মিয়ানমারের পৈশাচিক গণহত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা কানাডার দুই নাগরিকের!

অক্টোবর ৭, ২০১৭

॥ খুরশিদ আলম ॥

মিয়ানমারে যে পৈশাচিক ও নৃশংস গণহত্যা চলছে এবং লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে তার পিছনে ভূমিকা রয়েছে কানাডার দুই নাগরিকের! একজনের ভূমিকা সরাসরি এবং অন্যজনের ভূমিকা পরোক্ষ। সরাসরি যার ভূমিকা রয়েছে তিনি হলেন মায়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি। এবং যার বিরুদ্ধে পরোক্ষ ভূমিকার অভিযোগ উঠেছে তিনি হলেন জাতিসংঘ কর্মকর্তা রেনাটা লক ডেসালিয়েন।

সুচি কানাডার অনারারী সিটিজেন। অন্যজন জন্মগতভাবে কানাডিয়ান সিটিজেন। অং সান সুচি আবার শান্তিতেও নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। সুচিকে ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। ২১ বছর পর তিনি সেই পুরস্কার গ্রহণ করেন। তখন তিনি ভাষণে বলেছিলেন, নোবেল কমিটি যখন আমাকে শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে তখন তারা এটারই স্বীকৃতি দিয়েছে যে, আমার দেশের নিপীড়িত ও বিছিন্ন জনগণ বিশ্বেরই একটি অংশ।

ভাবতে অবাক লাগে, সেই অং সান সুচি আজ নিজেই মেতে উঠেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং বর্বর এক গণহত্যায়। নিজের দেশের সেই নিপীড়িত মানুষের বিরুদ্ধেই তিনি আরো ভয়াবহ ও নৃশংস নির্যাতন চালাচ্ছেন স্তম্ভিত বিশ্ববাসীকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে!

কানাডার দুর্ভাগ্য যে এই মহিলাকে অতীতে অনারারী সিটিজেনশীপ প্রদান করেছিল। অনেকেই এখন তার এই নাগরিকত্ব বাতিল করার দাবী জানিয়েছেন। কদিন আগে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন সুচির নাগরিকত্ব বহাল থাকবে নাকি তা ফিরিয়ে নেয়া হবে। হাফিংটন পোস্ট জানায়, তিনি এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি শোচনীয় এবং ভয়াবহ। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য মায়ানমারের সরকার ও অং সান সুচি এবং ঐ এলাকার অন্যান্য লোকদের সঙ্গে আমাদের কাজ করে যেতে হবে।

রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে কানাডায় আশ্রয় দেয়া হবে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, আমরা সবসময়ই খোলা থাকবো এবং সমবেদনাশীল থাকবো যেমনটা আমরা সবসময় আছি। কানাডা সবসময়ই সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রু–ডো মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সুচিকে ফোন করে মিয়ানমারে মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সিবিসির খবরে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের জরুরী ভিত্তিতে শক্ত অবস্থান গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে অং সান সুচিকে চাপ দেন জাস্টিন ট্রুডো। রোহিঙ্গা সংকটে সুচির বিশেষ ভূমিকা রাখার ব্যাপারেও গুরুত্বারোপ করেন ট্রুডো।

মায়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি গত জুন মাসে প্রথম কানাডা সফরে এসেছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুুডোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ট্রুডো জানান, ঐ সময় তিনি সুচির কাছে রোহিঙ্গাদের ইস্যুটি তুলেছিলেন।

২০০৭ সালে কানাডার তৎকালীন কনজারভেটিভ সরকার অং সান সুচিকে কানাডার অনারারি সিটিজেনশীপ দেয়। তবে Globe and Mail এর এক খবরে বলা হয়, কনজারভেটিভ পার্টির এমপি গার্নেট জেনুয়াস সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে দাবী করেন রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে বর্তমান লিবারেল সরকারের প্রতিক্রিয়া ধীর এবং অপর্যাপ্ত। গার্নেট আরো বলেন তিনি কানাডার পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা ইস্যুটি ১৩ বার উঠিয়েছেন। অন্যদিকে লিবারেল এমপি ওমর আলগাবরা দাবী করেন বর্তমান সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে যখনই প্রয়োজন পড়েছে তখনই কথা বলেছে।

