প্রবাসে পরহিতকর্ম -২৮

অক্টোবর ৮, ২০১৬

॥ রীনা গুলশান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘কত সুন্দর তোমার মুখখানা

উদ্ভাসিত হলো আমার চোখে

কোজাগর চাঁদের মতো

তোমার মুখখানা উদ্ভাসিত হলো

আর তোমাকে এত ভাল লাগলো…’

নবনীর সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই তার অনেক প্রিয় কবি- ওমর আলী’র এই কবিতাটি আবৃত্তি করছিল আবীরি। নবনী বললো, তুমি এত কবিতা কি করে যে মনে রাখো… জানো আমার কোন কবিতার লাইন-ই মনে থাকে না।

কারণ কবিতা তোমার প্রথম প্রেম নয়।

তোমার কি তাহলে কবিতাই প্রথম প্রেম? তাহলে আমি কত নম্বরে?

এই সব কিছু কিছু ভাললাগা বা ভালবাসা থাকে যার সঙ্গে মানুষের ভালবাসা মেলাতে নাই নবনী। মেলাতে গেলে মানুষের হৃদয়ের স্থূলতা প্রকাশ পায়।

ওহ… তুমি বলতে চাইছ আমি খুবই স্থূল ধরণের?

না… আমি তা মোটেই বলতে চাচ্ছি না। আমি কি কখনো তোমার কাছে জানতে চেয়েছি আমি তোমার কত নম্বর? ভালবাসার কোন নম্বর হয় না। প্রতিটি ভালবাসা তার নিজস্ব জায়গা দখল করে থাকে।

হু! বুঝেছি। আগেতো ছিলে আঁতেল আর এখন হয়েছো বাতেল।

হা… হা… বাতেল? দারুন বলেছো তো?

তা উকিল বাড়ি কবে যাচ্ছো?

এই তো সামনের বুধবার… দীপক এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছে।

আর বাসা চেঞ্জ করছো কবে?

এইতো তিনদিন পর।

প্রীসিলার ওখান থেকে আসার পর ঐ রাতেই আবীর সবাইকে (যারা ঐ ঘুমটি ঘরে ঘুমায়) বলেছিল এ মাসের শেষেই আমি নতুন বাসায় চলে যাচ্ছি।

তাই নাকি? সবাই এক যোগে বলে উঠলো। ঘুমটি ঘরে ওরা নয়জন ঘুমায়। বাইরে থেকে ৩/৪জন আসে মাত্র। তার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ইউনুস মিয়া। সে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো -তোমাগো সাহস আছে।

পাশ থেকে রেজাউল নামে একটা ফচকে ছেলে ফোড়ন কাটলো – ঠিক কইছেন… তবে সাহস করতে গেলে ট্যাকা গাটির থেইক্যা বাইর করতে হয়…।

বুজছি তুমি কি কাইবার চাও রেজাউল। আরে বাবা আমার নাই কাগজ…বাইরেই যাইতে সাহস পাই না, এই টোঙ্গের উপর জীবনের ১১ টা বছর চইল্যা গ্যালো আর ২/৩টা বছর কাডাইয়া এ্যক্কেবারে চইল্যা যামু গিয়া।

এবার আবীর প্রচন্ড বিস্মিত কণ্ঠে বললো –  আপনি আমেরিকাতে ১১ বছর আছেন? তাও কাগজ নাই…?

নারে ভাই, অনেক ট্যাকার মামলা। আমার এক মামায় বুদ্ধি দিলো (সেও এই হানে থাকে) উকিলরে ট্যাকা না খাওয়াইয়া ঢাকায় ২টা বাড়ি কর। একটায় থাকবি আর অন্যটাতে ভাড়া খাটাইয়া জীবনডা গুজরান করবি। তো আমি তাই করতাছি। পুরানো ঢাকায় বাপ দাদার আমলের ভাঙ্গা একটা বাড়ি আছিল। ঐডা ভাইঙ্গা ৬ তলা বাড়ি বানাইছি। আমার পরিবার দোতালায় থাকে। বাকী গুলান ভাড়া দিছি। আবার মোহাম্মদপুরে আড়াই কাঠা জমি কিনছি। ঐ হানেও বাড়ি শুরু করতাছি। শেষ হইলেই এ্যাক্কেবারে চইল্ল্যা যামু গিয়া।

কিন্তু আপনার বউ মানে ভাবী কোন অবজেকশন দেয় না?

না রে ভাই। এই ভাবেই আমার জীবন। আল্লাহর দেওয়া আশীর্বাদ। আমার বাবা মা’রে দ্যাখতাছে। ২ ডা বোনেরে সাদী দেছে। আমার বাচ্চা ২ডারে ঠিক মানুষ করতাছে।

আপনিতো খুবই ভাগ্যবান।

হ ভাই, হাছাই আমি ভাগ্যবান। এমুন বউ পাওয়া সত্যই ভাগ্যের … শুধু টাকা পাইয়াই খালাশ!

তবু আপনার কোন দুঃখ নাই?

