প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৪৩

জানুয়ারী 6, 2018

রীনা গুলশান

সেমিনারে তারা আমাদের একদম বাচ্চাদের মতন ধরে ধরে মুখে এবং ভিডিওতে শিখিয়েছে। তবে এটা যারা ওমরাহ্ করেছে, তাদের জন্য বেশ সহজ হয়ে যায়। তবে যারা কখনো ওমরাহ্ করেনি তাদের জন্য এটা অত সহজ হয় না। তবু কিছু টিপস লিখে নিয়ে আসলাম।

হজ্জ শুধু করলেই হবে না। আমাদের একটিই চিন্তা থাকবে, হজ্জ এ যেন কোন ত্র“টি না থাকে। আমাকে তো অহর্নিশ এই চিন্তাটাই কুরে কুরে খেয়েছে,‘আমি পারবো তো?’

এরপর আমাদের শেষ কিস্তির টাকাটা পাঠিয়ে দিলাম। তবে কোরবানীর টাকা এবং হজ্জের ফি’র টাকা একদম যাবার দিন দিয়েছি।

ভিসা করতে যাওয়ার সময় ওরা আপনার কাছে দোয়া চাইবে। যেদিন থেকে হজ্জ করবেন বলে নিয়ত করছেন, তখন থেকে প্রায় প্রতিদিন ২ রাকাত ‘সালাতুল হাযত’ নামাজ পড়বেন। হজ্জ করবেন নিয়ত করেছেন, টাকা পয়সা  জমা দিচ্ছেন, সব কিছু কেনা কাটাও সারা। তারপরও শেষ মুহুর্তে আপনার বিশাল কোন বিপদ হলো, যেতে পারলেন না আপনার এত সাধের হজ্জে। এরকম অনেকের হয়েছে এবং হতে পারে। সেই জন্যই এই নামাজটা পড়া উচিৎ। তবে এটাও ঠিক আল্লাহ যদি আপনাকে ডাক দেন হজ্জের জন্য, আপনি নিজে না চাইলেও ঠিকই হজ্জ করে আাসবেন। তবে আমাদের ‘হজ্জ’ কবুল হলো কিনা, সেটাতো ঐ আল্লাহ পাক পরওয়ারদেগারই জানেন।

অবশেষে যাবার ডেট জানানো। ফ্লাইট নং ইত্যাদি সব। ৭ আগস্ট আমাদের যাবার ডেট। এবং আসবার ডেট ছিল ৫ সেপ্টেম্বর। যদিও আমরা ১ দিন পরে এসেছিলাম। তখনও পাসপোর্ট পাইিনি। পাসপোর্ট তো আপনাকে ২ মাস আগেই দিয়ে দিতে হবে। ওরা মক্কার ভিসা করবার জন্য নিয়ে নিবে। পাসপোর্ট একদম ফেরত পাবেন এয়ারপোর্টে।

যাবার দিন ক্ষন পাবার সাথে সাথে নিজেকে নিজে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করতে হবে। হজ্জের নিয়ম কানুন একদম স্টেপ বাই স্টেপ মুখস্ত করে ফেলতে হবে। আমি একদিকে বিভিন্ন রকম বই পড়া শুরু করলাম। এরপর শুরু করলাম ভিডিও দেখা। আরবী, উর্দূ, হিন্দী এবং বাংলা সব রকম ভিডিও আমি দেখেছি। যুক্তরাজ্য থেকে একজন বাঙ্গালী ইমাম উনি হজ্জের উপর (প্রশিক্ষণ) খুবই সুন্দর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। আমার উনার বলার স্টাইল খুবই ভাল লেগেছিল।

খুব ভাল ভাবে আপনাকে শিখতে হবে ‘তাওয়াফ’ করা। এর কিছু বিধিনিষেধ আছে। ওখানে যেয়ে দেখি, বেশীর ভাগ মানুষই এই ভুলগুলো করেছে। আল্লাহ পাক হজ্জ কবুলের মালিক। তবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে, যেন আমরা ঠিক মত হজ্জ টা করতে পারি।

মক্কা বলেন আর মদিনা বলেন, অথবা জামারা-তে শয়তানকে ঢিল ছুড়তে যাওয়া বলেন, এই গোটা ব্যাপারটিতেই আপনাকে হাটতে হবে। প্রচুর হাটতে হবে। সে আপনি যতই ফাইভ স্টার হোটেলে থাকেন।

তাই হজ্জে যাবার ৩/৪ মাস আগে থেকেই আপনাকে হাটা প্র্যাকটিস করতে হবে। প্রথমে দশ/বিশ মিনিট হাটেন। তারপর হাটার টাইম বাড়িয়ে দেন। আপনার ওজন কমে যাবে। শরীরের চলৎশক্তি বৃদ্ধি পাবে। মনও ফুরফুরে থাকবে।

