তাসের আড্ডা – ১৭

এপ্রিল 8, 2018

শুজা রশীদ

সাইদের বাসায় স্রেফ ছেলেদের তাস খেলার আড্ডা বসার কথা ছিল কিন্তু আজ মেয়েরাও নানা টাল বাহানা করতে করতে শেষ পর্যন্ত এসে জুটেছে। ইদানীং তাদের তাস খেলার প্রতিও বেশ আগ্রহ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বেলার। যতটুকু না আগ্রহ তার চেয়েও রনিকে জ্বালানোর জন্য বেশী করে করে। রনির খুব ভালো একটা হাত এসেছিল। ডাকাডাকি হচ্ছে তার মধ্যে পটাপট তার হাতের তাসের খবর সে ব্রডকাস্ট করে দিল। রনি অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে তাকে ভস্ম করার চেষ্টা করল। বেলা খিল খিল করে হাসছে। তাস খেলা নিয়ে রনির সিরিয়াসনেস দেখতে তার মজাই লাগে।

আলাপ শুরু হল কনজারভেটিভদের লিডারশীপ ইলেকশন নিয়ে। “রনি ভাই, ডাগ ফোর্ড তো আপনাদের নেতা হয়ে গেল। আপনি খুশী?” কবীর বলল।

রনি মুখ বাঁকাল। “খুশী হব কি হব না বুঝতে পারছি না। এই লোকটার মধ্যে একটা ক্ষুদে ট্রাম্প ট্রাম্প ভাব আছে। প্যাট্রিক ব্রাউনের ফ্রি ফলের পর মনে হচ্ছিল একজন মহিলা এলে ভালো হত। ক্রিস্টিন এলিয়টতো প্রায় জিতে গিয়েছিল। ভোটের সংখ্যায় জিতেছে, কিন্তু ইলেক্টোরাল ভোটে হেরেছে। ট্র্যাম্প আর হিলারীর অবস্থা।”

জিত বলল, “ডাগ ফোর্ড আর ট্রাম্প অবশ্য এক নয়। ইমিগ্রেশন নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই। সে তার ভাই রব ফোর্ডের মতও নয়। আচার আচরণে ভদ্র। তবে রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা কম। একবার মাত্র কাউন্সেলর হয়েছিল।”

বেলা বলল, “আমার বেশী পছন্দ হয় না। কেমন যেন। এখন ক্যাথলিনের বিরুদ্ধে জিতবে কিনা সেটাই বড় কথা।”

সাইদ বলল, “ক্যাথলিনের বিরুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা ডাগ ফোর্ডেরই বেশী। কনজারভেটিভরা সব সময় টরন্টোর কোরে গিয়ে হারে। ফোর্ড পরিবারের সেখানে যথেষ্ট সমর্থন আছে। ঐ ভোটগুলো পাবার জন্যই তাকে লিডারশীপ ভোটে প্রতিযোগিতা করবার জন্য আনা হয়েছিল। কাজ হাসিল হয়েছে। এবার কনজারভেটিভদের ওন্টারিওতে ভোটে জেতার একটা বড় সুযোগ আছে। বিশেষ করে ক্যাথলিনের জনপ্রিয়তা যেমন ধুলায় লুটোপুটি খাচ্ছে।”

জালাল বলল, “এখন তো আবার প্রি স্কুলারদের জন্য ফ্রি চাইল্ড কেয়ার দেবার ঘোষনা দিয়েছে। ভোটের আগে মানুষকে পটানোর চেষ্টা।  আপনাদের কি মনে হয়, এতে কাজ হবে?”

রুমা বলল, “কেন হবে না? গরীবদের অনেক লাভ হবে। অনেকেই আছে যাদের বাচ্চা রাখার জন্য অনেক খরচ করতে হয়।”

রনি তেঁতো গলায় বলল, “বজ্জাতী! অন্যের টাকা নিয়ে খুব দাপাদাপি! বাজেট ব্যালেন্স করবার কথা, এখন বিশাল গ্যাপ থাকবে। এই ফান্ড কোথা থেকে আসবে তাও পরিষ্কার করে বলে না।  লাফ ঝাঁপ দিয়ে মিনিমাম ওয়েজ এতোখানি বাড়িয়েছে, জিনিষপত্রের দাম বাড়ছে, ফুল টাইম কাজের সংখ্যা কমছে। নিজের সুবিধামত এক দিকের মাল আরেক দিকে ঢালছে। এইবার যদি একে হারানো না যায় তাহলে বেইজ্জতী হবে।”

