প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৩৫
মে ১৪, ২০১৭
রীনা গুলশান
‘আকাশে যে আজ রঙের মেলা
মনে মেঘের মেলা…
হারালো সুর, হারালো গান
ফুরালো যে বেলা…’
সবাই বাসে বসে মোটামুটি ভাবে ঝিমাচ্ছিলো। কিন্তু পবন এক মনে গান শুনছিল। তার মনের মধ্যেও খুব গভীরতর মেঘের মেলা এবং খেলা করছিল। একা একা অনেক্ষণ কেঁদেছেও। এ এমন এক বেদনা যে কাওকে তেমন করে শেয়ারও করতে পারছিল না। মমতার সামনেও নয়। কারণ, সে তার বাবাকে আপাদোমস্তক শ্রদ্ধা করে। বাবা তার জন্য সব কিছু করেছে। সেও তাই বাবার জন্য সব করতেই প্রস্তুত ছিল। করেছেও। জীবনের অসম্ভব সুন্দর ৫টি বসন্ত সে মরুভূমিতে কাটিয়ে দিলো, খেয়ে না খেয়ে। প্রতিটি পাই পয়সা হিসাব করেছ।
তার এই অসম্ভব সুন্দরী এবং অল্পবয়সী স্ত্রীকে রেখে ৫টি বছর একা একা কাটিয়ে এলো। এটা যে কতটা কষ্টের যারা নিজেরা অতিবাহিত না করে সেই জীবন তারা কখনো বুঝবে না।
আসবার (কক্সবাজার) আগে যখন সত্যিকারের ভাইয়ের মত আব্দুর রহমান হাত দিয়ে আশ্বাস দিল, যে -“গেলে সবাই এক সাথেই যামু, নইলে আমিও যামু না, প্লানটা তোরাই করলি আর তোরাই যাইবি না? এইডা একটা কথা হইল?”
তবু পবন ভেবেছিল প্লেনে করে নিয়ে যাবে, বাচ্চাদের একটু প্লেনে চড়াবে… এখন টাকার কথা ভেবে বাসেই যাওয়া স্থির হলো।
যেদিন বাবার সাথে কথা হলো টাকার বিষয়ে, বাড়িতে আর কারোর সাথেই কথা বললো না পবন। রাতে বিছানাতে শুয়ে দুঃখে, রাগে নিঃশব্দে রোদন করছিল পবন। হঠাৎ টের পেল চুলের গভীরে অনেক ভালবাসাময় একটা ঠান্ডা পরশ…।
এমুন কইরা মন খারাফ কইরেন না। যা যাওনের তাতো চইল্যাই গ্যালো গিয়া… বাকী দিন গুলো আপনি যদি এইরকম মন খারফ কইরা পইড়্যা থাকেন তাইলে আমার কেমুন লাগবে? এই ৫টা বছর ধইরা শুধু এই দিন/রাত্রির জন্য অপেক্ষায় আছিলাম।
কিন্তু মমতা… তোমারে আমি একটু শান্তি দিতে পারলাম না। একটু বেশী সুখের লাইগ্যা কোনহানে পইড়্যা আছি… কিন্তু এইডা কি সুখ? এখন তো এই বাকী দিন গুলান কেমন চলবো এইড্যা ভাইব্যা মনডা আকুলি বিকুলি করতাছে।
মমতা বিছানা থেকে উঠে বাতি জালিয়ে তার বাক্স খুললো… একটা রুমালে বান্ধা থলির মত নিয়ে এলো… তারপর পবনের পাশে বসে গিট্ঠু খুলে অনেকগুলো টাকা বের করে পবনের হাতে দিল। পবন গুনে দেখলো ২২,৭৩৬ টাকা। পবন বললো, এইডা কি করবো?
