দারিদ্র বিমোচনে ‘বেসিক ইনকাম’ প্রকল্প কতটা সহায়ক হতে পারে?

5 মে, 2018

॥ খুরশিদ আলম ॥

অন্টারিও সরকার সম্প্রতি ‘বেসিক ইনকাম’ নামের একটি পাইলট প্রজেক্ট শুরু করেছে। যাদের আয় কম বা যারা বেকার কিংবা যারা শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে কাজ করতে অপরাগ, তাদেরকে এই প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ডলার প্রদান করা হচ্ছে মাথা পিছু। এই পাইলট প্রকল্পটি তিন বছর মেয়াদী। তিন বছর পর পর্যালোচনা করে দেখা হবে এর সুূফল কি হয়েছে। কিংবা আদৌ কোন উপকার হয়েছে কি না তাদের যারা এই প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করেছেন।

এই পাইলট প্রজেক্টে ৪ হাজার স্বল্প আয়ের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। টরন্টোর নিকটবর্তী হ্যামিলটন-ব্রেন্টফোর্ড এলাকা, থান্ডার বে এবং লিন্ডসে এলকায় বসবাসকারী স্বল্প আয়ের বাসিন্দাগণ এই সুযোগ পাচ্ছেন। গত সামার থেকেই শুরু হয়েছে এই প্রকল্প। অন্টারিওর প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন উইন গত বছর এপ্রিলে হ্যামিলটনে এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, অন্টারিওতে অরক্ষিত কর্মজীবী ও বেকারদের সহায়তা প্রদান এবং স্বল্প আয়ের লোকদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেছিলেন, এই অর্থ অত্যধিক এ কথা কোনভাবেই বলা যাবে না। মাথাপিছু বছরে মাত্র ১৭ হাজার ডলার বা তারও নীচে। কিন্তু তবু এই পরিমাণ অর্থ স্বল্প আয়ের মানুষদের জীবন মান উন্নয়নে যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে।

বেসিক ইনকাম পাইলট প্রজেক্টে বছরে ৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে। আগেই বলা হয়েছিল, মাথাপিছু ১৭ হাজার ডলার দেয়া হবে। তবে কর্মস্থল থেকে কারো যদি কোন আয় থেকে থাকে, সেই আয়ের অর্ধেক পরিমাণ অর্থ ঐ ১৭ হাজার থেকে কাটা যাবে। অর্থাৎ ১০ হাজার ডলার আয় থাকলে ৫ হাজার ডলার কাটা হবে ১৭ হাজার থেকে। এই প্রকল্পের আওতায় কোন দম্পতি বছরে সর্বোচ্চ ২৪ হাজার ডলার পেতে পারেন। যারা প্রতিবন্ধী তারা বেসিক ইনকামের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরো ৬ হাজার ডলার করে পাবেন।

বেসিক ইনকামের এই পাইলট প্রজেক্ট ইতিমধ্যেই ইতিবাচক কিছু ফল দিতে আরম্ভ করেছে বলে দাবী করেন যারা এর সুবিধা নিচ্ছেন। এমনি একজন হলেন ২৮ বছর বয়স্কা হ্যামিলটনের বাসিন্দা এ্যালানা বাল্টজার। তিনি টরন্টো স্টারকে বলেন এই প্রজেক্ট এর মাধ্যমে আমার বেসিক ইনকাম পূরণ হওয়াতে এখন আমার ফ্রিজ খালি থাকে না। আমি স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পারছি। গত নভেম্বরে শীতের জ্যাকেট কিনতে পেরেছি শীত থেকে বাঁচার জন্য। সারা জীবন সরকারী বাড়িতে থেকে বড় হয়েছি যেখানে বিবাদ আর কোলাহল নিত্যদিনের ঘটনা। যদি এই প্রজেক্ট অব্যাহত থাকে তবে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সরকারী বাসার হট্রগোল থেকে মুক্ত হতে পারবো। এই বেসিক ইনকাম আমার জীবনে একটা বড় ধরণের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে।

পিটারবরোর উত্তরে অবস্থিত লিন্ডসে এলাকার বাসিন্দা ৫৩ বছর বয়স্ক ক্যাথি মাহুদ টরন্টো স্টারকে বলেন, অত্র এলাকায় আমি ইতিমধ্যেই পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বেসিক ইনকামের সাহায্য পাওয়াতে এখানকার দরিদ্র বাসিন্দাদের জীবনে স্বস্তি নেমে এসেছে এবং তারা সুখী।

