প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৩৭
জুলাই ৮, ২০১৭
রীনা গুলশান
এতো ক্ষয় এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়।
তুমি জানো নাই-আমি তো জানি,
কতোটা গ্লানি এতো কথা নিয়ে, এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে
নিশ্চুপ হয়ে থাকি
বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি, এইতো জীবন,
এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত। -রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
বাসে উঠেই পবনের হৃদয়ের প্রতিটি তারে আজ বেদনার গুরুভার। কেন সে জানে না। এই যে জীবন থেকে ৮টি বছর স্বচ্ছন্দে চলে গ্যালো। এই ফুটফুটে তিনটে বাচ্চা। এদের বেড়ে ওঠা। তার মমতার দুঃখ, বেদনা, সুখ কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না। এই কি জীবন? এই জীবন কি সে চেয়েছিল??
৪টার মধ্যেই ফরিদপুর চলে এলো। সেখান থেকে আর ২ ঘন্টার পথ তার, আর একটা লোকাল বাসে করে এলো তাদের বাড়ী। সেখান থেকে অল্প দুরত্বে যার যার বাড়ীতে তারা চলে গ্যালো।
সারা পথ সে আর আব্দুর রহমান পরিকল্পনা করতে করতে এসেছে। ৫/৬ লাখ টাকার মধ্যে তারা যার যার জমিতে ১টা একতলা বাড়ী বানিয়ে ফেলবে। আর টোটাল ৫ কাঠার উপর পাচিল বানাবে, গেট দিতে (২টা) ৫০ হাজার টাকার মত লাগবে। তবে সবাই মিলে তারা ডিসিশন নিয়েছে পাচিল দিলেও, মাঝখানে আর একটা গেট থাকবে। এটা নিয়ে দুই বন্ধু খুউব মজাও করেছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন তারা আলাদা না হয়।
বাড়ী আসার পর যেন খুশীর জোয়ার নেমে এলো। মা পবনের গলা জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কাঁদলো।
এত শুকাইয়া গেছোস…এবার দেহি হাড্ডি বারায়ে গেছে। চোখ গর্তে ঢুইক্যা গেছে। বোনরা সব শশুরবাড়ী থেকে এসেছে। পরের ভাইটাকে দেখছে। ছোট দুইটাকে দেখছে না।
আকাশ আর বাবনকে দেখছি না যে? মাকে জিজ্ঞাসা করলো। ওর মা একটু অবাক হয়ে মমতার দিকে তাকালো। মমতা চোখ ঘুরিয়ে তাদের বেডরুমে চলে গেল। ছোটবোন ময়নাই অচমকা বলে উঠলো-
বড় দা, সেঝভাই আর ছোটভাই তো এক বছরের বেশী হলো মালয়েশিয়া গেছে।
তাই নাকি? আমিতো দেখি কিছুই জানি না। কি ব্যাপার?
তুই এত দুরে থাকোস, অল্প সময়ের জন্য একটু ফোন করস। তাইতে এত্তগুলান মানুষ… কত্ত কথা কমু।
মা কথাটা ঘুরিয়ে দিল।
বাবা আর নয়ন একটু পরই দুরে দুরে সরে গেল।
হঠাৎ করে পবন মুখের ভেতরে তেতো স্বাদ অনুভব করলো। এবং বুকের মধ্যে কেমন এক অজানিত ভয়ে হৃদকম্পন শুরু হলো। রাতে ভাল করে খেলও না। সকালে নাস্তা করেই আগে ব্যাংকে দৌড়ালো। পাস বুক, চেক বুক দুটোই নিয়ে। ব্যাংকের ম্যানেজার সেই আগের জন-ই, শহীদুর রহমান। সে তার একাউন্ট নম্বর দেখে বললো, ভাই কত টাকা তুলবেন?