সাইদ বলল, “স্বীকার করছি রাজনৈতিক খেল কিন্তু তোমার ভাবী কথাটা ঠিক বলেছে। একটা শ্রেণীর মানুষের অনেক উপকার হবে। ইউরোপে তো অনেক দিন ধরেই আছে। নর্থ আমেরিকাতেই সরকারগুলো এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।”

লাল ভাই বলল, “সব কিছুরই ভালো মন্দ দুই দিক আছে। কিন্তু ক্যাথলিনের উপর থেকে অনেকেরই মন উঠে গেছে। সমস্যা হচ্ছে কনজারভেটিভরা তো আবার ইমিগ্রান্টদের জন্য ভালো না।”

রনি আপত্তি করল। “লাল ভাই, কে বলেছে এই সব? জাস্টিন ট্রুডোর মত ইল্লিগাল ইমিগ্রান্টদেরকে দুই হাত বাড়িয়ে কানাডায় আহবান না করলেই কি ইমিগ্রান্টদের বিরুদ্ধে যাওয়া হয়? ইমিগ্রেশান একটা খুব গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার। এটাকে খুব সতর্কতার সাথে ম্যনেজ করা উচিৎ নইলে নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতের বাইরে চলে যাবে।”

জালাল তাস বাটতে বাটতে বলল, “বস তো ইন্ডিয়া গিয়ে কেলেঙ্কারী করে এসেছে। এইরকম একটা ভুল কি করে হতে পারে চিন্তা করা যায়? জাসপাল আতওয়াল হচ্ছে মার্কামারা শিখ সেপারাটিস্ট এবং শাস্তিপ্রাপ্ত টেররিস্ট। দিল্ল্লিতে রিশেপশনে তাকে নিমন্ত্রন জানানো হল আর কেউ কিছু জানে না এটা বিশ্বাসযোগ্য? এটা ট্রুডো কিভাবে মিস করে?”

ইলা বলল, “তোমরা শুধু ট্রুডোর দোষ দাও কেন? ও কি সব কিছু নিজে করে নাকি! “

সাইদ বলল, “কে করে সেটাতো আমাদের জানার দরকার না। বস হিসাবে দায়িত্ব তো তাকেই নইতে হবে। সম্পর্ক ভালো করতে গিয়ে ইন্ডিয়ার সাথে রীতিমত পানি ঘোলা করে ফেলেছে এই আতওয়াল ব্যাটাকে নিয়ে। খামাখা ভারতীয়দের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছে। দুর্বল নেতৃত্ব।”

বেলা বলল, “আসলেই। প্রথম প্রথম চেহারা টেহারা দেখে সবাই খুব পছন্দ করেছিল কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে খেই হারিয়ে ফেলছে। সব বাইরে বাইরে। আসল কাজ কিছুই করছে না। ভারতের এই সফর হচ্ছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ঐ দেশী পোশাক পরে নাচলে গাইলেই হবে?”

রুমা হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে বলল, “আচ্ছা, আমেরিকায় যে স্কুলের ছেলেমেয়েরা গান কনট্রোল নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, এটা সম্বন্ধে সবার মতামত কি?”

বেলা লুফে নিল। “ফ্লোরিডায় তো অন্তত কিছু কাজ হয়েছে। যদিও বদমাশ NRA (National Rifle Association) কেস ঠুকে দিয়েছে। অন্য কোথাও কিছু হবে বলে মনে হয় না।”

রনি বলল, “তথাকথিত সম্মানিত মানুষজন কিভাবে কথাবার্তা বলছে খেয়াল করেছ? মনে হয় যেন বেঁচে গিয়ে বাচ্চাগুলো অপরাধ করে ফেলেছে। পেনসিল্ভানিয়ার প্রাক্তন সিনেটর রিক স্যান্টোরাম তাদেরকে বলেছে CPR শিখতে কিংবা নিজেরাই স্কুল শূটিং বন্ধ করবার জন্য কিছু একটা উপায় বের করতে, খামাখা ল মেকারদেরকে নিয়ম কানুন বদলানোর জন্য বিরক্ত না করে! কত বড় গর্দভ হলে এই জাতীয় একটা কথা বলতে পারে? তারা রাজনৈতিকভাবে একটা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে আর সে তাদেরকে বলছে – চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।”

