শীর্ষ শিষ্টাচারের দেশ কানাডা থেকে বিনয় ভদ্রতা সৌজন্যতা লোপ পেয়ে যাচ্ছে?
এপ্রিল ৯, ২০১৬
॥ খুরশিদ আলম ॥
সম্প্রতি আমাদের এক পারিবারিক বন্ধুর ছেলের বার্থ ডে পার্টিতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার ও আমার স্ত্রীর। বাড়িতে স্থান সংকুলান হবে না বলে টরন্টোর স্কারবরোতে এলস্মেয়ার ও বার্চমাউন্ট এলাকায় একটি পার্টিরূম ভাড়া করা হয়েছিল বার্থ ডে পার্টি উপলক্ষে। সুসজ্জিত পার্টি রূম। অতিথি আপ্যায়নে যাতে কোন ত্রুটি না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখা হয়েছিল।
পার্টিরূমের প্রধান ফটকে আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অভিভাকদের একজন প্রতিনিধিকে দাঁড় করানো হয়েছিল। আমি অবশ্য ঐ ভদ্রলোককে দেখতে পাইনি প্রধান ফটকে। কারণ, অফিস থেকে ফিরতে দেরী হয়ে গিয়েছিল বিধায় পার্টিতেও সময়মত পৌঁছাতে পরিনি। এ জন্য সরি হোস্টের অভিমান দূর করতে হয়েছে। তবে ভিতরে প্রবেশ করতেই অনেক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কারো কারো সাথে দেখা হলো অনেকদিন পর। অভিবাদন বিনিময়ের পর ব্যক্তিগত খোঁজ খবরও নেয়া হলো অনেকের।
পার্টিরূমে বার্থ ডে উপলক্ষে সমবেত শিশুদের আনন্দ-উল্লাস দেখে ভালই লাগছিল। অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পর্বও ছিল একটি। এরপর নৈশভোজ।
অনুষ্ঠান শেষে যখন বিদায়ের পালা তখন আমন্ত্রণকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছিলাম। এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে বললেন, আপনি তো মিডিয়ার লোক, আপনার কাছে আমার একটি অপমানজনক অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই।
উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম ঐ ভদ্রলোকের অপমানকর অভিজ্ঞতাটা কি তা শুনার জন্য। তিনি যা বললেন তা শুনলে যে কারোরই অবাক হবার কথা। মনে মনে আহতও হতে পারেন কেউ কেউ। আমরা আসলে প্রতিনিয়তই এরকম অভিজ্ঞতার মুখমুখি হচ্ছি এই কানাডায় এসে যেখানে মানুষের সৌজন্যতাবোধ ও ভদ্রতা জ্ঞান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক উঁচু। কেউ কেউ বলেন পৃথিবীর সেরা শিষ্টাচারের দেশ কানাডা।
ভদ্রলোক সেদিন প্রধান দরজার সামনে সন্ধ্যা থেকেই দাড়িয়েছিলেন আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে দরজা খুলে দিতে এবং অভ্যর্থনা জানাতে। প্রায় ঘন্টাখানেক দাড়িয়ে থেকে গোটা তিরিশেক পরিবারকে তিনি অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে আট/দশটি পরিবারের সদস্য ছাড়া বাকী কোন পরিবারের সদস্যরাই তাকে ধন্যবাদ জানাননি দরজা খুলে দেওয়ার জন্য এবং অভ্যর্থনা জানানোর জন্য! ভদ্রলোক ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, আমি কি বেতনভোগী দাড়োয়ান ছিলাম গেটে?
