ফিরে দেখা : আত্মকথন ও একটি মনমুগ্ধকর সংগীত সন্ধ্যার গল্প
জানুয়ারী ৭, ২০১৭
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
আজকাল টরোন্টো শহরের কোন অনুষ্ঠানে বা রাস্তা -ঘাটে, মলে পুরানো পরিচিত বা বন্ধু বান্ধব কারো সাথে দেখা হলে কিছু কিছু জিজ্ঞাসার মুখে আমার প্রায়ই পরতে হয় । প্রশ্নগুলো প্রায়ই এই ধরনের, কি ব্যাপার আজকাল লেখা লেখি পাই না কেন পত্রিকায়? আপনাকেতো এখন কোন অনুষ্ঠানে দেখাই যায় না ? অথবা কি ব্যাপার আপনাদের সাহিত্য পরিষদের কোন অনুষ্ঠান বা সাহিত্য আসরের কোন সংবাদ পাই না। একবারে লাপাত্তা! কোথায় হারিয়ে গেলেন আপনি? স্মিত হেসে আমি তাদের জানাই- এখন আর অত সময় পাওয়া যায় না, তাছাড়া আর কত! অনেক তো হল আমাদের। এবার যারা শহরে নতুন তাদের পালা। এখনতো আমাদের শহরে প্রচুর কলা কুশলী, শহর ভরা কবি লেখক শিল্পী আবৃত্তিকার নাট্যকার নৃত্যশিল্পী সহ নানা গুনীজন আছেন।
কারণ যাই থাক সেগুলো কথার পিঠে কথা। মনের গহীনে জমে থাকা কোন কথা নয়। গত দশ পনের বছর আগে যখন বাংলা সাহিত্য পরিষদ টরন্টো’র সাথে যখন আমি অত্যন্ত নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলাম তখন একুশে ফেব্রুয়ারী, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, সাহিত্য আসর কবিতা জলসা এগুলো নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটত। প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে সাহিত্য আসর বসত আমাদের। কি দারুন আনন্দময় সময় ছিল। সবাই আমরা সেই আসরে নিজ নিজ নতুন নতুন লেখা প্রবন্ধ কবিতা গল্প নিয়ে হাজির হতাম।
কবিতা গল্প প্রবন্ধ নিয়ে মনমুগ্ধকর আলোচনা আর মনমাতানো গানের আবেশ নিয়ে বরফ ঝড়া শীতের রাতে অথবা গ্রীস্মের জোৎসনা ঝরা রাতে আমরা বাড়ী ফিরতাম। সে ছিল আমাদের জীবনের এক অনিন্দ্য সুন্দর এক সময়। তবে এখন কখনো কখনো সময় পেলে যাবার চেষ্টা করি শহরের কোন কোন অনুষ্ঠানে। গত কয়েক মাস আগে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকে’র প্রয়াণে আয়োজিত এক স্মরনসভায় গিয়েছিলাম বাংগালী পাড়া ডেনফোর্থে।
অনুষ্ঠান শেষে বাড়ী ফেরার পথে মিজান কমপ্লেক্সের উপরে রনি দা’র সাথে দেখা। টরন্টোর অত্যন্ত জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী রনি প্রেন্টিস রয়। যিনি এই দুর প্রবাসে থেকেও তার নিরলস সংগীত সাধনার আলো জেলে রেখে আমাদের নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রদীপ শিখা। তিনি তার সংগীত বিদ্যালয় ‘রাগরঙ’ স্কুলে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ভারতীয় উচ্চাঙ্গ বা মার্গ সংগীত । আমাদের নতুন প্রজন্মকে অত্যন্ত সযতেœ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি নাড়ী ও শিকড়ের কাছে। চিরতারুন্যে ভরপুর বন্ধুবৎসল বরেণ্য সংগীতশিল্পী রনিদা’র সাথে এই আবার দেখা হল প্রায় আট দশ বছর পর। কথা হল বেশ কিছুক্ষন তার সাথে।
তার পর আমার ,এই ফোন করি -করি করে আর রনিদা’র সাথে যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। গত সপ্তাহে ২৬শে নভেম্বর,২০১৬ শনিবার সিলেটের প্রখ্যাত শিল্পী শ্রী হিমাংশু বিশ্বাসের চিকিৎসায় সাহায্য ও সহযোগিতার জন্যে এক ফান্ড রেইজিং সংগীত সন্ধার আয়োজন করে রনি দা। অনুষ্ঠান সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হবার কথা ,আমি পৌনে সাতটায় গিয়ে পৌঁছলাম। হিন্দু মন্দিরের প্রবেশ পথে টেবিল পেতে রনিদা’র জায়া