এই পরবাসে রবে কে-৪

জুন 3, 2018

নাজমুল ইসলাম


স্কীলড ওয়ার্কার ক্যাটাগরিতে মাইগ্রেশনের নিয়ম অনুযায়ী ইমিগ্রেশন ভিসার জন্য আবেদন করা বেশ ঝামেলা। শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াও কাজের অভিজ্ঞতা, ইংরেজীর দক্ষতা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের যোগ্যতার প্রমাণসহ ইমিগ্রেশন ভিসার আবেদন করতে হয়। কানাডায় ভিসার যতগুলো ক্যাটাগরি আছে, একমাত্র ফ্যামিলি ক্যাটাগরিতে এধরণের কোন যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে না। স্পনসরকারীর পরিবারের সদস্য হওয়াটাই একমাত্র যোগতা। সেই যোগ্যতায় ফ্যমিলি ক্যাটাগরিতে কানাডা প্রবাসী বোনের স্পনসরশিপে ইমিগ্রেশন ভিসা নিয়ে বাবা মা’র সঙ্গে কানাডায় পদার্পন করে অজিত।
তৎকালীন কানাডা অভিবাসনের নিয়মানুযায়ী বয়স নির্বিশেষে অবিবাহিত সন্তান মাত্রই বাবা-মা’র ডিপেন্ডেন্ট হিসাবে গন্য হতো। ফলে বয়স পঁচিশ পেরিয়ে গেলেও অবিবাহিত থাকায় বাবা-মা’র ডিপেন্ডেন্ট হিসাবে অজিতের ভিসা হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন থাকলেও ভর্তির সুযোগ হয়নি তার। গাইডেন্সের অভাবে লেখাপড়া বাদ দিয়ে যে জীবনে অজিত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তাতে তার উচ্ছন্নে যাবার সমস্ত সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কানাডার ভিসা প্রাপ্তিতেই শেষ রক্ষা হয়।
শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বল্পতার কারণে টরন্টোতে এসে প্রথম কয়েক বছর বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল অজিতকে। দিনমজুরের কাজ থেকে শুরু করে ক্লিনিং, পিজা ডেলিভারী সবই করতে হয়েছে তাকে। শেষ পর্যন্ত তার এক শুভাকাঙ্খির পরামর্শে ইন্সিওরেন্সের উপর শর্টকোর্স করে ইনসিওরেন্স কোম্পানীতে চাকরি নেয় অজিত। কিছুদিন চাকরি করার পর অজিত ঠিক করে চাকরি আর না, এবার ব্যবসা করবে। কমিশন এদেশে ব্যবসার অন্যতম প্রধান উপাদান। দালালী আর সাপ্­লাইয়ের কাজে কমিশন বেশী। ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে অজিত শুরু করে তার স্বাধীন ব্যবসা। ওয়ান ম্যান অফিস। কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী কারখানায় কাঁচামাল সাপ্ল্ল­াইয়ের পাশাপাশি স্থাবর সম্পত্তি বেচাকেনার দালালীও শুরু করে সে।
আশির দশকে টরন্টো শহরে বাঙালী ব্যবসায়ীর সংখ্যা হাতে গোনা যায়। প্রতিযোগিতা কম থাকায় অজিতকে খুব একটা প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয় না। তরতর করে উপরে উঠে যায় সে। বিবাহ, সন্তানাদির পাশাপাশি একাধিক বাড়ী গাড়ীও হয় তার। নিজের কমিউনিটিতে যথেষ্ট পরিচিতি পেয়ে যায় সে। আর কি চাই? অর্থ, বিত্ত আর আত্মতৃপ্তির উত্তাপ ছড়িয়ে দিন গুজরান করে চলে অজিত।
