প্রবাসে পরহিতকর্ম -২৯

নভেম্বর ৫, ২০১৬

॥ রীনা গুলশান ॥

“চশমার কাঁচে সময়ের /

মাকড়শা জাল, ধুলোবালি, সারাক্ষণ কিচকিচ/

করবে আর আমি যৌবনের ফ্যাকাশে তুলোজমাট/

বালিশে হেলান দিয়ে বেঁচে থাকবার মহড়ায়/

এ পাশ ও পাশ করি।”

আবুল হোসেন এর এই কবিতাটি আবীরের খুবই প্রিয় একটি কবিতা, পড়তে পড়তে, কখন জানি চোখ দুটো লেগে গিয়েছিল। কি একটা শব্দে তন্দ্রা কেটে গ্যালো। আজ ওর ডে অফ ছিলো। এখন একদিনই অফ। শুক্রবার। এই দিনেই অফ নিয়েছে। জুম্মার নামাজটা পড়তে পারে। কাজ কামও সেরে ফেলে এই দিনে।

আবার বেল বাজলো। তিনটা বাজে। এখন কে এলো? জেরমেইন ঘরে নেই। আজকাল ছেলেটা বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে ৬/৭দিন গায়েব হয়ে যায়। তার একটা সলো এলবামও বের হয়েছে। গানের প্রচুর ডাকও পাচ্ছে। অবসর সময় আবীরের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারে। মাঝে মাঝে দুজন এদিক সেদিক ঘুরতেও যায়।

দরজা খুলতেই দেখে হাসিমুখে দীপক দাঁড়িয়ে, তার ছেলে কোলে। আবীর হাত বাড়িয়ে দিল বাচ্চাটির দিকে… আর বাচ্চাটি ঝাপিয়ে পড়লো আবীরের কোলে। অপূর্ব দখতে কোকড়া চুলের মিষ্টি মুখের আলেহান্দ্র’কে। দীপক অবশ্য রাজা বলে ডাকে। আবীরের ডে অফ এর ভূভাগ কাটে রাজাকে নিয়ে। রাজা এবারে দু’বছরে পড়েছে। তিন বছর হলো দীপকের বিয়ে হয়েছে। ভালই ধুমধাম হয়েছিল। তারা ৮/১০ জন গিয়েছিল রেজিস্ট্রি করতে। তারপর ঐ রাতেই তাদের বস্ নাজীমুদ্দিন সাহেব সবাইকে ডেকে খাইয়েছে। বাইরে থেকে রেস্টুরেন্ট ক্লোজ করে দিয়েছিল। খাবার পর সাবাই খুব আনন্দ স্ফূর্তীও করেছিল। বস আবার প্রীসিলার হাতে একটা এনভেলাপ দিয়েছিল…তাতে ৩০০ ডলার ছিল। এছাড়া ওরাও সবাই চাদা তুলে আরো ৪০০ ডলার দিয়েছে। বিয়ের ১৩ মাসের মাথায় রাজার জন্ম হলো। সবাই আনন্দে উদ্ভাসিত হলো। আজ ২ বছর হলো প্রীসিলা আর বারে কাজ করে না। এখন সে ফুল টাইম হাউজ ওয়াইফ। তবে ২ বছর ধরে রাজার ধারে কাছের বয়সের আরো ৩/৪টা বাচ্চা বাসায় দেখাশুনা করে। রাজার সময়ও ভাল কাটে। কিছু পয়সাও ঘরে আসে।

অবীর সেই আগের রেস্টুরেন্টের মালিকের নতুন অন্য রেস্টুরেন্টের ফুলটাইম হেডকুক। বেতনও ভাল দ্যায়…মাসে ২৫০০ ডলার পায়। এছাড়া মাস শেষে ২০০ থেকে ৩০০ ডলার টিপসও পায়। প্রতি তিন মাস পর পর ১৫০০ ডলার করে আজ তিন বছর ধরে ঐ ল-ইয়ারকে দিয়ে আসছে। কিন্তু কোন খবরই নাই। জিজ্ঞাসা করলেই নূরানী হেসে বলবে – ভাইরে… এত ইজি না… দিন দিন এসব ব্যাপার খুবই অসহজ হয়ে যাচ্ছে। এখানে আমার কিছুই করার নাই। আমি আমার সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছি।

ব্যাটার সাথে কথায় পারা যায় না। এই একরামুল সাহেবের ছোটভাইও বাংলাদেশে বসে বিভিন্ন মানুষকে পাকড়াও করে। দুই ভাই মিলে কাজ করছে।