চয়নিকা দত্ত বসে আছেন। তার সাথে কুশল বিনিময়ের পর আমি আমার জন্য টিকেট একটা কেটে ভিতরে গিয়ে বসলাম। অনুষ্ঠান শুরু হবার আরো কিছুক্ষন বাকি, আমি সময় কাটানোর জন্যে বসে বসে এল জি ফোনে গার্ডিয়ান পত্রিকা পড়ছিলাম। তখন হঠাৎ পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো উজ্জল সিনহা রয়। টরন্টোর বিখ্যাত তবলা বাদক উজ্জল সিনহা রয়। আমাদের সাহিত্য পরিষদের অনেক অনুষ্ঠানে তিনি তবলায় সংগত করেছিলেন। অনেকক্ষন বুকে জড়িয়ে ধরে অতি প্রিয়জনের মতন করে বললেন মনসুর ভাই কেমন আছেন? কতদিন দেখিনা! কোথাও পাইনা আপনাকে আজকাল। কোথায় যে হারিয়ে গেলেন আপনি! সেই কবে অনুষ্ঠান করেছি আপনাদের সাথে পনের বছর আগে। খুব মনে হয় আপনাদের কথা। এর পর দেখা হল লাভলীর সাথে। গেটে দাড়িয়ে টিকেট কাটছে, আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে ভীষন আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বলল – মামা কেমন আছেন? আমাদের এই আবেগের নিবিড়তা দেখে রনিদা’র গিন্নী চয়নিকা দত্ত বার বার লাভলীকে জিজ্ঞেস করছিলেন- তোমার কি আপন মামা ? লাভলী বলছে হ্যা আমার আপন মামা। তখন তার চোখ গড়িয়ে পরছে অশ্রুজল ,বলে মামা এতদিন পর দেখা। কোথাও পাওয়া যায় না আপনাকে। কোন কারনে কি রাগ করেছেন আমার উপর? একে বারে দেখা সাক্ষাত নেই, যোগাযোগ নেই। লাভলী ও আমি ঢাকার একই পাড়ার নতুন পল্টনের। সালমা সিকদার লাভলী সংগীত শিল্পী আমাদের সাহিত্য পরিষদের সাথে যুক্ত ছিল সেই প্রথম থেকেই ৯৮-৯৯ সালে। বিভিন্ন সাহিত্য আসরে অনুষ্ঠানে গানের আসরে তার উপস্থিতি ছিল অনির্বায। সবুর ভাই তাদের ছোট্ট ছোট্ট দুই কন্যা আর জায়া লাভলীকে নিয়ে সেই ব্রামটন থেকে তিরিশ কিলোমিটার পথ ঝড় বৃষ্টি বরফ ভেংগে চলে আসতেন সাহিত্য পরিষদের অনুষ্ঠানে। লাভলীর বড় মামা আমাদের নুরু ভাই তখন ঢাকার বিখ্যাত ওয়ারী ফুটবল ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। সে কথা আমরা খুব ছোট বেলা থেকে জানি। নুরু ভাই ছিলেন আমার বড় ভাই শাহাজাদার বন্ধু। আর টুটুল তার ছোট মামা আমাদের এক ব্যাচ জুনিয়ার আমার ছোটভাই নাদিরের বন্ধু কিন্তু আমরা পাড়ার একই ক্লাবে খেলে খেলে বড় হয়েছি। আমাদের ক্লাবের খুব ভাল স্টাইলিস্ট ক্রিকেট ও ফুটবল প্লেয়ার ছিল টুটুল। সে কয়েক বছর আগে আমেরিকায় সেটেল্ড হয়েছে।
অনুষ্ঠানের বিরতির সময় পাশে এসে বসল আমার দোস্তের বউ লাকী ভাবী আমাদের পড়ার ছোটবেলার বন্ধু আজগরের জায়া। তিনিও এসেছেন ব্রেম্পটন থেকে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম কি আমার দোস্ত কই? একা একা কেন? ভাবী হেসে বলল আপনার বউ যেমন আসে না আমার জামাইও আসেনা। এনিয়ে আমরা হাসাহাসি করলাম। অনেক গল্প হল ভাবীর সাথে। এর মাঝে প্রিয় বন্ধু লেখক জসিম মল্লিক এসে বসল পাশে। জসিম মল্লিক টরন্টোর বিখ্যাত লেখক যিনি তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লিখে এবং ফেসবুকে ‘এলে বেলে’ নামে একটা লেখা লিখে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। কিছুক্ষন পর লাভলী এসে যোগ দিল। আমাদের পাড়া নিউ পল্টনের গল্প হল, গল্প হল হারিয়ে যাওয়া আমাদের ছোটবেলার দিনগুলোর কথা।
