কানাডায় ইসলামী চরমপন্থা ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ
উভয় গোষ্ঠি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে কানাডিয়ানদের কাছে
আগস্ট ৪, ২০১৮
॥ খুরশিদ আলম ॥
কানাডায় জননিরাপত্তা এখন শুধু হোমগ্রোন মুসলিম নামধারী জঙ্গীবাদীদের কারণেই বিঘ্নিত হতে পারে তা নয়, তার সাথে নতুন আরেক উপদ্রব এসে হাজির হয়েছে যার নাম শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ। এই দুই উপদ্রব মিলে কানাডায় জননিরাপত্তার বিষয়টিকে এখন আরো বেশী হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছে। ফলে কানাডিয়ান নাগরিকগণ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
উদ্বিগ্নতা এখানেই শেষ নয়, সম্প্রতি এর সাথে আরো যোগ হয়েছে মানসিক রোগী কর্তৃক হত্যাযজ্ঞের ঘটনাও। গত কয়েকমাসের মধ্যে টরন্টোতে ঘটে গেছে এরকম দুটি হৃদয়বিদারক হত্যাযজ্ঞের ঘটনা। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৩ জুলাই টরন্টোর গ্রীকটাউনে (ড্যানফোর্থ ও লোগান এলাকায়)। ঐ দিন সন্ধ্যায় ফয়সাল হোসেন নামের এক যুবক (২৯) একটি হ্যান্ডগান ব্যবহার করে এক কিশোরী ও এক বালিকাকে হত্যা করেন। তার গুলির আঘাতে ঐ এলাকায় আরো ১৩ জন আহত হন। ফয়সালের পরিবার থেকে বলা হয় সে মানসিকভাবে অসুস্থ। চিকিৎসায়ও কাজ হচ্ছে না তার এই রোগ সারিয়ে তোলার ব্যাপারে। কিন্তু তারপরও তার আচরণে কখনো এমনটি প্রকাশ পায়নি যে, তিনি এরকম হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন। এমনটিই বলেছেন তার প্রতিবেশীগণ। তাদের ভাষ্যমতে ফয়সাল সর্বদাই একজন বন্ধুবৎসল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এরকম নিষ্ঠুর ও নৃশংস আচরণ করতে পারেন তা তারা ভাবতেই পারছেন না।
গত এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখে টরন্টোর ইয়ং ও ফিঞ্চ এলাকায়ও ঘটেছিল আরেক হৃদয়বিদারক হত্যাকান্ডের ঘটনা। ঐদিন অ্যালেক মিনাসিয়ান (২৫) নামের এক যুবক পথচারীদের উপর ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ভ্যান উঠিয়ে দেন। ঐ ঘটনায় নিহত হন ১০ জন এবং আহত হন ১৫ জন। পুলিশ জানায়, ঐ যুবক হামলার ঠিক আগে অনলাইনে রহস্যজনক কিছু বার্তা পোস্ট করেন যা থেকে ধারণা করা হয় তিনি নারী বিদ্বেষী। তার ভ্যানের আঘাতে যারা মৃতুবরণ করেন তাদের মধ্যে ৮ জনই ছিলেন নারী।
উপরের দুটি ঘটনায়ই প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল যে এর সঙ্গে হয়তো মুসলিম নামধারী জঙ্গী গোষ্ঠির কোন সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। কিন্তু পরে সে সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়া হয়। সিপি ২৪ এর এক খবরে বলা হয়, গ্রীকটাউনে যে ঘটনা ঘটেছে সেটার দায় দাবী করেছিল মুসলিম নামধারী জঙ্গী গোষ্ঠি আইএসআইএস। তবে টরন্টো পুলিশ কর্তৃপক্ষ সে দাবী নাকচ করে দেন। তারা বলেন, আইএসআইএস এর এই দাবীর পক্ষে কোন প্রমাণ মিলেনি।
আমরা মনে করি, একটি দেশে সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের উপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেটা কোন আদর্শের নামে হোক বা বিদ্বেষের কারণে হোক অথবা কোন মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি কর্তৃক যদি হয় তাহলেও না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমরা লক্ষ্য করছি যে, এরকম ঘটনা কানাডায় বিচ্ছিন্নভাবে হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটছে। আর এটিই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে কানাডার নাগরিকদের মনে।
