এই পরবাসে রবে কে-৫

আগস্ট ৪, ২০১৮

নাজমুল ইসলাম

কানাডার জনসংখ্যা যেহেতু খুবই কম, তাই কানাডা সরকার প্রতিবছর ইমিগ্রেশন বা অভিবাসনের মাধ্যমে এদেশের জনসংখ্যা বাড়াতে চেষ্টা করে। বস্তুত এই জাতি গড়ে উঠেছে অভিবাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এশিয়া, আফ্রিকা ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক অভিবাসী এসেছে এখানে। বছরখানেক হলো স্কিল্ড ওয়ার্কার ক্যাটাগরিতে ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডা এসেছে রেজওয়ান। তার বন্ধুদের ভাষায় স্বপ্নের দেশ কানাডা।

আসার পর থেকেই নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হতে চলেছে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি। এরই মধ্যে কারখানায় কাজ করার সুবাদে রেজওয়ানের সুযোগ হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সম্পর্কে জানার। বছরখানেকের অভিজ্ঞতায় মোটা দাগে ক্যাটাগরিক্যালি অভিবাসন প্রক্রিয়ায় আসা অভিবাসীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নিজের মনে বেশ মজার একটা চিত্র এঁকে নিয়েছে নবাগত রেজওয়ান।

স্টুডেন্ট এবং ওয়ার্কার ক্যাটাগরিঃ স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে অথবা ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিয়ে কাজের জন্য এসে একটা নির্দিষ্ট সময় থাকার পর আবেদন করে অনেকেই পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট (পিআর) হয়েছেন এখানে। এই দলে ছাত্রাবস্থায় আসা অভিবাসীর সংখ্যা বেশী।

ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিঃ অভিবাসীদের একটা অংশ আছে যারা নিজ নিজ দেশে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকার জোরে ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে ইমিগ্রেশনের আবেদন করে পিআর পেয়েছেন। এই ক্যাটাগরিতে বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা কিংবা নেতার হাতা থেকে শুরু করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সবাই আছেন। চারিত্রিকভাবে ধুর্ত মানসিকতার ইমিগ্র্যান্টই বেশী এই ক্যাটাগরিতে।

রিফিউজি ক্যাটাগরিঃ প্রকৃত রিফিউজি ছাড়াও অনেকেই টুরিস্ট ভিসা নিয়ে এসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে উদ্বাস্তু বা শরনার্থী (রিফিউজি) হিসাবে কিছুকাল থাকার পর পিআর হয়েছেন। এই ক্যাটাগরির অভিবাসীদের একটি অংশ আছে যারা আমেরিকায় কিছুকাল বসবাস করার পর বৈধ কাগজ না হওয়ায় অবৈধ বসবাসকারী হিসাবে তাড়া খেয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কোন না কোনভাবে বর্ডার ক্রস করে কানাডায় ঢুকেছেন। অতঃপর রিফিউজি স্ট্যাটাস নিয়ে পিআর-এর আবেদন করে পিআর পেয়েছেন। এই দলে আংশিক ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরির বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

ফ্যামিলি ক্যাটাগরিঃ পরিবারের একজন এখানে এসে সিটিজেন হবার পর পরিবারের অন্য সবার জন্য আবেদন করলে কিছু মানুষ সদলবলে/সপরিবারে ভিসা পেয়ে চলে এসেছেন। এই দলে উচ্চশিক্ষিত ইমিগ্র্যান্ট কম।

স্পাউসাল ক্যাটাগরিঃ এই ক্যাটাগরিতে বিবাহসূত্রে স্বামী বা স্ত্রী হিসাবে আবেদন করে ইমিগ্র্যান্ট ভিসা পেয়েছেন অনেকেই। বাংলাদেশী পুরুষদের ক্ষেত্রে যা জামাই ভিসা বলে বেশী পরিচিত।