এদিকে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য কানাডায় একটি গ্র“প স্বাক্ষর গ্রহণের অভিযান শুরু করেছে। ফরিদ খানের নেতৃত্বে কুইবেক বেইজড এই অভিযানে ইতিমধ্যেই প্রায় ৪৩ হাজার লোক স্বাক্ষর প্রদান করেন। ফরিদ খান Globe and Mail পত্রিকাকে বলেন, কানাডার সরকারকে এ বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে কানাডার ঘনিষ্ঠ যুগসূত্র তৈরী হয়ে আছে যখন থেকে অং সান সুচিকে কানাডার অনারারি সিটিজেনশীপ দেয়া হয়।

উল্লেখ্য যে, রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে কানাডার প্রধানমন্ত্রী সতর্কভাবে মতামত প্রকাশ করলেও কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড বেশ কড়া কণ্ঠেই নিন্দা জানিয়েছেন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। Globe and Mail জানায়- মন্ত্রীর অফিস থেকে এক বিবৃতি বলা হয়, কানাডা দৃঢ়ভাবে মায়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি এবং সে দেশের সামরিক নেতৃবৃন্দকে মনে করিয়ে দেন এই বলে যে, বর্তমান সংকট মোকাবেলায় দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা এখনই বন্ধ করতে হবে। তাদেরকে দেশে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সম্মান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের অধিকারকে অস্বীকার করা হলে সেদেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করা হবে যে গণতন্ত্রের জন্য সুচি সারা জীবন সংগ্রাম করে এসেছেন।

এদিকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কফি আনান কমিশন বাস্তবায়নে গঠিত কমিটির কার্যক্রমে বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলেছে কানাডা। মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতে রাখাইন রাজ্যে প্রবেশাধিকারও দাবি করা হয়। পাশাপাশি জাতিসংঘের ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে মায়ানমারের নীতিকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ (ক্লিয়ারেন্স অপারেশন) হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় কানাডার পক্ষ থেকে।

মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে দুটি প্রতিবাদ মিছিলও হয়েছে কানাডায়। মিছিলগুলোতে অনেক কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী ও মায়ানমারের নাগরিকদেরকেও অংশ নিতে দেখা গেছে। মিছিলের একটিতে অংশ নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে আসা খবর অনুযায়ী আমাদের কাছে রোহিঙ্গা নির্যাতনকে জাতিগত নিধনযজ্ঞই মনে হচ্ছে। এটি আমাদের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরো বলেন, আমি গর্বিত যে কানাডীয়রা এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে।

কানাডীয়রা মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্মম নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড গর্ববোধ করছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, জাতিসংঘে কর্মরত এক কানাডীয় নাগরিক রেনাটা লক ডেসালিয়েন নাকি মায়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে কাজ করেছেন! শুরুতেই যে দুই কানাডীয় নাগরিকের কথা বলেছিলাম, এই রেনেটা লক তাদের একজন। বিবিসি বাংলা এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ কথা প্রকাশ করে। ঐ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘গত মাসে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে শুরু করে, তখন থেকে এই সংকট মোকাবেলায় সামনের কাতারে আছে জাতিসংঘ। শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘ ত্রাণ সাহায্য পাঠিয়েছে এবং মায়ানমারের কর্তৃপক্ষের নিন্দা করে কঠোর ভাষায় বিবৃতি দিয়েছ।

কিন্তু এই সংকটের পূর্ববর্তী চার বছর ধরে মায়ানমারে জাতিসংঘের কার্যক্রমের প্রধান রেনাটা লক ডেসালিয়েন রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে ভূমিকা পালন করেন, তা নিয়ে অনেক অভিযোগ তুলেছেন তারই প্রাক্তন সহকর্মী এবং বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার কর্মকর্তারা। রেনাটা লক ডেসালিয়েন এর আগে বাংলাদেশেও জাতিসংঘের প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

কানাডার নাগরিক রেনাটা লক ডেসালিয়েনর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে:

