প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৪৭

মে 1, 2018

রীনা গুলশান

মদিনায় ‘ মসজিদুল মুনওয়ারাতে’ মানুষের মূল আকর্ষণই হলো ‘রিয়াজুল-জান্নাহ’ দর্শন। এবং নফল নামাজ আদায় করা। অনেকে ওখানে কোরআন তেলাওয়াতও করে থাকেন। কিন্তু প্রথম দিন-ই বাজীমাত করতে পেরেছিলাম। অর্থাৎ যে পয়েন্ট এর কথা বলা হয়েছে আমি সেখানেই দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে পেরেছিলাম। এবং তাতে করে আমার স্বর্গীয় সুখ অনুভূত হয়েছিল। তবে এর পর ৯ দিনে আমি আর একবার গিয়েছিলাম। যদিও ঐ পয়েন্টে যেতে পারিনি।
আমার কেন জানি মনে হতো, এই মসজিদটাই তো ‘রিয়াজুল জান্নাহ’। মসজিদ এর ঠিক মাঝখানেই তো হুজুর করিম (সাঃ) ঘুমিয়ে আছেন। উনার হুজরা খানাতেই (উনার শোবার কক্ষ) উনাকে সমাহিত করা হয়েছিল। এবং উনি ওয়াদা করেছেন, উনার কোন উম্মত ওখানে যেয়ে যদি ছালাম পেশ করেন, উনি সাথে সাথেই তার জবাব দিবেন। তাই প্রতিদিন যতবার যেতাম, মসজিদের ঢোকার দোয়া পাঠ অন্তেই বলতাম, একটু বিরবির করে (মনে মনে নয়), যেন নিজের কাছেই কর্নগোচর হয় – “আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লহ”। এবং, প্রতিবারই আমার মনে হতো, আমি যেন উত্তর শুনতে পেতাম। আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত। বাইরে এই যে প্রখর রোদ, মনে হয় গায়ের চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, প্রতিবারই মসজিদে ঢোকার সাথে সাথেই যেন স্বর্গসুখ। ওখানে থাকলে ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছুই লাগে না যেন।
আহা দিনগুলো যেন ফুৎকারেই চলে যাচ্ছিল। মন বলছিলো, আহা দিনগুলো যেন কোনদিন এবং কখনোই শেষ না হয়।
যদি আশেপাশেই কোথাও যেতে চান, তাহলে বেস্ট টাইম হলো, জোহর আর আছরের মাঝখানে। জান্নাতুল বাকীতে যদি যেতে চান, যে কোন নামাজের পরপরই যেতে পারেন। প্রায় প্রতি নামাজেই আমরা একটি করে জানাজা’র নামাজ পেয়েছি। জানাজা’র নামাজ কখনো পড়িনি। মদিনা, মক্কাতেই প্রথম পড়েছি। এটা মহিলাদের জন্য ওয়াজিব নয়। তুব ওখানে যেয়ে পড়েছি। পড়তে ভালই লাগতো। মনে হতো আহা, আমি যখন মরে যাব, সবাইতো আমার জন্য এভাবেই জানাজার নামাজ পড়বে।
তবে জান্নাতুল বাকীর ভেতরে এখন আর মহিলাদের যেতে দেয় না। এর অবশ্য অনেক যৌক্তিক কারণ আছে। তবে আপনি এর সীমানার বাইরে থেকে দেখে আসতে পারেন। ওখানে কারা কারা সমাহিত আছেন এটা অবশ্যই জানা অত্যন্ত জরুরী। এবং সেটা ইতিহাস। সবাইকে ব্যক্তিগত আগ্রহে এটাকে জেনে নেওয়া উচিৎ। তবে এখানে যারা সমাহিত হয়েছেন, তারা যে অত্যন্ত ভাগ্যবান এতে কোনই সন্দেহ নাই।
৮ দিনের দিন ইশা’বাদ আমাদের কাঙ্খিত ৪০ ওয়াক্ত নামাজ শেষ হলো। ৯ দিনের দিন আমরা যাত্রা করবো। আমাদের আগের দিনই কনফারেন্স কক্ষে (প্রতিদিনই আমাদের কনফারেন্স কক্ষে একবার ডাকা হতো, আছর বাদ অথবা মাগরীব বাদ) বলে দিয়েছিল যে পরদিন ফজর নামাজের পর ৯টার মধ্যেই যাত্রা শুরু হবে মক্কার উদ্দেশ্যে। মসজীদুল হারেমের উদ্দেশ্যে। এবং আমাদের প্রথমবারের মত ওমরাহ এর উদ্দেশ্যে।
যদিও ৯টার মধ্যে যাত্রা করার কথা তবু রওনা হতে হতে সেই ১১টার মত বেজে গ্যালো।
যাবার আগে সবাই শেষ বারের মত মসজিদে দৌড়ালো। নফল নামাজ পড়বার জন্য। দোয়া করবার জন্য। আমাদের মোট ৪১ ওয়াক্ত নামাজ হয়েছিল। আমাদেরকে কনফারেন্স কক্ষে বলে দিয়েছিল, মহিলারা যেন গোসল করে। ওমরাহ’র উদ্দেশ্যে একদম পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করে ফেলে। এবং অবশ্যই ওমরাহ’র উদ্দেশ্যে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে হবে। এবং হোটেল থেকেই মহিলাদেরকে ওমরাহ’র নিয়ত করতে হবে।