এখন দিনে দিনে আবীর খুবই অধৈর্যময় হয়ে যাচ্ছে। কারণ তার বউ নবনী তাকে প্রচুর হার্ড টাইম দিচ্ছে। এখানে যে তার কিছুই করার নাই…এটাই সে নবনীকে বোঝাতে পারছে না। এমন কি একরাম সাহেবকে সে বাংলাদেশের বেশ কিছু ক্লায়েন্ট দিয়েছে। তাদের কাছে থেকেও ভাল টাকা নিয়েছে এককালীন অথবা কারো কাছ থেকে ২/৩ বারে। এখন তারাও আবীরকে চাপাচাপি করছে। দেখা হলেই বলে, কি আবীর, খবর কি? কোন অগ্রগতিই তো নেই। এতগুলো টাকা আটকাইয়া আছে…ব্যাংকে রাখলেতো ইন্টারেস্ট পাইতাম!

আবীরের মেজাজ খারাপ হয়। সে বলে, আমি কি করবো? আমি কি তোমাকে টাকা দিতে বলেছিলাম? তোমরা একজন ল-ইয়ার চাইছিলে, আমি আমার ল-ইয়ারের খবর দিয়েছি। এখন আমাকে বলছো কেন? আমিতো নিজেও তিন বছর ধরে টাকা দিয়ে যাচ্ছি।

একদিন আবীরের প্রিয় বন্ধু হাসান ফোন করলো… (হাসান তার সবই জানে এ টু জেড)। আবীর জানোস এই ব্যাটা একরাম সাহেব এবং এদের পুরা পরিবারই কারাপ্টেড। এরা ৫ ভাই, ২ জন কানাডাতেও আছে। তার মধ্যে একজন ল-ইয়ার। হেই ব্যাটাও একই রকম। ২৫ থেইক্যা ৩০ লাখ টাকা একেক জনের কাছ থেইক্যা নিছে। কারো কোন কামই করে নাই। আমার বসের ভাই এর কাছ থেইক্যা জব্বর টাকা নিছে… ৫০ লাখ। কইছে ৫/৬ মাসের মধ্যে লইয়্যা যাইবো কানাডায়। কিন্তু কাজ কিছুই করে নাই। এখন কোন ভাই-ই ফোন ধরে না। এখন আমার বসের ভাই জুবায়ের মিয়া পাগলের লাহান হইয়া গ্যাছে। হের বিজনেস বেইচ্যা দিছে।

তুই সিওর কানাডার ল-ইয়ার একরাম সাহেবেরই আপন ভাই?

আরে হ, দোস্ত – নাইলে তরে ফোন করুম ক্যান?

হ্যায় আল্লাহ, এখন আমার কি হবে?

শোন যা হবার তাতো হইছেই… এদিকে ঢাকার ভাবসাবও ভাল মনে হইতাছে না। তুই অন্যকোন আমেরিকান ল-ইয়ার ধইর‌্যা একটা কিছু কর।

মানে কি? ঠিক করে বল।

আবীর আমার আর একটা ফোন আইছে… রাখি দোস্ত… পরে কথা কমু।

অবীরের কপালে অসংখ্য চিন্তার ভাজ খেলা করে। নিজের পরিবারেও বেশ কিছু প্রব্লেম নিয়ে আবীর রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে। নবনী হঠাৎ আব্দার করলো সে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করবে। তার মানে ২ বছর লাগবে। আবীর চিন্তায় পড়ে গ্যালো। তাদের এমন কোন নিকট আত্মীয় ঢাকায় থাকে না। তবে নবনীর একজন ফুপু আছে। ঢাকায় থাকে।

তুমি কি ভাবে পড়বে ঢাকায়? কোথায় থাকবে?

ক্যানো ঢাকায় যারা পড়তে আসে সবার কি আত্মীয় স্বজন ঢাকায় থাকে?

না… তা থাকে না। তবু তুমি একজন বিবাহিতা মহিলা।

তাতে কি হইছে… আমি প্রথমে আমার ফুফুর বাসায় উঠবো। তারপর কোন লেডিস হোস্টেলে উঠে যাবো।

কিন্তু মায়ের সাথে কথা বলেছো?

ক্যান… আমার সব ডিসিশন কি নির্ভর করছে তোমার মায়ের অনুমতি সাপেক্ষে?

আমি কি তাই বলেছি? তবু মরুব্বী বলতে তো এক মা-ই। মা আমাদের জন্য কি না করছে বলো?