বেতনভোগী হোক বা না হোক, দাড়োয়ানও একজন মানুষ। তারও অধিকার আছে সমাজের আর সব মানুষের মত সম্মান পাওয়ার। তার শিক্ষা বা আয় কম বলে তাকে হেয় করা যাবে না। এটাই নিয়ম হওয়া উচিৎ এবং এটাই মানবাধিকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, যে দেশটাকে আমরা পিছনে ফেলে এসেছি সেই দেশটাতে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। দরজা খুলে দেয়ার জন্য দাড়োয়ানকে ধন্যবাদ জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করার রীতি বাংলাদেশে নেই। যদি কেউ করতে যান তবে তাকে নিয়ে লোকে হাসাহাসি করবেন। পিতার সমান বয়স হলেও রিক্সাওয়ালাকে তুই বলতে মুখে বাধে না আমাদের অনেকেরই। বাড়ির কাজের লোকদের প্রতি আমাদের অধিকাংশের ব্যবহার চরম অপমানজনক এবং অমানবিক। সমাজের অবহেলিত মানুষকে সম্মান বা শ্রদ্ধা জানানোটা যেন আমাদের জন্য অধর্মের কাজ। সেটি করতে গেলে আমাদের জাত যাবে, পাপ হবে।
এরকম একটি সমাজব্যবস্থা থেকে আমরা কানাডায় এসেছি। সুতরাং কেউ যদি এখানে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য এবং অভিবাদন জানানোর পরও কাউকে ধন্যবাদ না জানান, বা একটুখানি হাসি উপহার না দেন তবে এ ঘটনার জন্য কাকে দায়ী করা উচিৎ? যে ব্যক্তিটি এরকম অশোভন ও শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করলেন তার কি লজ্জা পাওয়া উচিৎ নয়?
আমি ঐ ভদ্রলোকের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে কোন সদুত্তর দিতে পারিনি। যারা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। কিন্তু এদের একটি অংশের ভদ্রতাজ্ঞান কেন নেই সেই প্রশ্নের কি জবাব হতে পারে? দেশীয় সংস্কৃতির প্রভাব না অন্য কিছু?
আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর কয়েক আগের ঘটনা। গ্রীষ্মের এক বিকেলে আমি ড্যানফোর্থের ড্যানটোনিয়া পার্কের ভিতর দিয়ে হাঁটছিলাম। ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ার কারণে নিয়মিত হাঁটতে হয় আমাকে। পার্কের যে দিকটায় শিশুদের জন্য দোলনা ও পানির ফোয়ারার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেদিকটায় পথচারীদের চলাচলের জন্য সরু পিচঢালা রাস্তা রয়েছে। আমি ঐ রাস্তা ধরেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ নজরে এলো একটি পুলিশের গাড়ি। রাস্তার উল্টোদিক থেকে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে ধীর গতিতে। নিয়মিত টহলে এসেছে না কোন কিছুর খোঁজে এসেছে সেটি অনুমান করা গেল না। গাড়িতে একজনই পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। আমি বাংলাদেশের পুলিশ দেখেছি। তাদের সম্পর্কে অনেক কাহিনী পত্রপত্রিকায় পড়েছি। তবে সৌভাগ্যই বলতে হবে, দেশে থাকা অবস্থায় কোনদিন তাদের সংস্পর্শে যেতে হয়নি। বাংলাদেশের পুলিশের অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখেই গাড়িটি যখন কাছাকাছি চলে এসেছিল তখন আমি পিচঢালা সরু রাস্তা থেকে সরে গিয়ে ঘাস বিছানো মাঠের উপর নামতে যাচ্ছিলাম। এক পা ঘাস বিছানো মাঠের উপর চলেও গিয়েছিল। কিন্তু তখনই দেখলাম পুলিশের গাড়িটিই আমাকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে মাঠের উপর নেমে গেছে! এবং গাড়িতে থাকা পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তিনি মৃদু একটা হাসি উপহার দিলেন আমাকে! আমিও হাত উঁচিয়ে তাকে অভিবাদন জানালাম।
পার্কের ভিতর পথ চলতে গিয়ে আমার যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে জন্য পুলিশের গাড়ি আমাকে পথ ছেড়ে দিয়েছে! ব্যাপারটি তখন স্বপ্নের মত লাগছিল আমার কাছে। আমি শ্বেতাঙ্গ নই, গাড়িতে বসা পুলিশ কর্মকর্তা একজন শ্বেতাঙ্গ ছিলেন। তিনি আমাকে যথাযথ সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক রাস্তা ছেড়ে দিলেন! ভদ্রতা বা শিষ্টাচার অথবা সৌজন্য প্রকাশ যেভাবেই একে মূল্যায়ন করি না কেন এর তুলনা আছে কি?