কবির বলল, “তার CPR  মন্তব্যের উত্তর দিয়েছে একজন “গুলী খেলে CPR  এ কাজ হয় না।”

জিত বলল, “আশ্চর্যের ব্যাপার হল পার্কল্যান্ডের স্কুলের খুনীটার কাছে সারা দেশ থেকে মানুষ জন সমর্থন আর প্রেম নিবেদন করে চিঠি লিখছে, টাকা পয়সা পাঠাচ্ছে। এখন পর্যন্ত নাকি আট হাজার ডলার জমা হয়েছে। আরোও আসছে। বিয়ের প্রস্তাব আসছে। অসুস্থ সমাজ!”

কবীর যোগ করল, NRA  নাকি এই ঘটনার পর তিন গুণ বেশী ডোনেশন পেয়েছে। আসলে আমেরিকার অধিকাংশ মানুষই বোধহয় এই বন্দুকবাজী পছন্দ করে।”

সাইদ বলল, “রিটায়ার্ড সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস জন পল স্টিভেন্স যা বলেছেন সেটাই করা উচিৎ। বিপ্ল্লব যদি করতেই হয় তাহলে গান কন্ট্রোলের জন্য না করে একেবারে সেকেন্ড এমেন্ডমেন্ট রিপিল করবার জন্যই করা উচিৎ। আধাআধি না করে একেবারে মূল সমস্যায় গিয়ে হানা দেয়া উচিৎ।”

লালা ভাই বলল, “ট্র্যাম্প বাবাজী ঐ কথা শোনার পর সাথে সাথেই টুইট করেছে, ‘সেকেন্ড এমেন্ডমেন্ড কোনদিন রিপিল হবে না’।”

রনি বলল, “কোনদিন হবে কি হবে না সেটা ও বলার কে? ওকে গিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করুক না সেকেন্ড এমেন্ডমেন্টটা কি। আমার ধারণা বলতে পারবে না। ক্রীতদাস প্রথার কথা চিন্তা করেন। সেই সময় কেউ কি ধারণা করেছিল ঐ প্রথা বন্ধ হয়ে যাবে? একটা সিভিল ওয়ার লড়তে হয়েছে কিন্তু পরিবর্তন তো ঠিকই হয়েছে।”

লাল ভাই বলল, “ঐ গাড়োলের কথা বলতে ভালো লাগে না। একটু টরন্টোর কথায় আসি। এতো কাল ভাবতাম সিরিয়াল কিলার বোধহয় শুধু আমেরিকাতেই আছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের এখানে এই শহরেই একজন দিব্যি আমাদের নাকের ডগা দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিল। কি করে সম্ভব এটা?”

রুমা বলল, “আট বছর ধরে সে মানুষ খুন করে যাচ্ছে অথচ পুলিশ কোন কিছু বের করতে পারে নি। গত বছর ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর একজন PhD ক্যান্ডিডেট শাশা রিড গে ভিলেজে মানুষ জন যেভাবে মিসিং যাচ্ছে সেই ডাটা দেখেই ধারণা করেছিল সেখানে হয়ত একজন সিরিয়াল কিলার আছে। অথচ পুলিশ কি করে এমন নিক্রিয় থাকল? চোখের সামনে খুন হচ্ছে আর পুলিশের টনক নড়ছে না, ভাবা যায়?”

জিত বলল, “পুলিশের হচ্ছে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। তাও ভালো যে শেষ পর্যন্ত ধরতে পেরেছে।”

সাইদ বলল, “ঘটনাগুলো গে ভিলেজে ঘটার ফলে হয়ত পুলিশ মনযোগ কম দিয়েছে। ঠিক যেভাবে ফার্স্ট নেশানের মেয়েরা খুন হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন বিচার হয় না। খুনীরা ধরাও পরে না। কয়দিন আগে টিনা ফন্টেইনের খুনের বিচারেও তো লোকটা ছাড়া পেয়ে গেল। দুই ক্ষেত্রেই সম্ভবত এক ধরণের প্রিজুডিশ কাজ করেছে। ”