Canadian Race Relations Foundation এর সাথে পার্টনারশীপে পরিচালিত Angus Reid Institute এর এক জরীপে এই উদ্বেগের বিষয়টি ষ্পষ্টতই ধরা পরেছে। গত ১২ জুলাই প্রকাশিত ঐ জরীপ রিপোর্টে বলা হয়, প্রতি দশজনের মধ্যে চারজন বা ৪১% কানাডিয়ান বিশ্বাস করেন তাদের কমিউনিটিতে চরমপন্থী ব্যক্তিদের উপস্থিতি আছে। তবে ২৪% কানাডিয়ান মনে করেন এরকম কেউ নেই তাদের কমিউনিটিতে। আর ৩৫% কানাডিয়ান এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।
কানাডিয়ান নাগরিকগণ মনে করেন এ দেশে মৌলবাদী বা চরমপন্থী মুসলিম ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের অস্তিত্ব উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। জরীপে বলা হয়, ৫৪% কানাডিয়ান মনে করেন এ দেশে মৌলবাদী বা চরমপন্থী মুসলিমদের উপস্থিতি উদ্বেগের একটি বড় কারণ। অন্যদিকে ৪৪% কানাডিয়ান মনে করেন এখানে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উপস্থিতিও একই রকম উদ্বেগের একটি বড় কারণ হয়ে দাড়িয়েছে আজ।
অবশ্য আশার কথা এই যে, ৫৪% কানাডিয়ান বিশ্বাস করেন কানাডার আইনশৃংখলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ, যেমন কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস (ঈঝওঝ), রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (জঈগচ) এবং স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ এই সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখেন।
কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিহত করার ক্ষমতা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সত্যিকার অর্থে কতটুকু আছে? ইউরোপের ফ্রান্স ও ব্রিটেনসহ আরো কয়েকটি দেশে সন্ত্রাসীরা যেভাবে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে সেটি কি সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত করা যাচ্ছে? সেই স্টাইলে যদি কানাডায়ও হামলা শুরু হয় তবে তা প্রতিহত করতে কতটুকু সক্ষম এখানকার পুলিশ? কুইবেক সিটির একটি মসজিদে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী এক ব্যক্তি যখন অতর্কিতে হামলা চালিয়ে যে ৬ জন মুসল্লীকে হত্যা করে তখন কি তা প্রতিহত করা গিয়েছিল? কিংবা কুইবেকে যে দুজন সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যকে মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছিল সেটিও কি প্রতিহত করা গিয়েছিল?
২০১৪ সালে কানাডার পার্লামেন্ট ভবনেও জঙ্গী হামলা চালানো হয়েছিল। সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারসহ আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। হামলাকারী প্রায় বিনা বাধায়ই পৌঁছে গিয়েছিলেন সুরক্ষিত পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরে যেখানে হলওয়ের দুইপাশের কক্ষগুলোতে অবস্থান করছিলেন মন্ত্রী ও সাংসদগণ।
উল্ল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে কানাডায় মুসলিম নামধারী জঙ্গীদের কয়েকটি জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছেন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা করার জন্য অথবা জঙ্গীদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কিছু তরুনকে কানাডায় গ্রেফতার করা হয়েছে ইতিপূর্বে।
অর্থাৎ আমরা দেখছি, কানাডা জঙ্গী মুক্ত দেশ নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্ত রাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও অস্ট্রেলিয়াসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশে হোমগ্রোন জঙ্গী সন্ত্রাসীরা বেশ কিছু হামলা চালিয়েছেন। কানাডায় ঐ রকম বড় মাপের জঙ্গী হামলা হয়নি সত্যি কিন্তুু হবে না সেই গ্যারান্টি কে দিবে?