মাহুদ ইতিপূর্বে কর্মস্থলে এক দুর্ঘটনায় পড়ার পর থেকে ব্যাকপেইনে ভুগছেন। তার স্বামীও বছর দুই আগে গত হয়েছেন। ফলে চরম দারিদ্রতার মধ্যে পতিত হন তিনি। ডিজএবিলিটি বেনিফিট পাচ্ছিলেন মাসে ৭৩৫ ডলার। এখন বেসিক ইনকাম এর ১২০০ ডলার যোগ হওয়াতে বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন নিয়মিত। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পারছেন। ইতিপূর্বে করা ঋণসমূহ আস্তে আস্তে শোধ করতে পারছেন।

নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করতেন টিম বাটন। তিনি একটি ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ায় কাজ করতে অসমর্থ ছিলেন। পরে অন্টারিওর নতুন বেসিক ইনকাম কর্মসূচির মাধ্যমে সহায়তা পাওয়ায় তিনি বহু বছর পর প্রথমবারের মত ক্রিসমাসে বহু দূরে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরিকল্পনা করতে পেরেছিলেন। ওই সহায়তা পেয়ে তিনি স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার, বহুদিন ধরে ফেলে রাখা দাঁতের চিকিৎসা করানো এবং নিজ কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠার জন্য সহায়ক একটি কোর্স করার বিষয়ে ভাবারও সুযোগ পান। তিনি বলেন, এটি আমার জন্য একটি বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছে। প্রথম চেক পাবার পর থেকে আমি আমার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে আর বিষণœ মনে বসে থাকি না। এটি আমাকে বিষণœতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। আমি নিজেকে অনেক বেশি সামাজিক মানুষ বলে বোধ করছি।

৪৬ বছর বয়সী হ্যামিলটনের ডেভ চার্কিউইস্কি বলেন, তিনি বেসিক ইনকাম প্রকল্প থেকে যা পাচ্ছেন সেটি তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং মানসিক অসুস্থতাজনিত চাপ সহজতর করেছে। মানসিক অসুস্থতার কারণে ২০০২ সাল থেকে তিনি চাকরি করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, ১৪ বছর ধরে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসের পর এখন তিনি যেমন আছেন এতটা ভালো আগে কখনও ছিলেন না।

চার্কিউইস্কি এখন তার চাকরিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন যেখানে তার কাজ হলো মানসিক নানা জটিলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া।

এই বেসিক ইনকাম পাইলট প্রজেক্টটি আসলে চালু করা হয়েছে একটি পরীক্ষার অংশ হিসাবে। সেটা হলো, সরকারি সহায়তার অংশ হিসাবে অথবা দরিদ্র লোকেদের অধিকতর অর্থ দেওয়া হলে তা তাদের জীবনে উল্ল্লেখযোগ্য ভিন্নতা এনে দিতে পারে কি না তার মূল্যায়ন করা। দরিদ্র  লোকেরা পরবর্তী তিন বছর ধরে এই সহায়তা পেলে কী ধরণের সাড়া দেন সেটি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন কানাডা ও বিশে^র অন্যান্য স্থানের সামাজিক বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও নীতি-নির্ধারকরা।

এই পাইলট প্রকল্পের জন্য অন্টারিও সরকারের পক্ষ থেকে পরামর্শকের দায়িত্ব পালনকারী কানাডার সাবেক সিনেটর হাফ সেগাল বলেন, আমরা দেখতে চাই, “এই সহায়তা কী শিশুদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অধিকতর ভালো সুফল বয়ে আনতে পারে? তিন বছর ধরে এমন জীবনযাপনের ফলে এটি কি স্বাস্থ্যগত উন্নততর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে? কাজের ক্ষেত্রে যদি প্রণোদনার পরিপন্থী কিছু না ঘটে তাহলে এই সহায়তার কারণে কর্মস্থলের প্রতি অধিকতর অনুরাগের জন্ম দিতে পারে?”

