প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৩৬

জুন ১০, ২০১৭

রীনা গুলশান

চলে যাবার সময় ঘনিয়ে এলো। বাড়ি ভর্তি মানুষ। প্রচুর আত্মীয় স্বজনও এসেছে, আবার চলে যাচ্ছে। সবাই বেশ দুঃখ দুঃখ মুখ করে ঘুরছে। পবনের প্রিয় সব ডিস রান্না করা হয়েছে। মমতাকে এখন রান্না করতে দিচ্ছে না তার মা, বোনেরা। বলছে –  যাও পবনের সাথে বেশী করে সময় কাটাও।

যদিও মমতা খুউব বেশী ধারে কাছে আসছে না। দূর থেকে ঘুর ঘুর করছে। তবে পরী তার কোল থেকে নামছেই না। মায়েজ তো খুব বেশী বুঝতে পারছে না, তার বাবা আগামী কালই চলে যাবে।

দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসেছে, তাদের বারান্দায় লম্বা হয়ে। অনেক দিন পর চার ভাই পাশাপাশি বসে খেতে বসেছে। পবনের কতকিছু মনে পড়ছিল। ছোটবেলায়, পাশাপাশি চার ভাই এবং বোনেরা খেত। খেতে বসেও মারামারি করতো। মা যেদিন ডিমের কোরমা রান্না করতো, তারা ডিমের সাইজ মাপতো। এটা ভাবতে যেয়ে পবন একা একা হেসে ফেললো। কারোরটা ছোট হলেই আকাশ ফাটিয়ে চেচিয়ে বলতো, মা আমার ডিম ভাইয়ের ডিমটা থেকে ছোট।

খাবার পর সব ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন আড্ডায় মেতে উঠলো। রাত ৮টার দিকে পবনের বাবা তাকে ডেকে পাঠালো তার ঘরে। পবন তার বাবার সাথে আজও ঠিক মত কথা বলে না। তার বাবা ঠিকই ব্যাপারটি দেখেছে। তার ঘরে ঢুকতেই এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলো। তার হাত দুটো ধরে কেঁেদ ফেললো। বললো, পবন বাবা আমার আসলে খুবই ভুল হয়েছে। তুই আমাকে বিশ্বাস করে এতগুলো টাকা পাঠিয়েছিস-আর আমি তা সব সংসারে খরচা করে ফেলেছি।

সংসারের কথা বলছেন কেন? আমি সংসারের জন্য প্রতি মাসে আলাদা করে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। সংসারে আমাদেরতো তেমন কিছুই কেনা লাগে না। তবু ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছি। আমার বউ বাচ্চাকে ৫ হাজার টাকা করে দিয়েছি। বাকি টাকা ৫ বছরে… কত ছিলো? নিজেই চিন্তা করেন। বন্ধকী জমি ছাড়ানোর দায়িত্ব আমার ছিল। তার বাদেও কত ছিল। আপনি আমার কথা একটুও ভাবলেন না?

হু! আমার খুউব ভুল হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে এই ভুল আর কখনোই হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কষ্ট করে টাকা পাঠিয়েছ।

পবন আর কোন জবাব দিল না। বাবাকে বলে বেরিয়ে আসলো। পরদিন সকাল ১০টায় যাত্রা করবে। এবারে ওরা তিনজন। আব্দুর রহমানের বউও যাবে ওদের সাথে।

সারারাত মমতা কেদেঁছে। পবনও কেঁদেছে। সকালে কিছুই খেতে পারলো না। মমতা ওদের তিন জনের জন্য অনেক রকম খাবার দিয়ে দিল যাতে প্রয়োজনে রাস্তায় খেতে পারে। এ ছাড়া প্রচুর নারকেলের নাড়, তিলের নাড়–, চিড়ের মোয়া স্যুটকেসে ভরে দিল। আরো দিল আমের আঁচার।

বিদায়ের সময় পরীকে জড়িয়ে ধরে পবন একদম ডুকরে কেঁদে উঠলো। আর ময়েজকে বললো যে, তার জন্য খেলনা কিনতে যাচ্ছে।

বেশ ভালভাবেই দুবাই এসে পৌঁছালো তারা। এবারে আসার পর মাস খানেক পবন প্রচন্ড মনমরা হয়ে রইল। খাওয়া, কাজে কোন কিছুতেই মন বসেনা। আব্দুর রহমানেরও তথৈবচ। এদিকে আসবার দেড়মাসের মধ্যেই খবর পেল, মমতা আবার প্রেগনেন্টে। যেমন খুশী হলো, আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্থও হলো। এবারতো মমতা একা, কি করবে। ডাক্তারের কাছে যাওয়া, বাচ্চাদের দেখাশুনা?