পবন বললো, আপাতত ৬০ হাজার টাকা দেন। আর আগামী কাল ২ লাখের মত তুলবো। অবশ্য যদি কালকের মধ্যে ম্যানেজ করতে পারেন।
ম্যানেজার একটু বিষন্ন হেসে বললো, আমি আপনাকে ২০ হাজার দিতে পারি, পুরোটাই। যদিও তাতে একাউন্ট ক্লোজ হয়ে যাবে।
পবনের হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেল। মনে হলো সে বেহুস হয়ে যাচ্ছে। তবুও শেষ পর্যন্ত শক্তি সঞ্চয় করে কোন ভাবে বললো, ঠিক আছে ১৫ হাজারই দেন।
তখন ম্যানেজার নিজ থেকেই বললো, আপনি ডাইরেক্ট ব্যাংকে টাকা পাঠান না কেন? তাহলে তো এই সমস্যা হয় না।
যদিও পবন কিছুই বলেনি তবু ম্যানেজার পুরো ব্যাপারটি বুঝে গেছে। পবনের কোন কথা বলার শক্তি ছিল না। ১৫ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে সোজা আব্দুর রহমানের বাড়ী গেল ওরা তো অনেক আনন্দেই ছিল। পবন গিয়ে দুজনের সামনেই সব বললো। এই প্রথম পবন ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে গেল। কিন্তু রহমান প্রচন্ড রেগে গেল পবনের উপর। সে উল্টো চিৎকার করে পবনকে খুবই বকাবকি করে বললো, তোকে আমি অনেকবার বলেছি, সব টাকা পাঠাস না। দোষ তো তোর। তুই যখনই সব টাকা পাঠাস, তখন তোর আব্বা সব টাকা নিজের টাকা ভাবতে শুরু করে। এবং আরাম করে খরচা করে। একটি বারও তোর কথা ভাবে না।
পবন ঠিক বাচ্চাদের মত কাঁদকে থাকে। তারপর রহমানকে বলে, এখন কি করবো তাই বল।
তোর কি ইচ্ছা? রহমান উল্টো প্রশ্ন করে।
আমি এখানে আর এক দন্ড থাকবো না।
তখন রহমানের বউ সালেহাই দুই বন্ধুর মধ্যে এগিয়ে এসে, সুন্দর করে একটা সমাধান দেয়। বলে, তোমারা ঢাকায় যে জমি কিনেছো তাতে তো এখুনি বাড়ী বানাতে চাচ্ছো তাই না?
হ্যা, তো? রহমান বলে।
তাহলে মমতা আপাতত সাভারে চলুক। তারপর তোমরা টাকা পাঠাবে, আমরা দুই জন বাড়ি বানাবো। পাশেই আর একটা আপাতত দুই কামরার ঘরে দেখে মমতাকে উঠিয়ে দেব। আর আমরা নিজেরাই সব বুঝে নেব। আব্বা আমাদের সব দেখে শুনে দেবে।
ওমা! সালেহা… তুমিতো দেখি ইন্দিরা গান্ধির মত বুদ্ধিমতি! আব্দুর রহমান আনন্দে চিৎকর করে বললো।
এ কথায় সালেহা মিষ্টি করে হাসলো।
তারপর দুই বন্ধু পরামর্শ করে ঠিক করলো আগামী কালের নাইট কোচেই তারা ঢাকা যাবে। সালেহার বাবার বাড়ীতেই উঠবে।
পবন সোজা বাড়ী গিয়ে মমতাকে বললো, যা কিছু আছে সব বেঁধে ছেদে নাও।
মমতা পবনের মুখ দেখে কিছুই বললো না। যা বোঝার সে বুঝে গ্যালো। এতটা বছর এই বাড়ীতে আছে। ছোট বেলায় বিয়ে হয়েছিল। সে তাই এই বাড়ীকে নিজের বাড়ী মনে করে। তার নিজের যন্ত্রণা মনের ভেতর চেপে, সত্যি সত্যিই সব গুছানো শুরু করলো। সেই ছোট্ট বেলাতে বিয়ে হয়েছিল। এই বাড়ীর প্রতিটি ইট, কাঠ তার নিজের মনে হতো। তবু এবারে তার শশুরের বিচারে মমতা নিজেও খুবই দুঃখ পেয়েছিল। তবু স্বামীকে কিছুই জানায়নি। কিন্তু এবারে পবন জীবনে প্রথম বারের মতন মমতার উপর রেগে ফেটে পড়লো।
তুমি আমাকে জানাও নি ক্যানো… বাবা আকাশ আর বাবনকে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছে?