পুলিশ কর্মকর্তা তার কর্তব্য পালন করেছেন। পার্কের ভিতরের রাস্তায় পথিকের অগ্রাধিকার। পার্কের ভিতর কোন জরুরী পরিস্থিতি ছিল না তখন। তাই তিনি রাস্তা ছেড়ে দিয়েছেন পথচারীর জন্য। মানুষের প্রতি এই যে সম্মানবোধ এই যে কর্তব্য পরায়নতা এর জন্য কি উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন আছে?
দরজার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কদিন আগে আমি ড্যানফোর্থের মারহাবা গ্রোসারীর উপর তলায় অবস্থিত আমার অফিস থেকে নিচে নেমে আসছিলাম। পিছনে আসছিলেন আরো তিনজন ভদ্রলোক। তারা উপর তলায় অবস্থিত মসজিদে নামাজ শেষ করে নামছিলেন। আমি দরজা খুলে বের হয়ে এসেছি। কিন্তু দরজা ছেড়ে দেইনি। পিছনে যারা আসছিলেন তাদের জন্য দরজা খুলে রেখে অপেক্ষা করছিলাম। তারা তিনজন খোলা দরজা দিয়ে নির্বিঘেœ চলে গেলেন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে। ধন্যবাদ তো দুরের কথা, তারা আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না।
অবশ্য এর উল্টো চিত্রও আছে এই একই স্থানে। একবার অফিসের জন্য নিকটবর্তী স্টেপলস্ থেকে একটি রিভলভিং চেয়ার কিনে আনার পর সেটি নিয়ে উপরে উঠছিলাম সরু সিড়ি বেয়ে। কার্টুন এর সাইজ বড় হওয়াতে একটু সমস্যা হচ্ছিল। বিষয়টি লক্ষ্য করে দোতালা থেকে নিচে নামার জন্য অপেক্ষমান এক মুসল্লি সাহায্য লাগবে কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, না ভাই – একাই পারবো। মাত্র তো কয়েকটা সিড়ি। উপরে উঠে তাকে আবারো ধন্যবাদ জানালাম।
শিষ্টাচারের দেশ কানাডা। অনেকে বলেন বিশ্বসেরা শিষ্টাচারের দেশ কানাডা। কথাটা বাড়িয়ে বলা হয় তা কিন্তু নয়। সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা, বিনয়, অথবা শিষ্টাচার যাই বলিনা কেন এ বিষয়ে কানাডিয়ানদের জুড়ি মেলা ভার। বরং বিশ্বে কানাডিয়ানদের একটি ‘বদনাম’ আছে এই বলে যে, তারা একটু বেশী ভদ্র। রাস্তায় চলতে গিয়ে কেউ যদি অসাবধানতাবশত কোন কানাডিয়ানের গায়ের উপর এসে পড়েন অথবা কোনভাবে যদি গায়ে ধাক্কা লাগান তবে যে লোকটি গায়ের উপর এসে পড়লেন বা ধাক্কা লাগালেন তিনি কিছু বলার আগেই কানাডিয়ান লোকটি সরি বলবেন। এপলজি চাইবেন বা ঐ লোকটি কোনভাবে ব্যথা পেলেন কিনা সেটা জানতে চাইবেন।
কানাডিয়ানরা সাধারণভাবে বন্ধুবৎসল ও বিনয়ী। সততা, সংবেদনশীলতা, সহানুভূতি এবং নম্রতা তাদের চরিত্রের গভীরে প্রোথিত। অন্যের গোপনীতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তারা। ভুল করুন বা না করুন, অপরাধ করুন বা না করুন, সরি বলতে বা এপলজি চাইতে তারা মোটেও কার্পন্য করেন না। আর কথায় কথায় কথায় থ্যাং ইউ বলাতেও তাদের জুড়ি নেই। মোট কথা, উপরে উল্লেখিত আচরণগুলোকে কানাডার মূলধারার নৈতিকতা বলেই বিবেচনা করা হয়।
ক্যাালিফোর্নিয়ায় বসবাসকারী কানাডিয়ান নাগরিক ও স্ট্যান্ডফোর্ড ইউনিভারসিটির সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ক্যারিনা সুমান মেট্রো পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি প্রায়ই কানাডিয়ানদের এই সৌজন্যবোধ নিয়ে আমেরিকানদের মন্তব্য শুনি। আমি কানাডিয়ান এ কথা জানতে পারলে অনেক আমেরিকানই আমাকে বলেন, আমি কানাডিয়ানদের খুব পছন্দ করি। কারণ তোমরা খুবই ভদ্র এবং নম্র। তোমরা সবসময়ই সরি বল।
