প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৪৫

মার্চ 11, 2018

রীনা গুলশান

হজ্জ এর আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা। সেই ইচ্ছা শক্তিটাই ক্রমশ আপনার ভেতরে এক আলোক দীপ্তি নিয়ে বিচ্ছুরিত হবে। আশে পাশের কোন কিছুই আপনাকে আর প্রভাবিত করবে না। ক্যাবোল-ই ঐ ইচ্ছা শক্তিটাই আপনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কোন কষ্টই আর আপনাকে গ্রাস করবে না। এমন কি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম সবই আপনি মোদ্দা অর্থে বিস্মৃত হবেন।
জেদ্দায় বেশ অনেক্ষণ হলো এসেছি। বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। আমরা তো মক্কায় যাব না। আমাদের যাত্রা মদিনাতে। আমরা এসেছি সবচেয়ে দীর্ঘ প্যাকেজে। বাস নাকি বিমানে যাব মদিনাতে, বুঝতে পারছিলাম না। ইতিমধ্যে ঘন্টাখানেক চলে গ্যালো ঢিমা তালে। ক্লান্তি শরীরে ভর করছিল। টিম লিডারগণ কথা বলছিল ক্রমাগত। এর মধ্যে একজন এয়ারপোর্টের লোক এসে আমাদের ফর্ম দিয়ে গ্যালো। ঐ ফরম পূরণ করে দিলাম। এরপরই আমাদেরকে নির্দেশ দিল সামনে এগিয়ে যেতে। শুনলাম বিমানে করেই নিয়ে যাবে। মনটা খুশীতে নেচে উঠলো। কারণ তাহলে এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাব। আর বাসে গেলে আবার ৫/৬ ঘন্টার যাত্রা। শরীর আর নিচ্ছিল না। এয়ার বাসের লাউঞ্জের কাছে চলে এলাম। লম্বা লাইন। হঠাৎ তৃষ্ণা বোধ হলো। ভাবছি বলবো কাউকে পানির কথা। ওমা হঠাৎ-ই দেখি গাড়িতে করে মানুষ আসছে বিভিন্ন খাবারের সম্ভার নিয়ে। পানি, জুস, প্যাকেট খেজুর, ছোট ছোট কেক, কুকিজ সহ নানান খাদ্য। পানি একটা নিলাম। একদম বরফ ঠান্ডা। আহা মনটা একদম ভরে গ্যালো। বাইরে প্রখর তাপদাহ, আর মুঠোয় এক টুকরো ঠান্ডা শীতল পানি। আহা কি শান্তি। যদিও খাবার কিছুই খেলাম না। এরপর বিমানে উঠলাম। সবাইকে উঠাতে বেশ খানিকটা সময় অতিক্রান্ত হলো। অবশেষে বিমান আকাশ পথে উড়াল দিল, আমাদের স্বপ্নের পথ পাড়ি দিয়ে। আহা… মদিনা। আমার স্বপ্নের মদিনা। সেই পঞ্চম শ্রেণী থেকে অনার্সের সাবসিডিয়ারী পর্যন্ত আমার ইসলামিক ইতিহাস ছিল। তাই সুদীর্ঘ পাঠ, মস্তিষ্কের মধ্যে নড়াচড়া শুরু করলো। হাজার হাজার ইতিহাসের অবতারণা মনকে ক্রমাগত উদ্বেলিত করছিল।
বিমানের অন্য সব যাত্রীরাই ক্লান্ত, অবসন্ন ছিলো। কেউ কেউ সিট পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে শরীর এলিয়ে দিল। অনেকে আবার হাত পা ম্যাসেজ করার ক্রমাগত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিল। আমি এসব কিছুই করছিলাম না। এক অনাগত আনন্দের হাতছানি আমার হৃদয়কে ক্রমাগত উদ্বেলিত করছিল। আশে পাশের সবার বেশ ক্ষুধা অনুভূত হচ্ছিল। আমি নিজেও হঠাৎ ক্ষুধা অনুভব করলাম। আসলে জেদ্দায় বিমান ছাড়তে ছাড়তে বেশ দেরী হয়েছে। সবার ক্ষুধা লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা ইন্টারনাল এয়ার বাস। অতএব এক কাপ জুস বা পানি যার যা চয়েস।
