরাহ্ এর বা হজ্জের আগে) ব্যাকপ্যাক গুছানোর পালা। মনে রাখবেন এটা অসম্ভব জরুরী এটা ব্যাপার। কারণ আপনারা জানেন না যে, আপনার নিবাস থেকে হারাম শরীফ কতদুর। যেহেতু ব্যাকপ্যাক আপনার নিজের পিঠে নিতে হবে তাই খুব বেশী ভারী হওয়া চলবে না। মনে রাখবেন ওখানে কেউ কারো ভার নিতে পারবে না। তাই খুব বেশী ওজন যেন না হয়। আবার জরুরী জিনিশ ভুলে গেলেই সর্বনাশ। আবার আপনাকে আবাসে দৌড়াতে হবে। ব্যাগের (সাইড ব্যাগ অবশ্যই নিবেন না, কারণ ওটা নিয়ে তাওয়াফ করতে পারবেন না, যদি আপনি পবিত্র ক্বাবা ঘরের পাস দিয়ে করতে চান। অর্থাৎ এক তলায়। যদি দোতালায় করতে চান তাহলে আপনি যত খুশী ব্যাগ নিন, যদি আপনি নিজে তা বহন করতে পারেন। মধ্যে নিবেন কাগজ, কলম, অপনার সেল ফোন (ওটা ভাইব্রেন্টে রাখবেন), কোন ব্যাথার টেবলেট, একটা সেলাইনের পানি ভরা বোতল, আর ৩/৪টা পানির খালি বোতল ( তওয়াফ শেষে জমজমের পানি ভরে আপনার হোটেল বা নিবাসে নিয়ে আসার জন্য।), ছোট কোরআন শরীফ অথবা আপনি তওয়াফ বা সাহী করবার সময় যে সব দোয়া দরুদ পড়তে চান। যদি আপনার তা নজিস্ব মুখস্থ থেকে পড়তে চান, তা খুবই ভালো। সব থেকে ভালো হয় আপনি তওয়াফ এবং সাহী করবার সময় যা পড়তে চান কানাডা থেকেই ঠিক করবেন, কোন কোন দোয়া, দরুদ আপনি পড়বেন বা পড়তে চান, তা একটা সাদা কাগজে অথবা ডায়রীতে পরিষ্কার করে একটু বড় বড় করে লিখে নিয়ে যান। কারণ, তওয়াফের সময় ছোট ছোট লেখা পড়া যায় না। এত মানুষ থাকে যে ঠিক মত করে চলাই যায় না। অনেককে দেখেছি ছোট কোরআন শরীফ নিয়ে তাওয়াফ করা কালীন পড়তে। এটা অত্যন্ত অসুবিধাজনক ব্যপার। সাত দানার তসবী। এটা খুবই জরুরী। একটা আঙ্গুলের মধ্যে রাখতে হবে। একবার তাওয়াফ শেষে হবে একটি দানা টেনে নিচে আনবেন। এভাবে হিসাব রাখতে হবে। এটা না করলে খুবই যন্ত্রণার। অনেক মানুষকেই দেখেছি ভুলে যেতে। বিশেষ করে তাওয়াফ, যেহেতু গোল গোল ঘুরতে হয়, মানুষ ভুলে যায়। একবার ভুলে গেলে আবার প্রথম থেকে করতে হবে। সেটা খুবই কষ্টের। তাই সাত দানার তসবী অবশ্যই রাখবেন। ওটা মদিনায় অথবা মক্কায় কিনতে পাওয়া যায়। কানাডার নাগেট মসজিদেও পাওয়া যায়।
তাওয়াফ এবং সায়ী কানাডা থেকে ভাল করে টিভিতে দেখে দেখে শিখে যাবেন। ম্যাক্সিমাম মানুষদেরই দেখলাম, তাওয়াফ করার সময় কাবা শরীফের দিতে তাকাতে। এটা অত্যন্ত ভুল। মনে রাখবেন, আপনার টিম লীডার আপানাকে দেখিয়ে দেবে, ঠিক কোন জায়গাতে দাড়িয়ে তাওয়াফের নিয়ত করতে হবে। সব থেকে ভাল হয় আপনি নিয়তটা বাংলাতে (যার যার নিজের ভাষায় করা উত্তম) করলে – হে আল্লাহ তোমার ইচ্ছায় আমি বায়তুল হারাম তাওয়াফ করতে ইচ্ছা করছি। হে আল্লাহ, এ কাজ তুমি আমার জন্য সহজ সাধ্য কর ও কবুল কর। (চলবে)
রীনা গুলশান, টরন্টো
gulshanararina@gmail.com