মা দিবসের বিশেষ রচনা : মা’র রেখে যাওয়া সময়ের দাগ

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

হাসনাবাদ থেকে আমীরগঞ্জ মাইল দুই হবে পথ। বাবার হাত ধরে আমার কিশোরী মা তার বাবার বাড়ী ছেড়ে  আমীরগঞ্জ গ্রামে এসে নতুন ঘর বেধেছিলেন সেই কত বছর আগের কথা । নতুন মানুষ নতুন বাড়ী ভিন্ন  পরিবেশ এত কিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে  একটা নতুন জীবন গুছিয়ে নেয়া একজন কিশোরীর জন্য সহজ ছিল না। নতুন সংসারে এসেও তার মন পরে থাকত তার মায়ের কাছে হাসনাবাদ গ্রামে। সংসারের কাজে কর্মে ভুল ধরার জুড়ি ছিল না বাবার  ছোটবোন আমার ফুপুর। পান থেকে চুন খসলেই হল আর রক্ষা নেই। আমার কিশোরী মায়ের তার মাকে হাসনাবাদে দেখতে যাবার আব্দার তা বার বার নাকোচ হয়ে যেত বাবার দরবারে। বহুদিন মাকে  নিয়ে যাবার  জন্যে তার বাবার পাঠানো নৌকা খালি ফিরে গেছে হাসনাবাদ। মা’কে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়নি। মা’র মান অভিমান রাগারাগি  কান্নাকাটি কোন কিছুতেই  বাবার অনুমুতি মিলেনি। বাবার এই রুঢ়তা দাম্ভিকতা  ও নির্দয় আচড়নে মা কস্ট পেতেন। ব্যাথায় বেদনায় নীল হয়ে যেতেন। তখন নতুন সংসার মনে হত এ যেন এক বন্ধী সোনার খাঁচা। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবার পর বাবার বাড়ীর পথ নাকি বন্ধ হয়ে যায় সেই সময়ের অনেক অভিজাত পরিবারের এমন সংস্কার ছিল। বাবা যে  ছিলেন সেই সময়েরই মানুষ। সে সময়ের সামাজিকতা সংষ্কৃতি  ও সংসার সমাজের নিয়মের বাইরে যাবার সাহস দেখান নি তিনি। নববধুর জন্য ভালবাসা মনের ক্যানভাসে আটকে রাখাই ছিল নিয়ম। ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল সামাজিকতার শেকলে বন্ধী। এগুলো ছিল সেকালের সমাজ এবং সময়ের প্রতিচ্ছবি। মা তার জীবনের গল্পগুলো বলেছিলেন আমাকে এক সন্ধায় টরন্টোতে বসে।

বাবা ঢাকায় জমি খুজছেন শুনে বাড়িতে তুলকালাম কান্ড। কেউ তাতে রাজি না। গ্রামে বাবার খুব ভাল বন্ধু পন্ডিত কাকা, (আমরা তাকে  সে নামেই জেনেছি) তার সাথে পরার্মশ করা হল ঢাকার আসার ব্যাপারে। আর পন্ডিত কাকাই নাকি গ্রামের একমাত্র ব্যাক্তি যে বাবাকে ঢাকায় যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। আর ওদিকে হাসনাবাদে মার চাচা পন্ডিত মোন্তাজ নানা (টরন্টোর  বানু খালার বাবা) বাবাকে খুব উৎসাহিত করেছিলেন ঢাকা যেতে। গ্রামের বেশ কিছু ভাল ভাল জমি জমা বিক্রি করে দিয়ে বাবা ঊনষাট সালে ঢাকায় এসে বসতি গড়লেন। বাবার বড় ভগ্নিপতি  তখন কোলকাতা থেকে এসে ঢাকায় বাড়ি কিনেছেন। তিনিই তার আদরের একমাত্র  শ্যালকের জন্য ঢাকায় জায়গা কেনার ব্যাবস্থা করলেন। সে কারনে তার শ্বশুর বাড়িতে তার ওপর অনেকেই অসন্তুষ্ট ছিল এবং   নানা কথা শুনতে হয়েছিল।