কিন্তু পবনের মা আস্বস্ত করলো যে, চিন্তু করো না, আমরা সব সামলাতে পারবো।

এদিকে মাসের টাকার ব্যাপারে সবাই (আব্দুর রহমান, তার মামা এবং তার অনেক বন্ধুবান্ধব) বললো ডাইরেক্ট ব্যাংকে টাকা পাঠাতে। কিন্তু পবন আসবার আগে বাবার ক্রন্দনের কথা চিন্তা করলো। ভাবলো বাবাইতো তাকে পড়িয়েছিল। ছেলে যখন এতগুলো টাকা বাবার নামে পাঠায় বাবার মনে অনেক আনন্দ এবং অহংকার হয়। সেই আনন্দ থেকে পবন বাবাকে বঞ্চিত করতে চায় না। এবার আসবার পর বেতনও বেড়েছে। বস তার কাজে খুব খুশী ছিল। এতদিন পর তাই দুবাইতে সে একটা একাউন্ট করলো। দুবাইতে চলার জন্য নিজের খরচা (৩০ হাজারের মত বাংলাদেশী টাকা) হাতে রেখে বাবার নামে ৪৫ হাজার টাকা পাঠালো। বাবাকে ফোনে বললো, মমতাকে ১০ হাজার টাকা দিতে। আর বাবাকে ১৫ হাজার করে নিতে বললো। আর বললো, তার একাউন্ডে ২০ হাজার করে জমা রাখতে।

বাবা বললো, কোন অসুবিধা নাই।

এবার পবন ভেবে রাখলো, তিন বছরের মধ্যেই দেশে যাবে। দেশে একটা দোকান দেয়ার কথা চিন্তা করে রাখলো।

৮ মাসের মাথায় হঠাৎ এক সকালে ফোন এলো বাবার। বললো, তোমার একটা খুউব সুন্দর  পোলা হইছে। আমি নাম রাখছি মফিজ।

পবন খুশিতে একদম দিশাহারা। বন্ধুদের, কলিগদের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালো। আব্দুর রহমানের বউয়েরও এক মাস পরেই একটা মেয়ে হলো। দুজনই খুউব খুশী। আব্দুর রহমান কখনো দেশে তেমন টাকা পাঠায় না। শুধু বাবাকে ১০ হাজার টাকা দেয়।

তারা দ্জুনেই এবার ঠিক করলো, তিন বছরের মাথায় দেশে যাবে।

তিন বছরের আর বেশী দেরী নাই। পবন প্রায় প্রতিদিনই একটু একটু শপিং করে আনে। এর মধ্যেই আব্দুর রহমানের সাথে কাজে যোগ দিয়েছিল (২ বছর আগে) একট ভারতীয় (দক্ষিণ চেন্নাই) কৃষ্ণ রেড্ডী। ছেলেটা খুবই এম্বিশাস। সে হঠাৎ ওদের বললো, চলো আমরা কানাডাতে ইমিগ্রেশনের জন্য এ্যাপ্লাই করি। এখানে এভাবে থাকলে জীবনে বউ, বাচ্চা আনতে পারবো না। এখানে কোন লাইফ নাই। এখানে খাটতে খাটতে বুড়া হয়ে যাবো।

একরকম জোর করে ওদের দিয়ে কাগজপত্র তৈরী করিয়ে কানাডাতে ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করলো। পবন আর আব্দুর রহমান ধরেই নিলো তাদের ঐ সব হবেনা। কিন্তু কৃষ্ণ সারাক্ষণ অধির হয়ে থাকে। কবে তাদের দরখাস্তের জবাব আসবে।