আমাকে মা (শাশুড়ী) মানা করেছিল।
ওহ! তাই তুমিও আমাকে বললে না? আমি তোমার স্বামী… এটা তোমার বোঝা উচিৎ ছিল। শ্বশুর শাশুড়ীই তোমার সব হলো? বেশী ভাল হতে গিয়েছিলে? একবার নিজের স্বামীর কথা, নিজের বাচ্চাদের কথা ভাবলে না? তোমদের কি মনে হয়? দুবাইতে একটা করে টাকার গাছ আছে আমার? প্রখর মরুভূমিতে সে গাছ নাড়া দেই, আর টুপটাপ কইরা টাকা পড়ে? আর তোমাদের সেই টাকা পাঠাই। আর তোমরা সবাই আরাম কইরা দুই হাত দিয়া খরচা করো। সব বেঈমানের দল? চোখের পর্দাটাও নাই। যেন আমি বানের জলে ভাইসা আইছি। পবন আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছিল। বারান্দায় বাবা, মা, ভাই, বোন আত্মীয় স্বজন সবাই ছিলো।
মমতা জানে এর একটা শব্দও ওকে বলছে না পবন। তবু সে অঝোরে কেঁদে চলছে। তারপর খুউব মৃদু স্বরে জবাব দিল…
আমার ভুল হইয়া গেছে। আপনেরে আমার কওন উচিৎ ছিল। তাগোরে আমি নিজের বাব/মাই মনে করি। ত্যানারা কিছু কইলে আমি না শুইন্যা পারি না।
খুউব ভাল করছো। এখন না খাইয়্যা তিন বাইচ্চা লইয়া রাস্তায় গিয়া বইয়া থাকবা।
এই কথার মধ্যে পবনের মা হঠাৎ ঘরে এসে বললো- ক্যান পবন, এইডা কি কস? রাস্তায় বইবে ক্যান তোর পরিবার? এই ঘর বাড়ী নাই?
পবন ভাল করে এবারে মায়ের দিকে তাকালো- তারপর বললো, তাইলে তুমিই কও মা, কি আছে আমার বিবি বাচ্চার? আজ যদি তোমরা আমার অবর্তমানে আমার পরিবারকে ঘাড়ে ধাক্কাইয়া বার কইরা দাও, ওরা কৈ যাইবো?
এইডা ক্যামুন ধারার কথা কইবার লাগছোস। এই বাড়ী ঘর এইগুলান কি তগো না? আমরা কি কবরে লইয়্যা যামু?
মা… তুমি আর কথা কইও না। তুমি আমার বউডারে পর্যন্ত মানা করছিলা ভাইরা যে মালয়েশিয়া গ্যাল হেইডা আমারে না কইতে। ক্যান তুমি এমুন করলা? তুমি তো আমার মা। তুমিও আমার সাথে এমুন করতে পারলা?
আমি কি করবো। তোর বাবায় কইলো, তরে না কইতে। আমি কি করুম? আমার হইছে সব দিকে জ্বালা।
বাবায় ক্যান মানা করলো তুমি হেইডা বুঝলা না?
হেই কইলা তুই বিদেশ একা থাকোস, তোর সব কথা জানোনের কাম কি?
হেইডা তো বাবা ঠিকই কইছে। আমি ক্যান জানুম? আমারতো টাকা বানানের কাম। আর বাবা আরাম কইরা টাকা খরচ করবো।
এবারে পবন একদম মাথা খারাপের মত বারান্দায় এসে চিৎকার করা শুরু করলো। তারপর সোজা বাবার সামনে এলো। এসে নরম করেই জিজ্ঞাসা করলো-আপনি গতবার যখন দুবাই গেলাম কি বলেছিলেন মনে আছে? আমার টাকায় আর কোনদিন হাত দিবেন না।
হ বাবা বলছিলাম। তয় হইলো কি, ঐ দুইটাও তো আমার পোলা। ওদের উপরও তো আমার কর্তব্য আছে।
আর আমার উপর নাই! গতবার যখন দুবাই গেলাম… সবাই আমরে মানা করছিল, আপনারে সব টাকা না পাঠাইতে। তবু আপনার সম্মান আর ইজ্জতের কথা ভাইবা আমি সব টাকা আপনার নামে পাঠাইছি। আমিতো সরাসরি ব্যাংকে সব টাকা পাঠাইতে পারতাম। পারতাম না? আব্দুর রহমানতো কোন দিন বাপরে টাকা পাঠায় না। মাস গেলে ৫ হাজার টাকা দেয়। সব টাকা সে ব্যাংকে জমাইতাছে। আর আমি কলুর বলদের মত খাটতাছি… আজ এতটা বছর…!! (চলবে)
রীনা গুলশান
কবি ও লেখক
টরন্টো
gulshanararina@gmail.com