ঢাকায় বসতি গড়ার কয়েক বছর পরই বাবা না ফেরার দেশে চলে গেলেন। মা তার বিরাট সংসার নিয়ে একা হয়ে পরলেন। তারপর পাড়ি দিলেন জীবন যুদ্ধের এক  কঠিন সুদীর্ঘ সময় ।

মা টরন্টোতে বেড়াতে এলেন আমার কাছে ১৯৯৯ সালে। এর কয়েক বছর পর ইমিগ্রেন্ট হবার পর দেশে গেলেন বেড়াতে।

কয়েক মাস দেশে ছেলে মেয়ে ও আত্মিয় স্বজনের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আবার ফিরলেন আমাদের কাছে। মা এখানে পালা করে থাকতেন নাদিরের (ছোট ভাই) বাসায় ও আমার বাসায়। যখন যার সাথে যতদিন ভাল লাগত তার সাথে থাকতেন। মা খাবার টেবিলে একদিন বললেন তুই কাজে চলে যাবার পর তোর ফেরার জন্য শুধু আপেক্ষা করি আর শুধু দরজার দিকে তাকিয়ে থাকি কখন আসবি কাজ থেকে। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না বউ নাতি নাতনির সাথে থেকেও মা যেন একা আমার ঘরে। ছেলের ভালবাসা আদর সোহাগ তো ছেলের বউ পুরন করতে পারেনা এই সাধারন সত্য সহজ কথাটা আমার উপলব্দির তরঙ্গে মেলে দিল এক ভিন্ন সুর । ব্যাথায় ব্যাথায় মন ভরে গেল আমার। মার  দিকে শুন্য দৃষ্টি মেলে আমি শুধু  তাকিয়ে রইলাম কোন কথাই যেন আমার বলা ছিল না। আমার না বলা কথা  আমার মনের ভাষা মা বুঝতে পারলেন। দাওয়াত – নিমন্ত্রণ পার্টিতে মা আমাদের সাথে নিয়মিত যেতেন। কোথাও যাবার সময় আমি সারভিকে বলতাম দাদুর হাতটাকে শক্ত করে ধরে রাখ বাবা। রাস্তা ঘাট পারাপারের সময় বা অন্য সময় আমি মার হাতটা ধরে রাখতাম। খুব ভাল লাগত আমার। মনে হত আমি যেন ধরে আছি পুরো পৃথিবী। মনে হত আমি যেন হেটে যাচ্ছি এক আনন্দময় শহরের অলি গলি বেয়ে  পথ ঘাট  পেরিয়ে। ছোট সময় শার্লীন আমাকে জিজ্ঞেস করতো, ডেডি দাদুর হাতের স্কিন এত লুজ কেন? মা বলে দাদু যে বুড়ো হয়েছে এই কারনে। শার্লীন সে কথার কিছুই বুঝেনা। মা বলে তোমার ডেডি কিন্তু আমারো ডেডি তাকে কিন্তু আমিই পেটে ধরেছি সেটা তুমি জান ? শার্লীন বলে নো নো দাদু হি ইজ মাই ডেডি। নট ইউর’স।