-রোহিঙ্গাদের এলাকায় মানবাধিকার কর্মীদের যেতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা।

– এ নিয়ে জনমত গড়ে তোলার কর্মসূচী বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা।

– রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টার ব্যাপারে সতর্কবাণী দিয়েছেন যেসব কর্মকর্তা, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা করা।’

রেনাটা লক ডেসালিয়েন হচ্ছেন বর্তমানে আবাসিক সমন্বয়ক। তিনি এসব বিষয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। একটি সূত্র বলছে, রাখাইনে রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে যেভাবে মিয়ানমারে জাতিসংঘ কাজ করেছে, তার জন্য একটি আভ্যন্তরীণ তদন্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংস্থাটি। তদন্তের রিপোর্টটি প্রকাশিত হলে হয়তো জানা যাবে কানাডার এই নাগরিক কেন মায়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে কাজ করেছেন।

এদিকে সর্বশেষ খবর হলো, রহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব ছাড়াই গত ২৮ সেপ্টেম্বর শেষ হলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত বিতর্ক। কেউ অবশ্য এতে আশ্চর্য হননি। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী দুই দেশ চীন ও রাশিয়া। এটিও পূর্ব নির্ধারিতই ছিল। অর্থাৎ এরকমটাই হবে তা সবাই আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলেন। কারণ, এই দুই দেশেরই অর্থনৈতিক ও রাজনৈকি স্বার্থ জড়িত মায়ানমারের সাথে। সেখানে কয়েক লক্ষ কেন, কোটি লোক দেশছাড়া হলেও তাদের কিছু আসে যায় না। বরং সুবিধাই হয় এই দুই পরাশক্তির। সেই সাথে মায়ানমারেরও।

যুগান্তর এর এক খবরে বলা হয়, রহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব ছাড়াই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত বিতর্ক শেষ হলেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পালানো অব্যাহত থাকায় মিয়ানমার সরকারকে অবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধ করার সাহসী পদক্ষেপ নিতে বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব এ আহ্বান জানান।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্রুত নিজ দেশে ফিরতে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পরিস্থিতি এতটা জটিল হয়ে উঠছে যে শরণার্থী সংকটের দ্রুত অবনতি হয়ে মানবিক সংকট ও মানবাধিকারের দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। তিনি আরো জানান, রাখাইন রাজ্যে থাকা রোহিঙ্গাদের তিন ভাগের দুই ভাগ পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। এ সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। রাখাইন রাজ্যের মধ্যভাগের দক্ষিণে আরও আড়াই লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার সেনার ‘পদ্ধতিগত সহিংসতা’র কারণে উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব আরো বলেন, মিয়ানমার সরকারকে তিনটি বিষয় মেনে নিতে হবে। প্রথমত রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত মানবিক সহায়তার জন্য আক্রান্ত এলাকাগুলোতে অবাধে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। তৃতীয়ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের নিজ ভূমিতে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশ্ববাসী দেখেছেন গত প্রায় এক মাসে কয়েক হাজার নিরীহ রোহিঙ্গা নির্মম ও পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন। একটি গোটা নৃগোষ্ঠিকে বিশ্ববাসীর চোখের সামনেই নির্মূল করা হচ্ছে। অথচ শক্তিমানেরা কেউই কিছু বলছে না। মানবতা আজ সেখানে দানবদের পদতলে পিষ্ঠ হচ্ছে। পৈশাচিক গণহত্যা আজ সেখানে বৈধতা পাচ্ছে।

অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ নিরাপত্তা পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য রোহিঙ্গাদের উপর চলমান নির্যাতন বন্ধের দাবী জানিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববাসী জানেন তাদের এই দাবী কুম্ভিরাশ্র“ ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমরা জানি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচ স্থায়ী সদস্য রয়েছে। চীন ও রাশিয়া ছাড়া বাকী তিন রাষ্ট্র হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। এদের যে কোন এক রাষ্ট্র কোন ইস্যুতে ভেটো প্রয়োগ করলে আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