একজন শ্রম আইনজীবী ডেভিড ওয়েকলি বলেন, এটি একটি বিরাট ধারণা বলেই মনে হয়, কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে এটির প্রচলন কতটা সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, “আমি মনে করি না যে, এটা সাশ্রয়ী কোনও বিষয়। যত মানুষকে এ ধরণের সহায়তা দিতে হবে তাদের সংখ্যা এত বেশি যে তা কোনওভাবেই সামাল দেওয়ার মত নয়। এতে যে ব্যয় হবে সেটাও বিশাল। এটি একটি বিরাট ব্যাপার।”

ওয়েকলি মনে করেন, এ ধরণের সহায়তা দেওয়া হলে তা লোকেদের মধ্যে কাজের প্রতি অনীহার জন্ম দেবে। অন্য সমালোচকেরা বলেন, এটি কোনও অর্থবহ পরিবর্তনের সূচনা করবে না, বরং কার্যত অন্যান্য সুবিধা কর্তনের পটভূমি হিসাবে কাজ করবে।

সুস্থভাবে বেচে থাকার জন্য বেসিক কিছু আয় জুটলে মানুষজন কাজের প্রতি অনীহা প্রকাশ করবে এমন ধারনার বিরোধীতা করে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একজন পুরষ্কারপ্রাপ্ত সমাজসেবী এ্যালেস সাংহা বলেন, তাহলে ধনীর দুলালেরা কি সবাই অলস? খাওয়া পরার চিন্তা নেই বলে কি তারা সবাই সারাদিন ঘরে বসে থাকেন? তারা কি তাহলে আনপ্রোডাক্টিভ, মদ্যপ? সমাজের কোন কিছুতেই তাদের কোন কন্ট্রিবিউশন নেই?

এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় কানাডার পার্লামেন্টারী বাজেট অফিস একটি হিসাব প্রকাশ করে যাতে বলা হয়, কানাডাব্যাপী বেসিক ইনকাম প্রজেক্ট চালু করতে হলে সরকারকে অতিরিক্ত ৪৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রভিন্সে চালু ওয়েলফেয়ার ও ডিজএবিলিটি বেনিফিট বাবদ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সরকারকে ব্যয় করতে হবে ৪৩ + ৩৩ = ৭৬ বিলিয়ন ডলার। এটি করা হলে প্রায় ৭৫ লাখ কানাডিয়ান বেসিক ইনকাম থেকে বেনিফিট পাবেন।

বেসিক ইনকামের সমর্থকগণ মনে করেন এটি তেমন কোন বিশাল আকারের খরচ নয় কানাডা সরকারের জন্য। সরকার প্রতি বছর ৬ শত বিলিয়ন ডলারের বেশী খরচ করে থাকে বিভিন্ন কাজে।

তবে যারা বেসিক ইনকাম এর বিপক্ষে তারা বলছেন এটি সরকারের সামর্থের বাইরে। আর এটি করতে হলে জনগনের উপর টেক্স এর চাপ বৃদ্ধি পাবে। এই অভিমতের পক্ষে আছেন কনজারভেটিভ এমপি Pierre Poilievre আছেন।

কিন্তু উপরে উল্ল্লেখিত বাড়তি ৪৩ বিলিয়ন ডলারের খরচ দেখে চমকে গেলে চলবে না। এমনটিই মনে করছেন হাফিংটন পোস্টের সিনিয়র বিজনেজ এডিটর। তিনি মনে করেন বেসিক ইনকাম প্রকল্প চালু করলে আমরা প্রকৃতপক্ষে লাভবানই হব বিভিন্নভাবে। প্রথমেই যে বিষয়টি ঘটবে তা হলো দারিদ্রতা খাড়া ভাবে কমে যাবে। আর এর মধ্য দিয়ে সরকারের খরচ অনেক হ্রাস পাবে। কারণ, দ্ররিদ্রতা একটি বিশাল খরচের বিষয়। বিশেষ করে হেলথ কেয়ারের দৃষ্টিকোন থেকে। দারিদ্রতা মানুষের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক রোগ সৃষ্টি করে। আর এর ব্যয়ভার বহন করতে হয় সরকারকেই। এই খরচ মোটেও কম নয়। এর জন্য সরকারকে প্রতি বছর বিশাল অংকের খচর বহন করতে হয়। ২০১৭ সালে হেলথ কেয়ার খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ হয়েছে ২৪২ বিলিয়ন ডলার।