এই যে আফনার এই কয়ডা দিন চলনের লাইগ্যা।
পবনের আবারো চোখ ভরে গ্যালো মিশ্র প্রতিক্রিয়ার অশ্রুতে।
এইডা তোমার জমানো কষ্টের ট্যাকা…
না… একটুও কষ্টের না … আপনার কষ্টের ট্যাকা আমার কাছে পইড়্যা ছিল। এখন এই কয়ডা দিন এইডা দিয়া চাল্যায়া দ্যান। বাবার উপর রাগ রাইখ্যেন না। ময় মুরুব্বীদের উপর রাগ রাখতে হয় না।
পবন প্রচন্ড অবাক হয়ে মমতার দিকে তাকিয়ে রইল। এত বড় হৃদয় মমতার? সত্যি একবার একজন বড় ভাই বলেছিল – “স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ শারীরিক বা ভাললাগা প্রথম ৬ মাস তীব্র …তারপর ধীরে ধীরে সেটা গড়াতে থাকে ভালবাসায়… প্রথম ৫ বছর ভাললাগা এবং ভালবাসার মধ্যে ঘুরতে থাকে। তারপরই স্ত্রীর ব্যবহার এবং গুনাবলী সবকিছু মিলিয়ে বিবর্তিত হয় শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালবাসায়।”
পবন তার বাবার ব্যবহারে যতটা দুঃখ পেয়েছিল, তার থেকে লজ্জা পেয়েছিল বেশী, যে তার বউ মমতা কি ভাববে? কিন্তু এখন দেখে উল্টো। একেই বলে সত্যিকারের হৃদয়বান আত্মা। এত মহৎ হৃদয়ের তার বউটি। দুবাই থেকে আসবার সময় কতবার ফোনে জিজ্ঞাসা করেছে, “তোমার কি কি লাগবে বল।” প্রতিবারই মমতা মধুর হাস্যে বলেছে :- আপনে আইলেই আমার সঅব পাওয়া হইব। আপনে না থাকলে আমি ঐ সব পইর্যা কারে দেখামু?
আজ সেই সব মনে পড়লো, তারপর গভীর আবেশে মমতাকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, আমার কোন পূণ্য ছিল তোমার মত বউ পাইছি।
আপনের পূণ্য আপনি বাবা মা ভাই বোন সবাইরে লইয়্যা খাইতেছেন। নিজের লাইগ্যা বাইচ্যা নাই। তাদের আশীর্বাদে আল্লাহই দিলে আমাদের সবই হইবো আবার। চিন্তা কইরেন না।
পবন গভীর আবেশে তার অসম্ভব ভালবাসাময় স্ত্রীকে বেষ্টিত করলো ভালবাসার বন্ধনে।
ভাবনার সাগরে তলিয়ে ছিল। দেখলো সকালের প্রথম সূর্যটা একটু একটু করে আকাশের বুকে উঠে আসছে। দূর থেকে বোধহয় সাগরের নীল গর্জন। পবন মমতাকে জাগিয়ে দিল এই অপরূপ দৃশ্য দেখবার জন্য। মমতা দেখে তো একদম পাগল হয়ে আনন্দে বললো, ওমা… আমরা আইয়া পড়ছি কক্সবাজারে?
তারপর মমতাই সবাইকে ডেকে তুললো এবং বললো, সকালের প্রথম সূর্য কে দেখবার জন্য। মমতা প্রচন্ড উদ্বেলিত সাগরের কাছে পৌঁছানোর জন্য। জীবনের প্রথমবার সাগর দেখা। এটা প্রত্যেক মানুষের জীবনেই একবার হয়ে থাকে।
ওরা সবাই খুব সস্তা দরের একটা হোটেলে উঠলো। ২ রুম নিলো। তারপর সবাই মিলে ছুটলো সাগরের কাছে। আহা সাগর। ওদের প্রত্যেকেরই প্রথম সাগর দেখা এই ভাবে। এত আনন্দ। পবন যেন মুহূর্তে সব কিছু ভুলে গেল জীবনের সব না পাওয়ার বেদনা। পাঁচটি বছরের সব দুঃখ, বেদনা সব যেন ধুয়ে মুছে গ্যালো সাগরের এক একটি ঢেউয়ে। সাগারের কি অপার মহিমা। দেখলো ছেলে মেয়েরা পানিতে পা ডুবিয়ে ছুটোছুটি করছে, আর মমতা পরম আনন্দে নিজেও বাচ্চাদের মতন বাচ্চাদের পিছু পিছু ছুটছে। আব্দুর রহমানও তার নতুন বউ এর হাত ধরাধরি করে পানিতে হাটছে।
কক্সবাজারে তিনদিন ছিল। তারপর ওখান থেকে ওরা রাঙ্গামাটি গ্যালো। এত সুন্দর রাঙ্গামাটি। পবন মনে মনে ভাবলো… সৃষ্টিকর্তার কি অপরূপ সৃষ্টি…। রাঙ্গামাটিতে তারা অনেক ঘুরলো। ওখানকার স্থানীয়রা তাঁতের কাপড় বানায়। সেখানেও তারা ঘুরতে গ্যালো। মমতাকে খুউব সুন্দর সাদা লালের ট্রাইপ দেওয়া একটা চাদর কিনে দিল। যদিও মমতা না না করছিল। তবু দিল।
তারপর তার চট্রগ্রামে ১ দিন ঘুরলো। নাইট বাসের টিকিট কাটাই ছিল। দিনে দিনে ঘুরে নিল। হোটেলে উঠলো না। তাদের সবারই ইচ্ছা ছিল বায়েজিদ বোস্তামি’র মাজারে যাবার। খুব প্রশান্তি হলো মনে।
ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাস স্ট্যান্ডে চলে গ্যালো। রাত নয়টাতে বাস ছাড়বে। শেষবারের মত দু’চোখ ভরে চট্রগ্রাম দেখে নিল। বন্ধুকে সাথে নিয়ে একটু দুরে থেকে সবার জন্য রাতের খাবার নিয়ে এলো। পানি অবশ্য বাস থেকে দিবে। তবু দুই বোতল পানি নিয়ে নিল। পথে অবশ্য কুমিল্লা বাস টার্মিনালে থামবে। সেখান থেকে বাড়ির সবার জন্য রস মালাই কিনবে। বাড়ীর কথা মনে হতেই আবার পবনের চেয়াল ও মন শক্ত হয়ে গ্যালো।
বাস ছেড়েছে অনেক্ষণ। রাতের খাবার খেয়েছে সবাই বেশ মজা করে। পাতলা হাতে
বানানো রুটি আর শিক কাবাব সালাদ। বাচ্চারা অনেক্ষণ হলো ঘুমিয়ে পড়েছে। মমতার সথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলো। তারপর সেও ওর কাঁধে মাথা রেখে নিদ্রা দেবীর কাছে নিজেকে সমর্পন করলো।
শুধু পবন দু’চোখ মেলে বেশ খরখরে চোখে বাইরের পরিবর্তিত দৃশ্যের দিকে চেয়ে রইল। আর কয়েকটি দিন মাত্র। আবার এই সব ভালবাসার ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেই মরুভূমির বুকে। দুবাই অনেক সুন্দর শহর। হয়ত ট্যুরিস্টদের জন্য। তাদের জন্য নয়। তাদের মত খেটে খাওয়া মজদুর দের জন্য নয়। আজও তারা ঐ আব্দুর রহমানের মামার সাথেই থাকে। তবে এক রুমে নয়। তারা দুই রুমের একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে (খুউব ভাল ব্যবস্থা নয় এপার্টমেন্টের)। ভাড়া শেয়ার করে, খাওয়া… রান্না… সবই শেয়ার করে থাকে। কারণ তাদের সবারই একটিই চাওয়া টাকা সেভ করা। দেশে টাকা পাঠানো। ভবিষ্যত বেশ কিছুটা নির্ভার করা। এইটুকুইতো চাওয়া… এত কষ্টের বিনিময়ে…। (চলবে)
রীনা গুলশান
কবি ও লেখক, টরন্টো