পলকা বেগম অজিতের স্ত্রী। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে শুধু টাকা-পয়সা কিংবা শাড়ী-চুড়ির গল্পেই মগ্ন থাকে না সে, বরং কার স্বামী কি করে, তার ইনকাম কত, কে কোন ব্র্যান্ডের প্রডাক্ট ব্যবহার করে এবং সেগুলো এক্সপেন্সিভ কিনা ইত্যাদি তথ্য উদ্ধারে পলকার জুড়ি নেই। এ কাজটি পলকা বেগম যতœশীল দক্ষতার সঙ্গে করে থাকে। সুযোগমতো স্বামীর গুণকীর্তনও করে সচেতনভাবে। সামাজিক গ্যাদারিংয়ে গর্বভরে গল্প করে- ‘আমার স্বামী কতজনকে বাড়ী কিনে দিয়ে বড়লোক বানিয়ে দিল’। পলকা এমনভাবে বলে, মনে হয় যেন তার স্বামী নিজের পকেটের টাকা দিয়ে মানুষকে বাড়ী কিনে দেয়। পলকা বেগমের কথায় উপস্থিত অনেকেরই অস্বস্তি হয়। তবে অজিত এতে মোটেই অস্বস্তি বোধ করে না বরং পুলকিত হয়। স্ত্রীর মুখে এ ধরণের প্রশস্তি শুনে অভ্যস্ত সে।
একাধিকবার পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করলেও পড়াশুনায় বিশেষ এগুতে পারেনি পলকা বেগম। তবে বিয়ের পর কানাডা এসে স্মার্ট মেয়ে পলকা নিজেকে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছে। গাড়ী চালানো থেকে শুরু করে বাজারঘাট, শহরের যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি, সব পলকার নখদর্পনে। বাস্তবে প্রয়োগ নেই এমন একটি বিষয়ে অনলাইনে তিনমাসের একটা শর্ট কোর্স করেছে পলকা বেগম। তবে সেই অনলাইন ডিগ্রির কথা বলার সময় পলকা এমনভাবে বলে যেন পিএইচডি টাইপের কিছু একটা করেছে সে। বাড়িয়ে বলার অভ্যাসে স্থান, কাল, পরিবেশ না বুঝে অতিকথনের একটা আলাদা দক্ষতাও সে অর্জন করেছে। একবার কোন এক অনুষ্ঠানে গিয়ে ভরা মজলিসে পলকা বেগম এক ভদ্রলোককে প্রশ্ন করে বসে, ‘ভাই কোথায় আছেন?’ জবাব শুনে ভীষণ অপ্রস্তুত এবং খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। কারণ ভদ্রলোক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আর কই থাকবো? আপনার মতো টরন্টোতেই আছি’। এরকম উত্তর পলকা বেগম আশা করেনি। এক অস্বস্তিকর অবস্থা। সে আসলে জানতে চেয়েছিল, ভদ্রলোক কী করেন বা কোথায় চাকরি করেন?

কানাডিয়ান খিচুড়ি কালচারে কেউ তার চাকরি বা কাজের কথা কারও সঙ্গে শেয়ার করে না। সবাই শুধু বলে কাজে যাই। কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে কোম্পানীর সিইও সবাই বলে কাজে যাই। এদেশে কর্মক্ষেত্রে একটা ভাল দিক হলো, ‘জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ’ সবই এখানে কাজ হিসাবে গন্য। এটা এক দিক থেকে ভাল প্র্যাকটিস বলতে হবে। তারপরেও প্রচলিত অর্থে অডজবকারীদের প্রায় সবাই নিজ নিজ কাজের ধরণ ঢেকে রাখতেই পছন্দ করেন।
