তাসের আড্ডা – ১৪

জানুয়ারী 6, 2018

শুজা রশীদ

সব শনিবার তাসের আড্ডা বসানো যায় না, দাওয়াত থাকে। নিজেদের মধ্যে দাওয়াত থাকলে সুযোগ বুঝে তাসাড়ুরা সটকে পড়ে। কোন একটা স্থান খুঁজে নিয়ে খেলতে বসে যায়। কিন্তু সবসময় সেটা সম্ভব হয় না। আজ যেমন হচ্ছে না। কবীরের বাসায় দাওয়াত ছিল। ভেবেছিল খাওয়া দাওয়া সেরে বেসমেন্টে গিয়ে বসে পড়বে। কিন্তু খেতে খেতেই বিশাল তর্কা তর্কি শুরু হয়ে গেল। বিষয়বস্তু জেরুজালেম। শনিবার এলেই তাস খেলার জন্য ব্যাস্ত হয়ে থাকে রনিরা। এইসব ফালতু তর্কে জড়ানোর কোন আগ্রহই ছিল না তাদের কিন্তু বাক-বিতণ্ডা করা যাদের স্বভাব কোন সুযোগ অবহেলায় হারানো তাদের পক্ষে ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হয় না।

আলাপ শুরু হয়েছিল নেহাতই নিরীহভাবে। বেলা ইদানীং বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে ভয়ানক পড়াশুনা করছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খবর পড়ে। আগে এই সব ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ ছিল না। ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবার পর এই একটা পরিবর্তন হয়েছে। বেলা এমনই ট্রাম্প বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে যে সে তার সব খবর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাখতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগে ডিসেম্বরের ৬ তারিখে হঠাৎ করেই ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিল সে রাষ্ট্রীয়ভাবে জেরুজালেমকে ইস্রায়েলের রাজধানী হিসাবে মেনে নিচ্ছে এবং আমেরিকার এম্ব্যাসি সেখানে সরিয়ে আনবে।  তাই নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক গোলমাল চলছে। UN বাইশে ডিসেম্বর একটা স্পেশিয়াল ভোটের ব্যবস্থা করেছিল ট্রাম্প সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।  ১২৮ টি দেশ এই রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দেয় এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে বর্জন করে। নয়টি দেশ রেজুলেশনের বিপক্ষে এবং ৩৫ টি দেশ ভোট দান থেকে বিরত থাকে।  বিরতদের মধ্যে একটি দেশ হচ্ছে কানাডা। সেখানেই বেলার ভয়ানক আপত্তি।

“কানাডার মত একটা দেশের পক্ষে এভাবে ট্রাম্পের মত একটা বদমায়েশের ভয়ে ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকা মোটেই উচিৎ হয় নি।” বেলা বিশষ করে রনিকে শুনিয়ে বলেছিল। সবাই সহজেই বুঝেছে এই নিয়ে মিয়া বিবিতে বাসায় এক পশলা নিশ্চয় হয়ে গেছে।

“আরে ধ্যাত, তুমি কিচ্ছু বোঝ না,” রনি বিরক্ত কন্ঠে শুরু করেছিল। সেটা বিরাট ভুল হল।

মহিলারা সবাই একজোট হয়ে তার উপর চড়াও হল। রুমা কোমরে রীতিমত শাড়ি পেঁচিয়ে মারকুটে হয়ে তেড়ে এলো, “মানে? খুব পুরুষগিরি ফলাচ্ছ? তুমি খুব রাজনীতি বোঝ আর আমরা বুঝি না?”

সারেন্ডার করল রনি। “না, না, মোটেই তা নয়। মেয়ে বলে নয়, বেলার কথা বলছি। ও বোঝে এক ইঞ্চি, কথা বলে দশ ইঞ্চি।”

বেলা আজকে শাড়ী পরে নি। প্যান্ট শার্ট পরেছে। সে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে এগিয়ে এলো। “খুব বিদ্বান হয়েছ তুমি, এ্যাঁ? তর্ক করতে গেলে তো শুধু চিল্লাও, একটা যুক্তিও তো দিতে পারো না। বল, কানাডা কেন এই রেজুলেশনে ভোট দিল না? এটা ট্রাম্পের ভয়ে নয় তো কিসের ভয়ে?”