জিত বলল, “পুলিশের কথাই যখন উঠল তখন কয়েকটা জোক বলি।  রাত দুইটার দিকে এক লোককে রাস্তায় থামিয়েছে পুলিশ। অফিসার জিজ্ঞেস করল, ‘এতো রাতে গাড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?’ লোকটা উত্তর দিল, ‘একটা লেকচার শুনতে যাচ্ছি মদ

খাওয়া আর সিগ্রেট খাওয়ার নানা ধরণের অপকারিতা সম্বন্ধে।’ ‘বল কি? এতো রাতে তোমাকে কে লেকচার শোনাবে?’

‘আর কে? আমার বউ।’

আরেকটা বলি। এক লোক তার স্ত্রীকে নিয়ে রাতে গাড়ী চালিয়ে ফিরছে। পুলিশ তাকে থামাল।

অফিসারঃ তুমি ৬০ এর জোনে ৯০ তে যাচ্ছিলে।

ড্রাইভারঃ না তো। আমি তো ৬০ এই যাচ্ছিলাম।

স্ত্রীঃ মিথ্যে বল না হ্যারি। তুমি ৯০ তেই যাচ্ছিলে।

অফিসারঃ তোমার টেইল লাইট দেখলাম ভাঙ্গা। ঐ জন্যেও একটা টিকেট দেব।

ড্রাইভারঃ বল কি? ওটা কখন ভাঙল?

স্ত্রীঃ ভান কর না হ্যারি। ওটা মাস খানেক আগেই ভেঙেছে। তুমি তো জানই।

অফিসারঃ তোমার সিট বেল্ট পরা ছিল না। ঐজন্য আরেকটা সাইটেশন দেব।

ড্রাইভারঃ কসম অফিসার, সিট বেল্ট পরা ছিল। তুমি থামানোর পর খুলেছি।

স্ত্রীঃ মিথ্যে বল না হ্যারি। তুমি কোন দিনই সিট বেল্ট পর না।

এইবার ড্রাইভার খুব ক্ষেপে গিয়ে স্ত্রীকে ধমক দিল। “তোমার মুখটা একটু বন্ধ রাখতে পারছ না?”

অফিসারঃ ম্যাডাম, সে কি আপনার সাথে সব সময় এইরকম খারাপ ব্যাবহার করে।

স্ত্রীঃ একমাত্র যখন মাতাল থাকে তখন।”

কবীর বলল, “আমি একটা বলি। LAPD, FBI আর CIA প্রমাণ করবার চেষ্টা করছে যে অপরাধী ধরায় তারাই শ্রেষ্ঠ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাদেরকে পরীক্ষা করবে। সে তিনটা ভিন্ন জঙ্গলের মধ্যে একটা করে খরগোশ ছেড়ে দিয়ে প্রতিটা দলকে একটা জঙ্গল দিয়ে বলল খরগোশ ধরে আনতে। যারা আগে ধরতে পারবে তারা জিতবে।

CIA গেল। তারা জঙ্গলের মধ্যে ইনফরম্যান্ট বসাল। প্রত্যেকটা গাছ আর প্রাণীকে জিজ্ঞাসাবাদ করল। তিন মাস পরে এসে রিপোর্ট দিল, সেই জঙ্গলে কোন খরগোশ নেই।

FBI গেল। তারা সপ্তাহ দুই জঙ্গলের মধ্যে খুব খোঁজাখুঁজি করে যখন খরগোশ খুঁজে পেল না তখন পুরো জঙ্গল জ্বালিয়ে দিল। খরগোশ যদি থেকেও থাকে ঐ আগুনেই জ্বলে পুড়ে যাবে। এইবার বোঝ শালা খরগোশ, পালিয়ে থাকার মজা!

“পরিশেষে গেল LAPD – লস এঞ্জেলস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। দুই ঘন্টার মধ্যে তারা একটা ভালুককে পেটাতে পেটাতে টেনে হেঁচড়ে জঙ্গল থেকে বের করে নিয়ে এলো। ভালুকটা চীৎকার করছে, ‘ঠিক আছে! ঠিক আছে! আমি খরগোশ! আমি খরগোশ!”

শুজা রশীদ

কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

টরন্টো