প্রায় বছর দশেক পেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত অজিত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। অর্থবিত্তের মালিক হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেলেও উচ্চশিক্ষা হয়নি, মন থেকে এই খচখচানি কিছুতেই যায় না তার। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে গিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইমিগ্রেশনে নবাগত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট বন্ধুবান্ধদের দেখে অজিতের সে অস্বস্তি যেন আরও বাড়ে। একটু হীনমন্যতায় ভুগলেও কাউকে অজিত সেটা বুঝতে দিতে চায় না। বরং ঢেকে রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় সে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই বেশ অভিনব কিছু পন্থা অবলম্বন করে অজিত। টেলিফোনে কথা বলার সময় গলার স্বর বদলে একটা কৃত্তিম গম্ভীর ভাব এনে ‘হ্যালো’ বলা, সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে সবার সঙ্গে একটা দুরত্ব রেখে ভাব ধরে থাকা, আড্ডায় বা গ্যাদারিংয়ে সর্ববিষয়ে নিজেকে সবার চেয়ে বেশী জ্ঞানী প্রমাণের প্রানান্তকর চেষ্টা ইত্যাদি বিভিন্ন কৌশলে অজিত আড়াল করতে চায় তার সেই অস্বস্তি।
নিজেকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রমাণ করতে নিরলস চেষ্টা করে যায় অজিত। ইদানিং স্কীলড ক্যাটাগরিতে আসা উচ্চশিক্ষিত নিউ ইমিগ্র্যান্টদের আড্ডায় কম যায় সে। কারণ সেখানে গেলে নিজেকে বেশ তুচ্ছ মনে হয় তার। সোশ্যাল গ্যাদারিংও আজকাল এড়িয়ে চলে সে। স্ত্রী পলকা বেগম অজিতের এই কৌশলকে অন্যভাবে মেকাপ দেয়। সে পাশের বাড়ীর ভাবীর কাছে গল্প করে, ‘বুঝলেন ভাবী, আপনার ভাই এতো পার্সোন্যালিটি সম্পন্ন মানুষ যে সব জায়গায় যায় না, সবার সঙ্গে মিশতেও চায় না। আসলে ও এতো পার্সোন্যালিটি নিয়ে কথা বলে যে সবাই ওর সঙ্গে মিশতেও পারে না।’ পতিধনের আসল সমস্যা কি তা বুঝতে পারে না পলকা বেগম। স্বামীর শেখানো বুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গল্প করে চলে।
মেইনস্ট্রিম কানাডিয়ান হওয়ার জন্য অজিত প্রতিনিয়ত কসরত করে চলে। নিয়মিত নাইট ক্লাবে যাওয়া থেকে শুরু করে বার, জিম, পরকীয়া ইত্যাদি কোন কিছুই বাদ দেয় না সে। যে করেই হোক অতীতের সবকিছু মুছে ফেলতে হবে। এরই মধ্যে পরকীয়া করতে গিয়ে কিছুদিনের জন্য স্ক্যান্ডালের মালাও গলায় পরতে হয় অজিতকে। বন্ধুদের কারো কারো সঙ্গে সাময়িক ব্যবধান তৈরী হয় তার। পলকা বুদ্ধিমতী মেয়ে। প্রথমদিকে থানা পুলিশ করলেও পরকীয়ার মতো বিষয়কে উপলক্ষ্য করে স্বামীকে ছেড়ে যাবার মতো নির্বুদ্ধিতা সে করেনি। অজিতের অতীত সম্পর্কে পলকা বেগম তেমন একটা জানে না। তাই অজিতের যত হামবড়া গল্প চলে তার প্রিয়তমা স্ত্রী পলকা বেগমের সঙ্গে। কোন এক অজ্ঞাত কারণে সে সযতেœ আড়াল করতে চায় তার ফেলে আসা অতীতকে।