ফেডারেল স্কীলড ওয়ার্কার ক্যাটাগরিঃ ২০০০ সালের পর থেকে কানাডায় আসা ইমিগ্র্যান্টদের একটা বড় অংশ এসেছে এই ক্যাটাগরিতে। এদের মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজার, একাউন্ট্যান্ট ইত্যাদিসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর দক্ষ পেশাজীবিরা এখানে ইমিগ্রেশন নিয়ে এসেছেন। এই দলে শিক্ষিতের সংখ্যা বেশী। কারণ একমাত্র এই দলভূক্তদেরকেই শিক্ষাগত যোগ্যতায় এদেশে আসতে হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ক্যাটাগরিতেও বেশ কিছু দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

কানাডা আসার আগ পর্যন্ত এই দেশটি সম্পর্কে অন্যান্য সবার মতো রেজওয়ানেরও কোন বাস্তব ধারণা ছিল না। দেশী এবং প্রবাসী বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের কথা শুনে মনের রূপালী পর্দায় কল্পিত সব চিত্র দেখেছিল সে। ভেবেছিল কানাডা বুঝি সোনা দিয়ে মোড়ানো দেশ। প্রায় স্বর্গ টাইপের কিছু একটা হবে হয়তো।

কিন্তু আসার পর পরই স্বপ্নভঙ্গ ঘটে তার। দেশ ছেড়ে আসার সময় রেজওয়ানের মনে হয়েছিল খুব উন্নত একটা পরিবেশে যাচ্ছে সে। এমনকি আসার পর পরও কিছুদিন তার মনে হয়েছিল যে, এত কড়া ছাঁকনির ইমিগ্রেশন পদ্ধতিতে সারা পৃথিবী থেকে কেবল ভাল আর ভদ্র মানুষেরাই বুঝি এখানে এসেছে। ভেবেছিল এখানে সবকিছুই ”দি বেস্ট”। কিন্তু আসার পর রেজওয়ান অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে, ভাল মানুষের পাশাপাশি সারা দুনিয়া থেকে অনেক টাউট বাটপারও এখানে এসে পড়েছে এবং যথারীতি বাটপারি আর চাপাবাজি করে খাচ্ছে। দেশে যারা দুর্নীতিবাজ ছিল তারা দুর্নীতির মাধ্যমে  আয় করা পয়সা এনে এখানে মহাসুখে দিন গুজরান করছে। তাহলে আর লাভ কি হলো? মনে মনে নিজেকে এই প্রশ্ন করে রেজওয়ান।

চাকরি খুঁজতে যেয়ে রেজওয়ান নতুন সমস্যায় পড়ে। যেখানেই ইন্টারভিউ দিতে যায় সেখানেই একটি কমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স আছে?’ চাকরি না পেলে কিভাবে হবে কানাডিয়ান অভিজ্ঞতা? কাজ করতে পারলে তবেই না অভিজ্ঞতা। দেশে থাকতে একটা ব্যাংকে চাকরি করতো রেজওয়ান। ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কোন সম্বল নেই তার। সেটি দিয়েই সে চেষ্টা করে যাচ্ছে চাকরির। একটি ব্যাংকে ভাল ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি প্রায় হয়েই গিয়েছিল। কেবল এদেশের একটি রেফারেন্সের অভাবে শেষ মহূর্তে চাকরিটা তার হয়নি।