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন কায়দায় যে সকল আত্মঘাতি হামলা হচ্ছে সেগুলো ঠেকানো কোন দেশের আইনশৃংখলা বাহীনির পক্ষেই সম্ভব নয়। টরন্টোর মেকেনজি ইনস্টিটিউট এর নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কাইলা চাম ইতিপূর্বে সাংবাদিকদের বলেন, প্যারিস স্টাইলের হামলা খুব সহজেই ঘটতে পারে কানাডায়। আর এই কৌশলটি বর্তমানে আইএস সন্ত্রাসীদের সাধারণ কৌশলে পরিনত হয়েছে। nternational Intelligence Program for INSIGNIS Strategic Research Inc এর একজন পরিচালক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ডেভিড হ্যারিস টরন্টো সানের কাছে দেওয়া এক বক্তব্যে একই আশংকা প্রকাশ করে বলেন, “কানাডার সিকিউরিটি সার্ভিসেস এর লোকদের পক্ষে প্যারিসের আদলে সন্ত্রাসী হামলা প্রতিহত করা খুবই কঠিন কাজ হবে।
আমরা জানি ইতিপূর্বে ‘ইসলামিক স্টেট’ কানাডিয়ানদের উপর হামলা চালানোরও আহ্বান জানিয়েছে জঙ্গীদের কাছে। আমরা এও জানি, জঙ্গীপনার দিকে ঝুঁকে আছেন এরকম আরো বহু তরুন ও যুবক রয়েছেন কানাডায়। সরকারী লিস্টেই আছে ৯০ জনের বেশী। তাদের উপর অবশ্য কড়া নজরদারী রয়েছে। তারা যাতে দেশের বাইরে গিয়ে ইসলামীক স্টেটের সঙ্গে যুক্ত না হতে পারেন তার জন্য অনেকের পাসপোর্টও আটক করা হয়েছে। পাশ্চাত্যের এই তরুন জঙ্গীরা মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গীদের চেয়ে অনেক ভয়ানক ও দুধর্ষ। নতুন এক মিশনে নেমে পড়েছে এই জঙ্গীরা। এরা নতুন করে মধ্যযুগীয় খেলাফত শাসন কায়েম করার লক্ষে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছে। এদের জঙ্গী হওয়ার পিছনে যে কারণটি কাজ করছে তা হল ইসলাম সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক শিক্ষা ও চিন্তা ভাবনা।
অর্থাৎ একটি বিষয় এখন সুষ্পষ্ট যে, মুসলিম নামধারী জঙ্গী সন্ত্রাসী হোক আর শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসীই হোক, কানাডার সাধারণ মানুষ কারো হাত থেকেই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়।
ইতিপূর্বে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরাও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং সাম্প্রতিককালে তাদের কার্যক্রম যথেষ্ট পরিমানে বিস্তার লাভ করেছে। আর সন্ত্রাসী কার্যক্রমে তারা ইসলামী জঙ্গীদেরকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে!
মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে ৯/১১ এর ঘটনার পর এ পর্যন্ত ১৯ টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে এই চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা। অন্যদিকে এই একই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামী জঙ্গীরা ৭ টি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।
রিপোর্টে আরো দেখা যায়, ৯/১১ এর পর চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৪৮ জন। সাউথ ক্যারোলিনায় অবস্থিত একটি চার্চে যেখানে গণহত্যার শিকার হয় ৯ জন কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসী। চরমপন্থী এক শ্বেতাঙ্গ যুবক এই গণহত্যার নায়ক। অন্যদিকে ইসলামী জঙ্গী বা সন্ত্রাসীদের হামলায় এই সময়ের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ২৬ জন। ওয়াশিংটন ভিত্তিক নিউ আমেরিকা নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই তথ্য প্রকাশ করে ২০১৫ সালে।
চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের এই অপকর্ম বিষয়ে সাধারণ মানুষ খুব একটা অবহিত নন। তাদের কাছে বিষয়টি নতুন ঘটনা মনে হতে পারে। হতে পারে সেটা মিডিয়ার ভূমিকার কারণে। তবে পুলিশের কাছে শ্বেতাঙ্গ এই চরমপন্থীদের অপকর্মের তথ্য রয়েছে। কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভারসিটির অধ্যাপক চর্লস কুর্জম্যান এবং ড্যুক ইউনিভারসিটির অধ্যাপক ডেভিড শ্যাঞ্জার এক জরীপ চালান এ বিষয়ে। তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ৩৮২ টি কার্যালয়ের কাছে জানতে চান, তাদের এলাকায় সবচেয়ে বড় মাত্রার সন্ত্রাসী ঘটনার গুলোর মধ্যে কোনটির অবস্থান প্রথম এবং কোনটির অবস্থান দ্বিতীয়। ঐ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যালয়গুলো থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- ৭৪% সহিংস ঘটনা ঘটেছে চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সরকার বিরোধী কার্যক্রম এর কারণে। অন্যদিকে ৩৯% সহিংসতা ঘটেছে আলকায়দা সংশ্লিষ্ট ইসলামী জঙ্গীদের দ্বারা।
সিএনএন এর এক রিপোর্টে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস মনে করে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গী যারা মানুষের গলা কাটে, তাদের চেয়েও বড় হুমকী এই চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা।
সন্দেহ নেই বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একে তো ইসলামী জঙ্গীদের উৎপাতের কারণে কানাডা ও মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের মধ্যে কমবেশী উদ্বেগ রয়েছেই এখন তার সাথে আরো যোগ হয়েছে চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের উৎপাত।
লক্ষ্যনীয় যে, কানাডায় রক্ষণশীলদের কয়েকটি গ্রুপ সাম্প্রতিক সময়ে অধিকমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী একটি অনুভূতি বা চেতনা জাগ্রত করতে। এই রক্ষণশীলদের মধ্যে নব্য জাতিয়তাবাদের একটি চেতনা নতুনভাবে জাগ্রত হয়ে উঠেছে এখন। কানাডার মাল্টিকালচারালইম নীতিতে তারা বিশ্বাসী নন।
এদিকে কুইবেকের La Meute এর পাশাপাশি Soldiers of Odin নামের আরেকটি রক্ষণশীল সংগঠন তৎপর হয়ে উঠেছে যাদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বিদ্বেষ ছড়ানো ও বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে এরা এন্টি ইমিগ্রেন্ট ও এন্টি মুসলিম ভাবধারায় বিশ্বাসী। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে এই Soldiers of Odin নামের সংগঠনটি সমস্যা সৃষ্টি কারী। টরন্টোর নিকটবর্তী হ্যামিলটনের সিটি কাউন্সিলর ম্যাথিও গ্রিন অভিযোগ করেন এরা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। কানাডায় Soldiers of Odin এর সদস্য সংখ্যা রয়েছে বর্তমানে প্রায় ৩৫০০।
রয়টার্স এর এক প্রতিবেদনেও বলা হয় Soldiers of Odin এর ওয়েবসাইটে একসময় এরকম বক্তব্য লেখা ছিল যাতে বলা হয়, ইসলামিস্ট অনুপ্রবেশকারীরা এ দেশে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে এবং তাদের কারণে অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘মাইগ্রেন্টস নট ওয়েলকাম’ লেখা পোস্টারও দেখা গেছে মিছিলে।
আমেরিকার এন্টি ডিফেমেশন লীগ এর বার্ষিক প্রতিবেদনেও বলা হয়, হোয়াইট সুপ্রিমেসী গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে এই Soldiers of Odin এর সম্পর্ক রয়েছে।