লাল ভাই জানে প্রাণে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের সমর্থক। ট্রাম্পের ঘোষনার পর থেকেই তার নাওয়া খাওয়া একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। সে ক্ষুন্ন গলায় বলল, “এইটা আমি কানাডার কাছ থেকে আশা করিনি। বাংলাদেশের মত একটা ছোট্ট, গরীব দেশ যদি এই রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দিতে পারে, তাহলে কানাডা কেন পারবে না?”

জিত বলল, “ভাই, বাংলাদেশ আর কানাডা তো এক হল না। বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মানুষ হচ্ছে মুসলিম এবং তারা সবাই প্যালেস্টাইনের সমর্থক। এমনকি কিছু মানুষ তাদের হয়ে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে। সরকারের জন্য এটা একটা সহজ সিদ্ধান্ত। কানাডায় নানা ধরণের মানুষ থাকে। সবাই প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রে একই মত পোষন করে না। সরকারকে তো হিসেব করে চলতে হবে, নাকি?”

রনি বলল, “এই কথাটাই তো আমি বেলাকে বোঝাতে পারছি না।  এখন আমাদের যে অবস্থা তাতে আমি যদি সরকারে থাকতাম আমিও একই কাজই করতাম। কোন দরকার আছে আমেরিকার সরকারকে ক্ষেপিয়ে? এমন নয় যে এই ভোটের কারণে সত্যিকারের কোন পরিবর্তন হবে। সাইদ ভাই, আপনি কিছু বলছেন না কেন?  অন্য সময় তো আপনাকে থামানো যায় না। মহিলাদের মারদাঙ্গা ভাব দেখে ভয় খেয়ে গেলেন নাকি?”

সাইদ মৃদু হেসে বলল, “আর বলার কি আছে। আমদের সাথে এখন ট্রাম্প সরকারের NAFTA নিয়ে ফাটাফাটি চলছে। পাগলা ক্ষেপে গিয়ে NAFTA ক্যন্সেল করে দিলে কিছু সমস্যাতো হবেই। দু’পক্ষেরই হবে। আমাদের সমস্যা হয়ত কিছু বেশী হবে। জেনে শুনে কে চায় সেই ঝামেলায় পড়তে।”

বেলা বলল, “ভালোই পেয়েছে ট্রাম্প আমাদেরকে। কিছু হলেই NAFTA-র ভয় দেখায়। আরে, NAFTA চলে গেলে কি হবে? মরে যাবো আমরা? ওদের ক্ষতি হবে না? সারাক্ষণ ঐ বেয়াদপ বুড়ার ভয়ে থাকতে হবে?”

কবীর বেলাকে সমর্থন করে বলল, “ভাবী ঠিকই বলেছেন। ট্রাম্পতো সবাইকে ভয় দেখিয়েই সরকার চালাচ্ছে। ১২৮ টা দেশ তো সেই ভয়ে সিঁটিয়ে যায় নি। আমরা কেন গেলাম?”

রনি বলল, “আমাদের সাথে আমেরিকার সাড়ে পাঁচ হাজার মাইল বর্ডার, আলাস্কাকে ধরে। আমাদের ৮০% রফতানী হয় আমেরিকায়। আমাদের একটু সতর্ক থাকাটাই তো স্বাভাবিক।”

জালাল বলল, “কিন্তু আমদানি রফতানী তো দুই দেশের মধ্যেই হয়। আমেরিকার বেশ কয়েকটা স্টেটের প্রধান রফতানী ক্ষেত্র হচ্ছি আমরা। আমাদের জন্য সেখানেও লক্ষ লক্ষ কাজের সৃষ্টি হয়েছে। তাই না?”