বিশ্বের এই পাঁচ মোড়লের মোড়লগিরি আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ আরো অনেক দেশেই দেখেছি। যে কোন সমস্যা সমাধানের চেয়ে তা জিইয়ে রাখাই তাদের কাছে লাভজনক বেশী। সুতরাং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে হবে সেরকম আশা করাটা বোধ হয় বেশী চাওয়া হয়ে যেতে পারে।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমর দেখতে পাই মিয়ানমারথেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার প্রকল্প আরো বহু বছর আগেই শুরু হয়েছে। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন জানায়, “১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সেনা সরকার দেশটির ১৩০-এরও বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে দেয়। এতে তারা নাগরিকসহ বিভিন্ন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। সে সময় থেকে এখনও তারা দাবি করে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক। ১৯৯১-৯২ সালে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে অন্তত ৬ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে।”

সেই ৬ লাখ রোহিঙ্গা আজো নিজ দেশ মায়ানমারে যেতে পারেনি। গত কয়েক সপ্তাহে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা। ইকোনমিস্ট আরো জানায়, রোহিঙ্গাদের বর্তমান সংকট গত কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহতম। তারা বলছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার ঘটনায় সেখান থেকে যে সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় গতহত্যার ঘটনায় যত মানুষ পালিয়ে গেছেন, তা তার চেয়েও বেশি।

এবারের সংকটটা শুরু হয় গত ২৫ আগস্ট। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দাবী করে যে ঐ দিন রাখাইন রাজ্যে পুলিশের চেক পোস্টে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। আর এর পাল্টা জবাব দিতে গিয়েই দেশটির সেনাবাহিনী টানা অভিযান শুরু করে। সেনা অভিযানের মধ্যে আছে নিরীহ রোহিঙ্গাদের গ্রাম গুলো জ্বালিয়ে দেয়া, নারী ধর্ষণ, তরুন থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী রোহিঙ্গা পুরুষদেরকে গুলি করে হত্যা অথবা জবাই করে হত্যা, শিশুদেরকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা।

আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মিয়ানমার সেনাদের এ নির্মম কর্মকাণ্ডকে ইতিমধ্যে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, মিয়ানমারের নেতারা জোর গলায় অস্বীকার করে আসছেন এই বলে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে না। আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, শান্তিতে নোবেলজয়ী দেশটির নেত্রী অং সান সুচি সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যাযজ্ঞের সমালোচনা বাদ দিয়ে তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। সমালোকচরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে সুচি ব্যাপারটিকে বৈধতা দিয়ে দিয়েছেন।

অং সান সুচি নিজেই বলেছেন, কেন রাখাইন থেকে মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে সে বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছেন। মানবিক সংকট সমাধানে এগিয়ে না এসে সুচির এমন নির্জলা মিথ্যার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকেই তার নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে নেয়ার দাবি তুলেন।

এদিকে রোহিঙ্গা সংকটকে ‘মিয়ানমারের লজ্জা’ আখ্যা দিয়েছে বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন। টাইমের চলতি সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করা হয়েছে রাখাইন সংকট নিয়ে। যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টাইম ম্যাগাজিন বলছে, ‘রোহিঙ্গাদের দুর্দশায় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির নাম কলঙ্কিত হয়েছে। ১২ পৃষ্ঠার দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা এখনও অব্যাহত আছে। যারা আসছেন তাদের সবার গল্পই অভিন্ন। তাদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্ষণ ও পরিবারের সদস্যদের খুন করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হল কোনো পরিবারের দুর্দশা অন্যের চেয়ে কম নয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে-

গত ২৫ আগস্ট উপগ্রহের ছবিতে প্রথম ধরা পড়ে, রাখাইনে গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে। ওই রাজ্যে সেনা চৌকিতে কথিত মুসলিম জঙ্গিদের হামলার কয়েক ঘণ্টা পর থেকে পশ্চিম রাখাইনের সমগ্র টাউনশিপই জ্বলছে।