উল্লেখ্য যে, গত শতকের ৭০ দশকে মেনিটোবায় তিন বছর মেয়াদী একটি বেসিক ইনকাম প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। তিন বছর পর দেখা গিয়েছিল মেডিক্যাল খাতে সরকারর ব্যয়ভার ৮% কমে যায়। সেই হিসাবের সঙ্গে গত বছরের মেডিক্যাল খাতের ব্যয়ভার (২৪২ বিলিয়ন) তুলনা করলে দেখা যায় বেসিক ইনকাম চালু করলে শুধু মেডিকেল খাতেই সরকারের সেভিংস হতে পারে বছরে ১৯ বিলিয়ন ডলার। এই সেভিংস এর সঙ্গে আরো যোগ হতে পারে পুলিশী খরচ, আদালতের খরচ। জেলখানার খরচ। দেখা গেছে দারিদ্র পীড়িত অঞ্চলে অপরাধের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশী। এক হিসাবে আমরা দেখতে পাই জেলখানায় বন্দি ৮০% আসামী আসে ঐ সকল পরিবার থেকে যারা দারিদ্রপীড়িত। কানাডার মোট জনসংখ্যার ১৫% দারিদ্রপীড়িত।

সরকারের উপর খরচের চাপ কমাতে পারে এমন আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। আর সেটি হলো, কানাডার জব মার্কেটে পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদের প্রবেশ পথে যে সকল বাধা তৈরী করা রাখা হয়েছে সে সকল বাধা অপসারণ করা। আমরা জানি টরন্টোসহ দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোতে বিপুল সংখ্যাক পেশাজীবী ইমিগ্রেন্ট রয়েছেন যারা তাদের নিজ নিজ পেশায় প্রবেশ করতে পারেননি চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈমাত্রীয়সূলভ আচরণের কারণে। আরো ষ্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলা উচিৎ বর্ণবাদী মনোভাবের কারণে। পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদের সামনে ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নামক এক উদ্ভট বাধা তৈরী করে রাখা হয়েছে। অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনও এই বাধাকে বর্ণবাদী আচরণ বলে আখ্যায়িত করেছে। যদি এই বাধা তৈরী করা না হতো, তবে ঐ বিপুল সংখ্যক পেশাজীবী ইমিগ্রেন্ট কানাডার অর্থনীতিতে বড়মাপের অবদান রাখতে সক্ষম হতো। অন্যদিকে নিজেদের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের উপর অর্থনৈতিক চাপ বহুলাংশে কমাতে পারতো। এবং ভবিষ্যতে যদি বেসিক ইনকাম প্রজেক্ট স্থায়ীভাবে চালু হয় তবে আবেদনকারীর সংখ্যাও সীমিত থাকবে সন্দেহ নেই।

কানাডার দুইজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ড্যানিয়েল মারটিন এবং রায়ান মেইলি ইতিপূর্বে যৌথভাবে একটি প্রবন্ধ লিখেন টরন্টো স্টার পত্রিকায় যেখানে তাঁরা উল্ল্লেখ করেন, “মানুষকে অসুস্থ করে তোলার পিছনে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির যেমন ভূমিকা থাকে তেমনি থাকে তাদের ব্যক্তিগত অভ্যাস যেমন ধূমপান, খাবার ঠিকমত না খাওয়া বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া অথবা অলস জীবন যাপন করা ইত্যাদি। তবে এগুলোর চেয়েও অনেক বেশী ভূমিকা রাখে মানুষের দারিদ্রতা। দরিদ্র এই মানুষদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর জন্য শুধু ঔষধ প্রেস্ক্রাইব করলেই হবে না বা তাদের ব্যক্তিগত অভ্যাস বদল করতে বললেও কোন লাভ হবে না। প্রয়োজন তাদের আয় বৃদ্ধি করা যেটাকে বলা যেতে পারে সুস্থ আয় বা হেলদি ইনকাম।”

