প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৩৩

মার্চ ১১, ২০১৭

রীনা গুলশান

ইটন সেন্টারের ফুড কোর্টটি যারা দেখেছেন (নিউলি ভারশন) তারা জানেন এটা কত বড়! বলা হয় এটা নর্থ আমেরিকার সব থেকে বৃহৎ ফুড কোর্ট। সত্যি মিথ্যা আমি জানিনা। তবে এটা ঠিক, এমন কোন দেশী খাবার নাই, যা এখানে পাবেন না। আবার লেভেল ওয়ানে কুইন সাইডে ‘রিচ-ট্রি’ (মার্শে) ও আছে। এটাতো একাই একশো। অর্থাৎ একই রেস্টুরেন্টে ১৪ দেশের খাবার পাবেন। তবে বেসিক্যালী এটা ফরাসী রেস্তোরাঁ।

যাই হোক ফুডকোর্টে যখন লাঞ্চ করতে যাই আমি তখন নিচের চেয়ার টেবিলে বসিনা। আমি সর্বদা উপরের প্লাটফর্মের উপর খাবার রেখে উঁচু চেয়ারে বসি। জানিনা কেন। আমার খুব মজা লাগে। এখানে বসলে মোটামুটি গোটা ফুডকোর্টটা দেখা যায়। যদিও প্রাইভেসি কম থাকে। তবুও আমার মানুষ দেখতে খুউব ভাল লাগে। আমার রোজকার একই খাদ্য লাঞ্চে। ‘স্মুথি’। ওটাই একটু একটু করে খাচ্ছি আর লুবনার ফোনের অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখি পাশের টেবিলে বেশ বয়স্ক এক ব্যক্তি খাবারের ট্রে নিয়ে বসলেন। বেশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম লোকটাকে। ৬০/৭০ এর মধ্যে বয়স। খাবার এনেছেন এক প্লেট ভর্তি করে ‘ডিম সাম’। অন্য প্লেটে দেখলাম ফ্রাইড রাইস এবং ব্ল্যাক চিকেন। আমার খুবই মজা লাগলো মানুষটাকে দেখে আর তার খাবারের আয়োজন দেখে, কোন সামঞ্জস্য ছিল না। কারণ, লোকটাকে দেখেই মনে হলো আমাদের সাউথ এশিয়ান।  বেশ পরহেজগার টাইপ চেহারা। মুখ ভর্তি দাড়ি। তাতে আবার সুন্দর করে হেনা লাগানো। বেশ লাল দাড়িগুলো।

লোকটা বেশ আরাম করে চপচপ করে খাচ্ছিল। স্বভাবতই আশে পাশের লোকেরা বেশ ডিস্টার্ব হচ্ছিল। কিছুক্ষণ খাবার পর হঠাৎ লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো Ñ ইউ…বাংলাদেশ?

আমার খুবই হাসি পাচ্ছিল। ঠিক ইংরেজী শুনে নয়, এরকম ইংরেজীর সাথে আমি অনেক বেশী পরিচিত। আমার কর্মস্থলে ৩/৪ জন সহকর্মী এভাবেই কথা বলেন। তার মধ্যে একজন আছে ওর নাম কিমি ইয়ং (ভিয়েতনামি)। ৩৭ বছর আগে কানাডা এসেছেন। আজও এভাবেই কথা বলেন। মানুষ বুঝে ফেলে ওর কথা। এই মানুষটাতো খুব স্পষ্ট করে উচ্চারণ করলেন। আমিও আর ইংরেজীকে সম্মান প্রদর্শন না করে সরাসরি বাংলাতেই বললাম Ñ জি আমি বাংলাদেশী।

হ, সেইডা আমি আপনার মুখ দেইখ্যাই বুজছি।

আপনার বাড়ি কোন জায়গায়?

শরীয়তপুর। নানার বাড়ি ভোলা।

খুউব ভাল লাগলো। সরাসরি নিজের জেলার নাম বললেন। এতটা বছর এই দেশে এসেছি… আজ পর্যন্ত খুুউব কম বাংলাদেশী পেয়েছি যারা সরাসরি নিজের জেলার নাম বলেছেন। চোখ বন্ধ করে বলবেন ঢাকা। এবং গুলশান, ধানমন্ডি, উত্তরা ইত্যাদি পস এরিয়ার নাম বলবেন। কাউকে কাউকেতো দেখলেই বোঝা যায় ঐ জায়গাগুলোর নাম হয়তো বা লোকোমুখে শুনেছেন অথবা পত্রিকায় পড়েছেন। তবু বলবেন। কি জানি মিথ্যা বলে মানুষ কি স্বর্গীয় আনন্দ প্রাপ্ত হয়?

এই মানুষটাকে খুউব ভাল লাগলো। তার গ্রামের নামও বললেন। আমি একটু পরই ভুলে গেলাম। নিজের নামটাও বললেন। পবন মোল্ল্যা। বাহ্ সুন্দর নাম। তারপর নিজেই তার খাবারের মেনু দেখিয়ে বললেন : এইডা দেখলে আমার পুলি পিডার কথা মনে পড়ে। তাই যখুনি এই দিকে আসি এইডা খাইয়্যা যাই।

আমি আশেপাশের পরিবেশ ভুলে খিলখিল করে হেসে উঠলাম। এতক্ষণে বোঝা গ্যালো চাচামিঞা কেন ডিমসাম খাচ্ছেন। কিন্তু ব্ল্যাক চিকেন? ওটাতো একদম বিশ্রি খেতে। এরা এমন ভাবে সয়াসস দেয় যে বিশ্রি লাগে। যদিও আমি অন্যের মুখে শুনেছি। আমি ‘স্যাচুয়িন’ এ সাধারণত খাই না… যে সব হোটেলে পর্ক বিক্রি করে আমি সাধারণত সেখানে খাই না। একদম নিদানে না পড়লে।

মা তুমি কি খাও?

স্মুথি…

এইডা একটা খাওনের জিনিষ হইলো? দুপুর বেলায় প্যাট টা ভইরা খাওন দরকার।

ঠিকই বলেছেন। আমি অবশ্য বহু বছর ধরে এটাই খাই দুপুরে। আর বাড়িতে গিয়ে পেট ভরে ভাত খাই। এখানে আমার ভাত খেতে ভালো লাগে না। আমার ভাত হাত দিয়ে খেতে ভাল লাগে।

এইডা তুমি একটা কথার মত কথা কইছো। এই যে চামুচ দিয়া খাইতাছি কোন মাজাই পাইতাছি না।

এবারে আমিই প্রসঙ্গান্তরে গেলাম।

চাচা, কানাডায় এসেছেন কতদিন হলো?

সরাসরি উত্তর দিলেন না তিনি। তার বদলে বিশাল আকারের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর প্রচন্ড ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত কণ্ঠে বললেন, সে এক লম্বা কাহিনী।

আমি বুঝে পেলাম না কানাডায় কতদিন এই প্রশ্নের সাথে কি সম্পর্ক। তবে আমি বেশ উদগ্রীব হয়ে রইলাম। কাহিনী টা কি? শান্তভাবে অপেক্ষা করতে লাগলাম। জানি নিজের থেকেই বলতে শুরু করবেন। কোন কোন সময় এমন হয়।

মানুষের যখন হৃদয় মস্তিস্ক ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যায় তখন সে উদগীরণ করতে চায়। তাই এসব ক্ষেত্রে অপেক্ষা কার্যকর হয়।

মা তোমার নাম কি? … আমি নাম বল্লাম… নাম ধরেই বললেন…

আমি প্রায় ১৩ বছর আগে এই দেশে আইছিলাম।

বলেন কি! ১৩ বছর…। আপনার পরিবার এখানে কোথায় থাকে?

এখানে থাকে না… তারা সব দেশেই থাকে।

বলেন কি? আপনার কি কাগজ পত্র নাই?

কাগজ পত্র আছে… আমি আসলে কাগজ পত্র লইয়াই আইছিলাম। আমি হইলাম গিয়া একজন প্রফেশনাল ইলেকট্রিশিয়ান। কানাডাতে আইছি আমি দুবাই থেইক্যা। দুবাইতে আমি ১১ বছর আছিলাম। আমার এক বন্ধু এইহানে আইতে চাইলো… তো আমরা দুইজনে ইপ্লিকেশন (এপ্লিকেশন) করছিলাম। দুইজনেরই হইয়া গেল। আমরা দুইজন আজও একত্রেই থাকি ভিক্টোরিয়ার দিকে… একটা বেজমেন্টে ভাড়া লইয়া থাকি। তবে আব্দুর রহমান হইলো গিয়া অটো-মোবাইলের কাম করে।

চাচা আপনি কোথায় কাজ করেন?

মা Ñ আমি এই ডাউন টাউনেরই এক হাসপাতালে কাম করি… ঐ হানে পারমানেন্ট কাম করি।

হাসপাতালে?

চাচা হো হো করে হাসলেন খানিকটা। তারপর হাসতে হাসতেই বললেন…

মা, হাসপাতালে কি শুধু ডাক্তার আর নার্সরাই কাম করে? আমরা ওগোর থিইক্যা কম কাম করি না… বুঝলা?

হু… আসলেই জানতাম না। জানার কি শেষ আছে? মৃত্যুর আগের দিনও জানার মধ্য দিয়েই জীবন শেষ হয়। চিন্তা করলেইতো বোঝা যাবে এদের কাজতো আসলেই অনেক বেশী। একটা

হাসপাতালে কত মানুষ-ই তো লাগে। এরপর কিছুটা দ্বিধা এবং ভব্যতার বাইরে যাবে কিনা চিন্তা করতে করতে অবশেষে বলেই ফেলাম…

চাচা, পরিবারকে কানাডাতে আনেন নাই কেন? একা একা জীবনটা কাটিয়ে দিলেন… খুবই কষ্টকর এই জীবন।

চাচা আবারও বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর অনেক্ষণ পর একটু একটু করে অনেক কথা বলে গেলেন।

আমরা ৪ ভাই ৩ বোন। বাবা নিজেদের জমি চাষ করেই আমাদের চালাইতো। গ্রাম থিইক্যা অনেক দূর আইস্যা আমরা ভাই বোনেরা পড়া লিইখ্যা করছি। সবার বড় দুই বইন। এগোরে বিয়া দিতেই আব্বার অর্ধেক জমিন চইল্লা গ্যালো… বিয়ার যৌতুক দিতে। তারপরও আব্বা আমারে ফরিদপুর শহরে রাইখ্যা ইলেকট্রিশিয়ানে পড়াইল। ২ বছর। তখন মাত্র কুড়ি বছর বয়োস আমার। আব্বার ছোড বেলার বন্ধুর মাইয়া খুউব সুন্দর দেখতে… (তারা নাকি ছোড বেলার থিইক্যাই কথা বইল্যা রাখছিল, এর ছেলে, ওর মাইয়া) মমতা ওর নাম। হঠাৎ কইরাই আমার বিয়া দিয়া দিল। মমতারও তখন ১৫ বছর বয়েস। বেশ আনন্দেই দিনকাল কাটছিল। তারপর আমি এদিক ওদিক চাকরী খুঁজি। পাইনা। ৩/৪ মাইল দূরে একটা চাকরী পাইলাম। খুব অল্প বেতন। তবু ভাল লাগছিল। বউরে টুক টাক উপহার আইন্যা দেই। বাকী টেকা আব্বার হাতে তুইল্যা দেই।

এর মইধ্যে মমতার ১৭ বছর বয়সেই একটা কইন্যা সন্তান হইলো। ওর মায়ের মত খুউবই সুন্দরী। আব্বাজান নাম রাখলো পরি। সত্যই পরির মত দেখতে। (চলবে)

রীনা গুলশান

কবি ও লেখক

টরন্টো