প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৩৪

এপ্রিল ১৫, ২০১৭

রীনা গুলশান

মানুষ যখন তার স্মৃতিচরণের খেলায় মত্ত হয়… তখন তার মুখাবয়বে এক ধরণের রঙের খেলা চলতে থাকে। কখনো লাল হয়, কখনো গোলাপী কখনো বা নীল বর্ণ… আবার কখনো মুখে এক জ্যোতির ছায়া ঘুরে। পবন মোল্লার মুখে এখন সেই জ্যোতির ছায়া। প্রথম সন্তান। তাও বেশ অল্প বয়সে। পরির মত এক কন্যা তাদের ভালবাসার ঘরে এলো চাঁদের হাট বানাতে। একি কখনো ভুলবার?? এরপর তার আরো তিনটা বাচ্চা এসেছে… কিন্তু সেই ব্যাকুলতা আর অধিরতা আসেনি। ভালবাসা প্রতিবারই সবভাবেই এসেছে…তবুও প্রথম বাবা মা হওয়া সত্যিই বড়ই রোমাঞ্চকর!!

চাচা তার কাহিনীর খুবই আনন্দিত সময়ে লিপ্ত ছিলো। আমি যে তার পাশেই উৎকীর্ণ তার কোনই খেয়াল নাই।

মা-রে, পরী এলো ঘরে যেন চাঁদের হাট ভেঙ্গে এলো। মমতা অবশ্য ছেলেই চেয়েছিল। আমার সেই সব কোন অনুভূতিই ছিল না। শুধু বাবা হবার আনন্দেই অধির ছিলাম। সারাদিন পরীকে নিয়ে মত্ত থাকি। রাতে পরী কাঁদবার আগেই যেন আমি জেগে যাই। আব্বাজন পরির ধূমধাম করে আকিকা করলো। সবাই খুব আনন্দে মশগুল ছিলো।

তবু আমার ক্রমাগত মনে হচ্ছিল যা আমার উপার্যন সেটা মোটেই যথেষ্ট নয়। আমি অফিস থেকে আসবার সময় প্রায় রোজই একটা করে দৈনিক পত্রিকা কিনে আনি, যদি নতুন কোন জবের সন্ধান পাই। এপ্লিকেশন করেই যাই। জবাব আসে না। কি যে করবো ভেবে পাই না।

এদিকে মেঝো ভাইটা লেখাপড়ায় মোটেও ভাল ছিল না। এসএসসি’তে দুই বার ফেল করলো। তিন বারের বার কোন রকমে পাশ করলো। বাবা তাকে তার সাথে ক্ষেতি খামারে লাগিয়ে দিল। সেও খুব খুশী হলো। তিন আর চার নম্বর ভাইরা ভালভাবেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিল, আর সবার ছোট বোনটা। সংসারে তখন আর্থিক বেশ চাপ আসছিল।

এর মধ্যে আমার একদম ছোটবেলার বন্ধু আব্দুর রহমানের মামা দুবাই থেকে আসলো। সেই তার ভাগ্নেকে বললো আমি তোদের দুবাইতে নেবার ব্যবস্থা করবো। ওর মামার দুবাইতে গ্রোসারী আছে। অবস্থা বেশ ভাল। পবনও কথা বললো। মামা বললো পাসপোর্ট এবং টাকা রেডি রাখতে। ৪/৫ লাখ টাকা লাগবে। এর মধ্যে আবার জানা গেল, মমতার আবারো বাচ্চা হবে। খুবই বিড়ম্বিত সময় ছিল ঐ সময়টা পবনের জন্য। তবু কথা বার্তা চালাচালি করতে করতেই ১৩/১৪ মাস লেগে গেল। তারপর টাকার যোগার। এত টাকা ক্যাশ যোগাড়… তাদের মত নিন্ম মধ্যবিত্তদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। তবু পবনের বাবা ভাবলো একটা ছেলে উঠে গেলে গোটা সংসারটা উঠে যাবে। সে তাই তার বেশ বড়সড় ২ টা খুউব ভালো ফসলের জমি বন্ধক দিল গ্রামের সম্পন্ন সুদখোর সোহরাব মিয়ার কাছে। ৫ লাখই দিল। এর মধ্যে মমতার এক পুত্র সন্তান হলো। সবাই খুব খুশী হলো। পবনের বাবা নাম রাখলো ময়েজ উদ্দিন মোল্ল্যা। সবাই খুশি হলো। শুধু মমতা সারাক্ষণ মুখ ভার করে রইলো। পবনের নিজেরও মনটা খুব ভার ছিল। তার সুখের ঘরে যেন সুখ উপচে উপচে পড়ছিল। তাদের দুজনের ভালবাসা দিনে দিনে যেন বেড়েই যাচ্ছিল। শুধু কিছুটা অর্থ কষ্ট চাঁদের মধ্যে কালো দাগের মত। মমতা অবশ্য বারবার তাকে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল…আমার অত ট্যাকা লাগবো না। আপনারে কোন হানে যাওন লাগবো না। খুউব কষ্ট এইভাবে সবাইকে ছেড়ে আসা, সব কিছু ছেড়ে আসা।

তবু যেতে হয়। মানুষকে তবু চলে আসতে হয়। দুবাইতে আসবার পর মামার বাসাতেই উঠলো প্রথম। পরে দুই জনে মিলে একটি বাসা ভাড়া নেয়। ওর মামা ওদের দুই জনের জন্য একটা কারখানাতে কথাও বলে রেখেছিল। খুউব ভাল কাজ। বেতনও ভাল। নিজের জন্য কিছু টাকা রেখে বাকী সব টাকা বাবার নামে পাঠিয়ে দিত। ৩/৪মাস পরে অবশ্য বাবাকে বলেছিল মমতার হাতে ৫ হাজার করে টাকা দিতে। ভাল টাকা পাঠাচ্ছিল। বাবা সংসারের পিছনে টাকা খরচ করেও ২ বছরের মধ্যেই ধারের সব টাকা শোধ দিয়ে দিল। অন্য দুই ভাইকে শহরে রেখে পড়ালো। একজনকে ওয়েল্ডিং অন্যজনকে অটোমোবাইলে পড়ালো। আসবার সময় পবন তাদের গ্রামের জনতা ব্যাংকে একটা একাউন্ট করে এসেছিল। ধার শোধ হবার পর বাবাকে বললো-১০ হাজার সংসারে নিতে, ৫ হাজার মমতাকে দিতে আর বাকী টাকা তার ব্যাংক একাউন্টে জমা রাখতে। বাবা প্রতিমাসেই এটা সেটা বলে আরো টাকা নিচ্ছিল। মাসে সে প্রায় ৪০ হাজারের মত টাকা পাঠাচ্ছিল। হিসাব অনুযায়ী তার মাসে সব খরচা বাদেও ১৫-২০ হাজার টাকা জমা হবার কথা। এর মধ্যে ৫ বছর চলে গ্যালো। ৫ বছর পরে তারা দুই প্রাণের বন্ধু দেশে গ্যালো। এই ৫ বছরে সে সব থেকে বেশী মিস করেছে তার পরীর জন্য। সে এখন কত কথা বলে। ময়েজেরও ৫ বছর হয়ে গেছে। ইস্  এসব কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। তার বিদেশ থাকার কোন ইচ্ছাই কখনো ছিল না। তার ইচ্ছা ছিল ফরিদপুর শহরে একটা বাড়ি কেনা আর নিজের প্রফেশন বাদে একটা বড় কোন ব্যবসা শুরু করবার, যাতে করে বউ বাচ্চা নিয়ে তার খেয়ে পরে চলে যায়। মাত্রা এক মাসের ছুটি নিয়ে গিয়েছিল। মমতা আরো সুন্দর হয়েছে। বাড়িতে আরো একটি বউ এসেছে। মেঝ ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছে। পরি এখন যেন ডানা মেলে দিয়েছে। ৭ বছরের মত বয়স। ময়েজও ৫ বছরের। ময়েজও দেখতে প্রায় পরির মতনই। যাবার সময় পরির জন্য একটা চেইন, আল্লাহু লেখা লকেট, আর মমতা ও নতুন বউ লতিফার জন্য প্রায় একই ডিজাইনের দুইটা হার নিয়ে গিয়েছিল। আগে থেকে প্লান করা ছিল, বউকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যাবে আব্দুর রহমানের বিয়ের পর। ওর বউয়ের জন্য সুন্দর একটা বড় দেখে আংটি এনেছিল। ৭ দিনের মধ্যে বিয়ে হয়েত গেল। তার তখন কক্সবাজারে যাবে বলে পবন ব্যাংকে গ্যালো টাকা তুলতে। টাকা তুলতে গিয়ে তার প্রায় ভিমরি খাবার দশা। যেয়ে দ্যাখে তার একাউন্টে ৬ হাজার টাকা পড়ে রয়েছে। যেই টাকা দিয়ে একাউন্ট খুলেছিল। সেতো একটি চেক বইতে ২০ হাজার টাকা লিখে নিয়ে গিয়েছিল। এদিকে মমতা আর ছেলে মেয়েরা গ্রামের অর্ধেক মানুষকে বলেও ফেলেছে। ওতো মাথায় হাত দিয়ে ব্যাংকেই বসে থাকলো, অনেক্ষণ। মাথায় কোন কাজ করছিল না। তার যাবে বলে, আব্দুর রহমানও বলে রেখেছিল… তাদের সাথে তার নয়া বউ নিয়ে হানিমুনে যাবে।

ব্যাংক থেকে সোজা বাড়ি এবং বাবার সামনে…।

বাবা ব্যাংকে তো কোন টাকাই নাই।

বাবা কোন কথার জবাব দেয় না। মুখটা কেমন কাচুমাচু করে বলে থাকলো। মা-ও পাশে বসে থাকলো। আর বারান্দায় তার মেঝ ভাইটি উৎকীর্ণ ভাবে হাটাহাটি করছিল। অনেক্ষণ পর বললো…অয়নের বিয়েতে অনেক টাকা খরচা হয়ে গেল। হাত তো খালি ছিল, তাই তোর টাকায় হাত দিতে হলো। পুরা গ্রামের মানুষ খাওয়াইছি। তোর বিয়েতে তো এত কিছু করতে পারি নাই… তাই এবারে করলাম।

ওহ… আচ্ছা… তাই বলে আপনি আমার কথাডা একবার ভাবলেন না? খাইয়া না খাইয়া আমি আপনাগোরে টেকা পাঠাই।

আমি তোমার বউ বাচ্চারে দেইখ্যা রাখছি না? অগোরে ব্যাবগডিনের থিইক্যা ভালো রাখছি।

আব্বা, আমিতো অগো হাত খরচের আর পড়াশুনার লাইগ্যা ৫ হাজার আলাদা কইরা দেই।

আচ্ছা বাবা… এর পর থিইক্যা মনে থাকবো, তোমার টেকায় আর হাত দিমু না।

পবন কোন কথা না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সোজা বন্ধুর বাসায়। বন্ধুকে সব বললো। বন্ধু সব শুনে তো পাথর হয়ে গেল। পবন তো হাউ মাউ করে কেন্দে দিল। আব্দুর রহমান শুধু বললো…

কস কি? আমিতো ভাবতেই পারতাছি না… চাচাজানে এইডা করতে পারে?

আমি এখন মমতারে মুখ কেমনে দেখামু? হেইডা ক-দিহি??

চিন্তা করিস না দোস্ত… আমরা একসাথেই যামু। ভাবীরে কিচ্ছু কইস না। টেকা আমি দিমুনে।

না না তোর এমনিতেই কত খরচা হইল।

হেইডা ঠিক কথা… কিন্তু বিপদতো মাইনসের জীবনেই আহে তাই না? পরে আমারে আস্তে আস্তে শোধ দিয়া দিস।

পবন কথা বলে না। বন্ধুর দিকে সকৃতজ্ঞ  নয়নে চেয়ে থাকে। (চলবে)

রীনা গুলশান

কবি ও লেখক, টরন্টো