কানাডায় চাকরির ক্ষেত্রে রেফারেন্স খুব বড় ফ্যাক্টর। কেউ কেউ মজা করে বলেন ‘দেশে চাকরির জন্য মামা খালু দরকার হয়। কিন্তু কানাডায় স্বয়ং বাপের দরকার হয়।’ রেজওয়ানের তেমন রেফারেন্স একেবারে ছিল না তা নয়। একই ব্যাংকে সে তার দেশী কলেজমেট বন্ধু মফিজকে পেয়েছিল। কিন্তু বন্ধু মফিজ তাকে রেফারেন্স দিতে রাজী হয়নি। আরও অনেকের ক্ষেত্রেই এরকম ঘটেছে। মফিজরা এদেশে অনেক আগে এসে একজিকিউটিভ লেবেলে চাকরি করলেও বেশীরভাগই নিজের কমিউনিটির জন্য কোন দায়বদ্ধতা অনুভব করে না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার সময় চাকরির প্রসঙ্গে হাতি-ঘোড়া মেরে একাকার করে। ‘এই করেছি, তা করেছি। আমার মতো প্রফেশনাল কাজ আর কেউ করে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ পরিচিত বন্ধুবান্ধব কেউ রেফারেন্স চাইতে গেলে গড়িমসির শেষ নেই। আসল কথা হলো যত উঁচু লেবেলেই চাকরি করুক না কেন, মফিজদের অবস্থান এখনও তেমন শক্ত নয়। দু’একজন ইচ্ছা থাকলেও দেশী কাউকে রিকমেন্ড করতে ভয় পায়। কারণ ‘কোন এক সকালে উঠে দেখবো চাকরি নেই…’ সর্বক্ষণই এই দুশ্চিন্তা তাদের তাড়িয়ে ফেরে।

এই অবস্থা রেজওয়ানের একার নয়। অসংখ্য ইমিগ্র্যান্টের একই অবস্থা। দেশী ডাক্তার বন্ধুদের অবস্থা দেখে সবচেয়ে বেশী কষ্ট পায় রেজওয়ান। শুধুু দেশী নয় সারা পৃথিবী থেকে আসা অসংখ্য ডাক্তার এসেছে এখানে। অথচ চাকরি নেই। তাহলে সরকার এত ডাক্তারকে এনেছে কেন? প্রথম প্রথম রেজওয়ান এই হিসাব মেলাতে পারতো না। পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে সে। সরকারের এটা অজানা নয় যে, ইমিগ্র্যান্টরা আসার সময় বেশ ভাল অংকের টাকা নিয়ে আসে। আর বৈধ আয়ে সেই সুযোগ ডাক্তারদেরই বেশী। কারণ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ডাক্তাররা বেশ স্বচ্ছল।

কানাডার ইকোনমিতে ইমিগ্র্যান্টের অর্থের প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ভুমিকা আছে। আর সে কারণেই হয়তো কানাডা সরকার ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতেও ইমিগ্রেশন দিতে আপত্তি করে না। তা সে চোর বাটপার যেই ইনভেস্ট করুক না কেন। টাকার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। কেউ এটা থেকে মুক্ত নয়। শুধু মানুষ কেন, রাষ্ট্র হিসাবে কানাডারও তো টাকার দরকার। রেজওয়ানের মনে পড়ে যায়, ছেলেবেলায় স্কুলে মাষ্টার মশাই একটা মজার ধাঁধা বলেছিলেন। কেবল একটা অক্ষরের অবস্থান বদল করে একই কথায় প্রশ্ন এবং উত্তর দিতে হবে। প্রশ্নটা ছিলঃ- ‘পৃথিবীটা কার বশ’? উত্তর হলোঃ- ‘পৃথিবী টাকার বশ’।

ইমিগ্রেশনের ক্ষেত্রে কানাডা সরকার আরও একটি বিষয় বিবেচনা করে। সেটি হলো উচ্চশিক্ষিত ইমিগ্র্যান্ট। কেবল ডাক্তাররাই নয়, সমাজে যেকোন উচ্চশিক্ষিত ইমিগ্র্যান্টদের প্রভাব পজিটিভ। উচ্চশিক্ষিত ইমিগ্র্যান্টদের আত্মমর্যাদাও বেশী। কাজেই এদের দ্বারা সরকারের ঘাড়ে বোঝা হওয়ার সম্ভাবনা কম। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সম্ভাবনাও কম।

