প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৩৮

আগস্ট ৫, ২০১৭

রীনা গুলশান

এতদিন, এতটা বছর পর পবন আজই প্রথম নিজের উপর সম্পূর্ণ ভাবে দখল হারালো। সারা জীবন তারা মায়ের সাথে খুউব বন্ধুর মত মিশেছে। কিন্তু বাবার সাথে সর্বদা একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে। যদিও তার বাবা যে খুব রাগী তা নয়। তারা সব ভাই/বোন বাবাকে খুবই শ্রদ্ধা করে। বিশেষ করে পবন। পবন তার বাবাকে যেমন শ্রদ্ধা করে তেমনি ভালবাসে। প্রতিটি মানুষ (তার পরিচিত মহলের) তাকে মানা করেছিল, সব টাকা যেন বাবার নামে না পাঠায়। তবু সে পাঠিয়েছে। আজ তার জীবনের সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। পবন হঠাৎ হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললো। তারপর সেই স্বরেই বললো-

আপনার ধারণা পর্যন্ত নাই, ওখানে আমরা কি ভাবে থাকি? কি খাই? আমাদের সাথে ওখানকার মানুষেরা কি ধরণের আচরণ করে?

আপনি কখনো তা জানতে চাননি। ফোন করলেই শুধু একটার পর একটা অসুবিধার কথা বলেন। বাড়ি ঠিক করা লাগবে, অমুক জমি কেনা, বোনগো বিয়া দিলেন, অয়নের বিয়া দিয়া আমারে অর্ধেক ফতুর করলেন। দুই ভাইয়ের পড়ার খরচাও ব্যাবাগডি আমি দিছি। কিন্তু তাগের বিদেশ পাডাইলেন আমার ট্যাকায়। এমনকি আমারে জিগানোর প্রয়োজনও মনে করলেন না? আমারও তো পরিকল্পনা থাকতে পারে। পারে না? আমি কি সারা জীবন এই ভাবে বউ বাচ্চা, স্বজন ছাইড়া মরুভূমিতে পইড়া মরুম?? আমার কি জীবন নাই? স্বাদ আল্লাদ নাই?! বাচ্চা গুলানরে বড় হইতে দেখলাম না। মাইয়া বড় হইতাছে, তারে নিজে পড়াইতে পারলাম না। মমতার উপর কোন কর্তব্যই করলাম না। একটা যে কুত্তা… তার জীবনডাও আমার থেইক্কা ভালা। আপনি যে আকাশ আর বাবনরে বিদেশ পাঠাইছেন, তার জন্য আমি দুঃখ পাই নাই। আমারে একটু জিগানেরও প্রয়োজন মনে করেন নাই! পরপর দুইবার ব্যাংকের ম্যানেজারের সামনে আপনে আমার মাথাডা নিচু করলেন!! আপনে যা করোনের তা করছেন। এইবার আমি যা করোনের তাই করুম। আপনার উপর আমার যে কর্তব্য, হেইডা আমি করুম, কিন্তুক আমারে আর আপনে দেখবেন না।

এই কথা বলেই পবন ঘরে চলে গ্যালো। মমতা তখনো হাফুস নয়নে কাঁদছিলো।

পরদিন আব্দুর রহমানের পরিবার এর সাথে তারা সবাই ঢাকার পথে রওনা দিল। আসবার সময় সবাই আর্ত স্বরে কান্নাকাটি করছিলো। কিন্তু পবন মাকে ছালাম করে চলে আসলো। তার মনটা ভেঙ্গে চূরচূর হয়ে গিয়েছিলো। পবনের মনে হচ্ছিলো সে এই জীবনে আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। আসবার সময় শহীদ ভায়ের কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে আসলো। সাভারে জনতা ব্যাংকে একাউন্ট ট্রান্সফারের জন্য।

এতগুলো মানুষ, তারাই ৫ জন অচমকা একজনের বাসায় আসতে খুবই লজ্জা করছিল। তবু পরিচিত বলে আসতে পারলো। কিন্তু সালেহার বাবা/মা, এত্ত ভালো যে ৫ মিনিটের মধ্যে পবনের মনের ভেতরে সমস্তঅস্বস্থি দূর করে দিল। উল্টো এত আপন করে নিলো যে, কিছুক্ষনের মধ্যে পবনদের মনে হলো, সারাজীবন তারা এখানেই ছিল। সালেহাদের পাশের বাড়িটা তিনতলা। ঐ বাড়িরই একদিকের দুই কামরার একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া পেয়ে গ্যালো। পাশের ফ্লাটে বাড়িওয়ালা নিজেই থাকে। বুড়ো-বুড়ি। ৫ হাজার টাকা। মমতার খুবই পছন্দ হলো। পরবর্তী ৩/৪ দিন চলে গ্যালো এপার্টমেন্টটা অল্পের মধ্যে সাজিয়ে ফেলতে। রান্না ঘরের অনেক কিছু সালেহার মা-ই দিয়ে গ্যালো। এর পর সালেহার আব্বাই (নাসের সরদার) বললো, তুমি কোন চিন্তা করোনা পবন, আমার সালেহা আর মমতা দুই মেয়ের বাড়ি বানানোর দায়িত্বই আমি নিলাম।