সরকারের সহায়তা ছাড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য এই হেলদি ইনকাম নিশ্চিত করার তাৎক্ষনিক কোন উপায় এই মুহুর্তে নেই। অদূর ভবিষ্যতে হবে বা দূর ভবিষ্যতে হবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই। কারণ, মানব সমাজে ‘শোষণ’ বলে ক্যান্সারের চেয়েও একটা ভয়াবহ ব্যাধি বিদ্যমান আছে। মানুষের লোভ লালসা ঈর্ষা ও ক্ষমতাধর হয়ে উঠার হীন চেষ্টা থেকেই শোষণ প্রতারণা ইত্যাদির জন্ম হয়। আর এ সকল কারণেই বর্তমান বিশ্বে আমরা দেখতে পাই একদিকে অতি স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠছে এবং অন্যদিকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। অক্সফ্যামের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আট ধনকুবেরের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে ৩৬০ কোটি মানুষের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ! অক্সফ্যাম তাদের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়ে বিপজ্জনকভাবে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। অক্সফ্যামের গবেষণা প্রতিবেদনে আট ধনকুবেরের হাতে বিশ্বের দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত থাকার বিষয়টিকে ‘কল্পনাতীত বৈষম্য’ হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।

অন্যদিকে কানাডায় এই সুপার ধনীদের মধ্যে যারা শীর্ষে আছেন এমন দুইজন ব্যক্তির হাতে যে পরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে তার পরিমাণ দেশটির ১ কোটি ১০ লাখ দরিদ্র মানুষের হাতে যে সম্পদ রয়েছে তার সমান! সুপার ধনী এই দুই ব্যক্তি হলেন ডেভিড থমসন এবং গ্যালেন ওয়েস্টন সিনিয়র। ডেভিড থমসন ‘থমসন রয়টার্স’এর চেয়ারম্যান এবং গ্যালেন ওয়েস্টন সিনিয়র লবলজ কোম্পানী লিমিটেড এর প্রেসিডেন্ট। থমসন রয়টার্সের ব্যবসা হলো মিডিয়া আর লবলজ এর ব্যবসা হলো গ্রোসারী ও ঔষধের দোকান।

সম্পদের এই সীমাহীন বৈষম্য গোটা সমাজকেই একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। আর শুধু অক্সফ্যামের গবেষণা প্রতিবেদনেই যে এই বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে তা নয়। অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকেও প্রায় একই ধরণের চিত্র পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের জুনে প্রকাশিত কানাডার সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভ নামের একটি সংগঠনের রিপোর্টে দেখা যায়, সবচেয়ে ধনী ৮৬ জন ব্যক্তি বা পরিবার অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ০.০০২ শতাংশ লোক ক্রমশ আরও ধনী হয়ে উঠছেন এবং এই মুহূর্তে তাদের হাতে দেশের দরিদ্রতম এক কোটি ১৪ লাখ লোকের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত রয়েছে।

রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এই পরিসংখ্যান ১৯৯৯ সালের চেয়ে বেশি। ওই বছর সবচেয়ে ধনী ৮৬ ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ছিলো সবচেয়ে গরীব এক কোটি ১লাখ মানুষের সম্পদের সমান। তাদের ওই সম্পদ দিয়ে নিউ বার্নসউইক প্রভিন্সের সবকিছু কিনে ফেলার পরও আরো ৪ হাজার কোটি ডলার তাদের হাতে থেকে যাওয়ার কথা!

মানব সমাজের এই চরম বৈষম্য কোনদিন দূর হবে এমনটা আশা করা বোধ করি দিবা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদী নীতিতে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলোও আজপর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি এই বৈষম্য দূর করার জন্য।

আমরা জানি কানাডাকে বলা হয় ওয়েলফেয়ার স্টেট। অর্থাৎ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। জনগণের কল্যাণই এই রাষ্ট্রের মূল নীতি। সেই বিবেচনায় রাষ্ট্র বা কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলো দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠির কল্যাণে এগিয়ে আসা উচিৎ। তাছাড়া কানাডার সিংহভাগ মানুষই এই জাতীয় প্রকল্পের পক্ষে। ipsos এবং global news পরিচালিত এক জরীপ তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় কানাডার শতকরা ৪৪ ভাগ লোকই বেসিক ইনকাম প্রকল্পের পক্ষে। বিপক্ষে হলো ৩১%। আর শতকরা ২৪ জন কোন পক্ষেই মত দেয়নি। অর্থাৎ নিরপেক্ষ থেকেছেন।

যদি তিন বছর পর অন্টারিওর বেসিক ইনকাম এর পাইলট প্রকল্প পরীক্ষা নিরীক্ষার পর প্রতীয়মান হয় যে এটি সত্যিই একটি জনক্যাণমূলক পদক্ষেপ ছিল তবে তা প্রভিন্সব্যাপী চালু করা যেতে পারে। চালু করা যেতে পারে দেশব্যাপীও।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