এরপর জুতা ভাবনা। অন্তত পক্ষে আপনাকে ৩/৪ জোড়া জুতা বা স্যান্ডেল নিতে হবে। স্পঞ্জ তো নিবেন-ই। এছাড়া মিন্নায় যেয়ে হাটবার জন্য জুতাই ভালো। কম্ফর্টএবল। খুবই টাইট জুতা নিবেন না। বরং একটি লুজ ফিটিং নিবেন। তাতে হাটতে খুবই সুবিধা হবে। পায়ে ব্যাথা করবে না। যদি কারো পায়ের পাতা ফুলে যাবার টেন্ডেন্সী থাকে তো, তাদের জন্য লুজ ফিটিংস জুতাই ভালো।

একদম যাবার আগে আগে পকেট খরচা বাবদ কিছু ইউএস ডলার নিতে হবে। যাবার আগে অবশ্য প্রায় প্রত্যেকেই বলে থাকে ‘পকেট খরচা আবার কি’? আসলে পকেট খরচা লাগে। ওখানে গিয়ে কি ধরণের ঘটনার আপনি মুখোমুখি হবেন, আপনি কিন্তু তা জানেন না। তো, ইউএস ডলার তো নিবেনই, ওখানে সব জায়গাতেই ডাইরেক্ট ইউএস ডলার দিয়েই বেচা কেনা করা যায়। ওরা সুন্দর মতন হিসাব কিতাব করে, বাকী টাকা আপনাকে ফেরত দিয়ে দিবে। তবু কিছু রিয়াল করে নিয়ে যাওয়া খারাপ না কিন্তু। এখানে মিসিসাগায় একটা ব্যাংক থেকে সরাসরি রিয়াল করা যায়। অথবা, আপনার নিজস্ব যে ব্যাংকে আপনার লেন/দেন, ওখানে বললেও ওরা আপনাকে এনে দেবে। তবে ২ দিনের মত সময় লাগবে।  হাতে কিছু রিয়াল থাকা ভালো। ছোট খাটো জিনিশ কিনলেন। খাবার কিনলেন, ওষুধ কিনলেন, সরাসরি পয়সাটা দিয়ে দিলেন। বিশেষ করে ট্যাক্সিতে কোথাও যেতে চাইলে বেস্ট হলো রিয়াল। ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ৩০ বা ৫০ রিয়াল একবারে চাইবে, তাই ওদের কাছে ইউএস ডলার না দেয়াই ভাল।

এখান থেকে রিয়াল করে নিবার সার্থকতা আমি পরের দিনই ‘মদিনাতুল মুনাওয়ারা’ যাবার পথেই পেলাম। আপনিও পাবেন। রাস্তায় এমনকি মসজিদের কম্পাউন্ডের মধ্যে, মসজিদের ভেতরও প্রচুর গরীপ দেশী মানুষ পাবেন।

সব থেকে কষ্ট লাগবে মদিনার ‘মসজিদুল মুনাওয়ারা’র  সামনেই দাড়িয়ে ৮০ ভাগ ছেলে গুলো ঝাড় দিচ্ছে, সব বাংলাদেশী। সেই প্রখর রোদে ওরা মসজিদের সামলে এবং কম্পাউন্ডের ভেতর পরিষ্কার করছে। সেই রোদের তেজ আমরা ছাতা, টুপি পরেও কাহিল অবস্থা। ওরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দাড়িয়ে আছে। দাস প্রথা যে শেষ হয়ে যায়নি, ওখানে গেলেই টের পাবেন। গোটা সৌদী আরবে দাস প্রথা বেচে আছে। তার ৭০/৮০ ভাগ যাচ্ছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়া থেকে। আর মহিলা দাসী বা ন্যানি বা ঘরের কেয়ারটেকার হিসাবে যাচ্ছে প্রায় ৮০% ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া থেকে। অবশ্য বাংলাদেশ এবং ভারতও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নাই। তবে মজার ব্যাপার, এই যে এদের দাস বানিয়ে নিচ্ছে, এদেরকে মিনিমাম বেতনটাও দিচ্ছে না। এ যেন পেটেভাতে। হাতে ম্যাক্সিমাম ২/৩ রিয়াল ধরিয়ে দেয়।  মসজিদের সামনে যে ঝাড়–দার বা ঝাড় দিতো, আমি মোটামুটি ১০/১২ জনকে জিজ্ঞাসা করেছি (এদের মধ্যে পাকিস্তানী ও ভারতীয়ও ছিল), এরা সবাই বলেছে এদের বেতন প্রারম্ভিক ভাবে ৩০০ রিয়াল। আস্তে আস্তে ৪০০ পর্যন্ত হয়। আমার তো কেঁদে ফেলবার মত অবস্থা। আমি বললাম, এরা খেতে দেয়? বললো, কে খেতে দেবে? তাহলে এই ৩/৪ শ রিয়ালে কি ভাবে তোমাদের চলে? কালো হেকমত নামের ছেরেটা – ‘চলে না আপা…চলে না… চালিয়ে নিতে হয়।’ (চলবে)

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com