এই নিয়ে দাদু নাতীর তুমুল ঝগড়া।

একদিন ইফতারির টেবিলে মা বলছিলেন তার খাওয়া হজম হচ্ছনা। আমি বললাম তুমি রোজা রাখছ বলে হয়ত সমস্যা হচ্ছে পেটে গ্যাস গ্যাস ভাব। মা কিছুদিন পর আবার বলে তার পেটে গ্যাস ভাব এবং তার বদহজম হচ্ছে। মার এই অবস্থা নিয়ে হিউস্টনে গেলাম আমরা  শাহরিয়ারের বিয়ে খেতে। মা তখন খুব একটা খেতে পারেন না তার পরও নাতির বিয়েতে গিয়ে আনন্দ  ফুরতি করলেন। টরন্টোতে এসে মাকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। ওষুধ নিয়ে এলাম কিন্তু মার রোগ ভাল হয় না। এবার কিছু ব্ল­াড টেস্ট করানো হল। তখন পেটে ছোট্ট সিস্ট ধরা পরল। ডঃ বিমল জরুরী ভিত্তিতে স্পেসালিস্টের কাছে রেফার করল। অপারেশনের জন্য স্কেজুয়াল পেতে লাগল কয়েক সপ্তাহ। এ সময়ের মধ্যে পেটের ভিতর সিস্ট বড় হতে লাগল। তখন মা আর সলিড ফুড খেতে পারে না। মার অপারেশনের আগের দিন রতন ভাই হিউস্টন থেকে এলেন। সেন্টেনারী হসপিটলে পেটে অপারেশন হল। অপারেসন সাকসেসফুল। তবে মার ক্যান্সার রিমুভ করতে গিয়ে তার খাদ্যনালি কেটে ছোট করতে হয়েছে। মা অপারেশনের পর খুব দ্রুত রিকভারি করল। কয়েক দিন পরেই বাসায় ফিরল মা। পরে মা’র খাওয়া কমে গেল খুব অল্প অল্প করে বার বার খেতে হত। ডাক্তার বলল যেহেতু মা’র বয়স হয়েছে এবং শরীর দুর্বল শক্তিহীন সে কারনে সে কিমো দিতে আগ্রহী ছিল না। মা কিমোর ধকল নিতে পারবেনা। বলল পরে মার শরীরের অবস্থা উন্নতি হলে দেখা যেতে পারে। মা‘র জন্য একজন নার্স আসে তাকে পরিচর্যা করার  জন্য সপ্তাহে তিন দিন। মাকে গোসল করিয়ে দেয় খাওয়া দাওয়া করিয়ে দেয়। বাকি দিন সেগুলো আমি করে দিই। মাকে বাথরুমে নিয়ে নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিতাম। চুল আচড়ে দিতাম। তার জন্য স্পেশাল রান্না করে দিতাম। গায়ে লোশন ক্রিম মেখে দিতাম। আমার পান্তা ও সালাদ খুব পছন্দ ছিল মার। ছোট ভাই নাদির এবং তার বউ  মনি সেবা যতœ করার কোন ত্রুটি রাখেনি। নাদির ছুটির দিন মা’কে নিয়ে বিভিন্ন যায়গায় বেড়াতে যেত । মনি মার পছন্দ  মত নানা রকম রান্না করে মা’কে খাওয়াত। আমার গিন্নী সে তার মত করে যথেষ্ঠ সেবা করেছে মাকে।

দেশ থেকে ভাই বোনদের ফোন আসে মাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবার জন্য । তারা  সবাই বলে আমরা শেষ সময় মার সেবা যতœ করে দেই। তোমরা দুই ভাই অনেক করেছ মা’কে। এবার আমাদের সুযোগ দাও ভাই। মা’রও তার অন্য ছেলে মেয়েদের দেখার জন্য মন ছুটে গেছে দেশে। আমাকে মা বলে বাবা আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা কর। আমি জীবনের বাকি দিনগুলো আমার অন্যসব ছেলে মেয়েদের সাথে কাটাতে চাই। মিলন(সেজ ভাই ) ফোন করে বললেন আমরা মাকে যদি না দেখতে পাই তুমি সারা জীবন দোষের নিচে থাকবে। বোনরা কান্নাকাটি করে বলে ভাই মা’কে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দাও। আমরা সবাই মিলে মায়ের সেবা যতœ করব। ভগ্নিপতি কামরান ভাই কান্নাকাটি করে বলল মাকে পাঠিয়ে দিতে তাদের কাছে। মেজ ভাই (রতন) তাকে হিউস্টনে ফোন করলাম। তার ও  দেশে যাবার প্ল­ান। আমি বললাম আপনি মাকে সাথে নিয়ে ঢাকায় যান। অসুস্থ মাকে রতন ভাই টরন্টো এসে ভীষন  পরম যতেœ কষ্টে দেশে নিয়ে গেলেন। এসময় মার জন্য প্লে­নে জার্নি করা ছিল বিরাট ঝুকিপুর্ন। মা দেশে যাবার সময় আমার বউকে বলে গেছেন তোমাদের দুই বউয়ের  আদর যতœ সেবায় আমি খুব পরিতৃপ্ত। খুব সুখে আনন্দে কেটেছে কতগুলো বছর এদেশে তোমাদের সাথে। আল্ল­াহ তোমাদের যেন ভাল ও সুখে রাখেন।