আছে না? কি যে কও ভাই। দুঃখ ছাড়া মানুষ আছে নি? আল্লাহর সৃষ্টিতে একমাত্র ফেরেশতাদেরই দুঃখ নাই। অনেক দুঃখ এই বুকের মইধ্যে জইম্মা আছেরে ভাই… তোমরা বুঝবে না। যখন দেশে যামু… যে বউডারে রাইখ্যা আইছি… হ্যারে তো পামু না। বুড়ি হইয়া যাইবে গিয়া। আয়নাতে আমার নিজেরে দেইখ্যাই বুঝবার পারি। সেই বা আমারে ক্যামনে দেখবে… জীবন থেইক্যা এতটা বছর চইল্যা যাইতাছে কিন্তু কিছু করবার নাই। আমি জানি আমারে সবাই এইহানে ‘কিপটা মিয়া’ কয়। কিন্তু কেউ তো জানে না… কত্তগুলা মানুষ আমার এই ট্যাকার দিকে চাইয়্যা থাকে। আমি সত্যই কিপটা… নিজের পরানডারে কিছু দেই না। কিন্তু বেবাগডির জন্য আমি কিপটা না।

সত্যিই ইউনুস ভাই, আমাদের এই দুঃখের আর ত্যাগ তিতিক্ষার কথা না কেউ কোনদিন জানবে না, কেউ কোনদিন বুঝবে না। দীপক গভীর বেদনাহত কণ্ঠে বললো।

এমনকি কেউ কোন দিন স্বীকারও করবে না… রেজাউল আবারো বললো… তবে এবারে তার কণ্ঠে ছিল জ্বালা এবং কাঁন্না।

সবকিছু শুনে আবীর ক্যামোন জানি এক গভীর দুঃখে, বেদনায় এবং হাতাশায় অস্থির হয়ে গ্যালো। ভাবলো, ধূর! ক্যানো আসছিলাম এই দেশে? নিজের দেশেতো ভালই ছিলাম। খেয়ে পরে বেঁচে ছিলাম। দেশে তো আমি ফাইভ স্টার হোটেলে কুক ছিলাম। আর এই খানে কিনা হান্নানের মত বাবুর্চির এ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে কাজ করছি? আমি কি এই জীবনের জন্য এই দেশে এসেছিলাম? গভীর হাতাশায় নিমজ্জিত হয়ে সে রাতে নবনীর সঙ্গে কথা না বলেই বিছানাতে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

নির্ধারিত দিনে আবীর দীপককে নিয়ে হাজির হলো উকিলের অফিসে। ঠিক অফিস পাড়া নয়। বরং বাঙ্গালী পাড়া বলা যেতে পারে। পুরানো আমলের একটা বাংলো বাড়ি। দেখে মনে হয় ২০০ বছরের পুরানো বাড়ি। বাড়িটির উপরে সম্ভবত তার পরিবার থাকে আর বেইজমেন্টে অফিস বানিয়েছে। বেশ সাজানো গোছানো অফিস। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট, বার্গেন্ডি রঙের । বাচ্চা মতন একটি ছেলে ওদের বসতে বলে চলে গেল। বেশ অনেকটা সময় পর একজন সৌমদর্শন ব্যক্তি এলো ধীর পায়ে। মাঝারি উচ্চতা শ্যামলা বরণ, বুক পর্যন্ত কাঁচা পাকা দাড়ী। মাথায় ক্রীম রঙের একটি গোল টুপি পরা। ওদের সালাম দিয়ে আবার হাত বাড়িয়ে দিল মোসাফা করবার জন্য। তারপর নিজের নাম বললো।

আমার নাম একরামুল হক।

আবীর ও দীপক ওদের নাম বললো।

তারপর বললেন, ভাই… কি সাহায্য করতে পারি?

আবীর তার অবস্থানের কথা বললো।

তখন একরাম সাহেব বেশ চিন্তিত মুখে বললো –  এগুলো এখন খুবই ঝামেলার কেস। আপনাকে তো রিফিউজি ক্লেইম করতে হবে।

ওকে, তাই করবো।

হু… এর জন্য অনেক কাগজ পত্র দেশ থেকে আনাতে হবে। তো ভাই আমি দুই ভাবে কাজ করে থাকি। একটা আপনি আমাকে একবারে টাকা দিবেন। সেক্ষেত্রে দুবারে দিবেন। মোট টার অর্ধেক দিবেন যখন কাজ শুরু করবো। বাকি টাকাটা দিবেন কাগজপত্র একেবারে আপনি যখন পেয়ে যাবেন তখন। অন্য আর একভাবেও দিতে পারেন। সেটা হলো প্রতি তিনমাস অন্তর।

হু…। ভাই একটা ধারনা দিতে পারেন? মোটামুটি কতটা সময় লাগতে পারে? কারণ আমার বউতো এখনি আসার জন্য পাগলামী করছে।

পাগলামী করলে তো হবে না। সবকিছু পরিস্থিতি বুঝে করতে হবে। সে তো লেখাপড়া জানা একটি মেয়ে।

তাতো ঠিকই ভাই।

আচ্ছা ভাই, রিফিউজি ক্লেইম ছাড়া অন্য কোন ভাবে আনা যায় না?