আমরা সব মহিলারা পবিত্র হয়ে ওমরাহ’র উদ্দেশ্যে কাপড় পরিধান করে বাসে উঠে পরলাম। পুরুষেরা অবশ্য নয়। তারা গোসল করে পবিত্র হয়েছে, কিন্তু তাদের এহ্রাম পরতে পারেনি। আমরা মদিনা থেকে এহ্রামের কাপড় ক্রয়ে করেছিলাম। ওখান থেকে ক্রয় করা সব দিক থেকেই ভাল। কানাডা থেকে যদি নিয়ে যান, এখানে ভাল কোয়ালিটি গুলোর দামও বেশী আবার ওজন বেশী। এক সুটকেস শুধু এহরামের কাপড়ই যাবে। তাই মদিনা থেকেই কেনা ভাল। দামও সস্তা, কোয়ালিটিও অনেক ভাল। তো এমরামের কাপড় কিনে আবার বিসমিল্লাহ্ বলে ধুয়ে নিতে হবে।
মদিনা থেকেই আমাদের বলে দিয়েছিল, মক্কার এবং মিনার আলাদা সুটকেস গুছিয়ে নিতে। আমরা সেই ভাবেই আগের রাতে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। মিনার সুটকেস সব হোটেলের নিচে জমা দিয়েছিলাম। ওগুলো সব, মিনার পাশেই একটা শহর (মক্কার কাছেই) বাত্তা কোরাইস, সব সেখানে চলে যাবে। আমরা শুধু দশদিনের মত মক্কা থাকার কাপড় এবং অন্যান্য জিনিশ পত্র গুছিয়ে অন্য সুটকেসে নিলাম। বাস রওনা দিল। বাসে উঠার সাথে সাথে দুপুরের খাবার দিয়ে দিল। একজন মহিলা আমাদের সবাইকে ৭টা দানার তসবী উপহার দিল। তার মেয়ে নাকি নিজ হাতে বানিয়েছে।
পুরুষরা যে কাপড় পরবে (ওটাকে এহরাম বলে না, অনেকে ঐ কাপড়টাকে এহরাম মনে করে) এবং নিয়ত করবে। এবং ঐ কাপড় পরিধানের পর ওমরাহ্ এবং হজ্জের উদ্দেশে নিয়ত করে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হবে। এই টোটাল সিস্টেমের নামকে এহ্রাম বলে। এবং পুরুষদের এই এহ্রাম বাঁধার পর অনেক গুলো নিয় কানুন মেনে চলতে হয়। এবং সেটা বাধ্যতামূলক। যেমন –
১. সেলই করা কাপড় না পরা। তবে মহিলারা সেলাই করা কাপড় পড়তে পারবে।
২. খুশবু ব্যবহার করা যাবে না। কোন কিছুতেই না। লোশন, সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি আমরা শপার্স ড্রাগ মার্ট বা ওয়ালমার্ট থেকে কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম যেগুলো খুশবু বিহীন ছিল।
৩. স্ত্রী সহবাস বা ঐ ধরণের আলোচনা করা যাবে না।
৪. সাথীদের সঙ্গে ঝগড়া করা যাবে না।
৫. কোন গুনাহর কাজ করা যাবে না।
৬. মহিলারা মুুখ ঢাকতে পারবেন না।
৭. নখ কাটা যাবে না, চুল কাটা বা শরীরের একটি পশমও ছেড়া যাবে না।
৮. বন্য পশু শিকার করা যাবে না।
৯. উঁকুন বা পিপড়া জাতীয় কিছু মারা যাবে না।
মদিনা থেকে মক্কা যাবার পথে যেখান থেকে ‘মিকাতের’ শুরু সেখানে চারদিকে চারটা মসজিদ আছে। ওখানে আমাদের বাস থামলো। মাগরীবের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমরা নেমেই, ঝটপট ওজু করে মসজিদে নামাজ পড়লাম। এবং পুরুষরা নামাজের পর আবার দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে ওমরাহ্’র নিয়ত করলো। কাপড় সবাই মদিনার হোটেল থেকেই পরে এসেছিল।
মহিলারা ওমরাহের নিয়ত আগেই করেছিলাম। আবার বাস ছেড়ে দিল। এবার আমরা হজ্জ এবং ওমরাহের যাত্রী। বাসে উঠেই আমাদের লিডার জোরে জোরে পড়া শুরু করলো, আমাদের সাথে নিয়ে কোরাসের মত। সে যে কি আনন্দ। এক অপরিসীম পবিত্র অনুভূতিতে আমাদের হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রী জেগে উঠলো। আমরা সবাই জোরে জোরে এক সাতে সুরে সুরে পড়া শুরু করলাম। – ‘লাব্বায়েক, আল্লাহহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বায়েক-লা-শারীকালাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নেয়মাতা, লাকা ওয়ালমুলক, লা-শারীকা লাক।’ (চলবে )
রীনা গুলশান, টরন্টো
gulshanararina@gmail.com