মা আমার এখানে টরন্টোতে যখন ছিলেন তার হাতে ছিল প্রচুর সময়। সংসারের কোন ঝামেলা পোহাতে হত না। বাজার-সদাই রান্না-বাড়া এনিয়ে কোন চিন্তা ছিল না। কাজেই প্রচুর অবসর। মাঝে মাঝে মাকে বলতাম মা তোমার হাতের রান্না খাব। মা তখন নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন। সময় কাটানোর জন্য মা’র প্রধান সংগী ছিল এখানকার বাংলা পত্রিকাগুলো। সবগুলো বাংলা পত্রিকা এক সপ্তাহের মধ্যেও কয়েক বার করে পরা হয়ে যেত। সাথে ধর্মীয় বই পত্রতো আছেই। টরন্টোর পত্রিকায় আমার লেখা থাকলে খুব মনযোগ দিয়ে পড়তেন। কিছু দিন লেখা না থাকলে বলতেন কি ব্যাপার তোর কোন লেখা নাই কেন? আমার লেখা কেমন লাগে এনিয়ে মা’র সাথে কোন দিন কথা হয়নি আমার। তবে ধারনা করতাম মা’র হয়ত আমার লেখা ভালই লাগে তাছাড়া নিজের ছেলের লেখা বলে কথা, ভালতো লাগবে। মা আমার ‘ভাই বোন’প্রবন্ধটা পরে ভীষন কেদেছিলেন। আমরা মা ছেলে কেদেছিলাম দুজনেই। আবেগ বিরহ ভালবাসা সুঃখ দুঃখ ভাই বোনদের নিয়ে বুনুনো কথার এক গল্প

ছিল ওই প্রবন্ধে। একজন প্রবাসী ভাইয়ের ভালবাসায় চিন্তা চেতনায় প্রবাস যন্ত্রনায় ভাইবোনদের সে মানসপটে কিভাবে ধারন করেছে তার গল্প নিয়ে লেখা ভাই বোন প্রবন্ধাটা। মা  কিছুদিন ঢাকায় ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলতে না পারলে ভীষন মন খারাপ করে থাকত। আমার মেয়ে শার্লীনের মত গাল ফুলিয়ে রাখত অভিমানে রাগ করে। কোন কিছু কেনে দেবার জন্য আব্দার করত ছোট্ট মেয়ের মতন। আমার মা ছিলেন ছোটখাট  গড়নের খুব সাধারন একজন রমনী। অত্যন্ত সহজ সরল শান্ত এবং মিস্টিভাষীনি ছিলেন আমার জননী।। আমার  মনে পরেনা মা কোনদিন আমাদের শারীরিক শাসন করেছেন। আমাদের দুষ্টুমীর যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে গেলেও মা আমাদের গায়ে হাত উঠাননি কোনদিন। মা’কে টিজ মাঝে মাঝে বলতাম, মা তুমি সারা জীবন থাকলে ঢাকা শহরে কিন্তু তোমার হাসনাবাদের কথার টান যায়না। ব্যাপারটা কি ? মা আমার কথা শুনে হাসে কিছু বলেননা। মা ঢাকা- হাসনাবাদ  মিশানো এক এক্সেন্টে কথা বলতেন। খুব ভাল লাগত আমার।