দেশে বেড়াতে গেলে অজিতের স্থায়ী স্টেশন হয় শ্বশুরালয়। বাবা-মা একই শহরে আলাদা বাসায় বসে আফসোস করেন ছেলের জন্য। প্রতি সপ্তাহান্তে বাবা-মাকে গিয়ে দেখে আসে অজিত। কখনও বা অজিতের বাবা ছেলেকে দেখার জন্য একাই এসে পড়েন বেয়াই বাড়ী। তারপরেও শ্বশুর-শাশুড়ীকে রেখে নিজের বাবা-মা’র কাছে গিয়ে একদিনও থাকা হয় না অজিতের। যদিও এই বাবা-মা’র জন্যেই অজিত আজ কানাডার নাগরিক।


কাজের ফাঁকে ট্যাক্সিচালকের ইউনিফর্ম পরেই এক অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হয় সুজন। খাবার টেবিলে দেখা হয় বন্ধু রিফাতসহ তার আরও দু’তিনজন ট্যাক্সিচালক বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধুরা সবাই বাসায় ট্যাক্সি রেখে নিজের গাড়ী নিয়ে বেশ স্যুটেড বুটেড হয়ে সপরিবারে অনুষ্ঠানে এসেছে। কানাডায় ট্যাক্সিচালকের ইনকাম ভাল এরকম শুনেই সুজন ট্যাক্সি চালানোর কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু যেমনটি বন্ধুবান্ধবের মুখে শুনেছিল, উবার চালু হবার পর ট্যাক্সির সেই আগের রমরমা অবস্থা আর নেই। খেতে বসে সুজন হাসতে হাসতে তার বন্ধু রিফাতকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কি দোস্ত, আজ কত ইনকাম হলো? উবার এসে তো আমাদের আয় বরকত সব ভেস্তে গেল দেখছি।’
উত্তর দেয়া দুরে থাক, অস্বস্তি আর লজ্জায় লাল হয়ে যায় রিফাত। কারণ অত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের দৃষ্টি এড়াতে রিফাত তার নিজ শহর থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দুরবর্তী একটি শহরে গিয়ে ট্যাক্সি চালায়। তার চারপাশের কাউকে সে ট্যাক্সি চালানোর কথা জানতে দিতে চায় না। একই কারণে কানাডায় আসার পর প্রথম প্রথম গভীর রাতের শিফটে একটা কারখানায় কাজ নিয়েছিল রিফাত। উদ্দেশ্য যেন কেউ তাকে দেখে না ফেলে। সুজনের কথায় প্রচন্ড রাগ হয় রিফাতের। মনে মনে সুজনকে গালি দেয় সে- ‘হারামজাদা নিজে তো ডুইবা আছেই, আমারেও ডুবাইলো’।
সুজন এসব লুকোচুরির ধার ধারে না। দেশে থাকতে সে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ছাড়াও অনেক সরকারী বেসরকারী সংস্থায় কনসালটেন্সি
করেছে। জীবনে সম্মান প্রতিপত্তি কোন কিছুরই কমতি হয়নি কখনও। তাই মানসম্মান নিয়ে কোন হাহাকারও নেই সুজনের। প্রথম জীবনে পাওয়া সেই সম্মান আর প্রতিপত্তির তুলনায় এখানকার সবকিছু তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়, সব কাজই তার কাছে অড জব মনে হয়। আর তাই কেউ জিজ্ঞাসা করলে মিথ্যা বলতে পারে না সুজন। কোন রকম লুকোচুরি না করে অবলীলায় সবার সামনে ট্যাক্সি চালানোর কথা বলে দেয় সে। সুজনের টরন্টোবাসী আত্মীয়স্বজনরাও বেশ বিব্রতবোধ করে এতে। তাদের অনেকেই সুজনের ট্যাক্সি চালানো নিয়ে চিন্তায় ঘুমহারা। মাঝে মাঝেই তারা সুজনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আর কতদিন এভাবে ট্যাক্সি চালিয়ে কাটাবে?’