ক্যারিনা সুমান চার বছর আগে কানাডার ওয়াটারলু ইউনিভারসিটিতে পিএইচডি করার সময় নারী-পুরুষের মধ্যে এপলজি চাওয়ার বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। কোন একটি ঘটনায় এপলজি চাওয়ার বেলায় কে বেশী এগিয়ে সেটি গবেষণা করতে গিয়ে তিনি দেখেন নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশী মাত্রায় এপলজি চান।
ক্যারিনা বলেন, কানাডিয়ানরা অতিশয় ভদ্র। এর কারণ হতে পারে তারা ঐ পরিবেশে বড় হন। ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে শিখানো হয় সরি বলা। ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবার কাছেই সরি বলতে হয় ভুল করলে বা কোন খারাপ আচরণ করলে, এমনটাই শিক্ষা দেয়া হয়। ফলে ঐ সরি কালচারটা তাদের অস্থিমজ্জায় গেঁথে থাকে।
মেট্রো পত্রিকার সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ভাষাবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চার্লস ববার্গ বলেন, কানাডিয়ানদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি সম্ভবত বৃটিশ হ্যারিটেজ থেকে প্রাপ্ত। সমাজে তারা সবসময় শালীন ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত হতে চান।
তবে এটিও সত্যি যে সব কানাডিয়ানই এক রকম নন। এর মধ্যে কিছু লোককে খুঁজে পাওয়া যাবে যাদের নাক উঁচা। আকারে নয়, স্বভাবে। তারা এই সরি বা এপলজি কিংবা থ্যাং ইউ কালচারের ধার ধারেন না। অবশ্য এদের সংখ্যা কানাডিয়ান সমাজে খুব বেশী নেই। আর এদের বেশীরভাগই হয় বর্ণবাদী না হয় আত্মগরিমা এদের বেশী।
কিন্তু কানাডায় বসবাসকারী ইমিগ্রেন্টরা কতটুকু নমনীয় ও বিনয়ী? সংবেদনশীলতা, সহানুভূতি ও বন্ধুবৎসল এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মধ্যে কতটুকু বিদ্যমান? অপরাধ করুন বা না করুন, ভুল করুন বা না করুন সরি বলতে বা এপলজি চাওয়ার ক্ষেত্রে তারা কতটুকু উদার? তারা দিনে কতবার প্লিজ বা থ্যাং ইউ বলেন?
এ প্রশ্নের সহজ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশীদেরই উদারহণ দেয়া যাক। আগেই উল্লেখ করেছি দেশে আমরা অনেকেই সমাজের অবহেলিত মানুষকে সম্মান বা শ্রদ্ধা জানাতে অভ্যস্ত নই। আমাদের ধারণা, সেটি করতে গেলে আমাদের জাত যাবে। সরি বলাটাকে আমাদের দেশী কালচারে পরাজয় স্বীকার করা হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। ক্ষমা চাওয়াটাকে মনে করা হয় অক্ষমতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। কানাডায় এসেও আমাদের অনেকেই সেই মন-মানসিকতা নিয়ে জীবনযাপন করে থাকি। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে আসা ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে প্রায় একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীর অন্যান্য অনুন্নত এলাকা বা দেশ থেকে আসা ইমিগ্রেন্টদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা প্রযোজ্য।