খুউব বেশী সময় লাগলো না। সম্ভবত ১ ঘন্টার ৫ মিনিট আগেই বিমান পবিত্র মদিনার মাটিতে অবতরণ করলো। তারপর বেশ খানিকটা ছুটোছুটি, ব্যাগ ব্যাগেজের জন্য। আর সব ব্যাগ এবং স্যুটকেস-ইতো সবুজ রঙের ‘আল ফালাহ’র ট্যাগ লাগানো। একেক জন বিভিন্নভাবে তার স্যুটকেস কে চিহ্নিত করেছে। আমিও চিহ্নিত করেছিলাম, আবার কি মনে করে স্যুটকেসে বড় করে সিগনেচার পেন দিয়ে আমার নামও লিখেছিলাম। মদিনাতে নেমে সেটা কাজে লেগে গ্যালো। কারণ, দেখি সেম চিহ্ন আরো দুইজনের স্যুটকেসে আছে। কি যন্ত্রণা। এরপরতো ছুটোছুটি পড়ে গ্যালো। ইতিমধ্যে পেটের মধ্যে ক্ষুধার ঈঁদুরও ছুটোছুটি শুরু করেছে।
সবাই আবার যখন জমায়েত হলাম, দেখি একেবারে সামনেই দাড়িয়ে আছে সাব্বির ভাই, তার হজ্জ সারগেদ নিয়ে। কি যে আনন্দ হলো উনাকে দেখে। এই বিদেশ বিভূইয়ে এত্ত পরিচিত একজনকে দেখে কি যে ভাল লাগলো! ভাল লাগা দ্বিগুন হয়ে গ্যালো যখন দেখলাম সাব্বির ভাই সবাইকে বসতে দিয়ে, সবার দিকে খাবারের ইয়া বড় এক একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল। সৌদীর একটি জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট এর খাবার। আমাদের কেএফসি’র মত। চিকেন (বুকের মাংশ) লম্বা লম্বা ফ্রাই, পটেটো ফ্রাই, আবার খুবই সুন্দর এক একটা খেজুরের প্যাকেট, সাথে কোল্ড ড্রিংকস, জুস তা পর্যন্ত। আহ! এত্ত তৃপ্তি করে অনেকদিন খাইনি।
এরপর দুটো বাস ভরে আমাদেরকে নিয়ে রওনা দিল। মনের মধ্যে তখন অলরেডী ‘ লাব্বায়েক লাব্বায়েক ’ করছে। এক অপরিসীম আনন্দে মনটা ভরে উঠছে। সাব্বির ভাই ক্রমাগত আমাদের বলে যাচ্ছে, কোথায়, কখন আমাদের কি করতে হবে। কোথা কি পড়তে হবে। কোথা দিয়ে প্রথম মসজিদুল মুনওয়ারার মিনার দেখা যাবে। আমরা সবাই জানালা দিয়ে স্বতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়েছিলাম।
অতপর একুট দূরে থেকেই মিনার দেখা মিললো। যদিও অনেক রাত। ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবুও সবাই এক সাথে যেন বলে উঠলাম ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলাল্লাহ্।’
এয়ারপোর্ট থেকে বেশ খানিকটা দূর। চারপাশে ধূ ধূ করা মরুভূমি। আর বেশ সাজানো গোছানো একটা শহর। খেজুর গাছ গুলো এত্ত সুন্দর, মনে হচ্ছিল যেন একদম সাজানো।
বাস থেকে নামার আগেই সাব্বির ভাই সবাইকে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নামবার নির্দেশ দিলেন। কারণ, আমাদের প্রথমবার মদিনায় আগমন। তাই হুজুর সাঃ উপর একটা সশ্রদ্ধ প্রদর্শন। সবাই খালি পায়েই নামলাম। হোটেল একদম ‘মসজিদুল মুনওয়ারা’র কম্পাউন্ডেই। মসজিদের সামনেই বিশাল চাতাল, সিমেন্ট করা। তার যাবার মুখে প্রথমেই হোটেল হিলটন। তারপর আমাদের হোটেল ‘রয়াল ইন্’। ফাইভ স্টার। তবে বাইরে থেকে খুব জাকজমক নয়। ভিতরে ঢুকে কেউ গোসল করলো, কেউ অজু করলো। তারপরই আমাদের ছুটতে হলো মসজিদের দিকে।
তিনটা বেজে গিয়েছিল। দেখি চারদিকে তাহাজ্জুদ নামাজের আজানের সুর মিষ্টি একটা বাতাবরণের সৃষ্টি করলো। মনে হচ্ছিল দৌড় দিয়ে যাই। যাই হোক হোটেল দিয়ে মাত্র ৩ মিনিটের হাটাপথ।
তারপর সেই স্বপ্নের মসজিদ, মসজিদুল মুনওয়ারা। চোখের থেকে আপনাআপনি অশ্র“ নেমে আসছিল আনন্দে–হে আল্লা আমি এসেছি, আসতে পেরেছি, তোমাকে অজস্র শুকরিয়া। প্রাচীরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে পড়ছিলাম ‘‘বিসমিল্লাহি ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাগ ফিরলি যুনুবি ওয়াফ তাহলি আব ওয়াবা রাহমাতিকা।’’ – (চলবে)।
রীনা গুলশান, টরন্টো
gulshanararina@gmail.com