এর মধ্যে আব্দুর রহমানের শ্বশুর ওদের জানালো, সাভারে ৫ কাঠা করে জমি (নিষ্কন্টক) পাওয়া যাচ্ছে, পানির দামে। ৭ লক্ষ টাকায়। তোমরা কিনলে ভাল হয়। আব্দুর রহমান সাথে সাথেই রাজী হয়ে গেল। বললো, ফরিদপুর শহর পর্যন্ত চিন্তা করছিলাম, ঢাকায় হইয়্যা যাচ্ছে, চল দুজনে মিল্ল্যা কিইন্না ফেলি। এক যাত্রায় দুই ফল হইবো না। আড়াই কাঠা করে কিনবো।

কি মনে করে পবন রাজী হয়ে গেল। তার দুবাই একাউন্টে যা আছে তাতে হবে না। ৫০ হাজারের মত টান পড়বে। অসুবিধ নাই। দেশে একটা একাউন্টেতো টাকা আছেই। দুজনে-ই বায়নার টাকা ৫০ হাজার করে ১ লক্ষ টাকা  শ্বশুরকে পাঠিয়ে দিল। আব্দুর রহমানের শ্বশুর সাভারেই সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার। কথা হলো দেশে গেলে রেজিষ্ট্রি হবে। আব্দুর রহমানের বউ এখন বাচ্চা নিয়ে বাবার কাছেই আছে সাভারে।

দেখতে দেখতে ৩ বছর হয়ে গেল। যাবার আগে ২ মাস বাবাকে ১৫ হাজার করেই টাকা পাঠালো। কারণ সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ছাড়াও রেজিষ্ট্রির খরচাও লাগবে। আসবার তারিখ মমতাকে জানিয়ে বললো, ঢাকায় চলে আসতে। আব্দুর রহমানের বাবা

আসবে এয়ারপোর্টে, তাদের সাথেই মমতাকে আসতে বললো। বউ, বচ্চাকে এবারে

ঢাকা শহর দেখাবে। আব্দুর রহমানের মামা (যার সাথে ওরা থাকতো দুবাইতে) ঢাকায় একটা বাড়ি কিনেছিল। সিদ্ধেশ্বরীতে। দোতালা। সেখানেই তার বউ আর ৪ ছেলেমেয়ে থাকে (তিন মেয়ে এক ছেলে)। এবারে ঢাকায় তাদের ৬/৭ দিন লেগে যাবে। তাই এই ব্যবস্থা। মমতা এবং বাচ্চারা সব মামার বাড়িতেই উঠেছিল। এদিকে আব্দুর রহমানের বউ ও তার মেয়ে মামার বাড়িতে উঠলো। ওরা সবাই মামার বাড়িতে রাত ৮টার মধ্যে পৌঁছাল। আব্দুর রহমান ও পবনও ইতিমধ্যে চলে এল মামার বাড়িতে। রীতিমত উৎসব একটা। ওর মামাও একটা স্যুটকেস এক্সট্রা দিয়ে দিয়েছিল। বউ বাচ্চার জন্য প্রচুর শাড়ী, পারফিউম আর কসমেটিকস দিয়ে।

মমতা এবারে কিছুটা স্বাস্থ্যবতী হয়েছে। পবন তো বউ এর দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারে না ।

যাই হোক জমি রেজিস্ট্রি করলো দুজন। পবনের ৫০ হাজার সর্ট পরলো। আব্দুর রহমানই দিয়ে দিল। সেতো তার সব টাকাই ব্যাংকে পাঠায়। বাবাকে মাত্র ১০ হাজার টাকা দেয়। বউকেও ৫ হাজার দেয়। সে বেশ হিসাবি মানুষ। পবনকে সব সময় বকা দেয়। এত কষ্টের টাকা এইভাবে নয়/ছয় করছে…এসব বলে।

সাত দিন পর সবাই আবার একসাথে গ্রামের দিকে রওনা হলো। বাসে সারাক্ষণ পবন ছোট ছেলে মফিজকে কোলে নিয়ে বসে রইল।

জানালা দিয়ে হু হু বাতাস আসছিল। কি এক অপার শান্তি। কিন্তু পবন চুপি চুপি কাঁদছিল। এ কাঁন্না কেউ বুঝবে না। (চলবে)

রীনা গুলশান

কবি ও লেখক, টরন্টো