তাসের আড্ডা – ১৮

5 মে, 2018

শুজা রশীদ

আজ শনিবার তাসের আড্ডায় সবারই মন টন খুব একটা ভালো নেই। মাত্র কয়েকদিন আগেই ভ্যান চাঁপা দিয়ে দশ জন টরন্টোবাসীকে হত্যা করেছে এক লোক। খেলা খুব একটা আগায় না। আলাপ সেই দিকেই মোড় নেয়। রনি ডাউনটাউনে কাজ করে। নৃশংষ এই হত্যাকান্ড তার কাজের জায়গা থেকে বেশ দূরে হলেও আরও অনেকের মত সেও বেশ একটু নাড়া খেয়েছে।

“চিন্তা করতেও কষ্ট হচ্ছে যে টরন্টোতে এই জাতীয় একটা ঘটনা ঘটতে পারে।” রনি হাতের তাস টেবিলে ফেলে দিয়ে বলে। “আজ আর খেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বলতে পারেন বোধোদয় হয়েছে আমার।”

জালাল বলল, “কি নিয়ে কি হল বলেন তো? বোধোদয় হওয়াতো ছোটখাট ব্যাপার নয়।”

রনি বলল, “ভাই, এই যে ভ্যান সাইড ওয়াকে তুলে দিয়ে মানুষ মারার কায়দা বের হয়েছে, এটা নিয়ে অনেক চিন্তার মধ্যে আছি। আমি তো প্রতিদিন লাঞ্চ সেরে যাই বাইরে হাঁটতে। ডাউন টাউনের নানা রাস্তায় হাঁটি। এতো দিন নিশ্চিন্তে হেঁটেছি। এই ঘটনার পর এখন গাড়ী দেখলেই সিঁটিয়ে যাচ্ছি। সারা জীবনের সমস্ত ভুল ভ্রান্তি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বোধহয় কোন হারামী ব্যাটা গায়ের উপর গাড়ী তুলে দেয়।”

লাল ভাই বলল, “আপনার চিন্তার কোন কারণ নাই। এই ব্যাটা হল নারী বিদ্বেষী। তাই মেয়েদের উপর গাড়ী তুলে দিয়েছে।”

জিত বলল, “সেইখানে আশি বছরের দুই বৃদ্ধাও ছিল। তাদের উপর নিশ্চয় ব্যাটার কোন রাগ ছিল না। ওর মাথায় সমস্যা। এমন যদি কোন ব্যবস্থা থাকত যে ক্ষতিকর কিছু করবার আগেই এদেরকে ধরে ধরে কোথাও ঢুকিয়ে রাখা যেত। এতো গুলো নিরীহ মানুষ অকারণে প্রাণ হারাল। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে যদি এই জাতীয় উন্মাদের হাতে জীবন দিতে হয় তাহলে আর নিজেকে মুক্ত বলে বিবেচনা করার কি অর্থ?”

সাইদ এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিল। সে এবার বলল, “এটা তো নতুন কিছু নয় রে ভাই। আমাদের ভাগ্য ভালো যে কোন পাগল ইসলামের নাম নিয়ে কিছু একটা করে বসে নি। আমি তো প্রথম যখন শুনি তখন শুধু ভাবছি আর যাই হোক মুসলিম যেন না হয়। বার্সেলোনা, লন্ডন, নিউইয়র্কসহ আরোও বেশ কিছু শহরেই তো গত দুই বছরে বেশ কয়েকটা এই জাতীয় আক্রমণ হয়েছে। গত বছর অক্টোবর মাসেই তো নিউ ইয়র্কে এক লোক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছে একটা ব্যাস্ত বাইসাইকেল পথে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে আট জনকে হত্যা করেছিল। আমাদের ভাগ্য ভালো যে এতোদিন কিছু হয় নি।”

কবীর বলল, “আমি নিউ ইয়র্কে গিয়ে দেখলাম ম্যনহাটনে সব সাইড ওয়াকে ইয়া বড় বড় পাথর দেয়া। শেষ পর্যন্ত কি আমাদের এখানেও তেমন কিছু করতে হবে?”

রনি বলল, “করা তো উচিৎ। এটা দেখার পর কোন উন্মাদের মাথায় কি বুদ্ধির উদয় হবে কে জানে?”

সাইদ বলল, “দেয়া উচিৎ বললেই তো হয় না। খরচের ব্যাপার আছে না? শক্ত ইস্পাতের খুটিও পোঁতা যায়। কিন্তু একটা ঘটনা ঘটেছে বলেই সরকার একেবারে হাতা গুটিয়ে সাইড ওয়াক দুর্ভেদ্য করতে লেগে যাবে তা ধরে নেয়াটা ঠিক না।”

জিত বলল, “রনি ভাই, আপনার কি বোধোদয় হল সেটা কিন্তু এখনও বলেন নি।”

