‘আয়রন লেডি’ ও ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস ওম্যান ইন কানাডা’র স্বরূপ!

20 শে মার্চ, 2018

মোহাম্মদ আলী বোখারী

ব্রিটেনের প্রয়াত ‘স্টেটসওম্যান’ খ্যাত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট হিলডা থেচার, সংক্ষেপে বেরোনেস থেচার তার শাসনামলে অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের ৪ মে থেকে ১৯৯০ সালের ২৮ নভেম্বর আপোসহীন রাজনীতি ও নেতৃত্বগুণের জন্য ‘আয়রন লেডি’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। বলা হয়, তিনি তার দেশের যথার্থ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ফোকল্যান্ডস যুদ্ধ জয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদ্যমান  স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখেন। ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। অথচ এই ‘আয়রন লেডি’ উপাধিটির প্রচার ঘটে সমালোচক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তার প্রধানমন্ত্রীত্বেরও আগে অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ২৪ জানুয়ারি। কিন্তু কেন সেই উপাধি?
মার্গারেট থেচার তখন বিরোধী দল, কনজারভেটিভ পার্টির নেত্রী হিসেবে আগের বছর দায়িত্ব নিয়েছেন এবং ‘অ্যান্টিকমিউনিস্ট ক্রসেডর’ হিসেবে পরিচিত। ফলে সোভিয়েত আর্মির প্রচার মাধ্যম ‘ক্রাসনায়া জবেজদা’ মস্কোর বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের উপর থেচারের সমালোচনার জবাবে সাংবাদিক ক্যাপ্টেন ইউরি গ্যাভরিলভ রচিত ‘জেলেজনায়া দামা উগরুটজায়েত’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপে। সেটাই তৎকালীন রয়টার্স বার্তা সংস্থার মস্কো ব্যুরো প্রধান রবার্ট ইভান্স তার সম্প্রচারিত বার্তায় লিখেন, “ব্রিটিস টরি লিডার মার্গারেট থেচার ওয়াজ টুডে ডাবড্ ‘দ্য আয়রন লেডি’ বাই দ্য সোভিয়েত ডিফেন্স মিনিস্ট্রি নিউজপেপার রেড স্টার” এবং সংবাদটিতে ‘জেলেজনায়া দামা উগরুটজায়েত’ ইংরেজি অনুবাদে হয় ‘আয়রন লেডি ওয়েল্ডস থ্রেটস’, অর্থাৎ লৌহ মানবী হুমকির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এক সপ্তাহ পর থেচার নিজেই করতালিমুখর বক্তৃতায় সেই উপাধির প্রচার দেন লন্ডন সাউথ গেটের সেলবর্ন হলে, যেখানে তিনি বলেন, ‘আই স্ট্যান্ড বিফর ইউ টুনাইট ইন মাই রেড স্টার ইভিনিং গাউন, মাই ফেস সফ্টলি মেড আপ অ্যান্ড মাই ফেয়ার হেয়ার জেন্টলি ওয়েভড্, দ্য আয়রন লেডি অব দ্য ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড’ এবং গুরুত্ব আরোপ করে পুর্নব্যক্ত করেন, ‘ইয়েস, আই অ্যাম অ্যান আয়রন লেডি’। দেখা গেল, সোভিয়েতদের দেয়া অপবাদের তিন বছর পরই তিনি ব্রিটিনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরে সেটাই হয় তার রাজনৈতিক রূপায়ণ!