মা দেশে যাবার পর প্রথম দিকে শরীরটা কিছু ভাল হল তার পর আস্তে আস্তে শরীরটা খারাপ হতে লাগল। আমি যেমন আশা করেছিলাম দেশে মায়ের সেবা যতœ হবে কিন্তু আমার ভাই বোনরা সেভাবে করেনি। তাদের সবার নিজের সংসার নিয়ে সবাই ব্যস্ত। মা তখন ছেলে মেয়েদের সংসারে। বোনরা মায়ের সেবা যতœ যেভাবে যতটুকু করেছিল ভাইরা তাদের কর্তব্য ততটুকু করতে পারেনি। তাতে আমি পিড়ীত ও ব্যথিত হলেও আশ্চর্য হইনি। কারন  মার সাথে মেয়েদের সর্ম্পকের উচ্চতা থাকে  একটু ভিন্ন মাত্রায়। আর বিয়ের পর ছেলেদের সাথে থাকে অধরা মনপোড়া নিবীড়  একটা সর্ম্পক যাকে ধরতে গেলে মনে তুলে দহন। ইংরেজীতে যেমন বলে ‘সান ইজ এ সান টিল হি গেটস হিম এ ওইফ, ডটার ইজ আ ডটার  ইজ অল হার লাইফ’। ঢাকায় মাকে সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছে বড় বোন লিলি আপা। তার  নিজ  ঘর সংসারের কাজকর্ম ইত্যাদি করেও মাকে আদর যতœ সেবার বেলায় কোন  কমতি ছিল না। ঢাকা থেকে যখন ফোন পেতাম তখন বুকটা ধরফর করতে থাকত কি জানি কি খবর পাই মা’র। মিলন ভাই আমাকে যখন ফোন করে তখন বুঝি কোন ইমার্জেন্সি সংবাদ। একদিন বলেন মার শরীর ভাল যাচ্ছেনা তুই চলে আয় শিগ্রী। আমি ও ছোট ভাই নাদির টিকেট কেটে এক সপ্তাহের মধ্যে দেশে রওনা হলাম। টিকেট দুজনের একসাথে না পাওয়ায় নাদির গেল একদিন আগে ঢাকায়। ঢাকায় যেতে যেতে আমি শুধু  মনে মনে প্রার্থনা করাছি মা যেন আমাকে চিনতে পারে স্মৃতি শক্তি যেন থাকে। ঢাকায় গিয়ে দেখি মা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি মা’কে কপালে গালে মুখে হাতে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলাম। অশ্রুসিক্ত মা খুব আবেগী ভংগিতে বললেন আমার দেশের ছেলেমেয়রা ঠিক করে আমাকে আদরটাও করতে জানেনা। মা সারভিকে খুব দেখতে চেয়েছিলেন। বার বার জিজ্ঞাস করেন ওকে কেন নিয়ে আসিনি সাথে করে। টরন্টোতে দাদু নাতির কত স্মৃতি। পরদিন আমি আর রতন ভাই দুজনে আবারও ব্লাড টেস্ট করালাম, একই রির্পোট মার। ক্যান্সার লিভারে ছড়িয়ে পরেছে। তাই আর খেতে পারে না। দিন দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে । মা আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করে ‘বাবা তুমি কেনাডায় কবে ফিরে যাবা’। আমি যখন বলতাম জানুয়রীর ১৩ তারিখ। মা তখন মুখটা ফিরিয়ে নিতেন অন্য দিকে। মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত মায়ের। পরের দিকে মা যখন  যাবার কথা বারবার জিজ্ঞাস করত তখন আমি বলতাম, তুমি ভাল হলে যাব। এ কথা