প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৪৬

এপ্রিল 8, 2018

রীনা গুলশান

কি মিষ্টি একটা অপার শান্তি শান্তি পরিবেশ। মসজিদুল মুনওয়ারার মধ্যে ঢুকলেই, মনের মধ্যে একটা অসম্ভব অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে। মনে হবে, এখান থেকে আর কোনদিন সংসার নামক ঐ যন্ত্রণার সাগরে সাতার কাটতে যাবো না। সত্যি সত্যি অনেককে  দেখেছি, সকালে যেতে, তারপর একেবারে এশার নামাজ পড়ে তাদের আবাসে ফিরে আসতে।  আবার তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে আসা। যদিও এর মধ্যে একটু টেকনিক্যাল সমস্যা আছে। কারণ প্রতি নামাজের শেষেই, মসজিদের ভিতর অবস্থান করা, মহিলা পুলিশ, তারা আপনাকে বের করে দেবে। খুব ঝামেলা লাগবে। কিন্তু কিছুই করার নাই। তাদেরও কিছু রুলস এ্যান্ড রেগুলেশনস আছে। মসজিদ পরিষ্কারের ব্যাপার আছে। অনেকেই দেখলাম মসজিদের ভিতরেই খাওয়া শুরু করে দেয়। এটা একদম অনুচিত। সেজন্যই পুলিশ বের করে দেয়।

যাইহোক, মুসজিদুল মুনওয়ারায় জীবনের প্রথম নামাজ পড়লাম, তাহাজ্জুদের নামাজ। মজার ব্যাপার, মদিনায় তাহাজ্জুদের নামাজের আজান পর্যন্ত দেওয়া হয়। এই আজান শুনেই সবাই অযু করে মসজিদ পানে ছুটতে থাকে। তাহাজ্জুদের নামাজ এর কোন জমতি হয় না। আজান দিবে, কিন্তু জামাতে নামাজ পড়বে না। কারণ, এটা ফরজ নামাজ নয়। তাছাড়া এটা ১২ রাকাত নামাজ। কিন্তু আপনি ২, ৪, ৮ বা ১২ রাকাত পড়তে পারেন। এই নামাজ শেষ হলে সাধারণত মসজিদ থেকে বের করে দেয় না। আপনি কিছু তসবি পড়লেন অথবা কোরআন শরীফ পড়লেন। এর মধ্যেই ফজরের আজান দিয়ে দিবে। আপনি মদিনায় ১৫ মিনিট হাতে সময় পাবেন, জামাত পাবার জন্য। যেটা মক্কায় পাবেন মাত্র ৫ মিনিট। ফজর নামাজের পর, কিছুক্ষণ তসবী অথবা কোরআন পড়লেই এশরাখ নামাজ এর ওয়াক্ত হয়ে যায়। এই নামাজ পড়েই আপনি, আপনার আবাসে যেতে পারেন। এশরাখ এর নামাজ পড়বার সময় আপনি বায়রের চাতালে চলে আসবেন। কারণ তখন অত্যন্ত সুন্দর একটা জিনিশ দেখা যাবে। বায়রে যেহেতু তখন একটু একটু করে সূর্যের আলো ফুটতে শুরু করবে, আপনার পক্ষে ওখানে বসা দুস্কর হয়ে যাবে। তখনই দেখবেন, মাথার উপরে এতক্ষণ যেটা নেহাত লম্বা লাঠির মত ছিলো, সেটা একটু একটু করে ঠিক পদ্ম ফুলের মত খুলতে থাকবে। সে এক অপরূপ দৃশ্য। এক একটি ফুল খুলবে, অন্যটির সাথে মিশে যাবে। এত্ত সুন্দর দৃশ্যটা। সবাই ভিডিও করছে। আমি ভিডিও করার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আবার মাগরীবের সময়, ওটা ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে।

সবসময় মনে রাখতে হবে,যে, আপনি হজ্জ করতে গেছেন। হলিডে স্পেন্ড করতে যাননি। অনেক কে দেখেছি, ওখানে যেয়ে ঠিক ঐ রকম মনোভাব পোষণ করতে। হজ্জ করতে যাবার পর, আপনার মনোভাব হতে হবে, আপনি একজন ভিক্ষুক। আল্লাহর দরবারের ভিক্ষুক। মনের ভিতর একটা নিঃস্বতা অনুভব করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি হজ্জ করতে গিয়েছেন, অর্থাৎ আপনার অতিবাহিত হওয়া জীবনের সব পাপের জন্য, খারাপ কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে গেছেন।

আল্লাহপাক ক্ষমা করলো কিনা, সেটা তো আল্লাহপাকই  জানেন। কিন্তু, আপনি আপনার কোন কশরত ছাড়বেন না। আপনার মন এবং মুখ সারাক্ষণ বলতে থাকবে –

