আমি সন্তান হিসেবে ব্যর্থ

জুন 3, 2018

সুব্রত নন্দী

আমি সন্তান হিসেবে ব্যর্থ। আমার মা’কে আমি কানাডায় আনতে পারিনি, কোন ভাইকে কানাডায় আনতে পারিনি । সবাইকে ছেড়ে আমি বাংলাদেশ থেকে সতেরো বছর আগে স্বার্থপরের মতো পালিয়ে এসেছি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে সংসারের দায়ভার শুধু একজনের, বাকীরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে আয়েশ করে চলবেন , সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমোবেন। পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি তারা উত্তরাধিকার সূত্রে ভোগ করেন, কিন্তু যে বড় তাকেই সবার দায় নিতে হবে । সে হালের বলদ শ্রেণীর কিছু। তাঁর বিয়ে ,সংসার, সন্তান পালন সব কিছুই হারাম। আমার ক্যাডেট কলেজের এক বন্ধুর বড় ভাই আব্দুল রাশেদ আলী মন্ডল একটা নির্ঘুষ সৎ চাকুরি করতেন। শারীরিক কোন সমস্যা ছিল না অথচ তিনি বিয়ে করেননি পাছে স্ত্রীর খবরদারিতে দায়িত্বের ব্যাঘাত ঘটে। নিজের জীবনের সব সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে তিনি আট ভাই বোনের সংসারে সারাজীবন তেলের ঘানি টেনে গেলেন। এত দায়িত্ব পালন করেও তিনি শেষ জীবনে সমালোচিত নিন্দিত এবং যথারীতি তিনি ব্যর্থ । এখন শেষ বয়সে তাঁকে দেখবার আর কোথাও কেউ নেই। অথচ ভাই বোনেরা স্ব স্ব পদে প্রতিষ্ঠিত। ভুলেও তারা নিভৃত গ্রামে অযতœ অবহেলায় দিন কাটানো ভাইয়ের খোঁজ রাখেন না।
বাবার সম্পত্তির ষোল আনা ভোগ করে ব্যাংকে লক্ষ লক্ষ টাকা জমিয়েও ছোটরা কখনো সফল হয় না। অথচ কিছু না নিয়েও যত ব্যর্থতা শুধু বড় ভাইদের। অসুস্থ মা বাবার চিকিৎসার জন্য ছোট ভাইদের খাজাঞ্চি খানায় টান পড়ে। এই বুঝি জমানো টাকা শেষ হয়ে গেল!
বাংলাদেশের সবার হাতে এখন অনেক টাকা। কিন্তু এত থেকেও তারা দীনহীন ফকির। শুধু নাই নাই আর নাই। অথচ তারা দেশে বিদেশে ট্যুর করে, তালে তালে লাখ টাকার মার্কেট করে, দামী রেস্টুরেন্টে খায়। বাড়তি টাকা লাগলে, বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসার খরচ লাগলে এক জন আরেক জনের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়। আমি কেন ও দেবে, সে দেবে। অথচ বিদেশে দুই বেলা আঠারো ঘন্টা মজুদুরি করা সবার এক একটি টাকার গাছ আছে বলে আত্মীয় স্বজনের ধারনা। ফেসবুকে তারা দেখেন প্রতি শনিবার পার্টি আর দাওয়াত খাওয়া প্রবাসী ভাইয়ের হাসি মুখ ,আহা কি সুখি কত টাকা তার! এদিকে অধিক পরিশ্রমে তার ব্যাক পেইন হয়ে গেছে। বাড়ির মর্টগেজ আর বিল পরিশোধ করতেই তাদের জীবন ত্রাহি মধুসূদন। কিন্তু কেন সে প্রবাসে আছে? কারণ, এখানে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা আছে। বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আছে। চিকিৎসা আছে। ছেলে মেয়েদের সহজতর শিক্ষা আছে, আইনের শাসন আছে। আমি কোন উগ্রবাদি মুসলমানদের ভয়ে দেশ ছাড়িনি। ছেড়েছি অভাবের তাড়নায়। সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ছিলাম। অথচ ছেলে মেয়ে নিয়ে সৎভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নেই। এত শিক্ষিত হয়েও শুধু দিতে পারিনি বলে আত্মীয়রা আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন। তারা অষ্টম শ্রেণী পাশ দারোগা পুলিশ আত্মীয়দের চেয়ার এগিয়ে দিতেন। ঘুষখোর আত্মীয়ের তোয়াজ তোষামোদ করতেন। আমি এমন দেশে থাকতে চাইনি।
দেশে যেমন ধান্দাবাজি করে টাকা উপার্জন করা বড় লোক আছে, প্রবাসেও আছে। আসলে ধান্দাবাজের জন্য সারা পৃথিবীই উর্বর শস্য ক্ষেত্র। কেউ কেউ প্রবাসে এসে সৎ উপার্জনেও ধনী হয়েছেন । তবে আমি মনে হয় ধনী হবার জন্য জন্ম নেইনি। সবাই ধনী হতে পারে না । শত পরিশ্রম করেও না। প্রবাসেও আমার নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। উদ্বৃত্ত নেই। বেশির ভাগ প্রবাসীদেরই কোন উদ্বৃত্ত নেই। তারা ঋণ করে ঘি খান। আমি আমার ক্ষুদ্র সামর্থ থেকে বাংলাদেশে গরিবদের সাহায্য করি, মা ভাই বোনদের কিছু দেই। কিন্তু সেটা তাদের কাছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। তাদের হাজার বা লাখে পোষায় না। (পোষাবে কেন, বাংলাদেশে নাকি একদিনে দুই লাখ টাকার উপার্জন পান্তা ভাত, কথাচ্ছলে ডেসার এক ইঞ্জিনিয়ার আমাকে এমন কথা বলেছেন। শুধু কোচিং সেন্টার খুলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন এমন অনেক বন্ধু বান্ধবদের আমি চিনি)। তারা চায় কল্পিত টাকার গাছের অনেক টাকা।
আমার টাকার গাছ নেই। তাই আমি ব্যর্থ। আমি ঘামের মূল্যে টাকা উপার্জন করে ক্লান্ত হয়ে কখনো কখনো সোফার উপর ঘুমিয়ে পড়ি। এজন্য আমি ব্যর্থ। ব্যর্থ মানুষ সভ্যতার “অভিশাপ”। তাদের কেউ ভালবাসেনা।

সুব্রত নন্দী
টরন্টো