রনি গম্ভীর মুখে বলল, “প্রতিদিন অফিস যাবার আগে বেলার সাথে ঝগড়া করে যাই। এতো মাতবরি করে। আমি আমার অফিসে কি পরে যাবো সেটাও তার ঠিক করতে হবে। বোঝো ব্যপারটা? যাইহোক, এখন থেকে ঠিক করেছি, এই ঝগড়ার ব্যাপারটা বন্ধ করে দেব। হাসি মুখে বিদায় নিয়ে যাবো। কোথায় কিভাবে গাড়ি চাঁপা পড়ে মরে থাকব কে জানে।”

সবাইকে হাসতে দেখে রনি বলল, “এটা হাসির কোন কথা নয়। মধ্যবয়েসে এসে এখন শুধু মৃত্যুর কথা মনে হয়।”

কবীর হাসতে হাসতে বলল, “বেলা ভাবীকে আপনার মাথায় যে বোধের উদয় হয়েছে তার কথা বলেছেন?”

রনি মুচকি হেসে বলল, “আরে না! খাতির করলে মাতবরি আরোও বাড়বে।”

আরেক পশলা হাসি হল।

লাল ভাই বলল, “আচ্ছা স্যামি ইয়াতিমের হত্যার কেসে পুলিশটার বিচারে যে রায় হল, রায়টা কেমন হয়েছে বলেন তো? ছেলেটাকে খুন করল কিন্তু জেল হল মাত্র ছয় বছরের?”

সাইদ বলল, “কেসটা যত সহজ মনে হয় তত সহজ নয়। কনস্টেবল জেমস ফরসিলো প্রথম যখন স্যামিকে গুলী করে তখন তার বক্তব্য অনুযায়ী সে আত্মরক্ষা করবার জন্য গুলী ছোড়ে যেহেতু ছেলেটার হাতে ছোট একটা ছুরি ছিল এবং সে তার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসেছিল। কনসটেবল তাকে লক্ষ্য করে তিন টা গুলী ছোড়ে। তার একটা স্যামি ইয়াতিমের হৃতপিন্ডে লাগে এবং সেই ক্ষত থেকেই ছেলেটা মারা যায়। কিন্তু পুলিশ অফিসারের শাস্তি  হয়েছে সে জন্য না। স্যামি ইয়াতিম যখন গুলী খেয়ে পড়ে আছে বাসের মধ্যে তখন সে তাকে আরোও ছয়বার গুলী করে। এটার কোন দরকার ছিল না। এবং এই কারণেই তার শাস্তি হয়েছে। পরে গুলী করবার কারণটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢোকে না।”

লাল ভাই বলল, “আরে ভাই, ঐ ব্যাটা হচ্ছে রেসিস্ট। দেখেছে ভিন দেশী, শ্বেতাঙ্গ নয়, সাথে সাথে ওর রক্তে খুনের নেশা চেপে গেছে।”

রনি বলল, “লাল ভাই, সব কিছু এতো সাদা কালো করে না দেখাটাই উচিৎ। স্বীকার করছি এই অফিসারের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিৎ। আমার মতে তার যে শাস্তি হয়েছে সেটা যথাযথ। কারণ আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, ইয়াতিম কি করতে পারতো কিংবা কি করতে চেয়েছিল সেটা আমরা কিন্তু কখন জানবো না। একটা বাস ব্যাবহার করে অনেক জান-মালের ক্ষতি করা সম্ভব। যদি সত্যি সত্যিই তেমন কিছু একটা অঘটন ঘটে যেত তখন আবার আমরাই পুলিশকে দোষারোপ করতাম, সময় মত একটা ব্যাবস্থা না নেবার জন্য।”

জিত বলল, “আমাদের মত উন্নতদেশে মানসিক ভাবে অসুস্থদের জন্য আরোও ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা দরকার। সরকারী উদ্যোগ থাকা দরকার। পরিবারের হাতে ছেড়ে দেয়াটা ঠিক নয়। যদিও, পারিবারিক এবং বন্ধু বান্ধব্দের সহযোগীতা ছাড়া সরকারই বা কতটুকু করতে পারবে সেটাও একটা প্রশ্ন।”

কবীর বলল, “সরকারের কথাই যখন তুল্লেন তাহলে এবার বলেন আমাদের এখানে আগামী ভোটে কি হবে বলে আপনাদের ধারণা?”

সাইদ বলল, “আর ধারনার কোন দরকার আছে? পোলে তো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পিসি পার্টী অনেক এগিয়ে আছে। টরন্টো ছাড়া আর সব জায়গাতেই তারা এগিয়ে। একটা পরিবর্তন আসাই ভালো। ক্যাথরিন তো সবকিছুতে একেবারে প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়ে গেল। দেখা যাক ডাগ ফোর্ড যদি জেতে তাহলে সে কি করে।”

জিত বলল, “এন ডি পি কি লিবারেলদের চেয়ে ভালো করবে মনে হয়?”