দ্যাখো, আবার শুরু হয়ে গ্যাছে। এসব শুনতে শুনতে আমার কান পচে গ্যাছে।

আবীর খুব মন খারাপ করে ফোন রেখেছে। মা কখনো নবনীর নামে কিছুই বলে না। তবে ছোট ভাইটি সেদিন ফোন করে অনেক কিছু বলছিল তার ভাবীর নামে। সে নাকি কোন  কাজ কামই করে না। উল্টো তাদের সবার সাথেই খুব খারাপ ব্যবহার করে।

অনকেটা বাধ্য হয়েই আবীর রাজী হয়েছে। এখন মাসে ৬/৭ হাজার টাকা নবনীকে দেওয়া লাগে। সে এখন একটা লেডিস হোস্টেলে থাকে। মাকে টাকা দেয়। মা অবশ্য মানা করে। দুই ভাইয়ের পড়ার খরচ তো আছেই। ছুটি ছাটা হলেও নবনী বাড়ি যেতে চায় না। ওর বন্ধু হাসান ঢাকায় থাকে, সেতো সবই জানে। একবার হাসানকে ওর লেডিস হোস্টেলে পাঠিয়েছিল। হাসান সুপারভাইজার

মহিলার সাথে কথা বলে এসেছে। সে বলেছে নবনী নাকি মাঝে মধ্যেই কোথায় যেন চলে যায়। চরদিনের মাথায় পেল, তো উল্টো ঝাড়ি দিল নবনী।

তুমি কি আমার পিছনে চর

লাগিয়েছ? হাসান কেন আমার হোস্টেলে এসেছিল?

আমিই পাঠিয়েছিলাম- পরপর তিনদিন কোন খোঁজ খবর না পেয়ে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম।

কেন আমি কচি খুকি নাকি? আমার বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে নেটওয়ার্ক ছিল না।

আগে বলে যেতে পারতে?

হঠাৎ ঠিক হলো তো? তাছাড়া আমার কি স্বাধীনতা নেই? আমি নিজে কোন ডিসিশন নিতে পারি না?

আমি তোমাকে এসব কিছুই বলছি না নবনী… আমরা যেহেতু রোজই কথা বলি… বলেই ফোন কেটে দিল। কারণ আবীর জানে কথায় কথা বাড়ে। ওর এমনিতেই মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে সব মিলিয়ে।

এরপর থেকে নবনী আরো বেশী বেশী করে প্রেসার দেওয়া শুরু করলো। আবীরও খুবই হতাশ হয়ে একদিন হঠাৎ করে না বলে উকিলের বাসায় হাজির হলো। এবং মারাত্মক সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। দীপক সাথে ছিল, না হলে হয়তো বা একরামুল হকের মুখে একটা ঘুষি ই মেরে বসতো। একরামুল হকেরও খুবই রুদ্র মুর্তি… কোথায় নূরানী সমীহ চেহারা… আবীরও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো।

আমি আপনাকে অনেক রেসপেক্ট দিয়েছি। আপনি অবশ্যই এর যোগ্য না। আপনারা সমস্ত পরিবার একটা জোচ্চর পরিবার। বাংলাদেশ কানাডা আমেরিকাতে ভালই জচ্চুরী ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। আপনি আমার বন্ধুর টাকা পর্যন্ত হলফ করে নিয়েছিলেন। সে আজ পথে বসেছে। ব্যবসা বিক্রি করে দিয়েছে। শুধু আপনার কথায়। আপনি বলেছিলেন ৫ মাসের মধ্যে ওকে নিয়ে আসবেন।

তুমি জানো আমি তোমাকে জেলে ভরে দিতে পারি?

এবারে দীপক এগিয়ে একরামুল এর কলার চেপে ধরে হিস হিস করে বললো…শালা হারামী…চেষ্টা করে দ্যাখ আমার বন্ধুরে জেলে ভরতে … আমি তোরে এখানে মাটির নিচে গেড়ে তারপর জেলে যামু। ভাবছস নর্থ আমেরিকায় আছস আর… তুই যা ইচ্ছা করবি? জোচ্চর… তোরে আমি এবারে নজরে রাখলাম… দেখি তুই আর কয়দিন এই জচ্চুরী চালায়ে যেতে পারোস?

আবীর দীপককে টেনে নিয়ে গ্যালো।

তারপর একরামুলকে বললো…আজ থেইক্যা তোকে ছাড়লাম… তবে আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম… তোর এই সব টাকা ঐ খানে বুজাইয়া দিতে হবে।

এরপর দুই রাগান্বিত যুবক ফিরে এলো। আবীর আবারো প্রচন্ড হতাশার সাগরে ডুবে যেতে থাকে। (চলবে)