লক্ষ্যনীয় যে, এই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নানান ইস্যুতে তৎপর হয়ে উঠেছেন সাম্প্রতিক সময়ে। টরন্টো, মন্ট্রিয়ল ও ভেঙ্কুভার সহ নানান স্থানে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, র্যালি ও সমাবেশ করার চেষ্টা করছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা আধিপত্যবাদীদের তৎপরতার পর কানাডা এ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে এ কথা ভাবার কোন কারণ নেই।’
প্রধানমন্ত্রীর ঐ বক্তব্যের প্রতিফলনও আমরা দেখতে পাচ্ছি। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের হামলার পর পরই কানাডার একাধিক স্থানে তাদের সমর্থকরা সমাবেশ ও র্যালীর আয়োজন করেছেন। গত বছর ১৯ আগস্ট ভেঙ্কুভারে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের এক সমাবেশ আয়োজন করা হলে সেখানে উত্তেজনা চরমে উঠে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ভেঙ্কুভারে আধিপত্যবাদীদের মূল এজেন্ডা ছিল মুসলিম বিরোধিতা ও বর্তমান সরকারের ইমিগ্রেশন পলিসির নিন্দা জানানো। সমাবেশের দিন ঘটনাস্থলে তাদের হাতে ছিল কনফেডারেট পতাকা এবং ‘অল্ট-রাইট’ প্রতীক খচিত পতাকা। একজনের পরনে ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প এর ছবিযুক্ত টি শার্ট। ভেঙ্গুভারের সিটি মেয়র গ্রেগর রবার্টসন অধিপত্যবাদীদের এই সমাবেশের তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন বর্ণবাদ ও বিদ্বেষ এর কোন স্থান নেই এই সিটিতে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রিমিয়ার জন হর্গানও আধিপত্যবাদীদের বিরোধিতাকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, আমরা যে কোন ধরণের বর্ণবাদ, বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা এবং ধর্মান্ধতার নিন্দা জানাই।
একই ধরনের সমাবেশ ও র্যালীর আয়োজন করা হয়েছিল কুইবেক সিটিতেও। টরন্টোতে গত বছর ১৪ আগস্ট যুক্তরষ্ট্রের কনসুলেট অফিসের সামনে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কিছু আমেরিকান নাগরিকও ছিলেন। তারা সম্প্রতি ভার্জিনিয়াতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের বর্ণবাদী কার্যক্রমের তীব্র নিন্দা জানান।
সাম্প্রতিককালে কানাডায় এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কানাডার মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। সিবিসি নিউজে প্রকাশিত জনাথন মন্টপেটিট এর এক প্রতিবেদনে উল্ল্লেখ করা হয় “৯/১১ এর পর থেকে কানাডার গোয়েন্দা বিভাগের অধিকাংশ মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয় ইসলামী জঙ্গীদের উপর। কিন্তু আইএস বা আল-কায়দার মত জঙ্গী গোষ্ঠির উপর যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়ে আসছে, ততটা গুরুত্ব কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এবং রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এর পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে না শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের উপর।”
ভ্যাঙ্কুভারে বসবাসকারী সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসীদের উপর গবেষণাকারী জেমস এলিস বলেন, কানাডায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা নিরাপত্তার বিষয়ে হুমকী সৃষ্টির জন্য তেমনভাবে সংগঠিত নয় এরকম ধারণা খুবই বিপজ্জনক।
আমরা দেখেছি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা অতীতেও ভয়াবহসব নৃসংশতা চালিয়েছেন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে। সেই সময় তাদের টার্গেট ছিল কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠি। কৃষ্ণাঙ্গদেরকে গুলি করে হত্যা করার পাশাপাশি ঘরের ভিতর আটকে রেখে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটিয়েছেন এরা। আজকে তারা নর্থ আমেরিকায় মুসলিম সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সাউথ এশিয়ান, মিডল ইস্টর্ন ও আফ্রিকান অঞ্চল থেকে আসা ইমিগ্রেন্ট এবং রিফিউজিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছেন এবং সমাবেশ ও মিছিল করছেন।
এসবই দুর্বিত্তপনা এবং সন্ত্রাসী কার্মকান্ড। কোন সভ্য সমাজে এগুলো স্থান পেতে পারে না। এই দুর্বিত্তরা মুসলিম নামধারী জঙ্গী হোক বা শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী হোক তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা সরকারের দায়িত্ব।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