টাকা পয়সার জন্যে খুব বেশী দৌড় ঝাঁপ করার পক্ষপাতি নয় সুজন। বরং এ বিষয়ে সে বেশ উদাসীনই বলা চলে। অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত সে। মিনিমালিস্টিক লাইফস্টাইল যাকে বলে আর কি। সবকিছুতে খুব অল্পেই যেন তার তৃপ্তি আর সন্তুষ্টি। কৌতুকপ্রিয় সুজন নিজের অবস্থা নিয়েও রসিকতা করে। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, কেমন আছো সুজন? শরীরটা ভালো? সুজন খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়, ‘চলে যাচ্ছে একরকম। ‘অর্থাভাব’ ছাড়া আর তো কোন অসুখ নেই। তাছাড়া ওটাও তো জন্মগত রোগ। কমবেশী সবারই এই রোগ আছে। অর্থযোগ বা দৈবযোগ ছাড়া ভালো হবার নয়’।
সুজন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে অভিবাসীদের অর্থোপার্জনের নেশা। সবকিছু ভুলে সবাই যেন ছুটে চলেছে ডলারের নেশায়। দৈনন্দিন জীবন যাপন সুজনের কাছে এক রহস্য। এই রহস্যময়তাকে চলমান জীবনের প্রতি পদক্ষেপে উপভোগ করতে চায় সে। সবার সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারে সুজন। ছোট বেলায় পড়েছে, ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে’। মানুষের সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রেও এই নীতিই অনুসরণ করে সুজন।
দেশে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিতে বেশ ভালভাবেই চলে যেত সুজনের। তবু বাচ্চাদের লেখাপড়া আর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে পঞ্চাশোর্ধ হয়েও চাকরি ছেড়ে বাবা-মা’র অমতে ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে এসেছে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। হয়তো সে কারণেই এখানকার কাজকর্ম নিয়ে খুব একটা আপত্তি আফসোস নেই তার। এই বাস্তবতা সে মেনেই নিয়েছে।
ছাত্রজীবনে কিছুদিন তবলীগ করেছিল সুজন। তবলীগ জামাতের জীবন বেশ ফুরফুরে। চল্ল্লিশ দিনের চিল্ল্লা। পরিবার পরিজন রেখে নিশ্চিন্তে যাযাবরের মতো মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়ানো আর ধর্মের মাহাত্ম প্রচার। বেশ লাগতো সুজনের। সুজনের মনে পড়ে কোন এক জামাতে বয়ান করার সময় হুজুর বলেছিল, আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ ইত্যাদি সবকিছুর বরাদ্দ নির্ধারিত করে রেখেছেন। নিজের সেই বরাদ্দ শেষ হয়ে গেছে, এই ভেবে হুজুরের সেই বয়ানে সান্তনা খোঁজে সুজন। ‘জীবনে যা উপভোগ করার তা তো আগেই করে ফেলেছি’- নিজেকে এই প্রবোধ দেয় সে।

এই পরবাসে সুজন, রিফাত, অজিত পলকাদের আড্ডা আর অন্তর্দন্দ্ব চলে সমান্তরাল। চল্ল্লিশোর্ধ হয়ে প্রবাসে এসে হাবুডুবু খাওয়া সুজনদের বুঝতে পারে না যৌবনে প্রবাসী অজিতরা। প্রত্যেকের সমস্যা এবং তার ধরণ যে আলাদা সেটা বুঝতে চায় না কেউই। সবাই নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে চায় অন্যের উপরে। অজিতরা এদেশে এসেছিল নিজের ভাগ্যান্বেষনে আর সুজনরা এসেছে সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভেবে। যুবা বয়সে আগতদের সঙ্গে পরিনত বয়সে আসা ইমিগ্র্যান্টদের ধ্যান ধারণা, জীবনবোধে বিস্তর ব্যবধান। আত্মতৃপ্তির অনুভূতিও যে ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন এই বাস্তবতা বুঝতে চায় না অনেকেই।
একদিকে দাওয়াত খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, কার কয়টা বাড়ী, কে কত এক্সপেন্সিভ ব্র্যান্ডের পন্য ব্যবহার করে, কোন মডেলের কত দামী গাড়ী চালায়, ইনকাম কত এসবের মধ্যেই আনন্দ আর সুখ খুঁজে ফেরে অজিত-পলকারা। অন্যদিকে প্রাত্যহিক জীবনের চড়াই উৎরাই সামলাতে সুজনদের দুর্গতির অন্ত নেই এদেশে। অর্থাভাবের কষ্টের চাইতে চারিপার্শ্বিক অর্থোত্তাপের দহন অনেক বেশী অনুভব করে সুজনরা। কেটে যায় দিন, মাস, বছর। এমনি করেই নিরন্তর ভেসে চলে অভিবাসীদের জীবনতরী।
নাজমুল ইসলাম
টরন্টো, কানাডা

nazmul13@gmail.com

(এই লেখার সব চরিত্র কাল্পনিক। কোনো ব্যক্তি বা কারো ঘটনার সাথে মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। )