কানাডার বড় তিনটি শহরে প্রধানত ইমিগ্রেন্টদের বসবাস। এই তিনটি শহর হচ্ছে টরন্টো, মন্ট্রিয়ল ও ভেঙ্গুভার। সাম্প্রতিক কালে পরিচালিত কিছু জরীপে দেখা গেছে এই ইমিগ্রেন্ট অধ্যুষিত শহরগুলোতে শিষ্টাচার বা ভদ্র আচরণ কমে আসছে। ভেঙ্গুভার সান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ৬২% ব্রিটিশ কলম্বিয়ান মনে করেন গত পাঁচ বছরে ঐ প্রভিন্সের মানুষদের মধ্যে ভদ্রতা বা শিষ্টাচার কমে গেছে। সেখানে কেউ কেউ পিছন থেকে এসে লাইনের সামনের দিকে দাড়িয়ে যাচ্ছেন, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলছেন কেউ কেউ। রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় অভদ্র আচরণ করছেন অনেকে। জরীপে আরো দেখা গেছে বিগত পাঁচ বছরে মানুষের মধ্যে থ্যাংক ইউ বা প্লিজ বলার প্রবণতাও কমে গেছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার এক তৃতীয়াংশ অধিবাসীই এ কথা বলেন।
অবশ্য ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় যারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন তাদের মধ্য থেকে ৪৫% লোকের পর্যবেক্ষণ হলো ভদ্রতা ও নমনীয়তা কমে গেলেও এখনো অনেক যাত্রী আছেন যারা সিনিয়র সিটিজেন, ডিজএবল বা প্রেগনেন্ট মহিলাদের দেখলে তাদের নিজেদের আসনটি ছেড়ে দেন। অন্যদিকে ৭২% ব্রিটিশ কলম্বিয়ানের মন্তব্য হলো, বেশিরভাগ অভদ্র আচরণ দেখা যায় রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময়।
জরীপে দেখা যায় যারা স্যোসাল মিডিয়া ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে ৬২% অভদ্র আচরনের শিকার হন। দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়ে অভদ্র আচরণের শিকার হন ৫০% অধিবাসী। অফিসে কর্মরতদের ৪৮% অমার্জিত ব্যবহারের শিকার হন। পাবলিক ট্রানজিট ব্যবহারকারিদের মধ্যে ৪৭% অশিষ্ট আচরণের শিকার হন। রাস্তায় হাটার সময় ৪৩% অধিবাসী অভদ্র আচরণের শিকার হন।
কিন্তু কারণটা কি? ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ৭৫% আধিবাসী মনে করেন মানুষ অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকার কারণে এমনটি ঘটছে। অর্ধেকের বেশী অধিবাসী মনে করেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে আদর্শের কমতি একটি কারণ। আবার ৯৩% অধিবাসী মনে করেন শৈশবে বাবা-মা তাদের সন্তানদের আদব-কায়দা শিক্ষা দেননি বলেই এমনটা ঘটছে।
যাদের বয়স ৫৫ বা তারও বেশী তারা মানুষের এই অধোগতিতে কিছুটা নিরাশ। তবে যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ তাদের মধ্যে নিরাশার মাত্রা একটু কম। কিন্তু সাধারণভাবে সকলেই ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের অভাব লক্ষ্য করে চিন্তিত এ কথা নানাভাবে মিডিয়াতে উঠে এসেছে।
এরকম পরিস্থিতিতে কেউ কেউ অবশ্য শিষ্টাচার শিক্ষা দানের জন্য বিশেষ কোর্স চালু করার কথাও বলেছেন। কিন্তু সেটি সম্ভব হবে বলে
মনে হয় না। কারণ, যারা শিষ্টাচার শিখতে যাবেন তারা যে সমাজের অভদ্র অংশের লোক সেটি প্রকাশ্যভাবেই চিহ্নিত হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য যে, ভেঙ্গুভারের যে চিত্রটি আমরা উপরে দেখলাম সেটি কমবেশী টরন্টো এবং মন্ট্রিয়লেও চলে আসছে। সিনেমা হলে সিটের পিছনে পা তুলে দেয়া বা পা দিয়ে চাপসৃষ্টি কিংবা ধাক্কা দেয়া, শো চলাকালীন সেলফোনে কথা বলা, টেক্সট্ ম্যাসেস পাঠানো (ফোনের স্ক্রীনের আলোতে পাশের দর্শক বিরক্ত হতে পারেন), গাড়ি চালানোর সময় অধৈর্য হয়ে উঠা, অপর ড্রাইভারের প্রতি অশোভন অঙ্গভঙ্গী