পাশ থেকে সালেহা বললো- বাবা, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি শুধু আমাদের বুঝিয়ে দেবে। আমরা দুই বোনে সব করবো।

ব্যাংকের একাউন্ট এরই মধ্যে পবন ঠিক করে ফেললো। মমতার নামে অন্য একটা একাউন্ট করলো। যখন যেমন টাকা লাগবে নাসের আঙ্কেলের কাছ থেকে শুনে মমতার একাউন্টে ট্রান্সফার করবে। এটাও করলো আব্দুর রহমানের বুদ্ধিতে।

পবনও আর নিজের মতো কিছুই করবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। আব্দুর রহমান সত্যিই খুব বুদ্ধমান। আজ এই বয়সে এসেও পবন বলতে পারে, আব্দুর রহমান খুবই বুদ্ধিমান।

এক মাস শেষ হতে বেশী সময় লাগেনি। এবার দুবাইতে এলো পবন খুবই অস্বস্তি নিয়ে। কিছুটা দুশ্চিন্তাও ছিল সেই সাথে।

পরের মাস থেকে প্রথমে দেওয়াল এবং তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির কাজ শুরু করলো। বাড়ির ফাউন্ডেশন করা হলো ৬ তলার। টানা ৩ বছর লাগবে সবটা করতে। ডাবল ইউনিট। ওরা দেশে গ্যালো না। হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করছে। সংসার, বাচ্চা প্রতিপালন, বাড়ির কাজ দেখা শুনা। একতলাটা করলো ওয়ান ইউনিটের। একতলাতে মমতা বাচ্চাদের নিয়ে থাকবে। সামনে এক চিলতে জমি আছে। ওখানে সে ফুলের এবং সব্জির বাগান করবে।

৩ বছরের মাথায় কানাডা থেকে ইমিগ্রেশনের পেপার এলো। ঐ ব্যাপারে দৌড়া-দৌড়ি শুরু হলো। পরবর্তী ৬ মাস চলে গ্যালো সেই ব্যাপারে। তারপর যখন কানাডার কনফারমেশন লেটার এলো, তারা দুইজনেই সিদ্ধান্ত নিলো তারা বাংলাদেশ থেকে যাবে। এবং পরবর্তী তিন চার মাস তারা বাংলাদেশেই অবস্থান করবে। কারণ, কানাডা থেকে আবার কবে আসতে পারবে তারা জানে না। তাই এই প্রথমবারের মত এই সুবর্ণ সুযোগ তারা হেলায় হারানো না।

বাংলাদেশে যাবার পর তারা দুই বন্ধুতো হতভম্ভ হয়ে গ্যালো তাদের বাড়ি দেখে। ৫ তলা রেডি। ডাবল ইউনিট। ওরা যাবার পর একসাথে গৃহপ্রবেশ করলো। মমতা এবার বেশ শুকিয়ে গেছে। গায়ের রং ও বেশ পুড়ে গেছে রোদে। বাচ্চাগুলো তো পবনকে জড়িয়ে রাখলো। এই প্রথম পবন যেন সংসার করলো। প্রতিদিন বাজারে যেত। কি এক অপার আনন্দ। বাকী ৪ তলাতে ভাড়াও দিয়ে দিল।

এর মধ্যে জ্জ দিন পর হঠাৎ এক বিকালে তার ছোট মামাকে নিয়ে মা এসে হাজির। পবন তো দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মাকে খুউব মিস করছিলো। ওর মা ওকে অনেক বকাবকি করলো। বললো, তোমাগো বাপ-বেটার কাইজ্যার মধ্যে মায়েরে টানো ক্যান? আমি কি করছি? মায়েরা একই কষ্ট কইরা এক একটা বাচচারে জন্ম দেয়! আর পালপোশ করে। আর তুই তো আমার বড় পোলা!

মা… তোমার লাইগ্যা আমার বুকের মধ্যে পাড়াইতেছিল। হাছা… কিন্তু তুমি আইলা কেমতে?

হু… নিজের পেডের পোলার থেইক্যা যারে পেডে ধরিনাই… তারই পোড়ে আমার লাইগ্যা! মমতা তো আমারে মাঝেমধ্যেই ফোন দেয়। তারপর তোর আহনের খবর দিল। আমি তোর ছোটু মামারে খবর দিয়া চইল্যা আইলাম এইহানে। তোর বাপেরে কইছি, তোর নানার বাড়ি যাইতাছি। (চলবে)