অনুষ্ঠানের গেটে বসা চয়নিকা দত্ত সহ আরেক সুন্দরী রমনী আর সংগীত শিল্পী সুমি বর্মন। সুমী বর্মন আমাকে দেখে বেশ আনন্দিত এবং চমকিত হয়ে বললেন মনসুর ভাই কেমন আছেন। খুব ভাল লাগছে দেখে। কোথাও দেখা যায় না আজকাল আপনাকে। আমাদের সাহিত্য পরিষদের আড্ডা খুব মিস করি। তার পর খালি একটা চেয়ের দেখিয়ে বলল এখানে বসেন গল্প করি। আমরা বসে অনেক গল্প করলাম। সুমি বর্মন সেই শুরু থেকেই সাহিত্য পরিষদের সাথে যুক্ত ছিলেন তার দরাজ গলায় গান আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছি অনেক দিন ।
মানুষ মানুষের জন্যে – এ কথাটা আবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন রনি প্রেন্টিস রয়। সিলেটের একজন বরেণ্য সংগীত শিল্পী তার অসুস্থ্যতা আর টরন্টোর একজন শিল্পীর মানবিক বোধ ও মনের উজ্জলতার আলো মেলে ধরে এক ফান্ড রেইজিং সংগীতের আয়োজন করা দেখে। টরোন্টোর বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী অরুনা হায়দার তার ‘সুকন্যা নৃত্যাংগন’ এর শির্ক্ষাথীদের এবং নৃত্যকলা কেন্দ্র ও আনন্দ ধারা’র নৃত্য শিল্পীদের সমন্বয়ে এক অপূর্ব দৃষ্টি নন্দন নৃত্য দিয়ে শুরু হয় সংগীত সন্ধ্যাটি। টরন্টোর জনপ্রিয় শিল্পীদের মন মাতানো গান শ্রোতাদের নিঃসন্দেহে মুগ্ধ করেছে। সংগীতে অংশ নিয়েছিলেন মুনমুন রায়, সুমন মালিক। অর্পিতা বড়ুয়া, স্নিগ্ধা চৌধুরী, সুভাষ দাস, সংগীতা মুর্খাজী, মুক্তি প্রসাদ, গুনগুন বড়ুয়া,অর্পিতা বড়ুয়া ও রিদিতা সাহা।
এই সংগীত সন্ধ্যার অন্যতম আর্কষণ যে রনি প্রেন্টস রয় সে কথা বলাই বাহুল্য। সে কারনেই আমরা দর্শক সাড়িতে বসে অধীর আগ্রহে সেই সময়টির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে রনি প্রেন্টস রয় তার সুরের ঝর্নাধারায় দর্শকদের প্লাবিত করে নিয়ে যায় অনিন্দ্য সুন্দর এক আনন্দ মোহনায়। তার দরাজ গলায় ভেসে ভেসে উঠে বাংলা আর উর্দূ গজলের সংমিশ্রনে অর্পুব মনোহরী গান একের পর এক। রনি প্রেন্টটিসের সাথে বসে অতি সুমধুর কন্ঠে রাগমিশ্রিত বাংলা গান ও উর্দু গজল পরিবেশন করে তার অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রী অভিনন্দিতা দাস। নব প্রজন্মের এই অসম্ভব প্রতিভাময়ী শিল্পী তার সুরের মুর্ছনায়
মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আবিষ্ট করে রাখে আমাদের সকলকে সেই সন্ধ্যায়। সব শেষে রনিদার ঠুমরি গানের সাথে এক অপূর্ব অনবদ্য নৃত্য পরিবেশন করেন টরন্টোর প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী অরুনা হায়দার। ইয়াদ পিয়াকে আয়ে ——–। শিল্পী তার নৃত্যের তালে তালে দর্শক হৃদয়ে হাজার বছরের প্রাচীন ঋজু ভারতীয় সংগীত ও নৃত্য শিল্পের দ্যোতনা সৃষ্টি করে তাদের অনাবিল আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যান। অরুনা হায়দারের নৃত্যটি সংগীত সন্ধ্যায় নিঃসন্দেহে এক ভিন্ন মাত্রার সংযোজন করেছে। এই অনুষ্ঠানে তবলায় সংগত করেছেন উজ্জল সিনহা রয় এবং সজীব চৌধরী। আর ঢোলে সংগত করেছেন রর্বাট বদ্য। অনুষ্ঠানটির সার্বিক উপস্থাপনায় ছিলেন টরন্টোর বিশিষ্ট আবৃতিকার মেরি রাশেদিন। তার অনবদ্য প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় অনুষ্ঠাটির মানে রূপে ঝলক এনেছিল এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এবং তার সাথে সঞ্চালনায় ছিলেন চয়ন দাস। টরন্টোতে এই মহতি আয়োজনের জন্যে প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী রনি প্রেন্টিস রয়কে আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন ও অযুত কোটি শুভেচ্ছা।
মোয়াজ্জেম খান মনসুর ৪ঠা ডিসেম্বর ,২০১৬
টরন্টো , কানাডা
(বাংলাসাহিত্যপরিষদ, টরন্টোএর প্রতিষ্ঠাতাসভাপতি)