লাল ভাই বলল, “একেবারে ঠিক কথা বলেছেন। দিক না NAFTA ক্যান্সেল করে। ওদেরও কি খুব উপকার হবে?”

সাইদ বলল, “ব্যাপার শুধু NAFTA নিয়ে নয়। কানাডা একটা মধ্যভুমি বজায় রাখতে চায়। জেরুজালেমকে ইস্রায়েলের রাজধানী ঘোষনা করলে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি চুক্তির বারোটা বাজবে। প্যালেস্টাইনিরা পুর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী করতে চায়। এই অংশটা ইস্রায়েল অধিকার করেছিল ১৯৬৭ সালে মিশর, সিরিয়া এবং জর্দানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়। এখন পর্যন্ত সেটা বেআইনি ভাবে ধরে রেখেছে।  কানাডার লক্ষ্য বৃহত্তর শান্তিময় একটা সমাধান। আমেরিকাকে ক্ষেপিয়ে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।”

বেলা বলল, “ডিসেম্বর ৬ তারিখে যখন ট্রাম্প সরকার প্রথম ঘোষনা দিয়েছিল তখন তো ট্রুডো সরকারের ফরেইন এফেয়ার্স মিনিস্টার ক্রিস্টিয়ান ফ্রিল্যান্ড খোলাখুলি বলেছিল তারা দুই রাষ্ট্র সমাধানে বিশ্বাসী। ভোটে গিয়ে কেন পিছিয়ে গেল? আমার তো মনে হয় এটা আমাদের সবার জন্য একটা অপমানের ব্যাপার। ঠিক বলেছি না?”

বেলা সমর্থনের আশায় তাকাল অন্যন্য মহিলাদের দিকে। রুমা পলিটিক্সের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয়। মাঝে মাঝে খবর দেখার সুবাদে কিছু কিছু ব্যাপার সে শোনে। সে বড় করে মাথা দোলাল। লতা মোটামুটি আগ্রহী। সে খালি হয়ে যাওয়া তরকারির বাটি ভরে দিতে দিতে জোর গলায় তার সমর্থন জানিয়ে দিল। “বেলা ভাবী, ছেলেদের কথায় কান দেবেন না। ওনারা মনে করেন ওনারা খুব বড় বড় রাজনীতিবিদ হয়ে গেছেন। সব কিছু বেশী জটিল করে দেখার দরকার হয় না।  অনেক সময় সহজ বস্তু সহজ ভাবে দেখাই ভালো।”

রনি ভ্রু কুঁচকে বলল, “আরে, মিয়া বিবি দেখি জোট পাকিয়েছে আজকে। বাসায় ডেকে এনে অপমান!”

লতা হাসতে হাসতে বলল, “আরে, আপনাকে অপমান করব কেন? আমি বলছি লিবারেল গভর্নমেন্টের কথা। হারপার আর ট্রুডোর মধ্যে ফারাকটা কি হল?”

জিত বলল, “দেশের বৃহত্তর কল্যাণের ক্ষেত্রে ফারাক থাকবেই বা কেন? প্রগ্রেসিভ কনজারবেটিভ হিসাবে হারপার জাস্টিন ট্রুডোর চেয়ে কিছু কিছু ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে কঠোর থাকলেও, তারা কানাডার ভালো বই খারাপ তো কিছু করে নি।”