যাবে না কেন? যায়। তবে যেহেতু আপনি ভিজিটিং ভিসায় এসেই ক্লেইম করতে যাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটি বেশ খানিকটা জটিল হয়ে গেছে। আপনি যদি ২/৩ বার যাওয়া আসার পর ক্লেইম করতেন তবে সুবিধা হতো।

সেটি তো সম্ভব নয় ভাইজান।

বুঝিরে ভাই। তাহলে আমার উপরই ছেড়ে দিন। যেটা ভাল হবে আমি সেটা বুঝে শুনে করবো। তবে বেশ কিছু পেপার লাগবে, বিভিন্ন ধরণের।

ভাই, টাকার ব্যাপারটি যদি বলেন।

টাকাতো একবারে দিতে পারবেন না। তাই তিন মাস পরপর ১৫০০ ডলার করে দিবেন। আমি ২৫০০ করে নেই।

ওকে ভাই। আমি কাল পরশু এসে টাকাটা দিয়ে যাব।

ওরা বেরিয়ে পড়লো। সরাপথ দীপক বকবক করলো- কিভাবে তুমি এত টাকা ম্যানেজ করবে? ঐ ব্যাটা বাটপার। ২৫০০ ডলার যা তা কথা? তোমাকে তো মা’কে বউ’কে টাকা পাঠাতে হয়। আবার ঘর ভাড়া নিলে।

চিন্তা করো না। একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে ইনশাল্লাহ। আলœাহ চালানোর মালিক। বান্দাকে শুধু হাত পা নাড়াতে হবে। এটাই আমি বিশ্বাস করি।

ঠিকই বলেছ। আমিও এটাই বিশ্বাস করি।  দ্যাখো এই ৯টা বছর কত ফাইট দিলাম। কিচ্ছু হলো না। অবশেষে প্রীসিলাকে মিলিয়ে দিল ভগবান। কত যে কেঁদেছি… ঠাকুর একটা পথ দাও। মনে হতো সাহারা মরুভূমিতে চোখের জলগুলো শুষে নিয়েছে। কিন্তু দ্যাখ, ঠিকই ঠাকুর পাইয়ে দিয়েছে প্রীসিলাকে। অসম্ভব বুুঝতে পারে আমাকে জানো?

তা বিয়েটা করছো কবে?

এই তো আবীর সামনের মাসের ১৬ তারিখে। তুমি আর আমার চাচাতো ভাইটাই সাক্ষী হবে। আর প্রীসিলার তরফে ওর একটা কাজিন বোন আছে আর সেই বোনের বয়ফ্রেন্ড।

আরে আমি কি ভাবে সাক্ষী হবো? আমার তো কোন আইডিয়েন্টিটিই নাই।

অসুবিধা নাই। তুমি যাবে এটাই বড় কথা।

মাস শেষে আবীর ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে চলে গ্যালো। সবার খুব মন খারাপ হলো। বসের মুখটাও বেশ ইতস্তত লাগছিল। আবীর তাকে আস্বস্থ করলো – আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু এই জব আমি ছাড়ছি না।

জেরমেইন তাকে খুব সুন্দরভাবে অভ্যর্থনা করলো। ঘরটা আজ অনেক ঝকঝকে। এমনকি সে নিজে ওর জন্য একটা ল্যাম্ব রান্না করে রেখেছে সাথে গরম ভাত দিল ওদের মত। একটু ঝাল বেশী কিন্তু খুব ভাল লাগলো।

তোমাকে রান্না করে খাওয়াতে খুব ভয় করছিল।

ক্যানো?

তুমি হলে প্রফেশনাল সেফ। বলেই জেরমেইন হাসলো।

তাতে কি? জানো আমার মা যদি শুধু শাক ভাজি আর ডাল চচ্চড়ি বানিয়ে খাওয়ায়, ওটা আমার কাছে অমৃত!

হঠাৎ জেরমেইন বললো, তুমি কি আমাদের ডিশ রান্না করতে পারো।

দেখলেই পারবো। কোন ব্যাপার না। ক্যানো?

না, ডাউন টাউনে আমাদের একটা জ্যামাইকান হোটেল আছে। তারা একজন প্রফেশনাল সেফ খুঁজছে। আমার আঙ্কেল হলো ওটার মালিক।

আমার এমনিতেই দুদিন অফ আছে। তবু তারা যদি ভালো সেলারী দ্যায় আমি না হয় কিছু বেশী দিন দিতে পারি।

ওকে, তাহলে আজই চলো, আজ তোমার ডে অফ আছে।

হু…। দাড়াও একটু গুছিয়ে নেই।

জেরমেইনকে খুবই উৎফুল্ল এবং উদ্দিপক মনে হলো। আর সেই উদ্দিপনার চঞ্চলতা একটু একটু করে আবীরকে ছুঁয়ে গ্যাল। (চলবে)

রীনা গুলশান । কবি ও লেখক, টরন্টো।