রেজওয়ান দেশে থাকতে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরির সুবাদে বেশ ভাল অংকের টাকা নিয়ে এসেছিল। কষ্টার্জিত সেই টাকা দিয়েই বছরখানেক চলেছে সে। একটা অটোপার্টসের কারখানায় সর্বনিম্ন মজুরীতে কাজ নিয়েছে রেজওয়ান। সবার মুখে একই কথা, ‘এখনও ভাল একটা চাকরি হলো না?’ অথবা ‘কিছু একটা পড়াশুনা কর ভাল চাকরি হয়ে যাবে’। আড্ডায় বা সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে সবার মুখে ‘ভাল কাজ’, ‘ভাল চাকরি’ শব্দগুলো শুনতে শুনতে রেজওয়ান ভীষণ বিরক্ত। ভাল বলতে সবাই বোঝে অফিসে সুটেড বুটেড হয়ে বসে কাজ করা। কিন্তু রেজওয়ান বোঝে অন্যরকম। তার কাছে ভাল চাকরি মানে ভাল বেতনের চাকরি। বেতন ভাল হলে রেজওয়ান রাস্তা ঝাড়– দিতেও রাজী। কারণ রেজওয়ান দেখেছে তারই এক বন্ধু মিনিমাম আওয়ারলি পেমেন্টে একটা ব্যাংকে টেলারের কাজ করে। আর সেই বন্ধুরই এসএসসি পাশ স্ত্রী কোন পড়াশুনা ছাড়াই তার স্বামীর চেয়ে বেশী বেতনে ডে-কেয়ারে বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ করে। এই হিসাব মেলাতে পারে না রেজওয়ান।

রেজওয়ানের হতাশা আরও বাড়ে যখন দেখে তার বেশ ক’জন পরিচিত সরকারী চাকুরে আর রাজনৈতিক নেতার চ্যালা বছরের পর বছর চাকরি ছাড়াই বেশ ভাল আছে। তাদের প্রায় সবাই স্ত্রী সন্তানদের কানাডায় রেখে বছরের বেশীরভাগ সময় দেশে থাকে। দেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে এদেশে সংসার চালায়। সরকারী চাকুরেদের দেশের এক সপ্তাহের ঘুষের টাকা দিয়ে আর নেতার চ্যালাদের দু’একটা তদবির দালালীর টাকা দিয়ে বেশ ভালভাবেই কানাডায় মাস চলে যায়। বেশ সুন্দর ব্যবস্থা।

এদেশে আসার পেছনে রেজওয়ানের যতগুলো যুক্তি ছিল, তারমধ্যে অন্যতম হলো- এইসব দেশী চোর বাটপারদের চেহারা অন্তত আর দেখতে হবে না। কিন্তু বিধি বাম। এখানে এসে সে লক্ষ্য করে, দুর্নীতির টাকায় দেশী চোর বাটপাররা এখানেও বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। বাড়ী কিনছে, গাড়ী কিনছে, প্লাজা কিনছে। দেশেও এই চিত্র দেখতে দেখতে রেজওয়ান ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এখানেও সেই একই চিত্র দেখে হতাশ বোধ করে একদা বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নবাজ রেজওয়ান।

এই হতাশা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? এসব নিয়ে প্রায়ই চিন্তা করে রেজওয়ান। মনে মনে ঠিক করে, স্বজাতিদের এড়িয়ে চলবে সে। সবাইকে এড়িয়ে চলা সম্ভব না হলেও অন্তত দেশে যাদের সে বড় চোর বলে জানতো তাদের অন্তত এড়িয়ে চলবে। কিন্তু একই শহরে থেকে সেটা বেশ কঠিন কাজ। কারও না কারও সঙ্গে দেখা হয়েই যায়। তারপরেও রেজওয়ান চেষ্টা করেই চলে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই মাঝে মাঝে সে ভাবে- এই শহর ছেড়ে দুরে ছোট কোন শহরে চলে গেলে কেমন হয়?

নাজমুল ইসলাম

টরন্টো, কানাডা।

nazmul13@gmail.com