বা অঙ্গুলী প্রদর্শন করা বা গালাগাল করা, টেইল গেটিং করা, পাবলিক ট্রানজিটে বয়স্ক বা শারীরিকভাবে অক্ষম যাত্রীদের সিট দখল করে রাখা, পাবলিক প্লেসে বা এলিভেটরে ধুমপান করা, ফুটপাতে যেখানে সেখানে চুইংগাম ফেলা, ট্রেনে বা বাসে ভিড় দেখেও পিছন দিকে সরে না যাওয়া, কর্মস্থলে অধিনস্তÍদের প্রতি রুঢ় আচরণ করা, মালিক কর্তৃক শ্রমিকদের প্রতি রুঢ় বা অশোভন আচরণ করা এ সবই হচ্ছে টরন্টো ও মন্ট্রিয়লে। এবং আশংকার বিষয় হলো, যারা এগুলো করছেন তাদের মধ্যে কোন অনুশোচনাবোধ নেই। এই সকল অশোভন, অশালীন ও অভদ্র আচরণ করেও তারা দিব্যি দিন কাটাচ্ছেন। এ জাতীয় মানুষের মুখে কখনোই সরি শব্দটি শুনা যায় না। থ্যাংকইউ বলার অভ্যাসও নেই এদের মধ্যে।
বাঙ্গালী কমিউনিটিতে অশোভনতার আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। কমিউনিটির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিশেষ করে যে সকল অনুষ্ঠানগুলো বড় মাপের হয় সে সকল অনুষ্ঠানে দেখা যায় হলরূমের প্রবেশ পথে অবাঙ্গালী সিকিউরিটি গার্ড দাড় করিয়ে রাখা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, শতভাগ বাঙ্গালীর অনুষ্ঠানে অবাঙ্গালী সিকিউরিটি গার্ড কেন? শুধুই কি সিকিউরিটি গার্ড? মাঝে মধ্যে পোষাকধারী পুলিশও রাখা হয় ঐ অনুষ্ঠানগুলোতে। কারণটা কি? বাঙ্গালীরা কি আইন মানেন না? তারা কি অভদ্র আচরণ করেন অনুষ্ঠানে গিয়ে? নাকি টিকিট না কেটেই জোর করে হলরূমে ঢুকতে যান তারা?
না, বাঙ্গালীরা অভদ্র নন। প্রবাসে ল-এবাইডিং পিপল হিসাবে বাঙ্গালীর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে মেইনস্ট্রিমে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অল্প কিছু লোক নিয়ে। এরা সত্যিই আইন মানেন না। অনুষ্ঠানস্থলে অভদ্র আচরণ করেন। টিকিট না কেটেই অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতে চান। মহিলাদের প্রতি অশোভন আচরণও করেন কেউ কেউ। ইতিপূর্বে ফোবানা সহ একাধিক অনুষ্ঠানে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। আর তারই পরিনতি এই অবাঙ্গালী সিকিউরিটি গার্ড এবং ক্ষেত্র বিশেষ পুলিশের উপস্থিতি। বড় অনুষ্ঠান হলে পুলিশের উপস্থিত থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিরাপত্তার কারণে মেইনস্ট্রিম অনুষ্ঠানেও পুলিশের উপস্থিতি থাকে। কিন্তু বাঙ্গালীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুলিশের উপস্থিতি বা অবাঙ্গালী সিকিউরিটি গার্ডের উপস্থিতি কেমন যেন দৃষ্টিকটু লাগে। কিন্তু আয়োজকদেরই বা উপায় কি? অভদ্র বা অশোভন আচরণ ঠেকাতে হলে এর বিকল্প আর কি হতে পারে? বাঙ্গালী সিকিউরিটি গার্ড হলে যারা অবাধ্য দর্শক তারা তো তাকে পাত্তা দিতে চাইবেন না।
তবে এও ঠিক যে শিষ্টাচার কখনো জোর করে শিখানো যায় না। কিভাবে ভদ্র আচরন করতে হয়, কোন পরিস্থিতিতে সরি বলতে হয় বা ক্ষমা চাইতে হয়, বয়স্কদের প্রতি কিভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়, কখন ধন্যবাদ বলা উচিৎ এগুলো একজন মানুষকে শিখাতে হয়ে শৈশব থেকেই। তবেই সেই মানুষটি বড় হয়ে একজন আদর্শ নাগরিক হতে পারেন। একজন পারফেক্ট জেন্টলমেন্ট বা নিখুঁত ভদ্রলোক হতে পারেন।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কন্ঠ