সাইদ বলল, “পোলের নাম্বার অনুযায়ী ভোট কম পেলেও তারা সীট বেশী পেতে পারে লিবারেলদের চেয়ে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, পোল আর ভোট সব সময় সম্পূর্ণ মেলে না। তার প্রমাণ তো জনাব ট্রাম্প স্বয়ং।”

লাল ভাই বলল, “আমাদের স্কারবোর সাউথ ওয়েস্ট এলাকায় একজন বাংলাদেশী কানাডীয়ান মেয়ে এম পি পদে দাঁড়িয়েছে, সেটা জানেন?”

সাইদ বলল, “হ্যা, ডলি বেগম। এন ডি পি থেকে। বেশ সপ্রতিভ মেয়ে। কথা বলে ভালো লাগে। তবে সে পিসি ক্যান্ডিডেটের সাথে পারবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু ভোট নিশ্চয় অনেক পাবে।”

রনি বলল, “আমিও শুনেছি। কিন্তু এন ডি পির নেতা হিসাবে আমি জাগমিত সিংকে এখনও মেনে নিতে পারি না। হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসার মত মনে হল তার আচমকা এন ডি পির নেতা বনে যাবার ব্যাপারটা। তার নেতৃত্বে আছে এমন কাউকে ভোট দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।”

জালাল বলল, “আপনি তো ঐ এলাকাতেই থাকেন না। সুতরাং সেখানকার কাউকেই ভোট দেবার আপনার কোন সুযোগ নেই। তবে আমি নিশ্চয় দেব। আমাদের একটা মেয়ে জিততে পারলে আমাদের সবার মাথা উঁচু হয়, তাই না?”

রনি বলল, “মাথা উঁচু নিচুর ব্যপার তো এটা নয় জালাল ভাই। সে যদি জেতে তাহলে আপনার এলাকার জন্য কি করতে পারবে সেটাই আপনাকে ভাবতে হবে। শুধু বর্ণ, জাতি আর ধর্ম দেখে যদি আমরা ভোট দেই তাহলে যারা সত্যিকারভাবে যোগ্য মানুষ তাদের নেতৃত্ব দেবার সুযোগই আসবে না। মেয়েটা যদি যোগ্য হয় তাকে অবশ্যই ভোট দেবেন। কিন্তু শুধু আমাদের মেয়ে বলে নয়।”

লাল ভাই বলল, “রনি ভাই, এই দেশে সবাই তাই করছে। দেখেন চাইনীজরা কি করছে। ভারতীয়রা কি করছে। তামিলরা কি করছে। আমরা কেন করব না?”

সাইদ বলল, “ভালো হোক আর

মন্দ হোক এটা বন্ধ করা যাবে না। এই শহরের বিভিন্ন স্থানে যেহেতু জাতি ভিত্তিক এলাকা গড়ে উঠছে সেহেতু ভোটও যে খানিকটা জাতি ভিত্তিক হবে সেটা মোটামুটিভাবে বলেই দেয়া যায়। ঐ এলাকায় অনেক বাংলাদেশী ভোটার আছে। তারা সবাই ভোট দিলে ডলি হয়ত জিতে যাবে। দেখা যাক কি হয়। আমাদের পরবর্তি বংশধরেরা রাজনীতিতে এগিয়ে যাক এটা তো আমরা সবাই চাইবই। এতে ভালো বই মন্দ কিছু নেই।”

জিত বলল, “ভোটাভুটির কথাই যখন উঠে গেল তখন ভোট নিয়ে একটা জোক বলি।

এক রাজনিতিবিদ গেছে ইন্ডীয়ান রিজার্ভেশনে, নেটিভ ইন্ডীয়ানদের ভোট পাবার আশায়। সে বক্তৃতা দিচ্ছে, ‘যদি আমি ভোটে জিততে পারি তাহলে সব নেটিভ ইন্ডীয়ানদের জন্য ফ্রি উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করব।’ এই কথা শুনে উপস্থিত জনতা খুব হৈ চৈ করে চীৎকার করে উঠল, ‘হোয়া। হোয়া।’

রাজনীতিবিদ তো খুব খুশি। শব্দটার মানে না জানলেও সে ভাবল তারা নিশ্চয় ভালো কিছুই বলছে। সে আরও জোর গলায় বলল, ‘যদি আমি জিতি তাহলে সব নেটিভ ইন্ডীয়ানদের চিকিৎসা ফ্রি করে দেব।’ জনতা এবার আরোও জোরে বলে উঠল, ‘হোয়া, হোয়া।’

রাজনীতিবিদ ভাবল সে এদের সবাইকে জয় করে নিয়েছে। ভোটে সে নির্ঘাত জিতবে। সে মঞ্চ থেকে নেমে এসে কারো কারো সাথে হাত মেলাল। কাছেই এক দল গরু চরছে দেখে সে গদ্গদ হয়ে বলল, ‘আমাদের বিরাট ফার্ম ছিল। গবাদি পশু আমার খুব পছন্দ। আমি কি ওদের গায়ে একটু হাত বোলাতে পারি?’

তার ইন্ডিয়ান সঙ্গী বলল, ‘নিশ্চয়। তবে আবার হোয়া-য় পা দিও না যেন। খুব দুর্গন্ধ!’

শুজা রশীদ

কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট