‘হোয়াইট সুপ্রিমেসী ইজ টেররিজম’
সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৭
॥ খুরশিদ আলম ॥
কানাডায় শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে যারা বর্ণবাদী, শ্রেষ্ঠত্ববাদী এবং নব্য নাৎসি তাদের আধিপত্যবাদী কার্যক্রমও সন্ত্রাসবাদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর এই গোত্রভূক্ত লোকদের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম গত কয়েকমাসে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে কানাডায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আগে এদের কার্যক্রম ছিল সীমিত এবং প্রকাশ্যে খুব একটা আসতেন না এরা। এখন এরা যা কিছু করছেন তা প্রকাশ্যেই করছেন। কোন রকম ভীতি বা সংকোচ অথবা লোক লজ্জার তোয়াক্কা তারা আর করছেন না। কারণ, তারা জেনে গেছেন তাদের পিছনে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের আদর্শগুরু, তাদের রক্ষাগুরু, তাদের উদ্বুদ্ধকরণ গুরু। তার সাম্প্রতিকতম প্রমাণ মিলে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াতে ঘটে যাওয়া দাঙ্গায়।
গত ১২ আগস্ট ঘটে যাওয়া ঐ দাঙ্গায় একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩৫ জন। ঐ দিন ডানপন্থী শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করছিলেন যারা তাদের উপর আইএস জঙ্গীদের স্টাইলে সহসা গাড়ি উঠিয়ে দিলে এ ঘটনা ঘটে। দাঙ্গার সময় হেলিকপ্টার নিয়ে ঐ এলাকায় টহল দেওয়ার সময় সেটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গ রাজ্য ভার্জিনিয়ার একটি পার্ক থেকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধকালীন একজন জেনারেলের ভাস্কর্য অপসারণের দাবী জানিয়ে আসছিলেন এক দল নাগরিক। কিন্তু ভাস্কর্যটি অপসারণের বিরোধিতা করার জন্য ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা বিক্ষোভের জন্য জড়ো হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন নব্য নাৎসি গ্র“পের সদস্যরা এবং কুখ্যাত ক্লু ক্লাক্স ক্লান এর সদস্যরা। অন্যান্য আরো কয়েকটি হোয়াইট সুপ্রিমেসী গ্র“পের সদস্যরাও ছিলেন সমাবেশে। এই সময় তারা সেনাবাহিনীর মত করে পোষাক পরে ছিলেন। হাতে ছিল তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
১৮৬১ থেকে ৬৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকার গৃহযুদ্ধে দাসপ্রথার পক্ষে ‘কনফেডারেট’ বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়া জেনারেল রবার্ট ই লি এর ভাস্কর্য অপসারণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সকাল থেকেই সমবেত হন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা। পরে কনফেডারেট পতাকা নিয়ে নাৎসি আমলের নানা স্লোগান সহকারে পার্কের ওই ভাস্কর্য অভিমুখে যাত্রা করেন তারা। এ সময় অনেকের মাথায় হেলমেট ও হাতে ঢাল দেখা যায়।
তাদের বিরোধিতা করে কয়েকশ মানুষ ওই এলাকায় সমবেত হন। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এ সময় পার্কটি থেকে দুই ব্লক দূরে বিরোধীদের ভিড়ে একটি চলন্ত গাড়ি উঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে ৩২ বছর বয়সী এক নারী নিহত হন।
আর এর পরপরই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউজার্সিতে ছুটিতে থাকা অবস্থায় এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, “বিভিন্ন পক্ষের মধ্য বিদ্বেষ, গোঁড়ামি ও সহিংসতার এই কুখ্যাত প্রদর্শনীর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি আমরা।”
ঘটনার জন্য দায়ী ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের আলাদাভাবে নিন্দা না জানিয়ে তিনি ঢালাও ভাবে সবাইকে দোষারোপ করেন। তার এই বক্তব্যে তার দলের অনেক নেতারাও চটে যান। তারা বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ধরণের বক্তব্য দিয়ে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদেরই প্রশ্রয় দিয়েছেন।
রিপাবলিকান সিনেটর কোরি গার্ডনার বলেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট – দুর্বৃত্তদেরকে তাদের নামেই ডাকা উচিৎ। এরা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী। এরা যা করেছ তা আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ। আরেক রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও একে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত করেন। সিনেটর টেড ক্রুজ ও অরিন হ্যাচও একে আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ হিসাবেই উল্ল্লেখ করেন।
শ্বেতাঙ্গদের এই বিক্ষোভের সমালোচনা আগেই করেছিলেন চারলটসভিলের মেয়র সিঙ্গার। একে ‘ঘৃণা, গোঁড়ামি, বর্ণবাদী ও অসহনশীলতার প্রদর্শনী’ আখ্যায়িত করেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য পরবর্তীতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদেরও নিন্দা করেন। কিন্তু সেটা দৃশ্যতই নিজ দলের লোকদের চাপে পড়ে করেছেন। উল্ল্লেখ্য যে, ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকার গৃহযুদ্ধ হয় ওয়াশিংটনের কেন্দ্রীয় সরকারি বাহিনী ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ১১টি স্টেটের কনফেডারেট বাহিনীর মধ্যে। দাসপ্রথার পক্ষের কনফেডারেট বাহিনী কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হন, ঘটে দাসপ্রথার বিলুপ্তি। এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের অনেক শহরে কনফেডারেট প্রতীকগুলো ধরে রাখা হয়, যা এখনও রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কনফেডারেট পতাকা এবং ভাস্কর্যগুলো ঘিরে তৎপর হয়ে উঠে উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো।
আর তাদের জ্ঞাতি ভাই যারা কানাডায় থাকেন তারাও নানান ইস্যুতে তৎপর হয়ে উঠেছেন সাম্প্রতিক সময়ে। টরন্টো, মন্ট্রিয়ল ও ভেঙ্কুভার সহ নানান স্থানে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, র্যালি ও সমাবেশ করার চেষ্টা করছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা আধিপত্যবাদীদের তৎপরতার পর কানাডা এ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে এ কথা ভাবার কোন কারণ নেই।’
আর তার আলামতও আমরা দেখতে পাচ্ছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের হামলার পর পরই কানাডার একাধিক স্থানে তাদের সমর্থকরা সমাবেশ ও র্যালীর আয়োজন করেছেন। গত ১৯ আগস্ট ভেঙ্কুভারে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের এক সমাবেশ আয়োজন করা হলে সেখানে উত্তেজনা চরমে উঠে। প্রায় চার হাজার প্রতিবাদী সেখানে উপস্থিত হয়ে এই আধিপত্যবাদীদের কর্মকান্ডের বিরোধিতা করেন। তবে পরিস্থিতি বেগতিক হওয়ার আগেই স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ অধিপত্যবাদীদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে ঐ স্থান থেকে সরিয়ে নেয়।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ভেঙ্কুভারে আধিপত্যবাদীদের মূল এজেন্ডা ছিল মুসলিম বিরোধিতা ও বর্তমান সরকারের ইমিগ্রেশন পলিসির নিন্দা জানানো। সমাবেশের দিন ঘটনাস্থলে তাদের হাতে ছিল কনফেডারেট পতাকা এবং ‘অল্ট-রাইট’ প্রতীক খচিত পতাকা। একজনের পরনে ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প এর ছবিযুক্ত টি শার্ট।
ভেঙ্গুভারের সিটি মেয়র গ্রেগর রবার্টসন অধিপত্যবাদীদের এই সমাবেশের তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন বর্ণবাদ ও বিদ্বেষ এর কোন স্থান নেই এই সিটিতে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রিমিয়ার জন হর্গানও আধিপত্যবাদীদের বিরোধিতাকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, আমরা যে কোন ধরণের বর্ণবাদ, বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা এবং ধর্মান্ধতার নিন্দা জানাই।
একই ধরনের সমাবেশ ও র্যালীর আয়োজন করা হয়েছিল কুইবেক সিটিতেও। তবে সেখানে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা কোনঠাসা অবস্থায় ছিলেন যখন বিপুল সংখ্যক প্রতিবাদী জনতা এসে উপস্থিত হন। কার্যত তারা একটি ভবনের গ্যারাজে বন্দি অবস্থায় ছিলেন ঐ সময়। সন্ধ্যায় প্রতিবাদকারীরা চলে গেলে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা একটি র্যালী বের করেন।
টরন্টোতে গত ১৪ আগস্ট যুক্তরষ্ট্রের কনসুলেট অফিসের সামনে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কিছু আমেরিকান নাগরিকও ছিলেন। তারা সম্প্রতি ভার্জিনিয়াতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের বর্ণবাদী কার্যক্রমের তীব্র নিন্দা জানান।
বস্তুত অনেক দিন ধরেই কানাডার হোয়াইট সুপ্রিমেসীদের অপতৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবির্ভূত হওয়ার কিছুুদিনের মধ্যেই কানাডার কুইবেক প্রভিন্সের রাজধানী কুইবেক সিটিতে এই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সমর্থক এক তরুনের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের ৬ জন সদস্য। ৯/১১ এর ঘটনার পর পর যখন সন্দেহের তীর মুসলিমদের প্রতি, তখনও এরকম হত্যাযজ্ঞ ঘটেনি গোটা উত্তর আমেরিকায়।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন হামলার সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় লাফিয়ে ৬০ শতাংশ বেড়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হামলার ১৫৯টি ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে যা আগের বছর ছিলো ৯৯টি। এই খবর প্রকাশিত হয় সিবিসি নিউজে।
কানাডীয় মুসলিমদের জাতীয় কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান খালিদ এলগাজার ২০১৫ সালকে কানাডার মুসলমানদের জন্য একটি ‘কঠিন বর্ষ’ হিসাবে উল্ল্লেখ করেন। এলগাজার বলেন, বিদ্বেষমূলক হামলার শিকার অনেক মুসলিমই হামলার ঘটনা পুলিশকে জানান না, কারণ ভীত-শঙ্কিত থাকেন যে পুলিশে জানালে তাদেরকে আরও হেনস্তা হতে হবে অথবা তারা ভাবেন যে, পুলিশ কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেবে না।
নতুন ঐ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকেদের ওপর হামলার ঘটনা ২০১৫ সালে কমে ১৭৮টিতে দাঁড়িয়েছে যা আগের বছর ছিলো ২১৩টি। উল্ল্লেখ্য, কানাডায় ইহুদিরাই ছিলো সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হওয়া ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সেন্টার ফর ইসরায়েল অ্যান্ড জিউস অ্যাফেয়ার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শিমন কফলার ফোগেল যাকে খুবই “অশান্তিকর এবং স্পষ্ট” প্রবণতা বলে উল্ল্ল্লেখ করেন।
এক বিবৃতিতে ফোগেল বলেন, “ইহুদিদের ওপর হামলার বিষয়টি সব কানাডীয়র জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিৎ, কারণ ঐতিহাসিকভাবে সেমিটিক-বিরোধিতার বিষয়টি কোনও সমাজের মূল্যবোধের স্বাস্থ্যগত অবস্থা চিহ্নিত করে। যারা ইহুদিদের ওপর হামলা করে তারা বস্তুুতপক্ষে স্বাধীনতা, সাম্য ও সবার নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।”
সাম্প্রতিককালে কানাডায় এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কানাডার মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। সিবিসি নিউজে প্রকাশিত জনাথন মন্টপেটিট এর এক প্রতিবেদনে উল্ল্লেখ করা হয় “৯/১১ এর পর থেকে কানাডার গোয়েন্দা বিভাগের অধিকাংশ মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয় ইসলামী জঙ্গীদের উপর। কিন্তু আইএস বা আল-কায়দার মত জঙ্গী গোষ্ঠির উপর যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়ে আসছে, ততটা গুরুত্ব কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এবং রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এর পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে না শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের উপর।”
কিন্তু গুরুত্ব আরোপ করার মতো একটি বিষয় হলো – উত্তর আমেরিকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুধু ইসলামী জঙ্গীরাই চালাচ্ছেন তা সত্য নয়। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরাও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সাম্প্রতিককালে তাদের কার্যক্রম যথেষ্ট পরিমাণে বিস্তার লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে তারা ইসলামী জঙ্গীদেরকেও পিছনে ফেলে দিয়েছেন! ২০১৫ সালের ২৮ জুন টরন্টো স্টার এ প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে এই তথ্য জানা যায়।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে ৯/১১ এর ঘটনার পর এ পর্যন্ত ১৯ টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন এই চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা। অন্যদিকে এই একই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামী জঙ্গীরা ৭ টি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন।