রনি বলল, “আমার বরং জাস্টিনকে নিয়ে ভয়। সে যেভাবে নিজের পপুলারিটি নিয়ে সর্বক্ষন ব্যাতিব্যাস্ত, কখন যে কি করে বসবে। আমেরিকায় হাইতি থেকে আসা মানুষজনের অস্থায়ী প্রোটেকশন স্ট্যাটাস শেষ হয়ে যাবে সেই ভয়ে  মাত্র দেড় মাসে সাত হাজার হাইতিয়ানরা অবৈধভাবে কুইবেকের বর্ডার পেরিয়ে কানাডায় ঢুকেছিল এসাইলাম চেয়ে। প্রতি কেসের জন্য গড়পড়তা খরচ হয় দশ পনের হাজার ডলার। এটা আগস্টের মাঝামাঝির কথা বলছি। তারপর আরোও কত এসেছে কে জানে। আমেরিয়াকার প্রবলেম এখন আমাদের প্রবলেম হয়ে গেছে। ট্রুডোর তো আগ বাড়িয়ে টুইট করবার দরকার ছিল না ‘তোমরা সবাই কানাডায় চলে আসো। আমরা দুই হাত বাড়িয়ে তোমাদেরকে বুকে টেনে নেব’। হুবহু না বললেও সারমর্ম সেই রকমই দাঁড়ায়। পরে অবশ্য যখন চাপের মধ্যে পড়েছিল তখন যোগ করেছিল, সে কাউকে অবৈধভাবে আসতে বলে নি। কিন্তু একটা পাগলওতো জানে বৈধভাবে বর্ডারে গিয়ে এসাইলামের আবেদন করলে অধিকাংশকেই  রিফিউজ করা হয়। ”

লাল ভাই বলল, “ঐটা একটু বেশী বেশী করেছে।”

জালাল বলল, “কিন্তু এরাই তো একদিন এই দেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতিতে অবদান রাখবে, তাই না?”

বেলা বলল, “এক আলাপ থেকে অন্য আলাপে যাবার তো কোন দরকার নেই। আপনারা স্বীকার করে নিন যে কানাডার লিবারেল সরকার একটা খুব বড় ভুল করেছে এই রেজুলেশনে ভোট না দিয়ে।”

রনি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল। “নো ওয়ে। জান গেলেও ইজ্জত দেব না!”

বেলা চোখ পাকাল। “এটা আবার কি ধরণের কথা হল? ফাজলামি হচ্ছে!”

সবাই হাসছে। বেলা বিরক্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিল। “কথায় হেরে গেলে তখন ফাউ কথা বলে বিষয়বস্তু ঘুরিয়ে ফেলে। হারু পার্টি কোথাকার!”

জিত তাকে পিছু ডাকল। “ভাবী! দাঁড়ান। একটা জোক শুনে যান। নিউ ইয়ার নিয়ে। মনটা ভালো হতে পারে।

“নিউ ইয়ারের রাতে বড় অনুষ্ঠান আছে, তাই স্ত্রী বিকালের দিকে বিছানায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। ঘন্টা খানেক পর ঘুম থেকে উঠে স্বামীকে দেখে বলল, ‘এই জানো, একটা খুব দারুণ স্বপ্ন দেখেছি।’

স্বামী কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘তাই নাকি? কি স্বপ্ন দেখলে?’

‘দেখলাম তুমি আমাকে নতুন বছরের শুরুতে একটা এত্তো বড় হীরার আংটি দিয়েছ। এই রকম একটা স্বপ্ন কেন দেখলাম বল তো? এর অর্থ কি?’

স্বামী মুচকি হেসে বলল, ‘সময় এলেই জানতে পারবে।’

মাঝরাত পার হল। সবাই খুব হৈ চৈ করে নতুন বর্ষকে স্বাগতম জানাল। স্বামী সেই ভীড়ের মধ্যেও সময় করে স্ত্রীকে খুঁজে বের করল। স্ত্রী মনে মনে এই মুহূর্তের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তার মুখে হাসি আর ধরে না। স্বামী একটা ছোট গিফট প্যাকেট স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুভ নববর্ষ’। আবেগে, উত্তেজনায় ফেটে পড়তে পড়তে স্ত্রী দ্রুত হাতে ছোট গিফট প্যাকেটটা খুলল। ভেতরে ছোট একটা বই। বইয়ের নাম –  ‘স্বপ্নের অর্থ’।”

শুজা রশীদ

কথা সাহিত্যিক, টরন্টো

www.shujarasheed.com