শুনে মার চোখে মুখে ফুটে উঠত আনন্দের ঝিলিক। মা’র নাতি শাহরিয়ার হিউস্টন থেকে নতুন বউ নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে গেল। দাদু নাতির কত গল্প। শাহরিয়ার বরিশালে বেড়াতে গিয়ে ফিরল কিনা অসুস্থ মা সে কথা ভাবীকে জিজ্ঞাসা করেন। বাড়ীতে মা’র নাতি ও নাতিনরা সবাই মার  বিছানার পাশে। প্রতি বিকেলে মিথিলা  মৌসুমী  নাফিজ দাদুর সাথে এসে গল্প করে। নিতুও আমেরিকায় বসে দাদুর প্রতিদিনের খবর নেয়। সুরভী তার মেট্রিক পরিক্ষা নিয়ে ভীষন ব্যস্ত । সেও দেখে যায় নানুকে। রতন ভাই নাদির আর আমি মার বিভিন্ন কাজে সর্বদাই ব্যস্ত। মেঝ ভাই মিলন সেও মাকে দেখাশুনা করছে, ডাক্তার পাঠাচ্ছে ওষুধপত্র কিনে আনছে। ভগ্নিপতি কামরান ভাই সেও দেখাশুনা করছেন। ছোট বোন ডলি আসে পাশের ফ্লাট থেকে, মাকে দেখাশুনা করতে। বড় ভাই ইলেকশন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সময় করে তিনিও আসছেন মাঝেমধ্যে। বড় দুই ভাবী আসেন সকাল বিকাল। রাতে কাজ শেষে শাকিল নানুকে দেখতে  আসে। তমাল তার নাটক ড্রামা রিহার্সেল নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খুব একটা সময় বের করতে পারেনা । বড় ছেলে সারভির স্কুলের একটা কাজের জন্য আমার টরন্টো ফেরা খুব জররী হয়ে পড়েছিল। আমি বহু চেষ্টার পরও আগে আসার সিট পাইনি। নাদির তার তিন সপ্তাহ ছুটি শেষ হওয়ায় টরন্টোতে ফিরে আসতে হয়। মা তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তানকে কিছুতেই বিদায় দিতেই চান না। মা বলেন – বাবা মা’কে শেষ বারের মতন বিদায় দিয়ে যাও। বাবা, মার সাথে এটাই শেষ দেখা। তখন মা ছেলে আকাশ ভাংগা কান্নায় দুলতে থাকে। মা তার ছোট ছেলেকে কিছুতেই ফিরে যেতে দেবেন না। তার ক’দিন পর একদিন মা’র শরীরে পানি আসে ফুসফুসে পানি জমে। মাকে দ্বিতীয়  বারের মতন হাসপাতালে ভর্তি করানো হল।হাসপাতালের বিছানায় মা তখন গভীর অচেতন, কারো কোন কথাতেই সাড়া দেন না। এক দুপুরে মেজ ভাই রতন মার কানের কাছে মুখ রেখে বলল, মা  দেখ মনসুর এসেছে। মা শুধু একটি বারের মতন প্রথম ও শেষ তার চোখ মেলেছিলেন। রতন ভাই চোখের জল মুছতে মুছতে আমাকে বললেন- ভাই, মা’র ইউ আর দা হার্ট লাইন। হাসপাতাল থেকে মা আর বাড়ী ফিরে গেলেন না সারা জীবনের চিরচেনা ঠিকানায়- আজিমপুরের ৯৯ নতুন পল্টনের বাড়ীতে। আজকাল কিম্বা বহুকাল থেকেই  আমাকে একটা বিষয় খুব ভাবায় সেটা হল মাতা পিতার প্রতি ছেলে মেয়েদের সর্ম্পক ভালবাসার রং ঢং ও ধরন। কারো কারো ভালবাসা হয় গভীর থেকে গভীরতর। আবার