৯/১১ এর পর চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪৮ জন। ঐ বছর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে গত ১৭ জুন সাউথ ক্যারোলিনায় অবস্থিত একটি চার্চে যেখানে গণহত্যার শিকার হন ৯ জন কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসী। চরমপন্থী এক শ্বেতাঙ্গ যুবক এই গণহত্যার নায়ক। অন্যদিকে ইসলামী জঙ্গী বা সন্ত্রাসীদের হামলায় এই সময়ের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন ২৬ জন। ওয়াশিংটন ভিত্তিক নিউ আমেরিকা নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই তথ্য প্রকাশ করে।
চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের এই অপকর্ম বিষয়ে সাধারণ মানুষ খুব একটা অবহিত নয়। তাদের কাছে বিষয়টি নতুন ঘটনা মনে হতে পারে। হতে পারে সেটা মিডিয়ার ভূমিকার কারণে। তবে পুলিশের কাছে শ্বেতাঙ্গ এই চরমপন্থীদের অপকর্মের তথ্য রয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভারসিটির অধ্যাপক চর্লস কুর্জম্যান এবং ড্যুক ইউনিভারসিটির অধ্যাপক ডেভিড শ্যাঞ্জার এক জরীপ চালান এ বিষয়ে। তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ৩৮২ টি কার্যালয়ের কাছে জানতে চান, তাদের এলাকায় সবচেয়ে বড় মাত্রার সন্ত্রাসী ঘটনার গুলোর মধ্যে কোনটির অবস্থান প্রথম এবং কোনটির অবস্থান দ্বিতীয়। ঐ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যালয়গুলো থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- ৭৪% সহিংস ঘটনা ঘটেছে চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সরকার বিরোধী কার্যক্রম এর কারণে। অন্যদিকে ৩৯% সহিংসতা ঘটেছে আলকায়দা সংশ্লিষ্ট ইসলামী জঙ্গীদের দ্বারা।
সিএনএন এর এক রিপোর্টে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস মনে করে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গী যারা মানুষের গলা কাটে তাদের চেয়েও বড় হুমকী এই চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক কর্মকর্তাই মনে করেন চরমপন্থী এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা (যারা সভরিন সিটিজেন গ্রুপ নামেও পরিচিত) আইএস নামের জঙ্গী সংগঠনের সমান অথবা তারচেয়েও বেশী হুমকী বহন করেন। স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক কর্মকর্তারও এ বিষয়ে একই মত।
সন্দেহ নেই বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একে তো ইসলামী জঙ্গীদের উৎপাতের কারণে কানাডা ও মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের মধ্যে কমবেশী উদ্বেগ রয়েছেই, এখন তার সাথে আরো যোগ হয়েছে চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের উৎপাত। শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থীদের সাম্প্রতিক এই উৎপাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা চালানো হলেও কানাডা এতদিন চুপচাপই ছিল। তবে সম্প্রতি এখানেও গবেষণা বা তদন্ত চলছে। ফলাফল কি বেড়িয়ে আসবে তা সহজেই অনুমেয়।
টরন্টো স্টার এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ১৯৮০ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত মোটামুটিভাবে ৩০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে কানাডায় যেগুলো শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু কানাডার নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের দুই সাবেক সদস্যের মতে, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের দ্বারা যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটছে তা ইসলামী চরমপন্থীদের দ্বারা সংগঠিত সন্ত্রাসের সমতুল্য নয়। শ্বেতাঙ্গ আদিপত্যবাদীদের দ্বারা যে হুমকী সৃষ্ঠি হচ্ছে তা এখনো কম মাত্রার হুমকী। এ কথা বলেন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফিল গুরস্কি।
আরেক সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্টিফেনী কারভিন বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের বিষয়ে উপর কম গুরুত্ব দিচ্ছে এই কারণে যে, তারা প্রধানত ছোটখাট অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তিনি আরো বলেন, যদি প্রকৃত সংখ্যার দিকে তাকানো হয় তবে দেখা যাবে ইসলামী চরমপন্থীদের তুলনায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সংখ্যা কম।
টরন্টো স্টারে প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে আরো উল্ল্লেখ করা হয় যে, গত জানুয়ারীতে কুইবেক সিটিতে মুসলিম হত্যাযজ্ঞের মাত্র কয়েকদিন আগে কানাডার গোয়েন্দা তথ্য ছিল – শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা কানাডার ইমিগ্রেন্টদের জন্য কোন হুমকী নয়।
কানাডা সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এর ওয়েবসাইটেও উল্ল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের দ্বারা সৃষ্ট হুমকী তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটাচ্ছে। পরিসংখ্যানের দিক থেকে বিচার করলে এগুলো অকার্যকর।
কিন্তু সত্যিই কি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের কর্মকান্ড কম গুরুত্বপূর্ণ বা সংখ্যার দিকে থেকে বিচার করলে তা অকার্যকর? এই প্রশ্ন উঠেছে গত জানুয়ারীতে কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর।
ভ্যাঙ্কুভারে বাস করেন এমন একজন সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ জেমস এলিস বলেন, কানাডায়
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা নিরাপত্তার বিষয়ে হুমকী সৃষ্টির জন্য তেমনভাবে সংগঠিত নয় এরকম ধারণা খুবই বিপজ্জনক।
টরন্টো স্টার এর প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, ২০১৪ সালে কুইবেক প্রভিন্সিয়াল পুলিশের এক্সট্রিমিস্ট থ্রেট ডিভিশন এর পক্ষ থেকে সিনেট কমিটিকে জানানো হয়েছিল যে অধিকাংশ ওপেন ফাইল চরম ডানপন্থীদের বিষয়ে মোকাবিলা করতে হয়েছে। ২০১৫ সালের এক গবেষণায়ও দেখা গেছে কানাডায় মোটামুটি ১০০টি শ্বেতাঙ্গ অধিপত্যবাদী গ্র“প রয়েছে।
আমরা লক্ষ্য করেছি, সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় বিভিন্ন মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাটি হয়েছে কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে। আমরা আরো লক্ষ্য করছি যে, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের টার্গেট কিন্তু শুধু মুসলিম সম্প্রদায় নয়। তারা ইউরোপ বাদে অন্য সব অঞ্চল থেকে আসা সকল ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে বিষোধগার করছেন।
স্মরণ করা যেতে পারে যে এই শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা kkk (KKK stands for Knights of the Ku Klux Klan, a group of white, Christian supremists) নামের এক বর্ণবাদী সংগঠনের অধীনে অতীতেও ভয়াবহসব নৃসংশতা চালিয়েছেন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে। সেই সময় তাদের টার্গেট ছিল কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠি। কৃষ্ণাঙ্গদেরকে গুলি করে হত্যা করার পাশাপাশি ঘরের ভিতর আটকে রেখে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটিয়েছেন এরা। আজকে তারা নর্থ আমেরিকায় মুসলিম সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সাউথ এশিয়ান, মিডল ইস্টর্ন ও আফ্রিকান অঞ্চল থেকে আসা ইমিগ্রেন্ট এবং রিফিউজিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছেন এবং সমাবেশ ও মিছিল করছেন।
এতদিন আমরা জেনে এসেছি ৯/১১ এর ঘটনার পর ইসলামী জঙ্গীরাই নর্থ আমেরিকার মাটিতে বড় হুমকী। বিশেষ করে মুসলিম নামধারী হোমগ্রোন টেররিষ্টদের নিয়ে চিন্তিত ছিল দুই দেশের সরকারই। এখন দেখা যাচ্ছে এর সাথে যোগ হয়েছে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা বা আধিপত্যবাদীরাও।
আমরা আরো মনে করি ইসলামের নামধারী সন্ত্রাসীদের যেমন কঠোর হস্তে দমন করার পলিসি ও কার্যক্রম রয়েছে কানাডীয় সরকারের, তেমনি আমজনতার স্বার্থে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী বা আধিপত্যবাদীদের কঠোর হস্তে দমন করার পলিসি ও কার্যক্রম থাকা উচিৎ কানাডীয় সরকারের।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