প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৪৪
10 ফেব্রুয়ারী, 2018
আমি হজ্বের কথাই লিখতে চাই। ওখানে দক্ষিণ এশিয়ো দাস প্রথার যে কদর্য্য রূপ দেখে এসেছি, সেটা এই মুহুর্তে লিখতে চাচ্ছি না। তাহলে সাত খন্ড রামায়ন হয়ে যাবে। ওদের নিয়ে অবশ্যই পরে লিখবো। ওরা আমার হৃদয়ের মধ্যে ভয়াবহ রূপে বসে গেছে।
শেষ কিস্তির টাকাটাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধু হজ্ব ফি এবং কোরবানীর টাকাটা ওরা প্রায় শেষ মুহুর্তে জানিয়েছিল (ওদের সাথে আমাদের যোগাযোগ হতো অনলাইনে। সরাসরি টেলিফোনে নয়)। আমাদের ফ্লাইট ছিল ‘কানাডিয়ান এয়ারলাইন্স’। টরন্টো টু মাদ্রিদ (স্পেন) টু জেদ্দা।
তবে, এমনিতেই তো ৩ ঘন্টা আগেই যাবার নিয়ম। আমাদের আরো ২ ঘন্টা আগেই যেতে বলেছিল। কারণ পিয়াসন্স এয়ারপোর্টে সবাইকে জমায়েত করে, কিছু টিপস দিবে এবং দোয়া খায়ের হবে।
‘আল-ফালাহ্’ একটা আইডি-ও আমাদের দিয়ে দিবে। যাবার আগে কি কি করতে হবে, সবই ইন-ডিটেলস বলে দিয়েছিল ওরা।
বার বার নিজের মধ্যে নিজে রিপিট করছিলাম। এতদিনের যাত্রা। কোন ভুলচুক না হয়। সুটকেস গুলো বারবার চেক করলাম। বিশেষত ঔষধ গুলো।
অতপরঃ ৭ আগস্ট সেই – আমার অনেক সাধনার এবং অনেক আনন্দের এবং ভালবাসায় ভরা দিনটি। আল-ফালাহ্’র নির্দেশ অনুযায়ী – ১১টার দিকে হজ্বের নিয়তে গোসল করতে গেলাম। সুদ্ধ বস্ত্র পরে অতপরঃ দুই রাকাত ‘সালাতুল হাজত’ নামাজ পড়তে হবে। এটা আপনি বাংলাতেই নিয়ত করবেন। আমি হজ্বের নিয়তে ২ রাকাত নফল সালাতুল হজত নামাজ পড়েছি।
প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহার পর একবার সুরা কাফিরুন পড়বেন। দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস পড়বেন।
তারপর যা মন চায় দোয়া করবেন। এই নামাজ ব্যক্তিগত সমস্যাতেও পড়তে পারেন। হজ্বে যাবার পর সর্বত্রই এই নামাজ পড়বেন।
এরপর আস্তে ধীরে রওনা দিলাম। এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখলাম (আমাদের নির্ধারিত জায়গায়) ৮০ ভাগ হজ্ব যাত্রী (আল-ফালাহ্’র মাধ্যমে) চলে এসেছেন। এই যাত্রায় শুধু তারাই ছিল যারা ১ মাসের প্যাকেজে ছিল।
১৮৬ জন এর মধ্যে মাত্র ৫ পরিবার বাঙ্গালী। সাব্বির ভাই নিজেই এলেন। আমাদের (প্রত্যেকটি টিমের আলাদা করে ২ জন লিডার ছিল) টিম লিডার এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবার পাসপোর্ট ফেরত দিলেন। আর সবার হাতে যার যার ‘আল-ফালাহ্’র আইডি কার্ড দিয়ে দিল। আমরা যার যার গলায় তা ঝুলিয়ে নিলাম। কিছু দোয়া খায়ের হলো। আবার কিছু নির্দেশ দিলেন। এই একমানের প্রতিটি পদে পদে তাদের নির্দেশনামা জারী ছিল। তাই আপনার কখনো একা লাগবে না।
সাব্বির ভাইয়ের হাতে আমরা যাবার ৩/৪ দিন আগেই হজ্ব ফি এবং কোরবানীর টাকা পৌঁছে দিয়েছিলাম। এটা ক্যাশে দিয়েছিলাম। দুজনের মিলে ১১৬০.০০ কানাডিয়ান ডলার।
সাথে যা নিবেন ক্যাশ ডলার এটা আপনার ব্যাপার। তবে সাবধানে নিবেন।