এরপরই প্রতিবেশী বাংলাদেশে শরণার্থীদের ঢল নামে। বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারের মুসলিম নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাটিতে দৃশ্যত সেনাবাহিনীর প্রতিশোধের জেরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালাতে শুরু করে। শরণার্থীরা ত্রাণকর্মীদের বলেছেন, সেনারা তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং তাদের পালানোর পথেও স্থলমাইন বসিয়েছে। তারা জানান, পলায়নরত রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের গুলি করছে মিয়ানমার সেনারা।’

টাইমের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘‘সুচিকে ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। ২১ বছর পর তিনি সেই পুরস্কার গ্রহণ করেন। তখন তিনি ভাষণে বলেছিলেন, নোবেল কমিটি যখন আমাকে শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে তখন তারা এটারই স্বীকৃতি দিয়েছে যে, বার্মার নিপীড়িত ও বিছিন্ন জনগণ বিশ্বেরই একটি অংশ। নোবেল শান্তি পুরস্কার আমার মনের কোণে একটি দ্বার খুলে দিয়েছে।’’

সুচির মনের কোণে সেদিন কি দ্বার খুলে গিয়েছিল জানিনা। তবে আজকে তিনি যে একজন সাক্ষাৎ রক্তপিপাসু রাক্ষুসীর মূর্তি ধারণ করে বিশ্ব সভায় নিজেকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাতে কারো কোন সন্দেহ নেই। আর সে কারণে শান্তিতে তার নোবেল পুরষ্কার প্রত্যাহের দাবীও উঠেছে।

অবশ্য মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে দেয়া নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির প্রধান বেরিট রেইস এন্ডারসন। তিনি বলেছেন, ১৯৯১ সালে দেয়া এই পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কারণ কাউকে যখন এই পুরস্কার দেয়া হয়, তাকে আগের কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই দেয়া হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর কে কি করছেন, তা দেখা আমাদের এখতিয়ারে পড়ে না, একটা আমাদের কাজও নয়।

আজকে একদিকে বিশ্বের সাধারণ মানুষ অসহায় ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখছেন রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত এই পৈশাচিকতা আর অন্যদিকে বিশ্বনেতৃবৃন্দ মেতে আছেন দাবার গুটি চালনা নিয়ে।

আমরা জানি বাংলাদেশ ধনী দেশ নয়। এমনকি মধ্যম আয়ের দেশও নয়। তাই বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় স্থায়ীভাবে এত বিপুল সংখ্যা রোহিঙ্গার ভারণপোষণ এর দায়িত্ব নেয়া। তবু মানবিকতার খাতিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে এসেছে। তাদের আশ্রয় দিয়েছে। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। শেখ হাসিনাকে এখন বলা হচ্ছে মাদার অব হিউম্যানিটি।

মিয়ানমার যে এই বিতারিত রোহিঙ্গাদের আর ফেরত নিবে না সেটা সম্ভবত নিশ্চিত করেই বলা যায়। যেমনটা তারা প্রতিশ্র“তি দিয়েও ফেরত নেয়নি আগের বিতারিত রোহিঙ্গাদেরকেও।

এদিকে দমন অভিযানের মুখে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার আশ্বাস আবারো দিয়েছেন সু চির দফতরের মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ে। গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় এসে তিনি এ আশ্বাস দেন। মিয়ানমার মন্ত্রীর এ আশ্বাসকে বৈশ্বিক চাপ কমানোর কৌশল বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষজ্ঞরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের যদি ফেরত নেয়া হতো তবে তাদের মিয়ানমার থেকে তাড়িয়ে দেয়া হতো না। তারা বলেন, সু চির মন্ত্রী খিও টিন্ট যখন ঢাকায় বৈঠক করছেন, তখনও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ হয়নি। এখনো মিয়ানমার থেকে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে।

বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতি ও সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির কুচক্রে পড়ে মায়ানমারের ক্ষুদ্র এ নৃগোষ্ঠির অস্তিত্ব আজ চরম হুমকীর মুখে। এখন কানাডাসহ অন্যান্য মানব দরদী দেশগুলো এগিয়ে আসলে বাংলাদেশের উপর চাপ কমবে সন্দেহ নেই এবং রোহিঙ্গাদেরও একটা গতি হবে।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