‘আল্লাহুম্মা  আজিরনি মিনান্নার।’ সারাক্ষণ এটা বলতে  থাকবেন। আল্লাহ, হে মহান সৃষ্টিকর্তা তুমি আমাকে দোজখের হাত থেকে বাঁচাও। এত্তবার বলবেন যে, আল্লাহপাক একবার তো ইনশাল্লাহ্ শুনবেনই।

আমাদের অনেকে কানাডা থেকেই কোরআন শরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন। আসলে এটার কোন দরকার আছে বলে মনে হয়না। মসজিদের ভিতর প্রচুর পরিমানে কোরআন শরীফ আছে। সবাই পড়লেও সেই পরিমান শেষ হবে বলে মনে হয় না। তবে এখানে একটি কথা আছে। যদি কেউ বাংলা প্রিন্ট আরবী কোরআন শরীফ পড়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে আপনার কোরআন শরীফটা নিয়েই যেতে হবে। ওখানকার সব কোরআন শরীফ উর্দু প্রিন্ট। কিছু কিছু কোরআন শরীফ দেখলাম সৌদী থেকে ছাপা হওয়া। তাতে কোন এমনকি হরফ অর্থাৎ জের, জবর, নোকতা, পেশ কিছুই নাই। আমাদের জন্য এটা পড়া একেবারেই অসম্ভব। ইংরেজী অনুবাদের কোরআন শরীফও আছে।

এবারে ‘রিয়াজুল – জান্নাহ্’ দেখবার বা হুজুর (সাঃ) এর কবর জিয়ারতের ব্যাপার। এখান থেকে যেটা ভিডিওতে দেখে গিয়েছিলাম। আসলে সেই অনুযায়ী কাজ করা যায় না। তবে এটা পুরুষদের ক্ষেত্রে সম্ভবত জরুরী নয়। তারা ঠিকঠাক করতে পারে। কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।

প্রথমবার ফজরের নামাজ পড়ে আমরা চেষ্টা করেছিলাম, আমাদের সব কাজ শেষ করে হোটেলে আসতে আসতে ১২টা বেজে গিয়েছিল। খুব সাংঘাতিক। আমার মনে হলো মিলিয়ন জনতার মধ্যে আমি পিষ্ট হচ্ছিলাম। যদিও মহিলা পুলিশ তারস্বরে চিৎকার করতে করতে তার কণ্ঠের আওয়াজ একসময় ভেঙ্গে যাচ্ছিল। প্রথমে ঠিকই ছিল। বেশ শৃঙ্খলিত ভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। অনেক গুলো স্টেপ। অনেকগুলো গেট। দীর্ঘ করিডোর। এরপর ঠিক রিয়াজুল জান্নাহর কাছাকিছি এসেই একটি বিশাল চাতালে সবাইকে গ্র“পওয়াইজ বসিয়ে দিল। তারপর গ্র“পওয়াইজ ডাকছিল। এবং তাদের অন্য গেট দিয়ে বের হওয়ার কথা। কিন্তু কেউ বের হয় না। এদিকে টাইম ধরে ধরে মহিলা পুলিশ ডেকে চলেছে। আমরা ইউরোপ গ্র“পের মধ্যে পড়েছিলাম। জানিনা কেন। সবথেকে দলে ভারী ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া। এই গ্র“প একটা বিশাল ডানা মেলা গ্র“প। একজন অন্যজনের কাপড়ের সাথে কাপড় বেধে রাখে। ওদেরকে কোন ভাবে আপনি ক্রস করতে পারবেন না। ক্যামোন যেন এরা ওয়াইল্ড ধরণের। একটি ইংরেজী শব্দও বোঝে না। এদেরকে প্রতিটি ধাপে আপনি ফেস করবেন। রিয়াজুল জান্নাহ্তে তিনজন কে পরপর জিয়ারত করতে হবে। হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ), হযরত ওমর ফারুখ (রাঃ) এবং আমাদের মহান নবী করিম (সাঃ) এর মাজার।

রিয়াজুল জান্নাহ্ (বেহেশতের বাগান) তে পরপর তিনজনকে জিয়ারত করবার পর, হুজুর (সাঃ) যেখানে নামাজ পড়তেন সেখানে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হয়।  সাদা মার্বেল পাথরের একটা দেয়াল এর মত। লম্বা আছে জায়গাটা। তাই ঐ কর্নারটায় যেহেতু সবাই নামাজ পড়তে চায়, আপনি ইচ্ছা করলে ঐ লম্বা জায়গাটার যে কোন জায়গায় নামাজ পড়তে পারবেন। একই সওয়াব।

– (চলবে)।

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com