কারো কারো হয়  অগভীর অতীব্র । বড় ভাইয়ের  মা’কে ভালবাসার ধরনটা আমাকে সব সময়ই  ভাবিয়েছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, তার কেমন যেন এক ধরনের অগভীর শিথীল হালকা ভালবাসা ছিল মা’র প্রতি। এটা  হয়ত আমারই ভুল। হয়ত  এভাবে এটাই ছিল তার ভালবাসার ধরন অথবা আমার বা আমাদের চেয়ে ভিন্ন রকম। আমি তাকে প্রথম কাদতে দেখেছি মা যখন নিশ্চিত মৃতপথ যাত্রী। মা বাকরুদ্ধ আসাড় অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। বড় ভাই বিছানার পাশে বসে মা মা বলে চিৎকার করে কাঁদছেন। মা’র হাতটি ধরে কেদে কেদে বলছেন , মা একটি বারের মতন তুমি চোখ খোল। মা তুমি একটি বারের মত কথা বল। আমাদের মা নিঃচুপ নিথর কোন  কথা বলার ক্ষমতা নেই। শুধু শুনতেই পাচ্ছিলেন তার বড় সন্তানের কান্না। মা কি তখন বলতে চেয়েছিলেন তার প্রথম সন্তানকে তার মা হবার আনন্দ ঝলমলে সোনালী মুহুর্তের কোন গল্প অথবা একজন কিশোরী  মা যখন তার  সন্তানের মুখে প্রথম  মা ডাক শুনলেন সেদিনের আকাশ ভাংগা উল্ল­াসের গল্প অথবা সুদীর্ঘ সংসার জীবনের জমে থাকা  কোন না বলা কথা। মা কি বলতে চেয়েছিলেন বাবা এমন করে কান্না করতে তোকে তো আমি কখনো দেখেনি। মা’কে এমন করে ভালবাসিস- কই আগে তো কোনদিন বলিসনি। কোন দিনতো মার হাতটা ধরে বলিসনি মা তোমার শরীরটা আজ কেমন?  কোন দিনতো বলিসনি চল মা আজ সারা বিকেল চা খেতে খেতে তোমার সাথে গল্প করে কাটাব। তুমি আমাকে তোমার সেই ছেলেবেলার  গল্প শুনাবে। অনেক অনেক গল্প শুনাবে আর আমি শুধু শুনব। মা আজ চলে যাবার সময় তুই মা’কে খুলে দেখালি তোর ভালবাসার লুকানো জলতরংগ, দেখালি বাবা তোর ভালবাসার বাক্সে লুকানো সব হীরা মনি মুক্তা। হয়ত মা তখন ধীরে ধীরে পৃথিবীর সমস্ত লেনদেন মিটিয়ে অজানার পথে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অথবা মা’র  মগজের কোষে কোষে বয়ে যাচ্ছিল সুর্দীঘ জীবনের সুখ দুখের রকমারী গল্প।

আমার অভিমানী মা। আমার জানুয়ারীর ১৩ তারিখে কানাডা ফেরার অপেক্ষা না করে তার পরদিন আমাদের সবার ভালবাসা বুকে আর আচলে বেধে নিয়ে মেজ ছেলে রতন আর বড় মেয়ে লিলির হাতে হাত রেখে চলে গেলেন কোন এক অজানা  অচেনা না ফেরার এক দেশে। পৃথিবীর সব লেনদেন ভালবাসা বিরহ বেদনা সুখ  দুঃখের  হিসাব নিকাশ আর এ ধরত্রীর সমস্ত ঋন মিটিয়ে চলে গেলেন রবিবার ৪ঠা জানুয়ারী ২০০৯ সালে আমাদের মা। আকাশের তারা হয়ে চলে গেলেন দুর অজানায়  সুতোর উপারে।

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

০১ মে ২০১৬ টরন্টো