টরন্টো সান পত্রিকার প্রচ্ছদ

কিন্তু গত ১৯ মার্চ বহুল প্রচারিত ডেইলি টরন্টো সান পত্রিকার সচিত্র প্রচ্ছদে কানাডার অন্টারিও প্রদেশের অতি জনপ্রিয় প্রিমিয়ার বা মুখ্যমন্ত্রী ক্যাথলিন ওয়েন কেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বখ্যাত ‘ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি’ বা ব্যক্তিনিরপেক্ষ মনোবিজ্ঞানের গ্রন্থাকার অধ্যাপক জর্ডান পিটারসন কর্তৃক ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস ওম্যান ইন কানাডা’ উপাধিতে আখ্যায়িত হলেন, সেটিও বোধ করি আগ্রহদ্দীপক। এতে পত্রিকাটির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে অধ্যাপক পিটারসন বলেছেন, তিনি কোনক্রমেই তার (ক্যাথলিন ওয়েন) অনুরাগী নন এবং মনে করেন, তিনি ‘রেপ্রেহেন্সিবল আইডিওলগ’ বা ‘তিরস্কারযোগ্য ভাবাদর্শ’। তার বিশ্বাস, ‘আই থিঙ্ক শি ইজ এ উল্ফ ইন শিপ’স ক্লথিং অ্যাজ ওয়েল বিকজ শি ইজ নট এ লিবারেল বাই অ্যানি স্ট্রেচ অব দ্য ইমাজিনেশন’। অর্থাৎ তিনি ভেড়ার আচ্ছাদনে নেকড়ে, কেননা তিনি কোন ধারণার পরিসীমাতেই উদারপন্থী নন। বলাবাহুল্য, ওয়েন হচ্ছেন অন্টারিও লিবারেল পার্টির নেত্রী। অধ্যাপক পিটারসনের মতে, ওয়েনের নেতৃত্বে অন্টারিও লিবারেল পূর্বতন বামপন্থী এনডিপি (নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি, বর্তমানে বিরোধী দল) সরকারের পর্যায়ে উপনীত। ওই অধ্যাপক নিজে চৌদ্দ বছর বয়স বা তারও আগে থেকে রাজনৈতিক সচেতনভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, ফলে ‘সাইকোলজিক্যাল লেন্স’ বা মনোবিজ্ঞানের দুরবিনে রাজনীতিকে মূল্যায়ণ করেন। এমনকী নিজস্ব ধারণায় মনে করেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ‘পিটার প্যান’ বা স্কটিশ রম্যরচয়িতা স্যার জেমস বেরি’র ‘পিটার প্যান’ নাট্য চরিত্রের বালকটির মতো বেড়ে ওঠেননি। তাই তার মতে, ‘আই থিঙ্ক ক্যাথলিন ওয়েন ইজ অ্যান আট্টার ডিজাস্টার; আই থিঙ্ক শি ইজ দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস ওম্যান ইন কানাডা’।
অধ্যাপক জর্ডান পিটারসনের মন্তব্যটি এমন দিনে প্রকাশ পেয়েছে, যে দিন অন্টারিও প্রদেশ সরকার আগামী বাজেট উপস্থাপনের পরই সাধারণ নির্বাচনি প্রচারণায় নেমেছে। কেননা প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী চার্লস সওজা আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি ভর্তুকি পরিপূরণের পরিবর্তে ৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে অন্টারিওর জনগণের দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ‘ফেয়ারনেস প্রোগ্রামে’ বা ‘পক্ষপাতহীন কার্যক্রমে’ প্রণোদনা জোগাবেন। এ কারণে অধ্যাপক পিটারসনের মতে, ‘ফেয়ারনেস’ বহুধাবিভক্ত; অর্থাৎ অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সকল সন্তানকে এক করে ভাবা, অর্থাৎ ওয়েনের ইচ্ছা সকলের সমান সুযোগ করে দেওয়া নয়, বরং বামপন্থী ভাবনায় তাদের ফলাফল যেন অভিন্ন হয়। অধ্যাপকের মতে, অন্টারিও প্রদেশের সন্তানেরা তার দৌহিত্র নন; আমরা তার এতোটা সহমর্মীতা চাই না, এমনকী তার ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ বা সংখ্যালঘুপ্রবণ রাজনীতিরও প্রয়োজন নেই। ওয়েনের ভাবাদর্শের কারণে ইংলিশ কমন ল’-তে ব্যবহৃত ‘প্রিসামসন অব ইনোসেন্স’ বা ‘নির্দোষ প্রমাণের দায়ভার’ বিলীন হয়ে ‘বিলিভ অব অ্যাকুউজড্’ বা ‘দোষারোপের বিশ্বাস’ ও ‘প্রিপনডারেন্স অব এভিডেন্স’ বা ‘সত্যনিষ্ঠ ও যথার্থতার প্রমাণ’ স্থান করে নিচ্ছে, যা সত্যত্তোর আধুনিকতা ও এক ধরনের ‘প্যাট্রিআর্চাল টাইরানি’ বা ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নিষ্পেষণ’ চাপিয়ে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে এই অধ্যাপক তার মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য ব্যাপক সমালোচনার সন্মুখীন হলেও তার অনেক সমর্থকের কাছে ‘ফ্রি স্পিচ চ্যাম্পিয়ন’। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘টুয়েল্ভ রুলস ফর লাইফ’ জাতীয় পরিসীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে এবং ইউটিউবে স্থান নেওয়া বিবিসি সঞ্চালক ক্যাথি নিউম্যানকে দেয়া সাক্ষাতকারটি বিশ্বের ৮০ লাখেরও বেশি দর্শক দেখেছেন।
পুনশ্চ: প্রিমিয়ার ক্যাথলিন ওয়েন হচ্ছেন প্রথম কোনো মুখ্যমন্ত্রী যিনি শিক্ষামন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রীতে ‘হোয়াট লিডারশিপ ইজ’ ধারণায় বিপুলভাবে সমাদৃত এবং হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতি একনিষ্ঠ এবং ২০১৭ সালের মার্চে তার সরকার কানাডার অন্টারিও প্রদেশে প্রথমবারের মতো ‘বাংলাদেশ হেরিটেজ মান্থ’ সংসদীয় আনুষ্ঠানিকতায় প্রবর্তন করেছে। পাশাপাশি প্রদেশে সকল মধ্যবিত্ত সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা খরচ মওকুফ, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি ধর্মের চর্চা উন্মুক্তকরণ ও অনুর্ধ্ব ২৫ বছর বয়সীদের বিনামূল্যে ঔষধ সেবা প্রচলন করে যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তাই পাঠক, মার্গারেট থেচারের ‘লৌহ মানবী’ ও ক্যাথলিন ওয়েনের ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস ওম্যান ইন কানাডা’ উপাধির স্বরূপটি নিজ বুদ্ধিমত্তায় হৃদয়াঙ্গম করেছেন, আশাকরি।
ই-মেইল: bukhari.toronto@gmail.com
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো