প্রবাসে পরহিতকর্ম -৩১

জানুয়ারী ৭, ২০১৭

রীনা গুলশান ॥

“হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি – দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”

– জীবনানন্দ দাশ।

কবিতা পড়া আমার অনেকটা নেশার মতো। অথচ, ইদানিং অনেক অনেক গুলো দিন কবিতা কেনো, জরুরী কিছুই পড়তে পারছিলাম না। এমনকি গত ৬ সপ্তাহ লিখতেও পারছিলাম না। কারণ, মাথা নিচু করা নিষেধ ছিলো। চোখের প্রগাঢ় সমস্যায় ভুগছিলাম। কিন্তু আমার কঠিন সমস্যা হলো, যতক্ষণ না মারাত্মক বা গুরুতর কিছু ঘটে ততক্ষণ পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে যাবার ব্যাপারে অনীহা।

তাই চোখে দেখতে পারছিলাম না। বাম চোখে বেশ ভাল সমস্যা। চোখের সামনে কালো কালো ছোট ছোট বলের মত নৃত্য দেখি। চশমা খুললে বাম চোখে প্রায় দেখিই না বললে চলে। তারপর একদিন বড় ছেলে প্রায় তিন বছর আগে জোর করে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গ্যালো। ডাক্তার অনেক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে অবশেষে বিজ্ঞের মত রায় দিলেন, “তোমার চোখে ক্যাটারাক্ট (ছানি) হয়েছে। কিন্তু বললো না কত পার্সেন্ট। শুনলাম বাংলাদেশে নাকি তক্ষুনি বলে দেয় এবং মোটামুটি ৩০% হলেই সার্জারি করে দ্যায়। আমার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কিছুই তেমন বললো না। শুধু বললো এখনি সার্জারি করার সময় হয়নি। চশমার পাওয়ার অনেক বাড়িয়ে দিল বাম চোখের জন্য। ডান চোখের পাওয়ার অনেক কম ছিল।

এক বছর এভাবেই চলে গ্যালো। বিপত্তি দেখা দিল গত বছর থেকে…চশমা ছাড়া বাম চোখে কিছুই দেখি না। এমন কি চশমা পরেও বেশ ঝাপশা দেখি। সব লাইটই মনে হয় খুবই কম পাওয়ারের। আমার হাসবেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া করি, এত কম পাওয়ারের বাল্ব লাগিয়েছ কেন? আমাদের ঘরে আসলে ভাল পাওয়ারেরই বাল্ব লাগানো আছে। তাই সে বোকা বোকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এর মধ্যই হঠাৎ ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর ঘরের মধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। পড়ার সময় সোফার হাতলে লেগে আমার পাজরের ৬ নম্বর হাড়টি ভেঙ্গে গ্যালো। কি যন্ত্রণা… একটার পর একটা  বিপদের আর শেষ নাই। এই সব করতে করতে চোখের কথা ভুলেই ছিলাম। কিন্তু ভুললে বললে তো হবে না? চোখ বলে কথা!

৬/৭ মাস আগে হঠাৎ দেখি বিনা চশমাতে এক হাত দূরেও কিছুই দেখি না বাম চোখে। মাথার যন্ত্রণাও বেড়ে গ্যালো। কি করি? এরপর খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলাম। হাসপাতাল এবং প্রাইভেট ক্লিনিকে। কি নিয়ম কানুন ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রথমেই আমার হাসবেন্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে ব্লেড বা ছুরি দিয়ে করাবে না। লেজারে করাবে। প্রথমে ফ্যামিলি ডাক্তারের রেফারেন্সে একটা হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করলাম। লেজারে অপারেশন করাতে চাই শুনে বললো বেশ লম্বা লাইন। ব্লেড দিয়ে করালেও ৪/৫ মাস আগে এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাবে না।

আমার হাসবেন্ডের সবমিলিয়ে ভাল লাগলো না। কেন ভাল লাগলো না আমাকে বললো না। দেখলাম বাপ/বেটা (ছোট ছেলে রুম্মান) প্রচুর খোঁজ খবর করা শুরু করলো।

অবশেষে তারা LASIK MD তে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। এই ক্লিনিকটি কানাডার প্রথম প্রাইভেট আই ক্লিনিক। দুই বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিল ৪৫ বছর আগে। এখন সমস্ত কানাডাতে ৩০০ ক্লিনিক এদের। প্রথমেই খোঁজা হলো আমাদের বাড়ির (এজাক্স) ধারে কাছে কোন ক্লিনিক আছে কি না। খোঁজ পাওয়া গেল উইটবি’র কাছে একটা ক্লিনিক আছে। ১ সপ্তাহের মধ্যে এপয়েন্টমেন্ট পেয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে আমার ছেলে খঅঝওক গউ সম্পর্কে মোটামুটি ডক্টরেট করে ফেলেছে।

যাবার সময় তার বাবাকে বললো- বাপী, ডাঃ লয়েড কে ছাড়া অপারেশন করানো যাবে না। ডাঃ লয়েড সানি ব্রুক হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের হেড আবার LASIK MD’রও সার্জন।  উনি প্রাইভেটেই সাড়ে ৮ হাজারের মত লেজার অপারেশন করেছেন। এছাড়া প্রচুর দাতব্য চক্ষু অপারেশনে উনি নিয়োজিত আছেন। অতএব উইটবি’তে দেখালাম। পরপর দুজন অপ্টোমেট্রিস্ট ২ টি  কক্ষে তিন রকম মেশিনে চেক করলো। মজার ব্যাপার, আমার বাম চোখে ক্যাটারাক্ট হয়েছে… সেটাই জানি… কারণ বাম চোখে কিছুই দেখি না। তো, দুজন অপ্টোমেট্রিস্টই বার বার বাম চোখ দেখে… পরে ডান চোখ নিয়েই পড়লো। এরপর অরিজিনাল চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডাঃ কুম (ভুল হতে পারে উচ্চারণে) কাছে। উনিও দেখি সব রিপোর্ট দেখলো। তারপর বাম চোঁখ দেখলো। এরপরই ডান চোখ নিয়ে পড়লো। মেজাজটা খারাপ হয়ে গ্যালো। বললাম আমার ডান চোখে কোন অসুবিধা নাই। বাম চোখে দেখিনা। ডাঃ মিষ্টি করে হাসি দিল। তারপর যা বললো তা শুনে চক্ষু চড়কগাছ! বললো, তোমার বাম চোখে দেখার কিছুই নাই। এটা অলরেডি “ওভারল্যাপিং” হয়ে গেছে। কর্নিয়ার উপরেও চলে এসেছে। এমনকি তোমার ডান চোখেও ৬০% হয়ে গেছে।

সর্বনাশ! আমার তো ভয়ে ভিমরি খাবার উপক্রম।

যাই হোক, এরপর ডাক্তার প্রফেশনাল কথা শুরু করলো। চোখ (ক্যাটারাক্ট) অপারেশনের সময় তোমরা ইচ্ছা করলে ‘ওহিপ’ কভারেজ লেন্স নিতে পারো। অথবা পারসোনাল লেন্সও নিতে পারো। আমার হাসবেন্ড ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো –  ওহিপ কভারেজ লেন্স এবং প্রাইভেট লেন্সের মধ্যে পার্থক্য কি?

পার্থক্য এটাই যে, ওহিপের লেন্সটা একই সাইজের আসে। কিন্তু মানুষের চোখ এবং চোখের কনিয়া একই সাইজের হয় না। তাই যারা ওহিপ কভারেজ এর টা নেয় তাদের কোন কোন সময়ে এইরকম প্রব্লেম হতে পারে যে, তারা সোজা তাকিয়ে সাইডে দেখতে পারে না। ব্যাস এই একটাই প্রব্লেম হতে পারে। আর এই প্রব্লেমটা তাদের ড্রাইভিং করবার সময়ে খুবই ক্ষতির কারণ হতে পারে। আর প্রাইভেট লেন্স তোমার চোখের সাইজ অনুযায়ী পাওয়া যায়।

হু… এটার দাম কত পড়বে?

ষোলশ ডলার পড়বে। (পরে খবর নিয়ে জেনেছি হাসপাতালেও যদি কেউ প্রাইভেট লেন্স নিতে চায় নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডাক্তার রোগীতে জিজ্ঞেস করে অপারেশনের আগে। আর সব জায়গাতেই লেন্সের দাম ঐ ষোলশ ডলারই পড়ে।

আমিতো ড্রাইভিং করিনা। আমার প্রাইভেট লেন্স দরকার নাই। আমি পাশ থেকে মন্তব্য করলাম।

আমার হাসবেন্ড আমাকে পাত্তাই দিল না। মাস্টার বিয়ে করে এই যন্ত্রণা হয়েছে। সব ব্যাপারে মাস্টারি করবে, আর সবাইকে ছাত্র মনে করে…।

ওকে, আমরা প্রাইভেট লেন্সই নিব। তাহলে সার্জারির কি হবে? দুই চোখেই কি একই দিনে হবে? জানতে চাইলেন আমার হাসবেন্ড।

না। ক্যাটারাক্ট অপারেশনের নিয়ম হলো এক সাথে দুটো কখনো করা যাবে না। হাসপাতালে তো ৬ মাস বা এক বছরের আগে করবেই না। তবে আমরা ২ সপ্তাহের ব্যবধানেই করতে পারবো।

ওহ্ আচ্ছা। তবে আমরা কিন্তু ডাঃ লয়েডকে ছাড়া করাবো না। (তার মোক্ষম মন্তব্য ছুঁড়ে দিল, কারণ ছেলে তার বাবাকে এই ডাক্তারের কথাই বলেছিল।)

ঠিক আছে। তোমরা ওয়েটিং রূমে একটি বসো। ১৫ মিনিট পড়ে তোমাদেরকে কাউন্সিলর ডাকবে। সব টাকা-পয়সার হিসাব সেই তোমাদেরকে জানাবে।

এরপর কাউন্সিলর ডাকলো। একজন কোরিয়ান মহিলা মনো হলো। তবে চাইনিজও হতে পারে। সবিনয়ে মিষ্টি হেসে আমাদেরকে অভিবাদন জানালো। (যেহেতু টাকার ব্যাপার বলে কথা!!)

প্রথমত তোমরা ডাঃ লয়েডকে চেয়েছো। তার এপয়েন্টমেন্ট খুব শিঘ্রি নাই। তোমার বাম চোখের ডেট ৩১ অক্টোবর এবং ডান চোখের জন্য ১৪ নভেম্বর। (ওমা… মানে ৪ মাস পর। আমিতো চোখে প্রায় দেখতেই পারছিনা। )

এবারে ধীরেসুস্থে বললো… তোমার অপারেশেনের জন্য ৭ হাজার ডলার লাগবে। আমার বস বলছিল ২ চোখ হলে ৮ হাজার ডলার লাগতে পারে।

এবার মাস্টার সাহেব কথা বলেন না। এই ব্যাপারে তিনি আবার খুবই লাজুক টাইপের। আমি এবার হাল ধরলাম। বললাম, দ্যাখো আমরা তো ২ চোখ করাবো বলে ভাবিনি। তাই এটা খুব বেশী হয়ে যাচ্ছে। একটু কম করো।

মহিলাও কম যায় না। বললো, দ্যাখো, এটা এক সাথে তিনটা সার্জারি – ক্যাটারাক্ট, লেন্স এবং পাওয়ার ফিক্সিং। আচ্ছা, তোমরা একটু অপেক্ষা কর।

আবার ১৫ মিনিট পর ডাকলো। (ইতিমধ্যে আমার হাসবেন্ড আমার সঙ্গে অনেক্ষণ বকবক করলো। বললো, ফালতু অনুরোধ করলে। কোন লাভ হবে না। ১ ডলারও কমাবে না। )

আরে বাবা – অনুরোধ করতে দোষ কোথায়? তাছাড়া দরদাম করা সুন্নত। এ কথা শুনে মাস্টার মশাই বলনে, এটা কি চিংড়ি মাছের বাজার পেয়েছো?

যাই হোক। এবারে প্রায় ২০ মিনিট পরে ডাকলো। কাউন্সিলর মহিলা এবারেও মধুর হেসে বললো – ওকে। তোমার অনুরোধ আমরা গ্রাহ্য করেছি। (সম্ভবত ফোনে আলাপ করেছে উচ্চ পর্যায়ের কারো সঙ্গে)। তুমি আমাদেরকে ৫ হাজার ডলার দিবে। তবে তোমাকে মেডিসিন বেশ কয়েকটি কিনতে হবে। একসাথে ৪ টা করে মেডিসিন দিতে হয়।

আমি বললাম, আমার কোন মেডিসিন কভারেজ নাই।

যাই হোক –  আলহামদুলিল্লাহ… আমার অপারেশন ৩১ অক্টোবর হয়ে গ্যালো। এবং ডান চোখ ১৪ নভেম্বর হলো। প্রথমটাতে আমি অসম্ভব নারভাস ছিলাম। এত নারভাস ছিলাম যে সারজারীর সময় ডাঃ কিছু কথা বলে যেমন চোখটা নিচে নামাও, বা উপরে তাকাও… হয়তো এমনিই বলে… সে যাই হোক আমি কিছু শুনতেই পারিনি… হা হা। অপারেশনের পর ওরা রোগীতে ৪৫ মিনিট বসিয়ে রাখে। সার্জেন আরেকবার চেক করে। এবং সবরকমের নির্দেশ দিয়ে দ্যায়। অবশ্য অনেক আগেই বিশাল একটা ফাইল দিয়ে দ্যায়, তার মধ্যেও সব লেখা থাকে বিস্তারিত।

ওষুদের যদি কারো ইন্সুরেন্স না থাকে তো অবস্থা আরো খারাপ। আমার দুই চোখে ৪৮০ ডলারের ওষুধ লেগেছে।

তবে প্রাইভেট ক্লিনিকে অপারেশন করে একটিই লাভ হয়েছে যে, একমাসের মধ্যে দুই চোখ অপারেশন করানো গ্যাছে। আর ক্যাটারাক্ট এর পাশাপাশি ওরা আমার চোখের পাওয়ারও এ্যাডজাস্ট করে দিয়েছে। আর যত্মআত্মি ভালই করে। অপারেশনের পর ৪ বার অলরেডী আমাকে চেকআপ করেছে। ফেব্রুয়ারী মাসে আবার করবে।

এছাড়া ২ বছর (আগামী) আমাকে ফ্রি চেকআপ করবে। কোন অসুবিধা হলে (আল্লাহ না করেন) তারা ফ্রি দেখবে। আর যদি ওহিপ কভারেজ লেন্স নেন কেউ তাহলে দুই চোখে ৩ হাজার ডলারেই হয়ে যাবে ক্যাটারাক্ট অপারেশন।

তবে যাদের চোখে প্রচুর পাওয়ারের সমস্যা, তারা আজকাল দেখছি সবাই লেজার পাওয়ার এ্যাডজাস্ট করছে। আমার বসের কন্যা করেছে। সে একদম অন্ধের মত ছিল। এখন চশমা ছাড়াই ফরফর করে কম্পিউটারে কাজ করে। দেখে খুবই ভাল লাগলো।

ক্যাটারাক্ট অপারেশন শুধুমাত্র মিসিসাগার ক্লিনিকেই হয়। ওটাই সব থেকে বড় ক্লিনিক ওদের। এ ছাড়া সর্বত্র ছড়ানো রয়েছে LASIK MD এর ক্লিনিক। সেখানে চেকআপ এবং পাওয়ার এ্যাডজাস্ট অথবা পাওয়ার সেটিং করা হয়।

রীনা গুলশান

কবি ও লেখক

টরন্টো

gulshanararina@gmail.com