বিমানে উঠে বেশ একধরণের স্বস্থি অনুভব করছিলাম। যাত্রীদের লিস্টে আমাদের নাম ছিল। হালাল। আমাদেরকে সব ভেজিটারিয়ান ধরণের খাবারই দিল। খাবারও খুব ভাল ছিল।
বিমান যাত্রা অনেকে হয়ত এনজয় করে। আর আমি উঠেই বলতে থাকি মনে মনে, হায় আল্লাহ কখন কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাবো? যাই হোক ক্লান্ত বিধ্বস্ত (আমার ঘুমও আসে না প্লেনে) অবশেষে স্পেনের রাজধানী মাদ্রীদের মাটিতে ল্যান্ড করলো। এখানে ৩ ঘন্টার মতো ছিলাম। এখানে নামার পর বেশ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। এর আগে কখনো স্পেনে যাইনি। আর এ দেশটি নানা ভাবে বিখ্যাত। কি খেলাধূলা, কি ইতিহাসের বিষয়বস্তু সব দিক দিয়েই দেশটি খ্যাত। হৃদয় যেন নেচে উঠলো। মনে হলো নিমিষে ছুটে যাই দেশটির আনাচে কানাচে। কিন্তু এ তো আমার হলিডে স্পেন্ড নয়। এ যে হজ্ব যাত্রা।
নিজের ভিতর নিজের নির্বান প্রাপ্তি। আর এই অনুভব; কেউ কাউকে দিতে পারে না। যেদিন থেকে হজ্বের নিয়ত করবেন। একটু একটু অনুভবে আসবে। তবে এটাও ঠিক সকলের অনুভূতি কখনো একরকম হয় না। দেখলাম আমাদের গ্র“পের প্রায় সকলেই কিছু না কিছু ‘ট্যুরিজম সেন্টার’ থেকে কিনছে। ঐ দেশের ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত সব খেলোয়ারদের ছবি দেওয়া টি-সার্ট। তবে সব গলা কাটা দাম। হাফ স্লিভ টি-সার্ট এক একটি ৫০ ইউএস ডলার। আমি ১ বোতল পানি আর দুটো কফি কিনলাম, তাতেই ২০ ইউএস ডলার বেরিয়ে গেল। বিদেশ বিভূইয়ে বুঝে শুনে খরচা করতে হবে।
বেশ ফুৎকারেই সময়টা উড়ে গ্যালো। ৭ ঘন্টা প্লেন জার্নির পর মাদ্রিদে খুব ভাল লাগছিল। ইতি উতি দেখছিলাম।
আবার বিমানের ডাক। এবার সৌদী এয়ারলাইন্স। এখানে নামাজের জায়গাও আলাদা করা আছে। আমি অবশ্য আমার সিটে বসেই তখনকার সময় অনুযায়ী নামাজ পড়ছিলাম।
এবার প্রায় ৬ ঘন্টা অবিরাম যাত্রার পর জেদ্দার মাটিতে অবতরণ করলাম। সৌদী এয়ারলাইন্সে সব হালাল খাবার ছিল। ল্যাম্বের বিরিয়ানী দিয়েছিল। আরো সব উপাদেয় খাবারের সম্ভার।
কোন অসুবিধা ছাড়াই জেদ্দায় অবতরণ করলাম। এয়ারপোর্ট অনেক বড়সড়। তবে মোটেই জমকালো ধরণের নয়। কেমন যেন মরা মরা। খুব পুরানো ধরণের। দুবাই এয়ারপোর্টের কাছে কিছুই না।
তবু এই প্রথম সৌদী আরবের জেদ্দায় এলাম। খানিকটা স্বপ্নের দেশ বলা চলে। যে দেশের মাটিতে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জন্মেছিলেন। যেখানে ইসলামের জন্ম হয়েছিল। হজ্বের নির্দেশ এসেছিল।
আর আমি সেই ১৯৯৬ সাল থেকে আসছি। আসছি। ক্যাবোলি আসছি। আসা আর হয়ে উঠেনি। অবশেষে এলাম ২০১৭ সালে। প্রায় ২১ বছর পর।
এত্ত উত্তেজনা অনুভব করছিলাম যে আসপাস দেখবার কথা মনেও পড়ছিল না। সবাই এটা ওটা এয়ারপোর্টে খাচ্ছিল। আমার ক্ষুধা বোধও ছিল না।
অনাবিল এক আনন্দে মনটা ভরে উঠছিল বারবার। আল্লাহর সাথে কথা বলছিলাম। আল্লাহ তোমাকে শুকরিয়া…। (চলবে)
রীনা গুলশান, টরন্টো
gulshanararina@gmail.com